Wednesday 31 July 2019

অনির ডাইরি ৩০শে জুলাই, ২০১৯

প্রতিটা দিন, শুরু হয়, ঠিক একই রকম ভাবে। সেই ঘুম জড়ানো ভারি চোখ, মনের মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছা, আজ বেশ রবিবার। আর তারপর? ট্রেনে বিক্রি হওয়া মুচমুচে কচুভাজার মত ঝাল-নুন ছিটোতে থাকে জীবন।
সকাল ১১টা- “ম্যাডাম, কাল তারা এসেছিল। ঠিক আপনার অসাক্ষাতে। পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে, কি চিৎকার। বলেছে, এবার বেনিফিশিয়ারিদের এনে, আপনার চেম্বারে বসিয়ে বিক্ষোভ দেখাবে?”

“মানে? আমার ঘরে লোক ঢোকাবে? কে ভাই, সেই মহাপুরুষ? ঘরে লোক ঢোকাতে চাওয়াটা দেখছি গাঙ্গেয় হুগলীর মুদ্রাদোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
সকাল ১১টা ১৫-  প্রবল ইচ্ছে করছিল বরকে ফোন করে নালিশ করতে,কিন্তু সক্কাল সক্কাল কাউকে ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসাতে চাই না। তাই তীব্র ইচ্ছে দমন করে, তাঁকে ফোন লাগালাম, যাঁর ভয়ে আমার তিন তিনটে ইন্সপেক্টরের মুখ কালো হয়ে আছে। ব্যাটারা আবার বলছিল,আমায় নাকি ট্রেনিং করে রোগা এবং কালো লাগছে। ফোনটা বেজে গেল, যাই হোক।

১১টা ৩০- “ম্যাডাম, আঠারোটা ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় হারিয়ে গেছে।”
- মানে? কোথায় গেছে? বেড়াতে? ১৮জন একসঙ্গে বেড়াতে গেল? খুঁজেছো? “ম্যাডাম শুভজিৎ ধীমানকে দিয়েছিল।” “না ম্যাডাম আমায় দেয়নি। আমায় দিলে আমি কোনদিন হারাই? আমি সব গুছিয়ে রেখেদি কি না বলুন?  নির্ঘাত রমেশকে দিয়েছিল।” “বাঃ তা শুভজিৎ, রমেশ  এণারা সব কোথায়?” “শুভজিৎ পুজো করছে।” মানে? “ছুটি নিল যে, হোয়াটস্অ্যাপে।” বাঃ। তা ফাইলগুলো দিয়ে কি ধুনো দিচ্ছে?” “ম্যাডাম আমি কতবার বলেছি, আমায় দিতে, আমি সব গুছিয়ে রাখি।” ঝগড়া থামাবে তোমরা? আমি বলে সদ্য শিখে এলাম-নো ব্লেম গেম- নো স্কেপগোট। কোথায় কোথায় খুঁজেছো? চল আমার সামনে খুঁজবে চলো।

১২টা- “হ্যালো ম্যাডাম,আপনি ফোন করেছিলেন, সরি আমি ধরতে পারিনি, একটু ইয়ে করছিলুম। ”
“বেশ করছিলেন। আরে আয়াম সরি, আপনি আমার অসাক্ষাতে আমার অফিসে ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন, আমি থাকতে পারলুম না। আপনি একাই আমার তিন তিনজন ইন্সপেক্টরকে আমার অসাক্ষাতে চমকে গেলেন, হ্যাঁ গো,তা আপনারা নোটিশ দিয়েছিলেন? কই দেখিনি তো? মারের আগে ধাক্কা তো দেবেন?”
- “কি যে বলেন ম্যাডাম। আপনাদের সঙ্গে আমার কত ভালো সম্পর্ক। আপনারা কত হেল্প করেন।” “তাই বলে ওসব ছেলেপিলে ঢোকানোর গল্প করে যাবেন? আমি না হয়, মজা পেয়েছি,তবে,আমি আর কদ্দিন বলুন তো। এবার ট্রেনিং এ পাঠাক, আমি আর ফিরব না। ”
“হেঃ হেঃম্যাডাম আপনাকে যেতে দিলে তো।রাগ করছেন কেন? ও তো কথার কথা।  ওসব একটু বলতে টলতে হয়। বুঝলেন কি না। আপনি ট্রেনিং এ ছিলেন, তাই দেখা হল না। আপনি মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন, এবার গেলে নিয়ে যাব। রাগটাগ করবেন না। ”
১২টা৩০- “সঞ্চিতা,চিন্তা নেই,অমুক বাবু মিষ্টি নিয়ে  আসছেন। ছেলেপিলে আনছেন না। এই, তুমি পাহাড়ে চড়ে কি করছ?” “ফাইল খুঁজছি ম্যাডাম। আপনি বললেন তো। ” তাই বলে ধুলোর পাহাড়ে কে চাপতে বলল। শেষে বস্তা চাপা পড়ে মরবে নাকি?” “না ম্যাডাম, এই দেখুন ছটা ফাইল পেয়েছি। বাঃ গুড গার্ল। ধীমান-কৌশিক কিছু শেখো মাইরি তোমরা। সঞ্চিতা আমার একাই দশ শ।” “ম্যাডাম, দাঁড়ান। কাল আমি ময়দানে নামব। সব বস্তামস্তা বিদেয় করে ছাড়ব। ধুলোর আখড়া যত। ”
১। ৩০- রমেশ তোমাকে যে ফাইলটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটা রেডি হয়েছে? “ শুনুন না ম্যাডাম, আমি সব গুছিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামকে দেখিয়ে ফাইলটা রাখলাম, আর খুঁজে পাচ্ছি না। ” বাঃ। উনিশ নম্বর। সাত দিন। মাত্র সাতদিনের জন্য ট্রেনিংএ গেছিলামরে বাপ, তোমরা তার মধ্যে আর কি কি হারিয়েছো? একটা লিস্ট করে দাও হ্যাঁ। বার বার আমি জানতে চাইব, তোমরা এক এক করে শোনাবে,~ কাঁহাতক সহ্য হয় বাপ?

২। ৩০- “হ্যালো ম্যাডাম, চিঠি পেয়েছেন?  “আবার? আর কত চিঠি লিখবেন অমুক বাবু? আমি চাপা পড়ে যাব যে।ডিসপিউট চলছে তো। একটু ভরসা রাখুন না। উল্টো পার্টিকেও একটু ভাবতে দিন। এভাবে পত্রাঘাত করলে খেপে যাবে না? ” “না ম্যাডাম। চিঠি আমারই। তবে আইনটা আলাদা।” “ওরে বাবা, আবার নতুন আইন পড়াবেন?”

