Saturday 31 July 2021

তুত্তুরী উবাচ ৩১শে জুলাই, ২০২১

 

👧🏻-(ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে, বাংলা সংবাদ পত্রের  শিরোণাম পাঠ) সবুজ পাঠগার। 

👩🏻-কি! ঠিক করে বাংলা পড়তে কবে শিখবি?

👧🏻-(সলজ্জ হেসে) সরি। সবুজ পাঠাগার। (ফিক করে হেসে) পাঠাগার মানে কি মা? যেখানে পাঁঠা থাকে? 

👩🏻-(প্রচণ্ড রেগে) তোর মাথায় কি আছে? পাঠাগার মানে লাইব্রেরি। স্কুল বন্ধ বলে যেখানে যেতে পারিস না আর ভেউ ভেউ করিস। 

👧🏻-(লজ্জিত হয়ে) এঃ দুঃখিত।( কিছুক্ষণ পরে,ভাব জমানোর উদ্দাম বাসনায়) জানো তো মা, তুমি সেই যে আমায় ন্যাড়া করে দিতে না, তাই নিয়ে ক্লাসে ইমন আমায় খুব জ্বালাতন করত। সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলত, ‘সি পুরোযা’স হেয়ার ইজ লাইক গ্রাস-’।  আর অমনি সবাই হো হো করে হাসত। শেষে একদিন বিরক্ত হয়ে গিয়ে বললাম, ‘ইয়েস। আই নো ইটস্ ইওর ফুড। বাট প্লিজ ডোন্ট ইট মাই হেয়ার। ’ 

👩🏻-মানে? তুই ওকে গরু বললি?

👧🏻-(দুষ্টু হাসি চেপে) হ্যাঁ। আসলে মিস একদিন বলেছিল, ‘ইমন ইয়োর হেড ইজ ফুল অব কাউ ডাং।’ তারপর মিস আমাদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ডু ইউ নো হোয়াট ইজ কাউ ডাং?’ সবাই বলছিল পটি। মিস বলল,‘নো ইটস্ নট পটি। ’ তখন আমি হাত তুললাম, ম্যাম ইটস্ গোবর। শুনে সবাই হেসেই অস্থির। ঐযে আমি বলেছিলাম ওর মাথায় গোবর, তাই আমার ওপর রাগ। যখন বললাম, এটা তোর খাবার জানি, তাই বলে আমার চুলটা খাস না দয়া করে, তখন আবার ভ্যাঁ করে গেল ম্যামকে নালিশ করতে। ম্যাম আমায় প্রশ্ন করল, তুমি ওকে গরু বলেছ? আমি বললাম, ও আগে আমার চুলকে ঘাস বলেছে। তাই তো বলেছি, খাবার ভেবে খেয়ে নিস না যেন-


👩🏻- উফঃ বেচারা তোদের ম্যাম।

Wednesday 28 July 2021

অনির ডাইরি ১৫ই জুলাই, ২০২১

 



দুপুরের খাওয়া শেষ হতে হতে বিকেল চারটে। এটা অবশ্য চাটুজ্জে বাড়ির বরাবরের দস্তুর। সারাদিন গৃহস্থালির কাজ সামলে, স্নান সেরে, কুঁচিয়ে রাখা ধপধপে কাচা কাপড় পরে যখন খেতে বসত তৎকালীন জ্যেষ্ঠ কুলবধূ ওরফে আমাদের ঠাকুমা, তখনও ঘড়ি বলতো চারটে বাজে। ঠাকুমা চলে গেছেন আজ ষোল বছর হল, চাটুজ্জে বাড়ির এই প্রজন্মের বড় বউ অর্থাৎ আমাদের আদরের চৈতি যখন সব সামলে খেতে বসে,তখনও ঘড়ি বলে, চারটে তো বাজল রে।  


