Sunday 23 January 2022

অনির ডাইরি ২৩শে জানুয়ারী ২০১৯

 

 বিগত মধ্যরাত্রি থেকে যাঁরা ফেসবুক- হোয়াটস্অ্যাপ- এসএমএস আর মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, যাঁরা শুধুমাত্র অন্তর্জালে আবদ্ধ না থেকে ফোনটা করেই ফেলেছেন, তাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বড় ব্যস্ত এ জীবন আর বড়ই মূল্যবান এ সময়,তবুও তার মধ্যে থেকে কয়েক মুহূর্ত চুরি করতে পারা বড় কম কথা নয়। বিশেষতঃ অনিন্দিতা এবং চৈতালী এই মুহূর্তে যে চরম মানসিক শূণ্যতায় ভুগছে, তার মধ্যেও তাদের পাঠানো শুভেচ্ছায় আমি এক্কেবারে অভিভূত  তথা বিগলিত। 


এমনিতে আমি নিজেকে হাওড়ার মেয়ে বলে দাবী করলেও আমার জন্ম সেই সুদূর মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সে বছর বড় জব্বর শীত পড়েছিল, বাবা তো বলে সেটা নাকি বিগত শত বছরের শীতলতম দিন।ফুলহাতা হলুদ পুলওভারের ওপর জেঠুর কাছ থেকে ধার করা ওভারকোট চাপিয়ে, বাবা যখন পলাশী স্টেশনে নেমেছিল তখন ২১শে জানুয়ারি এর গভীর রাত। ডাক্তারের নির্ধারিত দিনলিপি অনুসারে আমার জন্মানোর কথা ছিল ২১শে জানুয়ারীই। ছুটি আর টাকা জুটিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে একটু দেরীই হয়ে গিয়েছিল বাবার, তাও প্রতিশ্রুতি মত টাকাপয়সা যোগাড় হয়নি। মন খারাপ আর উত্তেজনার যুগলবন্দি নিয়ে, বড় পাঁচ সেলের টর্চের ভরসায় অন্ধকার পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধার। শেষ পারানির নৌকায় নদী পেরিয়ে,এবার কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দিদার বাড়ি পৌঁছে দেখে মা দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, দুপুরে ভারি মশারি কেচেছে,মায়ের মনোবল তুঙ্গে। আর আমি? দূর দূর ডাক্তারবাবু বললেই হল নাকি? আমার বাবা না এলে আমি ভূমিষ্ঠ হব থোড়াই? ২১তো দূরের কথা-২২টপকে সেই ২৩শে ভোরে জন্মেছিলাম আমি। জন্ম থেকেই বাবার প্রাণ। এখনও প্রতি বছর ২২তারিখ রাতে বাবা আরেক বার শোনায়,ঠিক কি হয়েছিল সেবছর ২১-২২-২৩শে জানুয়ারী। 

বিয়ের পরও প্রতিবছর এই দিনটা নিয়ম করে হাওড়ায় কাটাই। না হলে বড় বেশী দুঃখ পায় আমার বৃদ্ধ বাবা। মেয়েটা তাহলে পরই হয়ে গেল। চ্যাটার্জী থেকে ভট্টাচার্যই হয়ে গেলে শেষে? 

এবছর আর যেতে পারিনি। কারণ মেয়ের স্কুল এবং আসন্ন পরীক্ষা। গতকাল মধ্যরাত্রে তাই আমিই ফোন করলাম আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে। শৌভিক যদিও চিমটি কাটছিল,“ওরে ওদের ঘুমোতে দে। ” কিন্তু আমি তো চিনি,বড় বেশী করে চিনি আমার জন্মদাতা এবং দাত্রীকে। জানতাম শ্রোতা হিসেবে আমি নেই তো কি, দালানের ডাইনিং টেবলে বসে নিঃসঙ্গ  বুড়োবুড়ি নিজেরাই স্মৃতিচারণ করছে সেই দিনটার। ফোন পেয়ে খুশির সীমা রইল না। যাক মেয়েটা বদলে যায়নি। আরো জানালাম বাপের বাড়ি যাচ্ছি না বলে,শ্বশুরমশাই খেতে নিয়ে যাবেন বলেছেন, আমার প্রিয় রেস্টুরেন্টএ। এরপর তো আর হাওড়া না যাওয়া নিয়ে কোন অভিযোগই থাকতে পারে না। 

ভোর থেকে স্বামী এবং কন্যা পর্যায়ক্রমে চপেটাঘাত  করেই চলেছে,“তুমি তো ছোট্ট বেবি। ছোট্ট বেবিদের জন্মের পর মেরে কাঁদাতে হয়।” জন্মের শোধ তুলে নিল বোধহয় দোঁহে। 

বেলা বারোটার সময় তৈরি হয়ে নেমে দেখি,গাড়িতে শাশুড়ি মাও বসে।  হাঁটু এবং ব্যালান্সের সমস্যার জন্য উনি পারতপক্ষে বাড়ি থেকে নড়তে চান না। তিনি নিজে চলেছেন,স্বেচ্ছায় আমার জন্মদিন পালন করতে পার্কস্ট্রীট এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে? তুত্তুরী মহানন্দে গিয়ে বসল ঠাকুমা-ঠাকুরদার কোলে। 

চালাও পানসি মার্কোপোলো। মার্কোপোলোর গোল্ডেন ক্রাম্ব ভেটকি আর মোহিতো দিয়ে যাত্রা শুরু করে- চেলো কাবাব হয়ে হট ব্রাউনি উইথ ভ্যানিলা আইসক্রীম দিয়ে ভুরিভোজ সমাপ্ত হল। পিটারক্যাটের সাথে চেলোকাবাব সমার্থক যাঁরা মনে করেন অনুগ্রহ করে একবার মার্কোপোলোয় খেয়ে দেখবেন। আর ফিশ এণ্ড চিপস্ টাইপ মাছ ভাজা ওদের অতুলনীয়। এত ভালো ভেটকি খুব কম রেস্টুরেন্টেই পাওয়া যায়। শৌভিক নির্দ্বিধায়,হাসিমুখে  বিল মেটাবার পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম, আগামী একবছর বরকে কোন বাজে কথা বলব না।ঝগড়া করব না।  সেটা যদিও তুল্যমূল্য  বিচার করতে করতে আপাততঃ আগামী এক পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে।  


ফেরার পথে ২ নং বাবা বললেন,“চলো একটু ঘুরে যাই। ছোট্ট করে লং ড্রাইভ আরকি।” ফলতঃ বাড়ির পথ না ধরে, গাড়ি ছুটল বিদ্যাসাগর সেতুর পথে। কোনা এক্সপ্রেস ওয়েতে বেশ খানিকটা ঘুরপাক খেয়ে, নিবেদিতা সেতুতে ৪৫টাকার টোল দিয়ে গঙ্গার হাওয়া খেয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। 

আরেকবার অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাদের সকলকে, খুব ভালো থাকুন সকলে। সময় বড় নির্মম, যে হারে গুরুজনদের ছাওয়া সরে যাচ্ছে মাথার ওপর থেকে-- আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে, আর বলতে চাই-- যাই হোক না কেন আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যতজোরেই দৌড়ক না কেন, আমি বদলাইনি।  তোমরাও বদলে যেও না।

Thursday 20 January 2022

আয় তবে সহচরী, ২০শে জানুয়ারী, ২০২২

 

👩🏻-এই তোমরা love like pity hate kiss miss marriage খেলতে?

👩🏻‍🎤- সেটা আবার কি? আরে হ্যাঁ ফ্লেমস্। F for friends, l for love এই সব। এখন কি তুত্তুরীরা খেলে?  

👩🏻- আরে না। ঐ যে দুটো লোকের নামের কমন লেটার গুলো কেটে কুটে যেগুলো পড়ে থাকে, সেই সংখ্যাটা দিয়ে দেখা। 1 হলে love, 2 হলে like এইভাবে। 7 হলে marriage। 8 হলে আবার লাভ। যেমন ধর Shyam আর Mita। এদের নাম নিয়ে খেললে, শুধু A আর M কাটবে। পরে থাকবে 5টা লেটার। অর্থাৎ ওদের সম্পর্ক হবে kiss😂😂😂


👩🏻‍🎤- (পরদিন সন্ধ্যা বেলা) আমার বরের নামের সাথে খেললাম, পিটি এল😔। কে যে কাকে দয়া করে কে জানে। 

👩🏻- দুঃখের কথা কি আর বলি, আমি সেই শচীন তেণ্ডুলকর থেকে শুরু করেছিলাম।  আমার কোন ক্রাশের সঙ্গে আমার লাভ কিস ম্যারেজ আসে না😣😫😩


👩🏻‍🎤- ঐ ভয়েই শালা আমি নিজেরটা আর করছি না। কিন্তু কি নেশা মাইরি। একটা পুরানো খাতা যোগাড় করে খেলেই যাচ্ছি। কার সাথে কারটা দেখব বলো?


👩🏻-👩🏻‍🎓 সাথে 👨🏻‍🎓 কি আসে দেখ দিকি?  