৩। ৩০-“হ্যালো সুকন্যা। এই আইনে কাজ করেছো?” “হ্যাঁ। ” বাঃ। সাধে কি তোমায় ফোন করি। শালা সবজান্তা মাইরি। এবার বলো দেখি সোনামণি কি করতে হবে। ” “পড়ে দেখ। ” ছিঃ এমন করে দর বাড়াতে আছে? পড়েছি তো। বুঝতে পারলে আর তোমার কি প্রয়োজন। বলো না বাপ-।”

৪টে- “হ্যালো অমুক বাবু, শুনুন। আপনার এই পাঁচ গণ্ডা চিঠির ওপর আরো গুটি ছয়েক অ্যাপ্লিকেশন লাগবে। ফর্মটা এসে নিয়ে যাবেন।” “ আরো ছয় কপি? আমায় যে অমুক বলল-”। “ধুর বাবা। আপনাকে কে বলেছে জানি না, আমায় খোদ আইনের বই বলেছে। জ্যান্ত সরস্বতী বাবা। ভুল বলে না। এবার দয়া করে,আপনি আসুন। আর একদম চিঠি লিখবেন না। ”

৫টা৩০-“দিদি, কাল আসব।” “আচ্ছা। কেন বলো তো?” “সেই যে সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টের কেসটা-”।  “অ্যাঁ? কোন কেস? কে কাকে হ্যারাজ করল। ধুর বাবা, মনে পড়ছে না কেন?” “না। না। দিদি, হ্যারাজমেন্ট অ্যাট ওয়ার্ক প্লেস অ্যাক্টটা নিয়ে বলতে বলেছিলাম না, রেকর্ড করে নেব। ” ওঃ। বাঁচলাম।

এইভাবেই অর্ধেকটা দিন কেটে গেল, এবার বোধহয় বাড়ি যাবার পালা। সেখানে আবার অঘটনঘটনপটিয়স তথা তাঁর কন্যা, কি পাকিয়ে রেখেছেন কে জানে? তবে সে তো অন্য গল্প। আপাততঃ অনেক হয়েছে বাপ। বাড়ি যাই।

Thursday 25 July 2019

অনির ডাইরি ২৪/০৭/১৮


দৃশ্য-১
"ম্যাডাম!" "বলুন?"
“ট্রেড ইউনিয়নের কি জেনারেল ম্যানেজার হয় ম্যাডাম?”
“কেন বলুন তো?কি হল আবার?এটা জানতে ফোন করেছেন সক্কাল সক্কাল?”
“আপনার পাঠানো চিঠির খামে ঠিকানা লেখা, প্রতি, জেনারেল ম্যানেজার, অমুক ট্রেড ইউনিয়ন-”
সর্বনাশ। কে লিখেছে? সোমনাথ? প্রীতি? রণিত? মান সম্মান আর রাখলে না দেখছি, জুট মিলেরটা জেনারেল ম্যানেজার আর ট্রেড ইউনিয়নেরটা জেনারেল সেক্রেটারি, তেলে আর জলে মিশিয়ে দিয়ে বসে আছো? আমার চিঠি দেখে টুকতে গিয়েও ভুল? কাজের সময় মন কোথায় থাকে?
দৃশ্য-২
“ম্যাডাম, আমি এত কম টাকা কেন পেলাম?”
“উ?”
“আমি জানতে চাই, আমায় এত কম টাকার অর্ডার করলেন কেন?”
“আরে বাবা, আপনি যা কাগজপত্র দিয়েছেন, তার ওপরেই তো ক্যালকুলেট করব? ফাইন্ডিংস্ টা পড়ে দেখুন, তাতে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মত সব বলে দেওয়া আছে, কিভাবে আমি নির্ধারণ করলাম, আপনি কত টাকা পেতে পারেন।“
“আপনি তো শুধু ম্যানেজমেন্টের আর্গুমেন্ট শুনলেন, গরিবকে তো সুযোগই দিলেন না। উনি আমাকে জেরা করলেন, অথচ আমি ওনাকে করতে পারলাম না।“
“আপনার উকিল করল তো? আপনার সামনে প্রশ্নোত্তর চলল, আপনি সই করলেন?”
“সে তো আমার উকিল করল। উনি তো আর আমার কথা জানেন না?” 
“উফ ভগবান!”
দৃশ্য-৩
“ম্যাডাম আসব?”
“বলুন এবার আপনার কি চাই?”
“ম্যাডাম আপনার লোক তো কই জানালো না? কটা মাল চাই। কিনে ছাপাতে হবে তো, আমার লোক মাল আনতে কলকাতায় গিয়ে বসে আছে।“
“কি যন্ত্রণা। রমেশ? শ্যামা বাবুকে জানাও নি? একটা কাজ কি কেউ সম্পূর্ণ কর না? সব আমার মাথায় চাপাতে হবে?”
“আচ্ছা। ম্যাডাম। সরি ম্যাডাম। আপনি রেগে যাবেন না ম্যাডাম এখুনি জানাচ্ছি।”
“সেটা ছাড়ো। এখনও জানানো হয়নি কেন? জবাব দাও?”
“কি করব ম্যাডাম, প্রমিত বাবু বললেন, ‘মেলে আছে দেখে নে।‘”
“বাঃ। কি আনন্দ। আমিই দেখি তাহলে? যত সব-”
দৃশ্য-৪
“ম্যাডাম, আপনার চা নিয়ে আসি?”
“হু।“
“সাদা না কালো?”
“যা খুশি। প্রচন্ড মাথা ধরেছে, একটু কড়া হয় যেন। আর পুঁচকে কাপে নয়।”
“বুঝতে পেরেছি। আমার খাবার গ্লাসটা মেজে আপনাকে দিচ্ছি দাঁড়ান।“
“আরে ধুর বাবা। অতো চা কি করব? স্নান?”
দৃশ্য-৫
“আসছি?ম্যাডাম।”
“বলুন?এই আপনারা এই সেদিনই ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন না?”
“ হ্যাঁ। সেগুলো সব পেয়ে গেছি ম্যাডাম। আজ আরো কয়েকটা কেস দিলাম, একটু বলে দেবেন যেন ছেড়ে দেয়।“
“সে তো এমনি দেবে। সব কাগজ পত্র ঠিক থাকলে আর কি চাপ?”
“তবু ম্যাডাম, আপনি জানেন না কি করুণ অবস্থা ওদের, রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে গরম পিচের ড্রাম উল্টে পড়েছিল, ছেলেটি গায়ে।বেঘোরে মারা গেছে। “
“ইশ।”
“আরো শুনবেন ম্যাডাম? ছয় বছরের বাচ্ছা মেয়ের মাথায় টিউমার, বাবা-মায়ের কি মানসিক অবস্থা ভাবুন। সর্বস্বান্ত  হতে বসেছে ম্যাডাম।লোকটি রিক্সা চালায়। বউটি সেলাই দিদিমণি। কোথায় পাবে? সাড়ে চার লাখ টাকা খরচা হয়ে গেছে, আবার ভেলোর যাবে-”।
দৃশ্য-৬
-ম্যাডাম, লাইফ সার্টিফিকেট সই করাব, এখন আসব? না কি টিফিন হয়ে গেলে?
-টিফিন তো আসেই নি। আপনিই আসুন। কি করতেন?
- বাস চালাতাম।
-এখন চালান না?
-উ হু।
-কেন? চোখ?
- চোখ নয় ম্যাডাম, আমি ৩৫ বছর অমুক রুটে বাস চালিয়েছি, কিন্তু তখন এতো ছোট গাড়ি ছিল না ম্যাডাম, আর ছেলেপুলেও এতো বিপজ্জনক ভাবে বাইক চালাতনি।
-হু। তা আপনি ৩৫ বছর বাস চালিয়েছেন, কটা লোককে টপকেছেন?
- হেঁহেঁ, না ম্যাডাম, মানুষ না, তবে বার কয়েক গরু-
দৃশ্য-৭
-“ম্যাডাম, টাকা ঢুকে গেছে, অসংখ্য ধন্যবাদ।“
“অ্যাঁ? টাকা? কিসের টাকা?”
“দুলাখ টাকা? অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ।“
- “আরেঃ বাঃ। খুব ভালো? তা বেনিফিশিয়ারি কোথায়? তার তো একটা ছবি তুলে রাখতে হবে, নোটিশ বোর্ডে।“
- “সে তো স্বর্গে চলে গেছে ম্যাডাম। তার বউ চলবে?
দৃশ্য-৮
- ম্যাডাম আসছি?
- কি চাই?
- ম্যাডাম চিনতে পারছেন? সেই যে দেখা হয়েছিল? অমুক দপ্তর-
- অ। বলুন কি চাই?
- ম্যাডাম, শুনুন না, আগের বার আপনি অনেক হেল্প করেছিলেন, এবারো একটু করে দিন না। বেচারা বুড়ো মানুষ, কটা টাকার জন্য দরজায় দরজায় ঘুরছেন।
- কিসের টাকা?
- পি এফ।
- এই ভাগো। পি এফ আমার অফিসের দায়িত্ব নয়।
- জানি ম্যাডাম। আপনি তো আগের বার বলে দিলেন পিএফ কমিশনারের অফিসে যেতে। আমরা গিয়েছিলাম, ওনারা একটা ফর্ম দিয়েছেন, ইনি বুঝতে পারছেন না, কি করে ফিল আপ করে। একটু বলে দিন না-।”
দৃশ্য-৯
- আবার আপনারা? না। না। আমি আর কোন মানুষের দুঃখ দুর্দশার গপ্প শুনব না। প্রচুর কাজ।
- শোনেন না ম্যাডাম, একটা প্রতিকার তো চাই, একজনের বই হারিয়ে গেছে।
- ইন্সপেক্টরকে বলুন ও ডুপ্লিকেট বার করে দেবে। এই জন্য আমায় জ্বালানোর কি কোন দরকার আছে?
- জানি ম্যাডাম। আমি কি আর আজ থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করছি? আপনি হয়তো তখনও জন্মাননি, তখন থেকে এই গরীব মানুষ গুলোর জন্য খাটছি। ডুপ্লিকেট বার করতে হলে তো বইটার নম্বর চাই।
- -ও। তাও নেই? ভালো। টাকা দেবার রসিদ? তাও নেই? অসাধারণ।যে বলবে কাক এ কান নিয়ে গেছে, অমনি আপনি এসে আমায় জ্বালাবেন?
- কি করব ম্যাডাম, এসব নিয়েই আছি। জানেন তো আদিতে আমরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসী, বাবা সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে ১৯৪২এ এদেশে চলে এসে ডানলপে চাকরী নেন, তাই আমাদের ভাইবোনেরা আজ সবাই মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি, মাঝে মাঝে ভাবি, জানেন, যদি বাবা, বাড়ি জমি আঁকড়ে পড়ে থাকত, কি হত? ৭২এ পালিয়ে আসতে হত এক কাপড়ে। তখন আমার মা হয়তো লোকের বাড়ি বাসন মাজত আর বাবাকে ভ্যান রিক্সা চালাতে হত-
এতরকম মানুষ আর এত ধরণের আবেগ অনুভূতিস্নাত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ভুলেই যাই, আজ ভোরে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে কাঁচা ঘুম চটকে যাবার হতাশায় মনে হয়েছিল কি সাংঘাতিক বর্ণহীন আমার।কাজের সাথে ভালোলাগা আর ভালোবাসার নিবিড় সম্পর্কের ফলে আপাতত পূর্ণ এ ঝুলি।  আপাততঃ বড় বেশী রঙীন এ জীবন।  কাল সকাল অবশ্য আবার অন্য বার্তা বহন করে আনবে- এই তো জীবন কালি দা।