মধ্যাহ্নভোজের পাট মিটিয়ে পাওয়া যৎসামান্য অবসরে, বৈঠকি মেজাজে কাঠের সোফায় পাশাপাশি বসি আমি আর পিসি, সমকোণে রাখা বড় কেদারায় আরাম করে বসে সিগারেট ধরায় বাবা। বৃদ্ধ এমনিতে ভয়ানক শক্ত, কিন্তু আপাততঃ যুগপৎ আঘাতে কিঞ্চিৎ হতভম্ব তথা জবুথবু। মায়ের অসুস্থতার জন্য কষ্ট পায় বাবা, কষ্ট পায় আমার দৌড়াদৌড়ি দেখে,  আর কষ্ট পায় নিজের অক্ষমতার জন্য। আশি পেরানো দেহে, কমে আসা গায়ের জোরে, জগৎ জোড়া মহামারীর আতঙ্কে, বদলে যাওয়া পরিমণ্ডলে অসম্ভব অসহায় বোধ করে বাবা। মুখে স্বীকার করে না যদিও- 


পশ্চিমের জানলা গলে এক ঝাঁক মশা সমেত আসে পড়ন্ত সূর্যের কমলা রোদ, কফি টেবিলের ওপর রাখা সিঙ্গোনিয়াম গাছের কচি কলাপাতা রঙের পাতায় ঠিকরে আসে আলো। মা না থাকায়, কিঞ্চিৎ অগোছালো বাড়িটা, অনেকটাই ধূলিমলিন। ওসব ভাবলে আরো খারাপ হয়ে আসে মন। মনখারাপের ভারী পর্দা সরিয়ে রসালো গল্প শোনায় পিসি ।বাবাদের জনৈক তুতো পিসেমশাইয়ের গল্প। যেমন রূপবান ছিলেন তিনি, তেমনি ছিলেন ধনী। আর তাঁর নারীলোলুপতা ছিল প্রায় কিংবদন্তি তুল্য। সদ্য স্বাধীন চূড়ান্ত হতদরিদ্র ভারত, সেই সময় গুণে গুণে তেরটা মোটরগাড়ির মালিক ছিলেন উনি। ছিল দুটি স্ত্রী এবং অন্তত হাফ ডজন রক্ষিতা। 


 প্রবাসী বনেদী বাঙালী পরিবারের ছেলে, বাবা বলে, ‘প্রদীপ কুমারকে দেখেছিস তো? নায়ক। ঠিক অমনি দেখতে ছিলেন, একেবারে রাজপুত্র। যেমন চোখ-নাক- মুখ, তেমনি টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। বোনেদের বিয়ে হয়েছিল গাঙ্গেয় বঙ্গের বিভিন্ন ছোটবড় রাজপরিবারে। ওনারা তিনভাই, মরার সময় ওনার বাপ, উইল করে তিন ছেলের প্রত্যেককে দিয়ে গিয়েছিলেন চল্লিশ হাজার করে টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কথা, তিরিশ সাল ধর, আইন অমান্য আন্দোলনে কাঁপছে ভারত, তখন চল্লিশ হাজার টাকা, মানে বুঝতে পারছিস, এ কালে চল্লিশ লাখ বা চার কোটিও হতে পারে-।’ তারপর? তারপর আর কি, বড় ছেলে ছিল রেসুড়ে। সবটাকা রেস খেলে উড়িয়ে দিয়েছিল।’ 


‘আচ্ছা এখনও কেউ রেস খেলে?’ প্রশ্ন করে পিসি। বেশ খানিকক্ষণ রেস কোর্স আর ঘোড়া নিয়ে চর্চা করে আবার স্বর্গীয় পিসেমশাইতে ফিরে যাই আমরা। । ‘বড় দাদা রেস খেলে সব টাকা ফুঁকে দেয়, আর উনি ফুঁকে দেন বেশ্যা বাড়ি গিয়ে-।তারপর দুই ভাই মিলে, ছোটভাইকে পাগল সাজিয়ে, তার ভাগের টাকাটাও আত্মসাৎ করে। তারপর সেই পাগল ভাই, নাকি একদিন সবার অলক্ষে লোহার শেকল কেটে গোপনে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তোর ঠাকুমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ছোট ভাইকে বড় আর মেজ ভাই মিলে পিটিয়ে মেরে কোথাও পুঁতে দিয়েছিল।'


পড়ন্ত রোদে ভাসমান ধূলিকণাদের দেখতে দেখতে, সম্পুর্ণ অপরিচিত, দীর্ঘকাল আগে মৃত জনৈক হতভাগ্যের জন্য ভারী হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে!