👩🏻‍🎤-(কাটাকুটি অন্তে) এই 👩🏻‍🎓, তোমাদের কিন্তু লাভ বেরোল। এই দ্যাখ। 😆😆😆


👩🏻‍🎓- (প্রবল ক্রোধান্বিত হয়ে) কত সাধ যায় রে চিতে

মলের আগায় চুটকি দিতে!!


👩🏻‍🎤-(সবজান্তা ভঙ্গিতে)এটা কি মারাত্মক এফেক্টিভ। 


👩🏻-(বোকার মত) কিন্তু এর মানে কি?মল মানে তো ইয়ে,পটি? পটির ওপর ডিজাইন করতে বলছে নাকি?


👩🏻‍🎤- ডিজাইন করতে কোথায় বলল? সেটা কি করে সম্ভব? বলছে তো ইয়ের আগায় চুটকি দিতে। তার মানে সঠিক সময় হাতটা পিছনে ঘুরিয়ে চুটকি বাজাতে ইচ্ছে হচ্ছে নির্ঘাত।(কিঞ্চিৎ চিন্তাভাবনা অন্তে) তবে ব্যাপারটা বড্ড messy হয়ে যাবে না? আর ইয়ে বড্ড দুর্গন্ধ ও।


👩🏻‍🎓-উফঃ ভগবান। মল মানে নূপুর। এরা কি  বাঙালি?

অনির ডাইরি ২০শে জানুয়ারি, ২০২২

 


‘হ্যাঁ কে, অনিন্দিতা? তুমি কি অফিসে?’ অচেনা  নম্বর, অপিরচিত কণ্ঠ। বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টায় আর কোথায় থাকব? তাই জবাব দিলাম। ফোনের ওপাড়ের ভদ্রলোক বললেন, ‘ কি আমাকে চিনতে পারছ?’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানালাম, নাঃ, মাত্র দুটো বাক্য বিনিময় হয়েছে,এবং তার দ্বারা কণ্ঠের মালিককে চিনতে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘এর মধ্যেই ভুলে গেলে? আমি রসুল সাহেব।’ 

ফোন ধরা অবস্থাতেই সটান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, ‘স্যার।’ রসুল সাহেব অর্থাৎ শ্রী আজিজ রসুল ছিলেন লেবার সার্ভিসের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যে সব সিনিয়র অফিসারদের দেখে তথা যাঁদের থেকে আমরা অর্থাৎ অফিসার হবার তালিম পেয়েছি রসুল সাহেব হলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত, তাতে কি? শিক্ষক তো শিক্ষকই থাকেন। স্যার বলেছিলেন বটে মাঝে মধ্যে এদিকে আসেন, তখন অনুরোধ করেছিলাম, যদি একবার অনুগ্রহ করে অধমের আপিসে পায়ের ধুলো দেন। 


স্যারকে আজ আবার বললাম সেই একই কথা। যদি আসেন, একটু কষ্ট করে। শিক্ষক সুলভ গাম্ভীর্যের সাথে স্বল্প হেসে স্যার বললেন, ‘আরে আসব বলেই তো জানতে চাইছি, তোমার আপিসটা কোথায়?’ বললাম আপনি যেখানে আছেন দাঁড়ান, আমি নিজে যাচ্ছি আপনাকে আনতে। এবার বকেই দিলেন স্যার, ‘আরেঃ বাবা, তুমি কেন আসবে? তোমার গাড়িটা একটু পাঠাও।আমার ড্রাইভার খেতে গেছে। ’ কথা শুনে বুঝলাম পাশের, পাশের বিল্ডিং এই আছেন স্যার। গাড়ি তো পাঠালামই, সাথে জসূয়াকেও পাঠালাম। জসূয়া আমার ইন্সপেক্টর। এই মুহূর্তে এই আপিসে আমার পরেই সবথেকে সিনিয়র ব্যক্তি। আমি না যাই, নং ২ তো অন্তত যাক। 


সেই ফাঁকে শুভাশিস আর আমাতে ব্রেন স্টর্মিং করতে লাগলাম, স্যারকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করা যায়। স্যার তো রীতিমত মিতাহারী, খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেল ক্যান্টিনে আজ শুধু স্যান্ডউইচ আর মিষ্টি পাওয়া যাবে আর মর্তমান কলা। কফি বললে করে দেবে বটে, তবে ওদের কফি বড় পাতলা লাগে আমার। 


স্যার এলেন, গোটা আপিস ঘুরে দেখলেন, খাবার যাবতীয় প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে শুধুমাত্র চা খাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার চেম্বারে বসলেন। বারবার অনুরোধ করলাম, স্যার আমার চেয়ারে বসুন। ওটাই এ ঘরের সবথেকে উঁচু চেয়ার। শুনলেনই না। টেবিলের উল্টোদিকের বিবর্ণ ভিজিটর চেয়ারে বসলেন। একটা তোয়ালে পাততেও দিলেন না। স্যারের উল্টোদিকে উঁচু চেয়ারে বসতে ভয়ানক অস্বস্তি লাগছিল, আবার বললাম, ‘স্যার প্লিজ বড় চেয়ারটায় বসুন।’ স্যার হেসেই উড়িয়ে দিলেন,‘এখন তো আমি অবসর প্রাপ্ত, ইন সার্ভিস থাকলেও বসতাম না। তোমার চেয়ারটা তোমারই। নির্দ্বিধায় বসো।’ সাধে এই লোকগুলোকে এত ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম আমরা। উঁচু চেয়ারে বসেও যে মাটির কাছে থাকা যায়, এগুলো এণাদের থেকেই শেখা। সাধে কি বলি, বস্ এরা আমাদের বস্ হতে শেখায়। ভালো থাকবেন স্যার। সময় পেলে আবার আসবেন। আরেকবার ঝালিয়ে নেব পুরাণ অনুশীলনী যত। 


Wednesday 19 January 2022

অনির ডাইরি ১৯ই জানুয়ারি, ২০২২

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা


পরশু সন্ধ্যা ৭টা১০- আপিস থেকে বাড়ি ফিরে তুত্তুরীকে পড়াতে বসেছি, লোকটার মেল ঢুকল।  নাঃ লোকটাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না, নিখাদ কেজো ইমেল। 


বাংলা বই খুলল তুত্তুরী। সুর করে ‘কাজলা দিদি’ মুখস্থ করছে, আমি মন দিলাম লোকটার চিঠিতে।  লোকটা লিখেছে, ‘মাননীয়/মাননীয়া মহোদয়, পত্রের প্রথমেই আমার পরিচয় জানাই।  আমি হলুম ধরুন গিয়ে শ্রী আজিজুল। মোর বাপের নাম ধরেন গিয়া এজাদ। মোর গাঁয়ের নাম, পূব বাহালা।১০ই মার্চ ১৯৫৯ সালে মোর জন্ম। পেশায় ছিলুম নির্মাণকর্মী। আপনাদের দপ্তর আমাকে নির্মাণকর্মী হিসেবে মান্যতাও দিয়েছিল বৈ কি। পেয়েছিলুম নির্মাণকর্মীর কার্ড। এখন বুড়া হৈছি। আর খাটতে পারিনে কো। তাই পেনশন দেয় আপনাদের দপ্তর। 

কিন্তু বিগত কয়েকমাস পেনশন ঢোকেনি কো। স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, শরীরের একটা অংশে বিশেষতঃ বাঁ হাত আর পায়ে তেমন সাড় পাই না আজকাল। পঙ্গুত্ব গ্রাস করিছে। ওষুধপত্রের ও যা অগ্নিমূল্য। পেনশনের টাকা কটা বড় দরকার, একটু দেখেন না। গরীবের বড় উপকার হয়।’ 


মোদ্দা কথা এই, এর সাথে আরো কিছু আনুষঙ্গিক কথাবার্তা, যা যে কোন সরকারী দপ্তর সম্পর্কে লোকে বলে আর কি। আমি বেশ কবার গেছি ব্লক আপিসে, ওরা বলেছে আপনার আপিসে পাঠিয়ে দিয়েছে বা বেশ কয়েকবার আপনাদের ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছি, পাইনি ইত্যাদি। পাবার কথাও নয়। সদ্য স্থানান্তর হয়েছে আপিসটা। বলে কয়ে টেলিফোন লাইনটা এখানে আনানো হয়েছে বটে, তবে এখনও তেমন শক্তপোক্ত নন তিনি। মাঝেমধ্যেই অক্ষিপটল উল্টে বসে থাকেন । আর সুস্থ হতেও সময় নেন বেজায়।  


পরশু রাত ৮টা ৯- অবশেষে ফিরে ফোন করল শান্তনু।  অচেনা পঙ্গু বৃদ্ধের মেলটা পড়ে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেলেতে দেওয়া তথ্য থেকে বৃদ্ধকে খুঁজে বার করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই শান্তনুকে ফোন করেছিলাম। শান্তনু পেশায় তাম্রলিপ্ত আপিসের সিকেসিও হলেও, গোটা অফিসটা থাকে ওর আঙুলের ডগায়। সমস্ত তথ্য সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে আপিসের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। শান্তনুকে গুছিয়ে বলার মিনিট তিনেকের মধ্যেই আমার মোবাইলে পৌঁছে গেল বৃদ্ধের নাম, পিপিও নম্বর, লাইফ সার্টিফিকেট কবে জমা পড়েছে, কবে কলকাতা গেছে তার বিশদ তথ্য। 