Saturday 20 July 2019

অনির ডাইরি ১৯শে জুলাই, ২০১৯

অনির ডাইরি ১৯শে জুলাই, ২০১৯
মুণ্ডুখোলার নাম শুনেছেন? কি ভাবছেন কোন জায়গার নাম? আজ্ঞে না মশাই, মুণ্ডুখোলা হল একটি  ব্যাঙ্কের নাম। ব্রাঞ্চ নয় কিন্তু। নামটাই মুণ্ডুখোলা ব্যাঙ্ক। তো কথা হচ্ছে আহাম্মদপুর , জিরাট নিবাসী বারীণ বাবুর কি যে মতিগতি হয়েছিল, উনি অ্যাকাউন্ট খোলার আর কোন ব্যাঙ্ক খুঁজে না পেয়ে, অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এই মুণ্ডুখোলা ব্যাঙ্ক। নিজের,স্ত্রীর তথা তৎকালীন অবিবাহিতা কন্যারও অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এই ব্যাঙ্কে। কি মুণ্ডুখোলা প্রীতি মাইরি বারীণ বাবু আপনার।
উনি প্রাইভেটে সিকিউরিটির কাজ করতেন, স্ত্রী বাড়িতে বসে ব্লাউজ শায়া বানাত। সময়মত দিলেন মেয়ের বিয়ে দিয়ে। তারপর ঐ আর কি, “বুড়োবুড়ি দুজনাতে মনের সুখে থাকত, বুড়ি বসে তামাক সাজত, বুড়ো বসে কাশত। ” বারীণ বাবুর পেনশন,পি এফ আমাদের তৎকালীন সাসফাউ কিছুই ছিল না। তবে ওণার বউয়ের একখানি বই ছিল বটে।
এহেন শ্রীমতী জ্যোৎস্না পাল হঠাৎ করো আক্রান্ত হলেন কর্কট রোগে। ঘটি বাটি বেচে চিকিৎসা তো হল,শুধু প্রাণটাই যা  বাঁচল না। বেচারা বারীণবাবুর নুন আনতে পান্তা ফোরায়। সেই সময় গ্রামের কালেক্টিং এজেন্ট দিদি বললেন,“ তোমার বউয়ের একখানি বই ছেল না? জমা টাকা তো পাবেই, আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে তো গো। ”
মুস্কিল হচ্ছে জ্যোৎস্নাদেবী নমিনি করে গেছেন তাঁর কন্যাকে। মেয়ে থাকে কলকাতায়।তার এত ঘোরার সময় বা প্রয়োজন কি? প্রয়োজন তো বারীণ বাবুর। মেয়েকে দিয়ে সই করিয়ে, উনি জমা করলেন সেই ক্লেম। সময় ২০১৬। তখনও আমাদের চুঁচুড়ায় আসতে বেশ কয়েকমাস দেরী। ২০১৭সালে সামাজিক সুরক্ষা যোজনা চালু হল। তার আগের সব ক্লেম আমরা অনুমতি সাপেক্ষে ঝেঁটিয়ে সাফ করলাম।
২০১৯এর গোড়ায় এসে হাজির বারীণ বাবু। আমি তো ট্যাকা পাইনি কো। বয়স্ক মানুষ কি যে বলেন বোঝাই যায় না। ভয় পেয়ে যান, নার্ভাস হয়ে যান। সর্বোপরি ওণার ব্যাঙ্ক- মুণ্ডুখোলা। ব্যাপারটা কেউই বুঝে বা বুঝিয়ে উঠতে পারি না। ইতিমধ্যে বদলে গেছে আমাদের অফিসের ঠিকানা। হয়ে গেছে অডিট। বদলে গেছে বলাগড়ের ইন্সপেক্টর। দু আড়াই বছর আগের কাগজ খোঁজা দুঃসাধ্য। সেই দুঃসাধ্যসাধন করেছে এই তিন মক্কেল। বাঁ দিক থেকে ধনিয়াখালির সিকেসিও সোমনাথ হাঁসদা, বলাগড়ের ইন্সপেক্টর দর্পনারায়ণ সাহা ওরফে আমাদের আদরের দর্প আর একদম ডানদিকে শ্রী কৌশিক মুখার্জী, আমার আরএলও ইন্সপেক্টর। পুরাণো কাগজ খুঁজে বার করে, ব্যাঙ্ককে চমকে টাকা ফেরৎ আনিয়ে। জবরদস্তি বারীণ বাবুর কন্যাকে দিয়ে সরকারী ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে তারপর সেই টাকা পাঠানো হয়েছে মেয়ের অ্যাকাউন্টে। টাকা পেয়ে বারীণ বাবু এসেছিলেন কৃতজ্ঞতা জানাতে। আজও অন্যদিনের মতই হাঁউমাউ করছিলেন, তবে গলায় বাজছিল খুশির সুর। বারীণ বাবু কতটা বুঝেছেন জানি না, তবে আমি জানি বারীণ বাবুর গল্পের নায়ক এই তিনজন। হয়তো সবটুকুই কাজের অঙ্গ,তবু যে অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে, দরদ দিয়ে এরা কাজটা করেছে, তার সাক্ষী স্বয়ং আমি । যে কোন ভালো কাজের লাইমলাইট সব সময় ওপর তলাই শুষে নেয়,আর যারা খেটেখুটে কাজটা করে তারা মিশে যায় জনস্রোতে।  বেতন হয়তো বাড়াতে পারব না, পদোন্নতি  বা চাকরির স্থায়ীকরণ ও করতে পারব না, কিন্তু দলপতি হিসেবে মাথার টুপিটাতো খুলতে পারি-। তাই বললাম, আয় বাপ তোদের একটা ছবি তুলেদি।

Thursday 18 July 2019

অনির ডাইরি ১৮ই জুলাই,২০১৯