এমন খুনি, দুশ্চরিত্র, লম্পট ছেলের সম্বন্ধ কে এনেছিল জানতে চাই, ‘ হবু শালার সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। ডিগ্রী নয় কিন্তু। ডিপ্লোমা। সেই সূত্রে ওদের বাড়ি আসা যাওয়া। দেখতে শুনতে ভালো, করিৎকর্মা। তখন বিশ্বযুদ্ধ চলছে, প্রচুর বিদেশি গাড়ি আসছে, বন্ধুর সাথে সেই গাড়ি সারানোর গ্যারেজ খুলে প্রচুর টাকাও কামাচ্ছিলেন। তারওপর পাল্টি ঘর।  ব্যবহারটাও ছিল খুব ভালো। সবার মন জিতে নিতে দেরী হয়নি। এই সব দেখে মলি পিসির সাথে বিয়ে দেওয়ার পর জানা যায়, সে কি জিনিস! মলি পিসি যখন আসন্নপ্রসবা, তখন জানাজানি হয় যে, তাঁর অবিবাহিত  ছোট বোনও সন্তানসম্ভবা-। আর দুই অনাগত শিশুর পিতা একই-।’ 


বেলা গড়ায় আরো একটু। সূর্যের গায়ে লাগে কমলা ছোপ। ঘড়ি তাড়া দেয়, এবার ফিরতে হবে নিজ গৃহে, কাল ইংরেজি পরীক্ষা শ্রীমতী তুত্তুরীর। আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত বইপত্র স্পর্শও করবেন না তিনি। তবুও উঠতে পারি না, জানতে মন চায়, তারপর কি হয়েছিল। 


সিগারেট ধরিয়ে বাবা বলে ,‘এমনিতে লোকটা বেশ ফ্যাসিনেটিং ছিল বুঝলি। সে যুগে, ১৩টা বিলিতি মোটরগাড়ির গল্প তো শুনেইছিস, তাছাড়া কত যে সম্পত্তি কিনেছিল লোকটা তার ইয়ত্তা নেই। পয়সা যেমন উড়িয়েছে, তেমনি কামিয়েও ছিল লোকটা। তবে নৈতিক চরিত্র বলে কিছু ছিল না। যে বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে গ্যারেজ খুলে উপার্জনের হাতেখড়ি, তাকেই একদিন ঠকিয়ে পথে বসাল লোকটা। গুণ্ডা লাগিয়ে গ্যারেজে আগুন লাগিয়ে দিল। বিলিতী বীমা কোম্পানির থেকে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ পেল, কিন্তু পার্টনারকে একটা পয়সাও দিলে না। বেচারা সেই লোকটা এমন ধাক্কা খেল যে আর জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। 


শুধু গাড়ি আর যন্ত্রাংশ নয়, আরো না না অবৈধ কাজে যুক্ত ছিলেন ভদ্রলোক, নিঁখুত জাল নোটের ছাঁচ হাতে তৈরী করে লাখো লাখো টাকা উপার্জন করে। তবে ঐ যে বলে না,পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না,  অধঃপতনের কোন স্তরে নেমেছিল লোকটা কেউ জানে না,তবে শোনা যায়, তৎকালীন ভারত সরকারের জনৈক হোমরাচমরা নেতার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন বখরার দ্বন্দ্বে। অসম তথা প্রবল প্রতাপশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নাকাল হয়ে, গোহারান হেরে অকালে পটাশিয়িম সায়নাইড খেয়ে আত্মহত্যা করতে হয় ওণাকে। রেখে যান দুই স্ত্রী আর কয়েক গণ্ডা বাচ্ছা।আর তারপরই নামে ধস। রাতারাতি উবে যায় কুবেরের ধন। তাতেও হাত ছিল দিল্লির সেই নেতার। মরেও নিস্তার পায়নি লোকটা। মূল্য চোকাতে হয় তার পরিবারকে-।'


 দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিসি বলে, ‘এমন অদূরদর্শী, অবিবেচক লোক দেখিনি, এত টাকা, এত সম্পত্তি অথচ কাউকে কিছু জানিয়ে পর্য্ন্ত যায়নি কোথায় কি ভূসম্পত্তি রেখে গেছে। বাচ্ছাকাচ্চা সমেত বউরা পড়ল অথৈ জলে।  এমনকি জানিস বাস্তু ভিটেটুকুও করে দিয়ে যায়নি। ভাড়া বাড়িতে থাকত ওরা, যখন উনি সুইসাইড করেন-। ভাড়া বাড়িটাও অবশ্য ছিল রাজকীয়। বাড়িতে চারজন ভৃত্য, দুই বউয়ের বাচ্ছা দেখার জনা দুয়েক আয়া, ঠাকুর, দারোয়ান কি ছিল না। দুই গিন্নীকে যা গয়না দিয়েছিল না অকল্পনীয়। গলায় পরার বারোমেসে চেনগুলোই ছিল আঠারো ভরি করে। ছেলেদের কোমরে বাঁধার চেন গুলো ছিল আট-দশ ভরির। ছেলেদের খাবার জন্য বিশাল বিশাল শিশিভর্তি হরলিক্স আসত বম্বে থেকে। অত বড় কাঁচের শিশি আমি জীবনে দেখিনি।  অথচ একটা ছেলেকেও লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেনি লোকটা। ছেলেগুলোর যে  কি পরিণতি হয়েছিল-।'


ঘড়ি বলছে পাঁচটা, এখনই না বেরোলে, অফিস টাইমের জ্যামে পরার সমূহ সম্ভাবনা। উসখুস করছি দেখে সচকিত হয়ে ওঠে পিসি,‘তোর বোধহয় এসব মান্ধাতার আমলের গল্প ভালো লাগছে না, না রে?’ বাবা অভিমানী সুরে সঙ্গত করে,‘বুড়ো হয়েছি তো, একটু বেশীই কথা বলি আমরা-। ’ ব্যাগ সরিয়ে আবার বসে পড়ি, কি করে বোঝাই এদের, গতানুগতিক সাদাকালো দৈনন্দিন জীবনের সবথেকে রঙীন অংশ এই বুড়োবুড়ির গল্প। থাকি না হয় আরো কিয়ৎ ক্ষণ, মন- প্রাণ-কান ভরে শুনি হারিয়ে যাওয়া অতীত আর  ভুলে যাওয়া কিছু চরিত্রের কথা।  যারা আপাদমস্তক সাধারণ হয়েও আসলে ছিল অনন্যসাধারণ।

Monday 19 July 2021

অনির ডাইরি ১২ই জুলাই, ২০২১

 


আজ দীর্ঘ আটদিন বাদে বাড়ি ফিরলেন জগুদা এন্ড কোং। বিগত এক হপ্তা আটদিন ধরে তেনাদের নিবাস ছিল ঠাম্মার গৃহ। ঠাম্মাই জগুবাবুর মাসি কি না। ফেরার সময় একরাশ দইবড়া, কোল্ড ড্রিঙ্ক, বেলজিয়াম চকলেটের আইসক্রিমও নিয়ে ফিরলেন তিনি। সাথে প্রায় তিনশ টাকার প্রণামী। যার গরিষ্ঠাংশই দুই দাদু এবং কাকাইয়ের দেওয়া। বাকিটুকু দিয়েছে তুত্তুরীর মাসি আর আবাসনের জনৈক দাদু, যিনি রথের দিন তুত্তুরীর কাছে ‘পেসাদ’ চেয়ে হাত পেতেছিলেন। 