দেখে আশ্বস্ত হলাম যে বৃদ্ধের তথ্য আমরা কুক্ষিগত  করে রাখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মহানগরে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে। ভাবলাম কাল এইটুকু তথ্যই মেল করে জানিয়ে দেব বৃদ্ধকে। 


পরশু রাত সাড়ে ৮টা- প্রবল বিরক্তি নিয়ে সোশ্যাল স্টাডিজের বই খুলল তুত্তুরী। আজকের পাঠ্য ডেজার্ট আর ফরেস্ট। বাংলা মাধ্যম থেকে পাশ করা আমি, নিরক্ষীয় চিরহরিৎ অরণ্য মুখস্থ করতেই কাঁদতে হয়েছে এতদিন এখন আবার ঐ একই জিনিস ইংরেজিতে বোঝাতে হচ্ছে মেয়েকে। এর থেকে বড় অত্যাচার আর কিছু হতে পারে? অতিকষ্টে ইকোয়াটোরিয়াল ময়েস্ট এভারগ্রিন থেকে ট্রপিকাল ড্রাই ডেসিডুয়াস ফরেস্টে পৌঁছতে বেরিয়ে গেল জিভ। ঢের হয়েছে বাপ।  আজ এইটুকুই থাক।  অকালেই ছুটি পেয়ে আনন্দে মত্ত নৃত্যরত তুত্তুরীর অসাক্ষাতে এসে সাহস করে ফোনটা করেই ফেললাম কলকাতার সুমিত বাবুকে। পেনশনগুলো মূলতঃ উনিই ছাড়েন। ভুল লিখলাম পেনশন অবশ্যই ছাড়েন বোর্ডের মাননীয় সিইও সাহেব। তবে যায় তো সুমিত বাবুরই হাত ঘুরে।মোটামুটি ওণার নখদর্পনে থাকে অনেকটাই তথ্য। যদিও এই ভাবে পূব বাহালা গাঁয়ের স্বর্গীয়(তাই হবেন নির্ঘাত) এজাদ বাবুর পুত্র আজিজুল বাবুর পেনশন কেন ঢোকেনি বা কবে ঢুকবে বললে উনি বলতে পারবেন না, তবুও যদি কিছু জানা যায়। যদি সামান্য ত্বরান্বিত হয় বৃদ্ধের কটা টাকা। 


ফোনের প্রথমেই বিস্তর মার্জনা চাইলাম, আপিস টাইমের আগে বা পরে বা ছুটির দিনে কেজো কারণে কাউকে ফোন করলেই মার্জনা চাই আমি। তারপর শোনালাম বৃদ্ধের করুণ মেলের কথা।  উনি অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে জানালেন, বৃদ্ধের পিপিও নম্বরটা দিলেই উনি কাল আপিসে গিয়ে জানিয়ে দিতে পারবেন, পেনশনের কি অবস্থা। ফোনটা রেখেই পাঠিয়ে দিলাম শান্তনুর দেওয়া পিপিও নম্বরখানা।  


গতকাল বেলা ১২টা ২৭- সুমিত বাবু বার্তা পাঠালেন, বৃদ্ধের লাইফ সার্টিফিকেট সিস্টেমে উঠে গেছে। এই মাসের মধ্যেই ঢুকে যাবে পেনশন। 


গতকাল বেলা ১টা ৬- প্রথমে ভেবেছিলাম বৃদ্ধকে ফোন করেই জানাই। বারংবার অনুযোগ করেছেন ওণার ফোন ধরেনি কেউ। তবে অফিসের ফোনটা আবার মৃত। ব্যক্তিগত ফোন থেকে জানালে যদি ভাবেন মস্করা করছে কেউ-। সাত পাঁচ ভেবে শেষমেষ ইমেলই করলাম। লিখলাম- 

‘প্রিয় আজিজুল বাবু,


আপনার ইমেল আমরা পেয়েছি। এতদ্বারা আপনাকে জানানো হচ্ছে যে আমাদের অফিস রেকর্ড অনুযায়ী, আপনার লাইফ সার্টিফিকেট কলকাতায় পাঠানো হয়েছে এবং কলকাতা অফিস তা পেয়েও গেছে। কলকাতা অফিসের সাথে আপনার কেসটা নিয়ে আমরা কথা বলেছি,  এবং ওনারা আশ্বস্ত করেছেন যে খুব শীঘ্রই, সম্ভবতঃ এই মাসের মধ্যেই আপনার পেনশন ঢুকে যাবে। ভালো থাকবেন এবং আসছে নভেম্বরে অবশ্যই মনে করে আপনার লাইফ সার্টিফিকেটটা জমা করবেন। 


ধন্যবাদান্তে


আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর তাম্রলিপ্ত।’


গতকাল রাত ৭টা৫৭- তুত্তুরীর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ঠিক করলাম পাটিসাপটা বানাব। বেশ খানিকটা নারকেলের ছাঁই রয়ে গেছে। গৃহকর্তার বড় প্রিয় পিঠে ঐটা। কড়ায় পাতলা ঘোল ঢেলে গ্যাস কমিয়ে একবার আপিসের ইমেলটা দেখতে গেলাম। এটাই আমার নিত্য রুটিন। দেখতে গিয়ে দেখি মেল করেছেন আজিজুল বাবু। জানিয়েছেন, এই বৃদ্ধের জন্য আপনাদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণে আমি ধন্য। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা নেবেন। ভালো থাকবেন।  


ভিতরে গুড় নারকেলের পুর ভরে আলগা করে পাটাসাপটা খানি মুড়তে মুড়তে ভাবলাম, একখানা ইমেল আর দুটো ফোন করা ছাড়া আমি আর করলাম কি? সদ্য চাকরিতে ঢোকার পর, তৎকালীন অফিসার সংগঠনের জনৈক বড় দাদা বলেছিলেন, ‘সরকারি আপিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সব থেকে বড় নালিশ কি জানিস? কেউ কথা শোনে না। একটু শুনিস। কাজ হওয়া, না হওয়া পরের কথা, মানুষের কথাটা তো শোন।’ তারপর কেটে গেছে কত বছর, ভাগ্যে সেদিন সেই ভদ্রলোকের এই কথাটা কান করে শুনেছিলাম।

Monday 17 January 2022

আয় তবে সহচরী ১৭ই জানুয়ারি, ২০২২

 


👩🏻-আজ রাতে পরোটা হয়েছে।সাদা ময়দার মুচমুচে মন খুশি, উর্বশী পরোটা- 

👩🏻‍🎤-বাঃ।  আর সঙ্গে কি?

👩🏻-নতুন আলুর দম। না মানে ঠিক দম নয়, মটরশুঁটি আর ধনেপাতা দিয়ে একটু ঝোলঝোল তরকারি। 

👩🏻‍🎤-বাঃ।  আর?

👩🏻- আবার কি? শেষ পাতে নলেন গুড়। ছোটদা দিয়েছে। বিশ্ব বাংলার টিউবে ভরা।  কি ভালো খেতে। 

👩🏻‍🎤- বাঃ। আর?

👩🏻- আবার কি? এখানেই শেষ। 

👩🏻‍🎤-ধুর ব্যাটা। আর মদ?

👩🏻-রামঃ। 

👩🏻‍🎤- ওরে পরোটা খেলে মদ খেতে হয়।  আমার গুরুর নির্দেশ। 

👩🏻- কি নির্দেশ? যেদিন বাড়িতে পরোটা হবে, সেদিন মদ খেতে হবে?

👩🏻‍🎤- হুঁ। 

👩🏻- আর পরোটা যেদিন হবে না?

👩🏻‍🎤- সেদিন তো অবশ্যই খেতে হবে। 

👩🏻-এটাও গুরুর নির্দেশ?

👩🏻‍🎤-হুঁ। আবার কি? 

👩🏻- এমন গুরু কোথা থেকে পেলি ভাই?