কি সব দিন ছিল, সোনায় মোড়া। স্বয়ং মা লক্ষ্মী বাস করতেন এই গাঁয়, তাই বোধহয় গাঁয়ের নাম শ্রীপুর। শ্রীপুর হল নৌশিল্পীদের গ্রাম। প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি   হত নৌকা,দেড় হাজার শ্রমিকের পেটে ভাত যোগাত এই নৌকা। পাতি বাবলা কাঠও এখানকার শ্রমিকদের হাতের ছোঁয়ায় পরিণত হত লজ্জাবতী অনাঘ্রাত পৃথুলা সুন্দরী নৌকায়। তারপর ভাসত তরী গাঙের জলে। ভরা শ্রাবণে উছলে উঠত নদী, ছাপিয়ে দুকূল, লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে গ্রাস করতে চাইত চরাচর, তখন সেই রাক্ষুসী নদীর হাত থেকে আবালবৃদ্ধবনিতাকে উদ্ধার করতে নামত শ্রীপুরের নৌকা। দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ত শ্রীপুরের নাম। আসেপাশের গাঁ ছাড়ুন সেই সুদূর পুরুলিয়া থেকেও আসত বায়না। তারপর কি যে হল, কার যে নজর লাগল। ক্রমশঃ কমতে লাগল বিক্রি। ইতিউতি গড়ে উঠতে লাগল সেতু।  একটা কৃশকায় সেতু গড়ে ওঠার অর্থ  হল, এপাড়-ওপাড় মিলিয়ে অন্তত সাতটা ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর বাস বা গাড়ি চললে তো কথাই নেই, ভাবতেও শিউরে ওঠে শ্রীপুরবাসী। তারওপর আছে ডিজেল চালিত স্টিমারের আক্রমণ। গড়ে ঘন্টায় চল্লিশ থেকে আটচল্লিশ কিলোমিটার বেগে দৌড়ানো পক্ষীরাজে সাথে পাল্লা দেবে গদাইলস্করি চালে দুলতে থাকা নৌকো? দুয়ো! দুয়ো!
সোনার দিনগুলো  কবে যে হারিয়ে গেল। নুন আনতে পান্তা ফুরানো শিল্পর সাধ্য কি এত লোকের পেটে ভাত জোগায়? শ্রীপুরবাসীর দ্বিতীয় উপার্জন বলতে ছিল টালিখোলায় কাজ। কিন্তু সেখানেও যেন শনি লেগেছে, টালি আজকাল কেনে কয় জনা? দুবার হনুমান লাফালেই তো টালির দফা গয়া। বন্ধ না হলেও খুউব কমে গেল টালি উৎপাদনের হার। বন্ধই পড়ে আছে বেশীর ভাগ চুল্লি। কোথাও আবার শুধুই ইঁট তৈরি হয় আজকাল। এই শ্রীপুরেই গিয়েছিলাম কাজের স্বার্থে। কাজ বলতে সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নাম নথিভুক্তকরণ।  শ্রীপুর গ্রামটা চুঁচুড়া থেকে বেশ অনেকটাই দূর, প্রায় কালনার সীমানা ঘেঁষে।হাওড়া থেকে কাটোয়া লাইন যদি ধরেন, চুঁচুড়া-ব্যাণ্ডেলের পর অনেকগুলো ছোট ছোট স্টেশন পড়বে, স্টেশনের নামগুলো বেশ মিষ্টি- মগরা, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, কুন্তিঘাট,জিরাট, বলাগড়। এই বলাগড় স্টেশন থেকে ফাঁকা পাটক্ষেত আর টলটলে পুকুরের বুক চিরে বেশ কিছুটা গেলে শ্রীপুর বলাগড় কল্যাণসমিতি প্রাথমিক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতেই জমায়েত হবার কথা এই নৌশিল্পীদের,অর্থাৎ যাঁরা এখনও এই পেশায় পড়ে আছেন।প্রায় শ খানেক লোক ধরে এই লাইব্রেরিতে, গিয়ে দেখা গেল মেরে কেটে জনা কুড়ি। তাও অধিকাংশই মহিলা, যাঁরা কেউ বাড়িতে বসে লেলাইফোঁড়াইয়ের কাজ করেন, কেউ বা আয়ার কাজ করেন। জনা কয়েক মাটির ঠাকুর গড়েন,স্যাকরার দোকানে কাজ করেন।  কিন্তু নৌশিল্পীরা কই? যাদের জন্য এভাবে দৌড়ে আসা? এত অনীহা কিসের ভাই?
স্যার বললেন, “চল কয়েকটা কারখানা থেকে ঘুরে আসি। এণারা বসুন।” এমন নয়,যে এণাদের আমরা চাই না, কিন্তু যাদের এত করে ডাকাডাকি, তারা কেন আসে না।
কারখানা বলতে বাঁশঝাড়, বা বটতলা। বা কোন খোলা মাঠ। বেলা দুটো বাজছে, জনা কয়েক খেতে গেছে, বাকিরা রীতিমত নিরাসক্ত। কি হবে, বাবু/দিবিমণি এসব করে? গরীব মানুষের কে আছে? এই যে কুতুবের বাপ, বয়স হয়েছে, ভালো খাটতে পারে না, ওর তোমরা কি উপকারে আসবে? সরকার তো আমাদের দেখে না। আমরাই বা কেন শুনব?
অনেক বোঝালেন স্যার। মোটরগাড়ি আর গরুরগাড়ির গল্প শোনালেন।  শুনলেনও ওঁদের কথা। ছবিটবিও তোলা হল কিছু। আমাদের সুশান্ত দিব্যি একটা নৌকার ওপর উঠে সেল্ফি তুলে নিল এন্তার। এবার ক্যাম্পে ফেরার পালা। স্যারের সনির্বন্ধ অনুরোধ ফেলতে না পেরে, ওণারা গুটি গুটি এসে জড় হলেন ক্যাম্পে। ঘর ভর্তি হয়ে উপচে যায় আর কি। এলেন ওণাদের বউ/বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও। কারণ,“তুমি আর কি বুঝবা? আমায় শুনতে দাও দিকি”। 
স্যার আর আমাদের বর্মণ সাহেব গুছিয়ে বোঝালেন সবকিছু। রমেশ প্রজেক্টর দিয়ে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন কি করে করে দেখালো। অনেকেই এসে এসে ফর্ম নিয়ে গেলেন। আমরা যে ভাঁওতা দিয়ে টাকা তুলতে আসিনি, তা বোঝাবার জন্যই,আসেপাশের গাঁ থেকে কয়েকজন নথিভুক্ত শ্রমিককে ডাকা হয়েছিল। তাঁরাও শোনালেন তাদের কথা। বিলি করা হল সামাজিক মুক্তি কার্ড। এবার ফেরার পালা, ফেরার সময় ভাবলাম, শুকনো ডাঙায় একবার নৌকা চড়েই দেখি না-