অথচ জগুবাবুদের যাত্রাটা কিন্তু মোটেও এমন শুভ হয়নি।  কি সাংঘাতিক যে কেটে ছিল রথের দিনটা। কোন কোন সকাল এমনি আসে, যখন একটু বেলা করে ভাঙে ঘুম। কোন কোন সকাল বয়ে আনে হাল্কা জাতি বিদ্বেষের গন্ধ।  কেমন, দিল তো ইতালী, ইংলণ্ডের নাকে আচ্ছা করে ঝামা ঘষে! 


বেলা গড়ায়, ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে গত রাতের বাসি উত্তেজনা। আর কি কখনও কবে, এক সাথে কোপা- উইম্বলডন আর ইউরো হবে? সে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চিলেকোঠার গুপ্ত কুঠুরি থেকে সহোদর- সহোদরা সমেত বেরিয়ে আসেন জগন্নাথ। 


বেলা বাড়ে, তুত্তুরীকে ছুটি দেয় না গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল। পড়ার ঘরে ল্যাপটপ চালিয়ে ঘাড় গোঁজ করে পড়তে বসে তুত্তুরী। ব্যাগ গোছাতে বসে শৌভিক। আগামী কালই বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে রওণা দেবে নতুন পোস্টিং এর উদ্দেশ্যে। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, টুকটাক কত কিছু কেনা বাকি। চটজলদি বেরোনোর তোড়জোর করি আমরা। তুত্তুরীর ক্লাশ শেষ হবার আগেই ফিরে আসব, মাত্র ঘন্টা খানেকের ব্যাপার। স্নানাহার ফিরে এসেই না হয়- 


ঠিক এগারোটা পয়ত্রিশে বাবার ফোন, আজও ভাসছে কথা গুলো ইথার তরঙ্গে, ‘তুমি কি ব্যস্ত আছ, আসতে পারবে? মা যেন কেমন-’।  ঠিক এই ভয়টাই পাই আমি সবসময়। ঠিক এই কথাগুলোই দুঃস্বপ্নে শুনি আমি, অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন এলেই ধড়াস করে ওঠে বুক। যদিও প্রতিবারই প্রমাণ হয়, অকারণ আশঙ্কা করি আমি, আর যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন কেন যে বাজে না কোন বিপদঘন্টি।  


এরপরের দৌড়দৌড়ি, মানসিক উত্তেজনা, মনোবেদনার গল্প জানে সময় আর জানি আমরা চার খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন, আমার বর আর অয়নের গিন্নি তথা আমাদের আদরের ভাই বউ চৈতি।ক্ষয়িষ্ণু হলেও যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার বোধহয় এটাই সবথেকে বড় সুবিধে, আমি আর শৌভিক পৌঁছানোর আগেই, ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার পর অ্যাম্বুলেন্স ডেকে, মাকে হাসপাতালে নিয়ে হাজির হয় মায়ের ভাসুর ঝি, দুই দেওর পো আর চৈতি। বাড়িতে নড়বড়ে বাবার কাছে থেকে যায় পিসি আর বুল্লু বাবু। 


হাসপাতালের কাজ মিটিয়ে, বাড়ির পথে যখন গড়াল গাড়ির চাকা, মায়ের পাশাপাশি বড় মন খারাপ করছিল মেয়েটার জন্যও। সারাদিন নাকি, আমাদের অনুপস্থিতিতে ফুলে ফুলে কেঁদেছে মেয়েটা। মামমাম অর্থাৎ দিদার প্রাণ যে তুত্তুরী। তুত্তুরী যদি কাঁদে, মন খারাপ করে থাকে, মামমাম কি আদৌ ভালো থাকতে পারে? 