Saturday 15 January 2022

অনির ডাইরি ১৫ই জানুয়ারি, ২০২২

 


পৌষ পার্বণ এলেই ঠাকুমার কথা খুব মনে পড়ে। আর মনে পড়ে যায় আমাদের সাবেকী রান্নাঘরটার কথা। এককালে এবেলা ওবেলা পঞ্চাশ-ষাট জনের পাত পড়ত এ বাড়িতে, সেই অনুপাতেই রান্নাঘরখানা বানিয়েছিলেন প্রপিতামহ। দুখানা দরজা, চারখানা জানলা, দুখানা কুলুঙ্গি ওয়ালা বিশাল ঘরটার আসল রঙ কি ছিল কে জানে। পৌনে শতক ধরে জ্বালানো উনুনের ধোঁয়ায় ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছিল ছাতের কড়িবরগা সমেত গোটা ঘরটাই। একটা ষাট ওয়াটের হলুদ বাল্বের আলোয়, কয়লা,ঘুঁটে আর গুলের উনুনে পিঠে বানাত ঠাকুমা। 


উনুন ধরানোটাও ছিল একটা আর্ট। ধরানোর আগে সাজানো হত উনুনটাকে। তলায় পাতা হত কয়েটা ঘুঁটে। ওই বয়সে আমার মনে হত ঘুঁটে দেওয়াটাও একটা আর্ট বটে। আমাদের পূব দিকের দেওয়ালে ঘুঁটে দিত পদ্মদি। আর আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন পাঁচিলের ওপর থেকে হাঁ করে দেখতাম আর খোশ গল্প করতাম পদ্মদির সাথে। পদ্মদির ঘুঁটের ওপর থরে থরে রাখা হত কয়লা অথবা গুল। আশির সোনালী দশক, তখন সববাড়িতেই একটা করে হাতুড়ি থাকত কয়লা ভাঙার জন্য। কয়লার থেকে অনেক সস্তায় মিলত ঘেঁষ বা কয়লার গুঁড়ো। ধুলোর মত সেই ঘেঁষকে মাখা হত ভাতের ফ্যান আর পুকুরের পাঁক দিয়ে। পাঁক বিক্রি করত নকী পিসি। দুপুর বেলা যখন পাড়ার সব সমর্থ পুরুষেরা কাজে বেরিয়ে যেত, ভিজে শাড়ি পরে দুহাতে পাঁকের বালতি নিয়ে বাড়ি বাড়ি পাঁক বিক্রি করতে যেত নকী পিসি। সেই ঘেঁষ আর পাঁক/ফ্যান মিশিয়ে গোল গোল বড়ার মত গুল দিত মায়াদি আর দেবীদি। ওরা যে আদতে গৃহ পরিচারিকা বা গৃহ শ্রমিক এই তত্ত্ব যখন আদতে আমাদের মাথায় ঢুকেছিল, ততোদিনে মায়াদি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন আর দেবীদি বিবাহ করে বসতি গেড়েছে সুদূর খানাকুলের কোন গাঁয়ে।  


উনুনের আঁচে বসানো চাটুতে কাঁটা বেগুনের বোঁটা দিয়ে তেল মাখিয়ে ঘরের শিলে বাটা চালগুড়ির মিশ্রন ঢালত ঠাকুমা, তারওপর উল্টে দিত মাটির সরা। ছ্যাঁক করে আওয়াজ হওয়া মাত্রই লাগোয়া রোয়াকে বসে নারকেল দড়িতে গিঁট ফেলতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। ঠাকুমার মুখে শোনা সেই উমনো-ঝুমনোর গল্পের বাবাটার মত। 


কেন জানি না আজও মনে হয় ঠাকুমার মত আস্কে পিঠে আর কেউ বানাতে পারে না। আমার বড় মাসির মত পিঠেই বা কে বানাতে পারে? কি অমানুষিক খাটতে পারত বড়মাসি। অ্যালুমিনিয়ামের মস্ত গামলা ভর্তি ভর্তি পিঠে বানাত একা হাতে। দুই মাসি, মেসোমশাই, চার দাদা, তাদের অগণিত বন্ধুবান্ধব সবাইকে পেট পুরে খাইয়েও ঝোলা ভরে পাঠিয়ে দিত আমাদের জন্য।  দুধ পুলিই বলুন বা সিদ্ধ পুলি, ভাজা পিঠেই হোক বা পাটি সাপটা সবকিছুই দুধরণের বানাত বড়মাসি, এক ধরণের ভিতরে থাকত নারকেলের পুর আর এক ধরণের পিঠের ভিতর হরিণঘাটার দুধকে ঘন করে প্রায় শুকিয়ে ফেলা ক্ষীরের পুর । সকাল থেকে একা হাতে আপিস টাইমের রান্না বাড়া করে সবাইকে খাইয়ে আপিস-ইস্কুল-কলেজে পাঠিয়ে, জামাকাপড় কেচে, শুকিয়ে, রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনে, দুপুরে হাল্কা গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে কাচা কাপড় পরে পিঠে বানাতে বসত বড়মাসি আর রাতারাতি হয়ে যেত পিঠে বানানোর মেসিন। খুব খুব মিস করি সেই দিনগুলোকে। শুধু পিঠে বানিয়েই ক্ষান্ত হত না বড়মাসি, দাদাদের হাত দিয়ে গরম গরম আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে তবে শান্তি। দাদাদের সময় না হলে, ধুত্তোর বলে নিজেই বাড়ির শাড়ি পাল্টে, ঘোমটা টেনে, ঝোলা হাতে রওণা দিত আমাদের বাড়ির দিকে। শুধু একদিন নয়, পরপর তিনদিন। 


পৌষ পার্বন এলে জ্যাঠাইমার কথাও খুব মনে পড়ে। কি ঝটপট পিঠে বানিয়ে ফেলত জ্যাঠাইমা। মালপোই বলুন বা ভাজাপিঠে বা রসবড়া সবকিছুই আধঘন্টার মধ্যে রেডি করে ফেলত জ্যাঠাইমা। কোন উৎসব বা পার্বণ নয়, জ্যাঠাইমা পিঠে বানাত শুধু আমার জন্য। যখনই খেতে চাইতাম, যাই খেতে চাইতাম। জ্যাঠাইমার কাছেই পায়েস বানাতে শেখা আমার। পৌষ পার্বণে আর কিছু বানাই বা না বানাই, ঘণ লাল চাপ-চাপ গুড়ের পায়েস অবশ্যই বানাই।


এই বছর অবশ্য পিঠে পায়েস বানানোটা ছিল বেশ চাপের ব্যাপার। সদ্য নতুন জেলায় আস্তানা বানিয়েছি আমরা। কাছাকাছি দোকানবাজার কোথায় কি কিছুই আজ অবধি শিখে উঠতে পারিনি। সবকিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় সহযোগীদের ওপর। শৌভিকের আগের বেশ অনেকজন মহকুমা শাসকই একলা থাকতেন হেথায়, আমার মত পাগল আর কে আছে, যে মেয়ের মহানাগরিক পড়াশোনা, ইস্কুল জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র একসাথে থাকা, একসাথে বাঁচার মোহে বদলী নিয়ে আসবে গোবিন্দপুর। তো সেই কারণেই হয়তো সহযোগীগণ অভ্যস্ত একলা মানুষের দোকানহাট করাতে। আমরা যে সদলবলে থাকব এবং যাবতীয় উৎসব পাব্বন ঢাকঢোল পিটিয়ে করব তা আর বেচারা জানবে কি করে।


 বলেছিলাম পলাশ ‘একটু ভালো গুড়’ এনে দিও তো। পলাশ এনে দিয়েছে বৈকি। ভয়ানক 'ভালো' প্রায় সাড়ে তিনশ টাকার গুড় এবং যথার্থই 'একটু' অর্থাৎ মাত্র পাঁচশ গ্রাম। আর এনে দিয়েছে দুখানা নিটোল নারকেল। ও দুটো অবশ্যি কেনা নয়, উপহার। আমার পিঠে বানানোটা যে পলাশের ঘোরতর না পসন্দ, তা পলাশ খোলাখুলিই জানিয়েছে আমায়। 'ম্যাডাম, আপনি করবেন কেন? ম্যাডামরা আবার ওসব  করে নাকি? তাদের অত সময় কুথা? আমার বউ বানিয়ে দিবে খন।' সত্যিই পলাশের বউ বানিয়ে দেয়, অনেক কিছুই, যেমন ধরুন বাড়ির পুকুরের গেঁড়ির ঝাল, নারকেল নাড়ু, সিদ্ধ পুলি, আরো কত কি। ভীষণ সুস্বাদু হরেক রকম খাবার। তাই বলে পৌষ পাব্বনের দিন এরকম বেয়াড়া আব্দার কেউ করে? না হে পলাশ, আমি নিজেই বানাব।  


নারকেল তো পেলাম, কাটারি আর কুরুনি নেই যে। 

শেষে রান্নার দিদিকেই ধরলাম। এই জেলার মেয়েরা ভয়ানক কর্মঠ। আমাকে একটা অন্তত নারকেল যদি একটু বাড়ি থেকে কুরে এনে দেয়। ভগবান মঙ্গল করুন তাঁর, অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি, একটা নয়, দুটোই কুরে এনে দিয়েছেন তিনি। যে চায় চিনি, যোগান চিন্তামনির মত, মাত্র একশ একটাকা দিয়ে এক কিলো দুর্ধর্ষ ঝোলা গুড়ও এনে দিল আমার আপিসের শুভদীপ্ত। ব্যাস আর কি? বাকিটা তো চেনা সিলেবাস।  


বাসনকোসনের ভয়ানক অভাব সত্ত্বেও টুকটুক করে অনেক রকমই হল, পায়েস, দু রকম সিদ্ধ পুলি( নোনতা আর মিষ্টি), দুধ পুলি, ভাজা পিঠে, রস বড়া, সরু চাকলি। নতুন থালা বাটি কিনে, সাজিয়ে ঘরের ঠাকুরের সামনে যখন তুলে ধরলাম, ঘড়িতে রাত পৌনে দশটা। এত উঁচু গ্যাসের টেবিল, যে বড় কড়া বসিয়ে লেঙচে লেঙচে পিঠে বানাতে গিয়ে যন্ত্রনায় বেঁকে যাচ্ছে পিঠ আর হাঁটু। 