অনির ডাইরি, ১৭ই জুলাই, ২০১৯


কি কালান্তক গরম মাইরি। বিদিকিচ্ছিরি তাল পাকানো ভাদ্দুরে গরম। উত্তরবঙ্গে উপুড়হস্ত, উদার প্রকৃতির, কেন যে দক্ষিণবঙ্গের প্রতি এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ, কে জানে? সেই কথাই শোনাচ্ছিলাম বাবাকে, রোজই ট্রেনে উঠে ফোন করি কি না। নাঃ এবারে বুঝি, বর্ষা আর হল না। আর কবেই বা হবে? বাবার যদিও উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি চোখে ইয়ে মানে কানে ধরা পড়ল না। বৃদ্ধ বরাবরই ভয়ানক আশাবাদী।
আজও যথারীতি, “আরেঃ দাঁড়া। কে বলেছে বর্ষা হবে না? সুদ সমেত সব ফেরত পাবি। পুজোটা আসতে দে।“ কি আজগুবি কথা মাইরি, বছরের সবথেকে আনন্দের দিনগুলোতে কে চায় বর্ষার পানি? বলতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ ততোক্ষণে বহুদূর পাড়ি দিয়েছে, “ সে বছর মহালয়া পড়েছিল, ১৯শে সেপ্টেম্বর। তার ঠিক আগের দিন আমাদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। হামলা যে হবে, খবর ছিল। স্থানীয় এমপি, যুগল মণ্ডল, স্বয়ং বাবাকে খবরটা দিয়েছিল। সন্ধে সন্ধে অসিত (স্বর্গীয় ছোটকাকু) আর আমি খেতে বসেছি। ব্যাগ গোছানো। খেয়ে উঠেই বেরিয়ে পড়ব। রাত ৯টার ট্রেন। খুব সম্ভবত দুন এক্সপ্রেস। গভীর রাতে গিয়ে নামব কোডার্মা।“
ব্যারাকপুরের আগে, অকারণে দাঁড় করিয়ে দিল ট্রেনটাকে, বাবাও চুপ। বাড়িতে হামলার গল্পটা আমি জানি। রাত দশটা থেকে প্রায় দুটো আড়াইটে অবধি অবাধে ভাঙচুর হয়েছিল, মহল্লার মুষ্টিমেয় প্র-নকশাল বাড়ি। গলা ঝেড়ে আবার শুরু করল বাবা, “প্রচণ্ড মারে, সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম। ব্যাটরা থানার মেঝেতে যখন জ্ঞান এল, তখন সবে শুরু হচ্ছে মহালয়া। পুজোর মরশুম। আদালত বন্ধ। আমাদের চালান করে দিল, মল্লিকফটকের জেলে।“
খানিকটা কেশে নিয়ে, “ সেবারেও এমন দম চাপা গরম। পঞ্চমী, ষষ্টী কেটে সপ্তমী পড়ল। আমার আর ছোট কাকুর পুজো বলতে, জেলের তিনতলার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা, বাইরে পুলিশ লাইনের পুজো।“ থাকতে না পেরে জানতে চাইলাম, “আর মা? মা কি করছিল?মা তোমার সাথে দেখা করতে যেত?জেলে?”প্রসঙ্গত আমার বাবা এবং মায়ের শুভদৃষ্টি জেলে আর আদালত চত্বরেই সম্পন্ন হয়েছিল।সুদূর মুর্শিদাবাদের অজ গাঁ রামনগরের ঘোষ বাড়ির মেয়েরা বরাবরই ভয়ানক রকমের আবেগপ্রবণ এবং বাস্তবজ্ঞানহীন (মা,মুষ্টু এবং ছোটো কেলিও না প্লিজ)। বৃদ্ধ বলল, “তা তো মনে নেই,  হ্যাঁ গো, তুমি আসতে আমার সাথে দেখা করতে?” মায়ের বলে রক্তে সোডিয়াম নিম্নগামী,মুহূর্তে মুহূর্তে সব ভুলে যায়, তার কাছে জানতে চাইছে, না জানে কোন মান্ধাতার যুগের কথা। সর্বোপরি মা আপাতত তার ছায়ার সাথে মধুর বাক্যালাপে নিমগ্ন। ট্রেনের ঝমঝম ছাপিয়ে, দুজনের গলা কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এই নিয়ে কতবার যে ছায়াকে বরখাস্ত করা হল, আর ডেকে আনা হল তা ঈশ্বরই জানেন। মা যে শোনা মাত্র মুখঝামটা দিল, বেশ বুঝতে পারলাম। বাবা দেখলাম তাও আশা ছাড়ল না,এবার আমায় পাকড়াও করল, “গুগল করে দেখ না, কোন সালে ১৯শে সেপ্টেম্বর মহালয়া পড়েছিল।“ ইল্লি আর কি? গুগুল যেন আমার আলাদিনের জিন।
বাবা দেখি, তখনও বিড়বিড় করে চলেছে, “৭৩ না ৭৪ রে বাবা? এ হে হে, দাদা থাকলে, এখুনি বলে দিত। বলো না গো, আমি দ্বিতীয়বার কবে জেলে গেলাম?” মা বোধহয় বলল, তখনও মা, বাবাকে চিনত না। বাবা সোল্লাসে শুরু করল, “তখনও বিয়ে হয়নি, বুঝলি। যা বলছিলাম, ষষ্টি অবধি, আকাশ ঝকঝকে, গরমে নাভিশ্বাস ওঠে, হঠাৎ সপ্তমীর দিন সন্ধে সাতটা থেকে শুরু হল বৃষ্টি। সে কি সাংঘাতিক বৃষ্টি রে, তিনদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি। নবমীর দিন দুপুর বেলা, হো- হো চিৎকার। আমরা জেলের তিনতলার জানলা থেকে দেখছি, হাফ প্যান্ট আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, দৌড়চ্ছে পুলিশগুলো। পুলিশ লাইনের প্যান্ডেল, তুমুল বৃষ্টিতে ক্রমশ হেলে পড়ছে। দড়ি-দাড়া দিয়ে তাকে খাড়া করার যতই চেষ্টা করে, ততোই তিনি হেলে পড়েন। শেষে, হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল, আমাদের চোখের সামনে। দশমীর দিন বিকালে, বৃষ্টি থামতে, দেখা গেল, প্রতিমা গলে মাটিতে মিশে গেছে। ঘটটা কি ভাগ্যি খাড়াই ছিল, সেটাতে নমঃ নমঃ করে পুজো করে, বেলচা করে ঠাকুরকে তুলে, ভাসান দেওয়া হল।“বাবার দেখি গল্প শেষ করার কোন ইচ্ছেই নেই, আমাকে বোধহয় তুত্তুরী ঠাউরেছে। শুনতে দারুন লাগলেও, ইতিমধ্যে ট্রেন অনেকটা এগিয়ে গেছে, পরের স্টেশনে নামতে হবে। কথা ঘোরাতে বললাম, “এবার রাখি? কাল এই এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি হয়েছে, জানতো।ক্ম্যুনাল টেনশন- “ বৃদ্ধ কথা শেষই করতে দিল না, “আরেঃ দূর দূর, সেসব কিছু নয়। খবর দেখিসনি,দু ব্যাগ পেটো পেয়েছে পুলিশ। এরকম প্রচুর পেটো জমানো আছে, মাঝে মাঝে দু একটা তো পেটো মারবেই। তোর কাছে থাকলে, তুইও-।“ কথা না বাড়িয়ে, ফোনটা রেখে দিলাম। বলেছিলাম না, বৃদ্ধ ভয়াবহ রকমের আশাবাদী।