এত সাধ করে, বাবার হাতে পায়ে পড়ে উঁচু লফট থেকে রথ নামিয়েছিল মেয়েটা। দূরভাষের ওপার থেকে উমা বলল, 'দিদিভাই, পারলে একটু ফুল আনবে?' নমোঃ নমোঃ করেও নাহয় বেরোক তুত্তুরীর রথ-। গত বছরেও করোনার দৌলতে বাক্সবন্দি ছিলেন জগুদা আর তাঁর ভাইবোনেরা। 


সন্ধ্যা নামার মুখে, হাসপাতালের পোশাক বদলে, স্নান সেরে, উদরপূজা করার ফাঁকে ফাঁকে দেখলাম প্রবল কোস্তাকুস্তি করতে করতে কেমনি সেজে উঠছে কাকিমা আর তুত্তুরীর রথ। সেজে ওঠা রথে আসীন হলেন জগুদা এন্ড ফ্যামিলি। প্রথম প্রণামী দিল তুত্তুরীর মাসি, অতঃপর দুই বীরাঙ্গনা রওণা দিলেন রথ এবং জগন্নাথদেব সহ মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে। পড়ন্ত বিকেল, ফাঁকা পথঘাট আর গোটা আবাসন সাক্ষী রইল কাকিমা আর তার সোনাইয়ের খুনসুটি, ঝগড়া আর গভীর বন্ধুত্বের। কে বলবে, এই মেয়েই সারাদিন কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠার এটাই তো সবথেকে বড় সুবিধা, একা থাকে না কেউ।

Thursday 15 July 2021

অনির ডাইরি, ১৩ই জুলাই, ২০২১

 অনির ডাইরি, ১৩ই জুলাই, ২০২১



পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটার অলিতে-গলিতে, হাড়ে-পিঞ্জরে একা-একা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে আজও কি যে ভীষণ ভালো লাগে। মনে মনেই চলে কথোপকথন, কখনও আমি ছোটাই কথার ফুলঝুরি, তো কখনও বা কান পেতে শুনি, কি কয় এই বুড়ি শহর। 


এই ভর দুপুরে ঝিম ধরে থাকা এই বাড়িটায় প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় বসত বিশাল সৎসঙ্গের আসর। সিংহাসনারূঢ় প্রায় এক মানুষ সমান অনুকূল ঠাকুরের সাদা-কালো ছবির গলায় ঝুলত টাটকা রজনীগন্ধার মালা। পুষ্পের সুবাসে, আগরবাতির সৌরভে মথিত হয়ে উঠত আমাদের গলি। রাস্তা জুড়ে পাতা সারি সারি কাঠের বেঞ্চে হত বিপুল ভক্ত সমাগম। হত ভজন সংকীর্তন। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত নাতিদীর্ঘ, ছিপছিপে চেহারার বাংলার স্যার শ্রীনাথ বাবু ছিলেন ঋত্বিক। শ্রীনাথ বাবু যখন ঋত্বিক হিসেবে মাইক ধরতেন, পলকে থমকে যেত সব গুঞ্জন। এমনিতে মোটেই মারকুটে নয়, বরং বেশ অমায়িকই ছিলেন স্যার, একবারই কেবল গাঁট্টা খেয়েছিলাম স্যারের হাতে। তখন আমি দশম শ্রেণী, কোচিং ক্লাশের সরস্বতী পুজোর চাঁদা, খামে ভরে, ক্লাশ-ব্যাচ এবং ‘স্বরস্বতী পূজা' লিখে যেই স্যারকে দিয়েছি, ওমনি ঠকাস্। 


আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির মুখোমুখি রাস্তার নামটা ভারী সুন্দর, জয়নারায়ণ বাবু আনন্দ দত্ত লেন। এখেনে পা রাখলেই, মনে হয়, কেমন যেন থমকে আছে হারিয়ে যাওয়া সহস্রাব্দ। 