শৌভিক তুত্তুরীকে বেড়ে দিয়ে নিজের হাতের পিঠে নিজে খেতে বসে হঠাৎ ভীষণ মনটা খারাপ হয়ে গেল। এক প্রস্থ খারাপ হল তাদের জন্য যাদের কাছে পিঠেপুলির জন্য হ্যাংলামি করতাম আমি আর দ্বিতীয় দফায় খারাপ হল তাদের জন্য প্রতি বছর আমার হাতের পিঠে খাবে বলে হ্যাংলার মত বসে থাকে যারা। যাঁদের কেউ গুরুজন আবার কেউ লঘু।এত দূরে সরে আসার জন্য খাওয়াতে পারলাম না যাঁদের কাউকেই।  প্লিজ এমনি থেকো তোমরা, বদলে যেও না, আর সবথেকে বড় কথা হারিয়ে যেও না।

অনির ডাইরি ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২২

 



কোন গুলো তুত্তুরীর বানানো বলুন দিকি? খুব সাবধান কিন্তু, ভালো করে দেখে বলুন আর ইয়ে মোটেই সত্যি কথাটা বলবেননি কিন্তু। বললেই গোঁসা ঘরে খিল দেবেন শ্রীমতী তুত্তুরী। এই অধম ভুক্তভোগী আজ্ঞে। 


আজ আমাদের পৌষ পার্বন কিনা, পর্যায়ক্রমে গুড়ের পায়েস, নোনতা পুলি, সিদ্ধ পুলি, দুধ পুলি, রস বড়া, ভাজা পিঠে, সরু চাকলির গন্ধে সুরভিত মোদের ক্ষুদ্র গৃহ কোণ। দৌড়ে দৌড়ে সব কিছুতে হাত লাগাচ্ছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। শুধু পড়তে বসতে বললেই, ছলছলিয়ে উঠছিল আঁখি দ্বয়। তাঁর নাকি 'পচন্ড' I repeat 'পচন্ড' মাথা ব্যথা করছে। 


তা সেই মাথা ব্যথা নিয়েও তিনি গেলেন মাসির সাথে নোনতা পুলি গড়তে, নোনতা পুলি বোধহয় হাওড়া জেলারই বৈশিষ্ট্য। সিদ্ধ পুলির মধ্যে মিষ্টি নারকেলের পুরের পরিবর্তে আলু ফুলকপি/বাঁধাকপি মটরশুঁটির শুকনো ঝাল তরকারির পুর ভরা হয়। এক নাগাড়ে মিষ্টি খেয়ে মুখ বিস্বাদ হয়ে আসে যখন ঝাল পুলি তখন মঞ্চে নামে এবং বাকিটা যাকে বলে, 'veni vidi vici'। 


মাসির অপরিসীম ধৈর্য্য, মাসি দেখিয়ে দিল, বুঝিয়ে দিল। একটা হাতে ধরে বানিয়েও দিল। তারপরও যখন শ্রীমতী তুত্তুরী পুলির পরিবর্তে একখানা মণ্ড নির্মাণ করলেন, তখন মাসি কিঞ্চিৎ উত্যক্ত হয়েই বললেন, 'তোকে আর করতে হবে না। তুই যা তো।' ওমনি আর কি, গোঁসা ঘরে পড়ল খিল। কেবল বাবা ছাড়া আর কারো অনুমতি ছিল না সেই ঘরে প্রবেশ করার। নেহাত মা'টা কোন নিয়ম মানে না, তাই না ধরে আনল আদরে সোহাগে। একবার মাসি বলে দিল তুই পারবি না, ওমনি তুইও বিশ্বাস করে নিলি যে তোর দ্বারা হবে না?মাসি না হয় তোর ভালোবাসায় অন্ধ, সারা জীবন এমন বহু মানুষের সংস্পর্শ এ আসবি, যারা আরো খারাপ ভাবে, বলবে। বলবে তুই পারবি না। বলবে তোর দ্বারা হবে না। তখন কি করবি? পালিয়ে আসবি? আরে চেষ্টা তো কর। করে তো দেখ? হলে হবে, না হলে না হবে। মহাভারত তো অশুদ্ধ হবে না। আর ইয়ে তোকে পড়তেও বসানো হবে না। 


অতঃপর আবার পূর্ণ উদ্যমে পুলি বানাতে হাত লাগলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। ভালো গুলো ওরই বানানো বুঝলেন তো,  ইয়ে খারাপ গুলো, ধরে নিন আমিই বানিয়েছি না হয়। মা কালি, আমি মিথ্যে কথা বলি না-

Wednesday 12 January 2022

তুত্তুরী উবাচ ১২ই জানুয়ারি, ২০২২

 

👩🏻- শৌখিন বানান কি?

👧🏻- স এ ঔ কার-

👩🏻-কি? ওটাই তো অশুদ্ধ বানানটা ছিল। তুই কি শুদ্ধ বানানগুলো না পড়ে উল্টোটাই পড়েছিস?

👨🏻-(পাশ থেকে ফাইল সই করতে করতে, মুচকি হেসে) ঠিকই আছে। ও সুখ থেকে না হয় সৌখিন করেছে। 

👩🏻- (বিরক্ত হয়ে) ভুলভাল শেখাস না। বাবার কথায় কান দিস না তো।  পুষ্প বানান কি?

👧🏻- প এ উ-স্প। 

👩🏻- উফঃ ভগবান। বিশেষণ বানাণ কি?

👧🏻- ব এ ই(দম নিয়ে)- শ য়ে একার-(পুনরায় দম নিয়ে) ষ (আবার দম নিতে গিয়ে মায়ের রক্ত চক্ষু পর্যবেক্ষণ পূর্বক তড়িঘড়ি) ন। 

👩🏻- উফঃ। আবার? আরেঃ ওটা তো অশুদ্ধ বানানটা। 

👧🏻-(প্রবল চিন্তান্বিত হয়ে) তাহলে কি ণ?

👩🏻- হুঁ। তোকে ণত্ব-ষত্ব বিধান বলেছিলাম না। ষ য়ের পর  সবসময় ণ বসে। আগে র এর পরও বসত। এখন বসে না। 

👧🏻-(প্রবল বিরক্তি নিয়ে বিশেষণ বানান লিখতে লিখতে স্বগতোক্তির ঢঙে) কিছুদিন পর ষ এর পরেও বসবে না। 

👩🏻-কল্যাণীয়েষু বানান কি?

👧🏻-( বেশ কয়েকবার ঢোঁক গিলে, এক ডজন চোখ পিটপিট করে, বাবার দিকে সাহায্যের অভিলাষায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বিফল মনোরথ হয়ে) ক-ল এ য ফলা- দন্ত্য ( মায়ের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি) ণ এ ঈ। কল্যাণী। (বিকট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) এষু বানানটা যেন কি? ও হ্যাঁ এ শ এ উ। 

👨🏻-(দড়াম করে ফাইল বন্ধ করে) ঐ শুটা ইংরেজি।  মানে জুতো। তোর মা যেটা আনতে যাচ্ছে। শু-শিক্ষা দিতে।

Friday 7 January 2022

অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২২

 


শৌভিক দিব্যি আছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, নিজেকে রাজা উজির ভেবে দিব্য চটি ফটফটিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, গোছা গোছা ফাইল আর সার্টিফিকেট সই করছে, শ্যেন দৃষ্টিতে আমার সমস্ত কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে, পদে পদে আমার দোষ ধরছে, চুরি করে মুখে একটা নারকেল নাড়ু পোরার সাথে সাথেই চলমান অশরীরীর মত এসে উদয় হচ্ছে এবং আমার গুষ্টির তুষ্টি করছে।  সর্বোপরি কথায় কথায় আস্তিন গুটিয়ে ঘটি-বাঙালের ঝগড়া করছে। কে বলবে আজ সন্ধ্যার ডাকে খবর এসেছে ব্যাটা কোভিড পজিটিভ। 


 এমনিই তো ছেড়ে গিয়েছিলাম মঙ্গলবার। দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম আমার শহরে। দুর্গা পুজোর পর আর থাকাই হয়নি বাবার বাড়ি। একদিকে পিছিয়ে যাওয়া দুয়ারে সরকার, অন্যদিকে তুত্তুরীর বন্ধ ইস্কুল, তাই ভেবেছিলাম দুটো দিন কাটিয়ে আসি হাওড়ায় গিয়ে। বাপের বাড়ি ভারি মজা। নৈশ ভোজে মায়ের হাতের লাল আটার লুচি, আলু ফুলকপির জিভে জল আনা বাটি চচ্চড়ি  আর কড়কড়ে চিনি। বেলা সাড়ে নটার সময় চোখ খুলেই মুখের কাছে ধরা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, প্রাতঃরাশে কাঁচা আম আর লঙ্কার আচার দিয়ে ম্যাগি, দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে কাঁচা লঙ্কা আর অপরিমিত কাঁচা তেল দিয়ে পোস্ত বাটা, হিং গন্ধী বিউলির ডাল, আচারের তেল দিয়ে মাখা এক তাল আলু ভাতে, কাঁচা সর্ষের তেল ছড়ানো আলু-বড়ি পোস্ত, নিটোল করে ছাড়ানো হাফ বয়েল সিদ্ধ ডিম আর সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে নেটফ্লিক্স দেখা- এত সুখ সহ্য হলে তো।  