Sunday 14 July 2019

তুত্তুরী উবাচ, ১৪ই জুলাই, ২০১৯


-মা, এসবিআই কি বলো তো?
-( অন্যমনস্কভাবে ) স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইণ্ডিয়া।
-হলো না। এস বি আই মানে হল, সো বি ইট। মানে আমেন। আমেনকে তো এসবিআই ও লেখা যায়, নাকি?
- পরীক্ষায় লিখে আসিসনি তো? তোদের যা গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল, রসগোল্লার হাঁড়ি উল্টে দেবে খাতায়।
- নাঃ। এমনি বলছি। ( খানিকবাদে) যাই গিয়ে টিভিটা নিভিয়ে দিয়ে আসি।
-কেন? বাবা খেলা দেখছে তো?
-সেই জন্যই তো। পাঁচ ঘন্টা ধরে বসে বসে টিভি দেখছে-
-তাতে তোর কি? তুই ঘুমো। ছেলেদের খেলা দেখলে মন ভালো হয়।
-আর মেয়েদের?
-(বিরক্তি এবং হাই চেপে) শাড়ি দেখলে। (অতঃপর শুধরে নিয়ে) না মানে, এভাবে ক্যাটেগরাইজ করা অনুচিত।  যার যেটা দেখলে মন ভালো থাকে, মেয়েরাও খেলা দেখে।
-আর ছেলেরা?ছেলেরা শাড়ি দেখে মা?
-(বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে) দেখতেও পারে। পরতেও পারে। তাতে তোর কি? যার যা ইচ্ছা করতে পারে। তুই ঘুমো তো।
-(সবজান্তার ভঙ্গীতে)হ্যাঁ। ঠিক বলেছো। আমি একবার একটা বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম, একটা মেয়ে রাস্তা দিয়ে শাড়ি পরে যাচ্ছিল। যেতে যেতে হঠাৎ তার শাড়িটা খুলে গেল। তখন সে ব্যাগ থেকে তার বরের লুঙ্গিটা বার করে পরে নিয়ে চলে গেল।
-ওরে বাপরে বাপ। কোথা থেকে এসব গাঁজাখুরি গপ্প শিখিস বাবু তুই?হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে গেল-
   

Thursday 11 July 2019

অনির ডাইরি ১০ই জুলাই ২০১৯




ঠ্যাং খোঁড়া হয়ে বাড়িতে বসে আছি। কখন যে মচকালাম, তাও বুঝতে পারছি না। অবশ্য, এতদিন কেন যে মচকায়নি,সেটাই আশ্চর্যের। বিধাননগর স্টেশনের যে কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে লোকাল ট্রেনে চড়া বা নামার আগে বীমা থাকা অবশ্য প্রয়োজন। কি অখাদ্য স্টেশন মাইরি! কোন প্ল্যাটফর্মে কোন পাখা পাবেন না। শুধু কি তাই? কি নীচু প্ল্যাটফর্ম গুলো বাবারে। ঐ প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রতিদিন হাঁচোড় পাঁচোড় করে,জনা কয়েক নিত্যযাত্রিনীকে কোঁৎকা মেরে ট্রেনে ওঠা, তথা ফেরার পথে, গেট অালো করে হাওয়া খাওয়া পাবলিকদের পুনঃ কোঁৎকা মেরে, তথা নামতে না দিয়েই ঠেলে উঠতে চাওয়া যাত্রীদের গুষ্টি উদ্ধার করে ঝপাং করে নামা চাট্টি খানি কথা নয়। তাও মাঝে মাঝে আবার শাড়ি পরে। সাধের হিলস্ গুলোতে ঘরবাড়ি বানিয়েছে মাকড়সারা। বৃষ্টির দিনে পাতি চপ্পল আর শুকনো কালে স্নিকার ছাড়া গতি নেই ।
আমার যদিও ধারণা, পা মচকানোর সাথে বিধাননগরের কোন যোগ নেই। কালপ্রিট আমার কন্যা। ঘুমের ঘোরে নির্ঘাত আমার পায়ে চেপেছিল। অবশ্য তাতে আমার ঘুম কেন ভাঙল না, সেটা একটা লাখ টাকার প্রশ্ন বলতে পারেন। আমার বরের মত যথারীতি অন্য। মারুতি ৮০০র ইঞ্জিনের ঘাড়ে টাটার ট্রাক চাপালে যা হয়-। ভাবনা চিন্তা গুলোও কেমন যেন হুল ফোটানো মাইরি। বলল, আমার জন্য ছুটি নিয়েছে, একা নড়তে চড়তে পারছি না বলে, পরে বুঝলাম কারণ ম্যানচেস্টারনগর।