সত্যি বলছি মাইরি আওয়াজ দেবার জন্যই ফোনটা করেছিলাম। ওরম আমি প্রায়ই করি, হাওড়ায় গেলেই। ‘ কি রে, কি করছিস? আপিস যাচ্ছিস? আজ ছুটি না? ওঃ আজ বুধবার বুঝি, ইশ্ কত খাটিস তুই। পারিস কি করে, কে জানে? ভেবেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আমি তো এই ঘুম থেকে উঠে, জলখাবার সাঁটিয়ে আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুতে যাচ্ছি। আজ ভাবছি চানটাও আর করব না-। ’ 


কিন্তু এবারে জবাবটা প্রত্যাশিত পেলাম না। অঝোর গালি বর্ষণের বদলে ভেসে এল ম্রিয়মাণ কণ্ঠ, ‘নাঃ আজ আমিও যাচ্ছি না। পলাশকে(ড্রাইভার) নিষেধ করে দিলাম।বললাম অফিসে থাকতে। প্রয়োজনে ডেকে নেব।  শরীরটা ঠিক যুৎ লাগছে না। কাল রাত থেকে গলায় ভীষণ ব্যথা।’ গলায় ব্যথাটা শৌভিকের নৈমিত্তিক সমস্যা। টনসিলের ধাত, মাঝেমধ্যেই ঠাণ্ডা লেগে ইনফেকশন হয়। পইপই করে নিষেধ করা সত্ত্বেও যে ভাবে গরম জলে স্নান করে সকাল-সকাল পাতলা টিঙটিঙে একখান টিশার্ট পরে ছাতে পায়চারি করে বা সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে ঐ টিশার্টটা পরেই হনহন করে বাগানে হাঁটে, ঠাণ্ডা লাগাটা তো সময়ের অপেক্ষা। কতবার বলি, ওরে একটা টুপি পর অন্তত, ছেলেদের টাকে ঠাণ্ডা বেশি লাগে- শোনে কেমন? যাই করতে বলি, শৌভিকের একটাই জবাব, ‘শ্বশুরটাকে করতে/পরতে বল। ’ সারাদিন আমার বাপকে নিয়েই পড়ে থাকে লোকটা। ঈর্ষা, পাতি ঈর্ষা। এত বছর বিয়ের পরও, আমার প্রিয়তম পুরুষ আমার বাবা কি না। 


যতই লঘু ভাবে নিই ব্যাপারটা, শৌভিক অফিস কিন্তু চট করে কামাই করে না। বিশেষতঃ অসুস্থতার অজুহাতে তো নয়ই। বেলা এগারোটা নাগাদ ফোন করলাম, খোঁজ নিতে। কম্বলের তলা থেকে চিঁচিঁ কণ্ঠে জবাব এল, ‘পলাশকে একটা থার্মোমিটার আনতে বলেছি। জ্বর আসছে।’ এরপর আর রিস্ক নিইনি। তুত্তুরীকে তার দাদু-দিদার নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে একাই ফিরে আসি তাম্রলিপ্ত। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ যখন দরজা খুলে দিল শৌভিক, মুখ লাল, চোখ ছলছলে। টেবিলে আধখাওয়া ম্যাগির প্লেট। জীবনেও এ বাড়িতে অর্ধভুক্ত প্লেট পড়ে থাকে না টেবিলে। যতই শরীর খারাপ হোক উচ্ছিষ্টটুকু ময়লার বালতিতে ফেলে, সিঙ্কে প্লেটটা নামাবেই শৌভিক। জন্মসূত্রে Virgo কি না, তাই পরিচ্ছন্নতার বাতিক মারাত্মক। সেই লোকটা আজ কোন মতে দরজাটা খুলে দিয়েই গিয়ে শুয়ে পড়ল, তখনই বুঝতে বাকি রইল না, কি বাঁধিয়ে বসেছে। 


বুধবার রাতটা সত্যিই একটু চাপে কাটল। প্যারাসিটামল চিবিয়েও জ্বর দাঁড়িয়েই রইল ১০২ এর ঘরে, সাথে ব্যাপক কাঁপুনি আর অসহ্য বেদনা। এ আমার চেনা লক্ষণ। ২০২০র জুন-জুলাই মাসে ঠিক একই অনুভূতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলাম। খুঁড়ে খুঁড়ে বেদনা বার করে আনে কোভিড। ভাগ্যে ছুঁতে শেখেনি হৃদয়কে। 


  ঝঞ্ঝাবহুল রাতের পর বৃহস্পতিবার সকালটা অবশ্য শুরু হল বেশ পজিটিভ ভাবে।  জ্বর পুরোপুরি না সারলেও থমকে দাঁড়াল ৯৯ এর ঘরে। গলা ব্যথা, কান কটকট আর পিঠে  সামান্য বেদনা বাদে রোদ খেতে গেল বাকি ব্যথাবেদনার দল। সদলবলে সদর হাসপাতালে টেস্ট করাতে গেল শৌভিক। বাড়ি বসে করল না কেন? এ প্রশ্ন করিয়া লজ্জা দিবেননি।  রাপিড টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ এল।  RTPCR টেস্ট করিয়ে  দুটো পাখনা সমেত উড়তে উড়তে বাড়ি এল শৌভিক। শুক্রবারও উড়ছিল, এমন সময় খবর এল বাবু ওমিক্রন বাঁধিয়ে বসেছেন। 


তারপর থেকে শুধু তুল্যমূল্য বিচারই করে চলেছি আমরা। আমার কোভিড আর শৌভিকের কোভিডের। আমার সময় টেস্ট করাতেই লেগেছিল পাঁচ ছদিন। তাও পোড়াতে হয়েছিল বিস্তর কাঠ আর খড়। আর ওর বেলায়-। আমার সময় একঘরে হবার ভয়ে হাতে গোণা জনা কয়েক বন্ধু ছাড়া আর কাউকে খবর দিতে সাহস পাইনি আমরা। যেদিন টেস্ট হয়েছিল, সেদিনই  দুসপ্তাহের মত চাল, আলু, মাছ আর ডিম কিনে গুদামজাত করে রেখেছিল শৌভিক। এমনকি তুত্তুরীর জন্মদিনেও বেরোয়নি বাড়ি থেকে। ঐ গুদামজাত সামগ্রী দিয়েই মাথা খাটিয়ে হাতে গোণা উপকরণ দিয়ে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে দিয়েছিলাম মেয়ের সামনে। সুস্থ হয়ে আপিস যেতেও বুক কাঁপছিল, যদি আমাকে অচ্ছুৎ গণ্য করে এক ঘরে করে ব্যাটারা। যদিও ফুল,মিষ্টি আর কিসব উপহার দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল আমার তৎকালীন টিম, তবুও মনে আছে সেই গা ছমছমে দিনগুলোর কথা। 


আর শৌভিকের বেলায়, দুবেলা আসছে যাচ্ছে ফাইলের পাহাড়। এবেলা ওবেলা খবর নিয়ে যাচ্ছে শৌভিকের লোকজন। খুচখাচ বাজার নিয়ে চার বার তো পলাশ একাই এসে ঘুরে গেল। টেস্ট করতে যাবার সময় শৌভিকের ড্রাইভার আর সিকিউরিটিকে বললাম, ভালো করে মাস্ক পরে যেতে। দুজনে হেসে উড়িয়ে দিল। ব্যধিটা একই আছে অথচ কত বদলে গেছে সমাজ আর তার দৃষ্টিভঙ্গি। 


পুনশ্চঃ আর একটা জিনিসও বদলায়নি, তা হল আমার ভূতের ভয়, সেদিনও একা শুতে পারতাম না, আজও নয়। ভূতের থেকে কোভিডের সঙ্গে কুস্তি করা অনেক ভালো রে বাবা।

অনির ডাইরি ১লা জানুয়ারি, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 


পূর্ব মেদিনীপুর জেলা যে এতখানি ঐতিহ্যপূর্ণ তা এখানে আস্তানা না বানালে হয়তো জানতেও পারতাম না। এ জেলার আছে, নিজস্ব ইতিহাসের ধারা। গোটা জেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে একটা দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা রাজবাড়ি। আরো বেশিও থাকতে পারে আমি এখনও পর্যন্ত কেবল তমলুক, মহিষাদল, পাঁচেৎগড়, কাজলাগড় আর ময়না রাজবাড়ির হাল হদিসই জানতে পেরেছি। আজও সেই সব রাজবংশ তথা তাঁদের অধীনস্থ ভূস্বামীদের তৈরি অসংখ্য পোড়া মাটির মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই জেলার এদিক-ওদিক। বেশ কিছুর অবলুপ্ত প্রায়। বাকিদেরও অবস্থা খুব খারাপ। যেগুলো সারানো হয়েছে, সেগুলি দেখলে কান্না পায়। পাতি সিমেন্ট বালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাবতীয় পোড়ামাটির সুক্ষ্ম কারুকার্য।  