একে তো ঠ্যাঙ খোঁড়া হয়ে বসে আছি, তারওপর কি বিষফোঁড়া মাইরি এই হোয়াট্স অ্যাপ। কেন যে এই অফিশিয়াল গ্রুপ গুলো তৈরি হয়? হ্যাঁ গা বিতান দা, রজত স্যার, সুকন্যা আর নবীন, যত কাজ কি আজই করার ছিল ভাই তোমাদের?
পৌনে ছটা নাগাদ বাধ্য হয়েই ছাতের উদ্দেশ্য রওণা দিলাম, প্যারাসিটামলের দাক্ষিণ্যে ব্যথাটা আপাততঃ কিঞ্চিৎ প্রশমিত আর বসার ঘরে বাপ মেয়েতে যা “আপনা ধোনি আয়েগা” শুরু করেছে। বিশেষতঃ ছোটটার চিড়িংবিড়িং বেড়ে গেছে আড়াইগুণ। বড়টা তো শুধু খেলা নিয়েই মগ্ন, ছোটটা আবার খেলার সাথে সাথে যাবতীয় বিজ্ঞাপন নিয়েও সমান উৎসুক। পারলে সবই কিনে ফেলে আর কি। 

হাঁটতে  যে খুব একটা পারলাম তা নয়, তবে সাময়িক ভাবে সব ব্যথা সব হীনমন্যতা, অপদার্থতা  বোধ ভুলিয়ে দিল আকাশ। ঘিঞ্জি, দূষিত, জনবিস্ফোরনে ক্লান্ত, ক্লেদাক্ত রোজকার শহরটা, চোখের সামনে সামান্য মেঘের প্রসাধনীতে পলকে তিলোত্তমা।এমনকি ফাঁকা  বিলবোর্ডের কঙ্কাল বা ছাতে গজানো আগাছার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা কালো মেঘ আর ঝোড়ো হাওয়াও কি অপরূপ মোহময়। বারংবার এটা হয়, জানেন তো, যতবারই বিরক্ত হয়ে উঠি জীবনের প্রতি,একঘেঁয়ে লাগে সবকিছু,  প্রকৃতি ততোবারই স্বতোঃপ্রণোদিত হয়ে মনে করিয়ে দেয়- বড় ভাগ্যবান আমরা। বড় সুন্দর এ পৃথিবী, বড় বেশী মোহময় এ জীবন। ভালো থাকুন আর আশ মিটিয়ে ভালোবাসুন। আকাশও বোধহয় তাই শেখায়-