মংলাইয়ের মন্দিরটা অবশ্য এখনও টিকে আছে। পয়লা জানুয়ারির দুপুরে আমরা গিয়েছিলাম ফুল দেখতে। ক্ষীরাই নয়, ওখানে আজ বড় ভিড় আর হট্টগোল। তাই ভিতরে, গ্রামে যেখানে আমরা ছাড়া কেউ নেই এমন অঞ্চলে। এবছর যদিও ফুলের হাল খুবই খারাপ। অসময়ের বৃষ্টিতে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ পাঁশকুড়ার ফুলের চাষ।  অন্যান্য বছরে এতদিনে মাঠগুলো ভরে যায় রঙবেরঙের মরশুমি ফুলে। দূর থেকে মনে হয় শতরঙী গালচে পাতা হয়েছে বুঝি। এবছর এখনও আসেনি ফুলের পুরো বাহার। তাও যা দেখা গেল, আমরা তো তিনজন তো তাতেই মোহিত। বড় উর্বর এখানকার মাটি, ফুল-সব্জি যাই লাগানো হয়, ঝেঁপে আসে ফসল। 


ফুলের শোভা দেখে ফিরে আসব, বিডিও সাহেব অনুরোধ করলেন কয়েকটা স্থানীয় মন্দির দেখে যেতে। সবই বেশ প্রাচীন, আড়াই-তিনশ কি আরো পুরানো পোড়ামাটির মন্দির। রাজপথ থেকে বেশ অনেকটা ভিতরে, চাষের জমির মাঝে মংলাই রাধাদামোদর মন্দিরে গিয়ে যখন আমরা পৌঁছালাম, সন্ধ্যা নামছে। দিনের শেষে রাসমঞ্চের পিছনে মুখ লুকাচ্ছেন অস্তমান দিনমণি। 


১৭খানা চূড়াওয়ালা তিনতলা দোলমঞ্চ। মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়। সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম তুত্তুরী আর আমি। তিনতলায় ওঠার আর সাহস হল না। বেশ খারাপ অবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন এবছর বন্যায় দীর্ঘদিন ডুবে ছিল দোলমঞ্চটি।  সাপখোপের বাসা। শীতকাল বলে হয়তো সামনে আসছেন না তাঁরা, তাই বলে বেশী সাহস না দেখানোই বাঞ্ছনীয়। দোলমঞ্চটি শোভিত অপরূপ পোড়ামাটির ভাস্কর্যে।  


বঁদিকে ভগ্নপ্রায় মন্দির।  আদতে বানিয়েছিলেন যে ভূস্বামী, তাঁর বংশধরেরা আজও চেষ্টা করে চলেছেন মন্দিরটিকে টিকিয়ে রাখার। আজও উপাসিত হন,এই মন্দিরের দেবতা। ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে পৌঁছেছি আমরা, দেবতার সামনে জ্বলে উঠেছে সন্ধ্যাদীপ, অন্ধকার মন্দিরের ভিতর কম্পমান দীপশিখা যেন আচমকা শরদ্বিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর কোন ঐতিহাসিক গল্পের পটভূমিকায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কে জানে কালের মন্দিরার মত কোন গল্প রচিত হয়েছিল কি না, এই মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে।  


মন্দিরের গায়ে রয়েছে অসংখ্য পোড়া মাটির মূর্তি। যার অন্যতম হল ১৮ হাতের মা দুর্গা। বিষ্ণু মন্দিরে দেবী শক্তির মূর্তি কেন? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? সবকিছুই যেন কেমন রহস্যে মোড়া-






Saturday 1 January 2022

অনির ডাইরি ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২১

 

পৌনে তিনটে নাগাদ ফোন করলাম। ফোনের ওপার থেকে চরম ব্যস্ত কেজো স্বর বলল,‘হুঁ?’ আমার ভয় পাওয়া চেহারা আমি আদতে আনাড়ি, স্বভাব সিদ্ধ ভীতু স্বরে জানতে চাই, ‘বেরোলে?’ রোজ একই প্রশ্ন করি। তবে অন্যান্য দিন সময়টা পেছিয়ে যায় আরোও ঘন্টা তিন, সাড়ে তিন। আজ তো বছরের শেষ দিন। 


বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি আমি। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য বাড়ি ফেরা, বাসি রুটি আর সকালের বা আগের দিনের লাউয়ের তরকারী বা দু পিস স্যাঁকা পাঁউরুটি আর সকালের বেঁচে যাওয়া ডাল নাহলে নিছক দুধ কর্নফ্লেক্স খাই আমরা মা আর মেয়ে। নাক সিঁটকাবেন না। এগুলো মোটেই তেমন খারাপ নয়, ভয়ঙ্কর তো হল ওলকপি আর বড়ির তরকারি। এই মোটা মোটা করে কাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ওলকপির সাথে সামান্য আলু আর বড়ি মিশিয়ে ঝোল। উফঃ একবার রাঁধলে তিনদিনেও শেষ হয় না তা। 


যাই হোক, যাই থাকুক তাই দিয়ে টিফিন সেরে শ্রীমতী তুত্তুরীর মাথায় একখানা চাঁটি মেরে আপিস যাই আমি। আমার সাথে বসে ঐসব অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়া আর আমার হাতের চাঁটির জন্য বসে থাকে তুত্তুরী। যেদিন কোন মিটিং এ আটকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়, সেদিন একটু বেশীই শুকিয়ে থাকে মেয়ের মুখ। বুঝি খিদে পেয়েছে, কিন্তু না খেয়ে বসে আছে মায়ের জন্য। তমলুক পোস্টিং এর এই একটাই ভালো দিক খুঁজে পায় তুত্তুরী। 


তবে আজ ফিরব না। কাজ গুছিয়ে বেরোতে একটু দেরী হবে। সকালে বলাতে মুখ ঝুলে গিয়েছিল শ্রীমান তুত্তুরীর। তখন উপযাজক হয়ে শৌভিকই বলেছিল, পৌরসভায় কিসব কাজ আছে, সামলে ফাইলপত্তর নিয়ে তিনটের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। এখন যখন ফোন করলাম, জাস্ট উড়িয়েই দিল, ‘না-না-না। দেরী হবে।’ অগত্যা কি আর করি, মাসির ফোনে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, ‘খেয়ে নে বাবু। বাবার দেরী হবে।’ 


সাড়ে তিনটে নাগাদ, শৌভিক উচ্চস্বরে ঘোষণা করল,‘আমি বেরিয়েছি।’ যেটা অনুচ্চ থেকে গেল, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। এবার পাতাতাড়ি গোটাতে হবে আমাকেও। অন্ততঃ মহকুমা শাসকের সেটাই মনোবাঞ্ছা। মুস্কিল হচ্ছে গোটাও বললেই তো আর গোটানো যায় না। ফাইল-চিঠি-অর্ডার জলদি হাতে গোটাচ্ছি, জহর বাবু এসে বললেন,‘ম্যাডাম চলে যাবেননি যেন।  একটু মিষ্টি-’। মিষ্টি বোধহয় বানিয়ে আনছে ব্যাটারা, উসখুস করছি আমি। আরএলও ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করছি,‘সৌরভ আমি বাড়ি যাই?’ সব আপিসে আপিসমাস্টাররা আটকায় কর্মচারীবৃন্দকে, এখানে উল্টোপুরাণ। সৌরভ গম্ভীর সুরে বলে, ‘দাঁড়ান ম্যাডাম, আজ শেষ দিন তো। সব লাইফ সার্টিফিকেট গুলো গেল কি না একবার দেখে নি।’ মিনিট পনেরো পর জানা গেল তাঁরা হেঁটে হেঁটে মহানগরের পথ ধরেছে। এবার আমিও গুটি-গুটি- মানে হেঁ-হেঁ আর কি। 

আবার মাথা নাড়ে সৌরভ। আসে আরো কিছু কাজের ফিরিস্তি, আসতেই থাকে। যতক্ষণ না আমি নাকে কাঁদতে শুরু করি। ‘আমি বাড়ি যাব। যাবোই-’।


আজ বর্ষশেষ। ফেসবুকের পাতা ভরে ওঠে সুসজ্জিত উৎসব মুখর নরনারী আর রঙবেরঙের তরল পানীয়র ছবিতে। কম্বল মুড়ি দিয়ে নেটফ্লিক্সে ডুবে যাই আমি। আপাততঃ কিছুদিন আর বই পড়ছি না। মাইকেল প্রঙ্কোর দা লাস্ট ট্রেন শেষ করে পুরো ঘেঁটে গেছে মাথা। কেন যে বইটার এত নাম, কারা যে এইসব বইগুলোকে এত পুরষ্কার দেয় ভগবান জানে। ব্যোমকেশ-ফেলুদা-শবর-কাকাবাবু ছাড়ুন আমাদের কিরিটি রায়ও এর থেকে অনেক ভালো। অন্তত পড়ে বোঝা যায় কে, কি এবং কেন। জাপানীদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা।  

 