Sunday 7 July 2019

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই, ২০১৯







রথের মেলা তো বসতো, আমাদের হাওড়া ময়দানে, সে না জানি কবেকার কথা। তখনও শরৎসদন তৈরি হয়নি। মোটামুটি পঞ্চাননতলা থেকেই বসে যেত কাঠের হাতে ঘোরানো চৌকো বাক্সের মত নাগর দোলা, তারপাশে লাল ঝালর দেওয়া চাঁদোয়ার নীচে গোল করে  ঘুরত, ঝুলন্ত হাতি- ঘোড়া-কুমীরের দল।পুঁইইইই করে বাজত তালপাতার বাঁশি।করররকটকট করে চিৎকার করে উঠত ব্যাংবাজি। ঘোলাটে মেঘলা আকাশে ওড়ার তাল কষত রঙ বেরঙের গ্যাস বেলুন, ফুঁ দিলেই বনবন করে ঘুরত নীলগোলাপি কাগজের পাখা। ত্রিপল টাঙিয়ে বসত, মাটির পুতুলের পসরা। তাদের মধ্যেই যে গুলো কৃষ্ণনগরের, তাদের দেমাক ছিল খুব, হাত দিলেই ছাঁকা লাগত, কি দাম বাপস। সারি সারি বসত গরম জিলিপির দোকান, বিক্রি হত, সর্ষের তেলে ভাজা ইয়া বড় বড় পাঁপড়, চুড়া করে বিক্রি হত, গুড়/চিনি কটকটি, খোলা শুদ্ধ বাদাম ভাজা, বিক্রি হত বটি, কাটারি, কাঞ্চননগরের ছুরি, কাঁচি, কাঠের চিরুনি,খাঁচায় ভরে বিক্রি হত,ঝিমনো টিয়া পাখির দল। গলার কণ্ঠীর ওপর কারো মাথাটা লাল, কারো নীল, কারো বা হলদে-সবুজ। বাবার হাতেপায়ে ধরে, একবার আদায় করেছিলাম একটা টিয়া। ২০টাকা দিয়ে কেনা পাখি, ঐ টাকায় তখন এক ব্যাগ বাজার হত, মেয়ের জেদের কাছে পরাভূত বাবার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য কত কথাই যে শুনতে হয়েছিল বাবাকে। পাখি নয়তো, প্রাণপাখি, শখ করে নাম রেখেছিলাম, মদনমোহন। সপ্তাহখানেকের বেশী বাঁচেনি মদনমোহন। মনকে আজও প্রবোধ দি, হয়েই তো এল, শীঘ্রই আবার দেখা হবে, ভবসিন্ধুর ঐ পাড়ে-
রথ নিয়ে কত যে স্মৃতি, সেই যে সেবার এক তুতো মাসির শাশুড়ি কাউকে কিছু না জানিয়ে ঠিক করে বসলেন, জগন্নাথ দেবের রথের রশির খণ্ডিতাংশ ওনার চাইই চাই। ঐটি যদি জোটাতে পারেন, তো ব্যাস, স্বয়ং সৌভাগ্যলক্ষ্মী স্বযাচিত হয়ে আপনার করতলগত হবেন। কিন্তু, জগন্নাথে ভেজাল থাকলে চলবে না, রশি হতে হবে, নির্ভেজাল  অকৃত্রিম “জগন্নাথ দেব অব শ্রীক্ষেত্রের” রথের। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করে, যখন উনি নিজের অভীপ্সা ব্যক্ত করলেন, বাকিদের অবস্থা কি হল, বুঝতেই পারছেন। ছোট মাসি আর মেসোমশাই, রীতিমত সারাদিন ধরে কাউন্সেলিং করলেন, বিদেশ বিভূঁই বলে কথা, একটা মারও বাইরে পড়বে না। অতি কষ্টে তাঁকে নিরস্ত করে, সকলে বেরোলেন রথ দেখতে। রিস্ক না নিয়ে, খোদ ছোট মেসো আর বড় মাসি দুদিক থেকে ঘিরে রইলেন ভদ্রমহিলাকে,আশেপাশে চক্রব্যূহ বানিয়ে রইল বাকিরা। কোন বেচাল দেখলেই, সোজা গোল করে ঘিরে ফেলা হবে। রথ কাছাকাছি আসতেই, পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। কে যেন, বড় মাসির সিটিগোল্ডের হারটা ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান, বড় মাসি, চিৎকার করে উঠল, “আমার হার, আমার হার”। ছোট মেসোমশাই ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “ কি হল?কি হল? কি গেল?কি গেল?” প্রাথমিক ঘেঁটে যাওয়া অবস্থা কাটিয়ে,  সবাই যখন সম্বিৎ ফিরে পেলেন, ভদ্রমহিলা ততোক্ষণে বেপাত্তা। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে, বাসায় ফিরে দেখা গেল, উনি প্রসন্নবদনে, আমাদেরই প্রতীক্ষারত। শুধু আশ মিটিয়ে রথই টানেননি, সকলের অগোচরে, শাড়ির ভাঁজ থেকে নতুন ব্লেড বার করে, কুচ করে কেটে নিয়েছেন, খানিকটা সুতো।
হুগলীতে এসে ইস্তক শুনছি, গুপ্তিপাড়ার রথের কথা। মাহেশের তুলনায় প্রচার অনেক কম, তবে ঐতিহ্য এতটুকুও কম না। দূরদূর থেকে মানুষ আসেন, গুপ্তিপাড়ার রথ দেখতে। জমিয়ে বসে রথের মেলা বসে। রথের দিন কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঢোকা যায় না, অন্যদিন তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। শুক্রবার, যাচ্ছি যাব করে কাজ গুটিয়ে,অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই বেজে গেল সোয়া পাঁচটা। পথপ্রদর্শক আমাদের শ্যামল। পিপুলপাতির মোড় হয়ে, হুগলী ঘাটের তলা দিয়ে, গাড়ি গড়াল আসাম রোডের পথে। হাইরোডের সমান্তরালে দৌড়য় রেলপথ, কখনও দৃশ্যমান, কখনও অদৃশ্য। গুপ্তিপাড়া কাটোয়া লাইনে একটা ছোট্ট ষ্টেশন। এদিকের ষ্টেশনের নাম গুলো খুব মিষ্টি, মগরা, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, কুন্তিঘাট,জিরাট, বেহুলা, গুপ্তিপাড়া-। ঘিঞ্জি শহর ছাড়ালেই, খোলা সবুজ মাঠ। জানলা দিয়ে বিনা অনুমতিতে ঢুকে আসে, টাটকা জোলো হাওয়া। বলাগড় ব্লক শুরু হতে না হতেই, শ্যামল সাধতে শুরু করল, “ম্যাডাম, আমাদের গাঁয়ের মন্দিরটা একবার দেখতে চলুন। বেশীক্ষণ লাগবে না। মন্দিরের গায়েই গাড়ি দাঁড় করাব, পাক্কা দুমিনিটের বেশী নেব না। দেখবেন কত বড় মন্দির। সাড়ে তিনশ বছর আগের মন্দির ম্যাডাম। কত লোক ভোগ খায়, একটি বার চলুন-।“
গ্রামের নাম, ডুমুরদহ নিত্যানন্দপুর। মন্দিরটি আপাত বিশেষত্বহীন, তবে পরিবেশটি বড় মনোরম। কোন দেবতার মন্দির সেটি উল্লেখ করে, চাকরিটিকে আর বিপদগ্রস্ত করতে চাই না।
 মেলায় পৌঁছতে পৌঁছতে বাজল সাড়ে ছয়। মেলায় ঢুকেই প্রথম যে অনুভূতিটা হল, আরেঃ এতো আমার শৈশবের হারানো মেলা। সেই রেশমি চুড়ি, মাটির পুতুল, হাড় জ্বালানো ব্যাঙ বাজি, বাসনপত্র, সারিসারি জিলিপির দোকান থেকে ভেসে আসা মনমাতান সৌরভ। চুড়ো করে রাখা খোলা শুদ্ধ বাদাম আর গুড় কটকটি। পাঙ্খা বরফ, কাগজের ফুল, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। পুরো মেলা ঘুরে দেখার সময় ছিল না। তারই মধ্যে তুত্তুরীর জন্য কেনা হল কাঁচের চুড়ি।কেনা হল মাটির পুতুল, শ্যামল কিনল কাগজের ঘুরঘুরে নীল-গোলাপি পাখা, রমেশ বোধহয় যা পাওয়া যাচ্ছে সবই কিনে ফেলল, কেনা হল, গরম গরম মথুরা কেক। পাতি বিলিতি ডোনাট, শুধু বেকড নয়, খলখলে করে তেলে ভাজা। কাগজে মোড়ার আগে তার ওপর ছড়ানো হল আইসিং সুগার। কেনা হল লেবু লেবু গন্ধ আর নুন মাখানো পপকর্ণ। গুড় না চিনি তর্ক করতে করতে কেনা হল, গরম গরম জিলিপি। গুপ্তিপাড়া হল সন্দেশের জনক, এখানকার গুপো সন্দেশ অমৃতসমতুল। গুপ্তিপাড়ায় গিয়ে, গুপো সন্দেশ  না কেনা গর্হিত অপরাধ, কাজেই? 
কলাবেচা তো হল, এবার রথ দেখার পালা, ঘড়ি বলছে, সাড়ে সাত। এখান থেকে চুঁচুড়া যেতেই লাগবে আরও ঘণ্টা দেড়েক, সেখান থেকে বাড়ি বোধহয় মধ্যরাতে পৌঁছব। সে হোক। রথ দেখে জুড়িয়ে গেল প্রাণ। কি অপরূপ সুন্দর রথ, হ্যাংলার মত ছবি তুলছিলাম আমরা, বর্মণ সাহেব, প্রীতি আর আমি, শ্যামল, ছুটে এসে বলল, “করেন কি? এটা তো রথের পিছন দিক।“  ইয়ে যার পশ্চাৎদেশই এত মনোরম, না জানি, তার অগ্রভাগ কি হবে? আশা করি বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বয়ং বিচার করুন। প্রায় মিট্মিটে আলোয়, ঘিঞ্জি দোকান বাঁচিয়ে মুঠোফোনে ভাগাভাগি করে তোলা। আটটা নাগাদ যখন তাড়িয়ে সকলকে নিয়ে ফিরছি, শ্যামল তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত, “ কোনটা দিয়ে রথে চড়া যায় গো? ও ম্যাডাম, দাঁড়ান, যাবেন না। এতদূর থেকে এলেন, রথে একবার চাপবেন না?” গুটি কয়েক গুড়গুড়ে রথে চেপেছে বটে, তাই বলে, আমি?ছেলেটার জীবনে বুদ্ধি হবে না মাইরি, সাধে শ্যামলের ওপর চটে যাই?