তুত্তুরীকে বগলদাবা করে ইন্ডিয়ানা জোনস্ দেখতে বসে শৌভিক। হেড ফোন ভেদ করে ভেসে আসে বাপবেটির উত্তেজিত কথাবার্তা। কোনটা যে বেশি বিমোহিত বুঝতে পারি না। একবাটি গরম চিলি-পটেটো বলস্ ভেজে নিয়ে দুজনের মধ্যে ঢুকে বসি আমি।  একসাথে তিনজনে ঘুরে বেড়াই পেট্রা নগরীর পথে পথে। মা-মেয়েতে একসাথে প্রেমে পড়ি তরুণ হ্যারিসন ফোর্ডের। শৌভিকের সাথে ঝগড়া করি কে বেশী মহোময় শন কনোরি নাকি হ্যারিসন ফোর্ড। এই ভাবেই কাটুক না আগামী বছর, আগামী প্রতিটা বছর। বছর আসুক, বছর যাক, সম্পর্ক গুলো অমলিন থাকুক সবার। বাকিটা ঠিক ম্যানেজ হয়েই যাবে।

অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১

#তাম্রলিপ্তকড়চা


বাড়িটা মম করছে টাটকা ফুলের সৌরভে। বিগত দুদিন ধরে যেখানেই গেছি, সে ময়না হোক বা নন্দকুমার,চণ্ডীপুর হোক বা শহীদ মাতঙ্গিনী- তাজা ফুলের স্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে এজেন্ট আর এসএলওরা। যত বলি, এতো প্রথম আলাপ নয়, এর আগেও মিলিত হয়েছি আমরা, আমার চেম্বারে। তারপর একপ্রস্থ ট্রেনিং হয়েছে পোর্টালের নতুন মডিউল নিয়ে, তাহলে আবার কেন? আর আমি তো অতিথি না, আমি তো তোমাদেরই লোক। ঠিক যেমন, তোমরা আমার লোক। 


শুরু করেছিল ময়না। ময়না আমার সবথেকে অবহেলিত ব্লক। একে তো তমলুক শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূর, প্রায় পশ্চিম মেদিনীপুর লাগোয়া, তারওপর দীর্ঘদিন যাবৎ নেই কোন পাকাপাকি ইন্সপেক্টর, নেই কোন কন্ট্রাকচুয়াল ক্লার্কও। এতদিন অতিরিক্ত দায়িত্বভার সামলাতেন যে ইন্সপেক্টর, সাম্প্রতিক অর্ডারে বদলি হয়ে যাবেন তিনিও। আবার নতুন কারোর ঘাড়ে চাপবে ময়না। 


সদ্য বদলি হয়ে এসেছি নতুন জেলায়, এর মধ্যেই বদলি হয়ে যাচ্ছেন চার জন ইন্সপেক্টর সাহেব। ওদিকে ৪৮ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যাবে দুয়ারে সরকার। চাপা উৎকন্ঠায় ভুগছিলাম, তাই ভাবলাম যাই একবার সামনা-সামনি দেখেই আসি, কতটা প্রস্তুত সবাই। ভেবেছিলাম ময়নার লোকজন হয়তো ক্ষেপে থাকবে, গেলেই উজাড় করে দেবে নালিশের ঝাঁপি। বদলে পেলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা। টুকরো নালিশ যে ছিটকে আসেনি তা নয়, ওটুকু ও না হলে সন্দেহ হত, ব্যাটারা কাজের কিস্যু জানে কি না। গিয়েছিলাম এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে, ফিরলাম আশ্বস্ত হয়ে। 


এবার নন্দকুমারের পালা। এদের একটু বকলাম অবশ্য, এতদূর এসেছি, ময়না থেকে আবার তমলুক ফিরে উল্টোদিকে যেতে হয় নন্দকুমার। একটু না বকাবকি করলে কেমন যেন গা ম্যাজম্যাজ করে। বদলে নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রণজিৎ একবাটি ছানার পায়েস খাওয়াল। ‘খান না ম্যাডাম, এখেনে এটা খুব ভালো বানায়। আমরা প্রায়ই খাই, ইয়ে খেলে মাথা ঠাণ্ডা হবে।’ বলি রসমালাইকে ছানার পায়েস বলে খাওয়ালে পৃথিবীর কারো মাথা ঠান্ডা হয়? যত বলি, এটা ছানার পায়েস না, এটা রস মালাই। এই তো পুঁচকে পুঁচকে একপাল রসগোল্লার বাচ্ছা সাঁতার কাটছে ঘন দুধে। বললে শুনছেই বা কে আর মানছেই বা কে? রঞ্জিত সমানে লড়ে গেল, ' না ম্যাডাম, এটা ছানার পায়েসই। রসমালাই তো ওই গুলো, লম্বা লম্বা রসগোল্লা, ঘন দুধে ভেসে থাকে-।' আপদ ওই বস্তুটাকে যে ক্ষীর চমচম বা মালাই চমচম বলে, সেটা তখন আর মাথায় আসেনি। নাহলে ছাড়তামই না ব্যাটাকে।


নন্দকুমারের পর চণ্ডীপুরের পালা। দীঘা যাবার রাস্তা ধরে, হলদি নদী টপকে খানিক গেলেই চণ্ডীপুর ব্লক। হলদি নদীর পাড়ে, বিশাল গঙ্গা মন্দির। মকর সংক্রান্তিতে নাকি মস্ত মেলা বসে এখানে। আসন্ন মেলার প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে, রাস্তার ওপর বাঁধা চলছে সুদৃশ্য তোরণ। পথে পড়ে ছোট্ট রেলস্টেশন, নাম ‘লবণ সত্যাগ্রহ’। এই জেলায় যদি এমন স্টেশন না থাকবে তাহলে থাকে কোথায়। 


বদলী হয়ে যখন এই জেলায় আসি,কে না সতর্ক করেনি। ‘খুব সাবধান। পূর্ব মেদিনীপুর কিন্তু হুগলী নয়। চুঁচুড়ার বদান্যতা, আনুগত্য এই জেলায় আশাও করো না।’ নাঃ আমি আশা করিনি। কেন করব? এই জেলাটা তো হুগলী নয়। এখানকার মানুষজনই বা কেন হুগলীর মানুষের মত হবে। 


গাঙ্গেয় বঙ্গের অধিবাসীরা যতই তাচ্ছিল্য করুক, কিচ্ছু যায় আসে না এই জেলার। এই জেলার চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা বলেই হয়তো অনেক বেশি লড়াকু এখানকার মানুষজন। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জেলা যার সীমান্ত বরাবর খোলাখুলি আড়ামোড়া ভাঙে স্বয়ং বঙ্গোপসাগর। জেলা জুড়ে জড়িয়ে আছে কত যে রাজবাড়ি আর তাদের অজানা ইতিহাস। বিশ্বাস হচ্ছে না তো?  তমলুক,মহিষাদল, কাজলাগড়, পাঁচেতগড়, ময়না।  পাঁচটা রাজবাড়ির হাল হকিকৎ তো এখুনি কড় গুনে বলে দিতে পারি। আর স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা যদি বলেন, তো এই জেলার ধারে কাছে বর্তমান এপার বঙ্গের কোন জেলা আসবে মশাই? ' ভারত ছাড়' আন্দোলনের সময় আক্ষরিক অর্থে মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল এই জেলা। এই তো গত ১৭ই ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের ৭৯তম জয়ন্তী পালিত হল।


চণ্ডীপুরের পর শহীদ মাতঙ্গিনীর পালা। এখানকারই মেয়েছিলেন কিনা তিনি। ব্লক চত্বরে রয়েছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি। বছর শেষের পড়ন্ত রোদে, তাঁর মূর্তির সামনে ক্ষণিক দাঁড়ালাম আমরা, কাকতলীয় ভাবে এই ব্লকের এজেন্ট এসএলও দের মধ্যে মহিলারাই সংখ্যা গরিষ্ঠ, মেয়েদের মধ্যেও আবার অল্প বয়সীদের থেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সংখ্যা বেশ বেশি। বলে দিতে হয় না, এটা গান্ধীবুড়ির মহল্লা। দিদিদের মধ্যে অনেকেই কাজে ঢুকেছেন এই সহস্রাব্দের শুরুতে। তারপর কত কি ঘটে গেছে, বদলে গেছে স্কিম, উঠে গেছে মোটকা সাবেকি লেজার খাতা, এসেছে- গেছে একাধিক সাইট, বদলাননি শুধু এখানকার দিদিরা। জনৈক দিদি গল্প শোনাচ্ছিলেন এ বছরের মত বন্যা দীর্ঘদিন দেখেনি গান্ধীবুড়ির ব্লক। খোদ ব্লক অফিসটাই দীর্ঘদিন ছিল আধ ডোবা হয়ে। তারই মধ্যে কাজে আসতেন তাঁরা। এক হাঁটু জল ঠেলে। খুব সাদামাটা ভাবে বললেন, 'হাঁটুর ওপর জল ম্যাডাম। ল্যাট্রিন অবধি জলের তলায়। ওই জল ঠেলে এলি কি পা চুলকাইত।' পাশ থেকে ইনস্পেক্টর সাহেব বললেন, 'পচা জল তো ম্যাডাম। বিডিও অফিস থেকে কিছু গামবুট দেওয়া হয়েছিল , তবে সে তো আর -'। বুঝলাম, উনি পাননি। পাবার কথাও নয়। তাজ্জব আমি প্রশ্ন করলাম, ' শাড়ি পরেই আসতেন? মানে ভিজে শাড়ি লটপট করতে করতে?' ওনারা হেসে মুখে চাপা দিলেন, ' হায় ম্যাডাম কি যে বলেন, শাড়ি পরবুনি?'