ঢুকতেই বাঁদিকে বড়কালীর পাকা মণ্ডপ।  আমাদের মধ্য হাওড়ার সবথেকে লম্বা কালী বলেই ওণার এমন নাম। ফি বছর বাড়ত বড়কালীর উচ্চতা এবং বিসর্জনের দিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হত আমাদের শহর, বিপদের আশঙ্কায় কেটে দেওয়া হত যাবতীয় ওভার হেড তার। এতদসত্ত্বেও বেশ কয়েকবার মাথার চুল পুড়িয়েছিলেন বড়কালী। শেষে ক্লাবের ছেলেরা বলল, 'তুই আর কমপ্ল্যান খাস নে মা।' আজকাল তাই একটু খর্বাকার হয়েছেন বটে, তবুও মায়ের মুখ দেখতে হলে, ব্যথা করে ঘাড়।  


 ডানদিকের ঐ যে বিবর্ণ সবুজ কাঠের দরজাওয়ালা বাড়িটা দেখা যায়, ঐ বাড়ির বুড়ি মালকিনকে দেখতে ছিল পুরো মেম সাহেবদের মত। টকটকে ফর্সা রঙ, লালচে কেশদাম, গোলপানা মুখ, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। কানাকানি শুনতাম যে, অল্প বয়সে রীতিমত ডানাকাটা পরী ছিলেন উনি, বাড়ির অমতে অসবর্ণ বিবাহ করে রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন সে যুগের মধ্য হাওড়ার বুকে। ওনার স্বামীও ছিলেন তেমনি অপরূপ রূপবান, সদ্য স্বাধীন ভারতে জনৈক প্রসিদ্ধ মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির ইস্টার্ন জোনের সবথেকে বড় ম্যানেজার ছিলেন তিনি। কর্পোরেট রেষারেষির জন্য খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গিয়ে আত্মহনন করতে বাধ্য হন তিনি। বারান্দায় দাঁড়িয়েই থাকত মেম বুড়ি আর রাস্তায় চেনা পরিচিত যাকেই দেখতে পেত, জুড়ে দিত খোশ গল্প।ছোট্ট বেলায় ওনার পীড়াপীড়িতে বেশ কয়েকবার গেছিও এণাদের বাড়ি। গোটা মহল্লায় তখন শুধু এই একটি বাড়িতেই ছিল টেলিফোন। 


একটু এগোলেই, ইংরেজি ভি অক্ষরের মত দু ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। ডানদিকের গলি ধরে খানিক এগোলেই আগে একটা খাটাল পড়ত। ও পথে পা বাড়ালেই, দখিনা পবন বয়ে আনত ভুরভুরে গোবরের গন্ধ। এখন অবশ্য আর নেই খাটালটা। সরকারী নির্দেশে সরে গেছে বহুদিন। 


বাঁদিকের রাস্তাটা ধরব আমি। আগে বাংলা বছরের প্রথম চার মাস জুড়ে এ রাস্তার ধারে শুকাতেন পুঁচকে পুঁচকে মুণ্ডহীনা রক্ষে কালী। পূজার ঠিক দু এক দিন আগে, তাদের ঘাড়ে চাপত মাথা। তারপর হত অঙ্গরাগ। শরৎ নামার সাথে সাথেই, পাট চুকত উলঙ্গিনীর। বিক্রি না হওয়া মূর্তিগুলিই সামান্য ছাঁচ বদলে হয়ে যেতেন কোজাগরি। কার্তিকে একরাশ কালি আর কার্তিক, আর পৌষে শুকাত সরস্বতী। রাস্তার ধারে আজও কিছু অসমাপ্ত খড়ের কাঠামো পড়ে আছে, আকার দেখে মনে হয়, হয়তো কালে কালে বিশ্বকর্মা হবেন তাঁরা। অথবা নব কার্তিক। যাই হোন না কেন,আজ নিছক কন্ধ-কাটা। 


সামনে মল্লিকদের বিশাল অট্টালিকার একতলার ঘর গুলি নিয়ে চলত অজিত বাবুর কোচিং। সাদা কালো দাবার বোর্ডের মত মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে গাঁতিয়ে পড়তে বসত ছেলে আর মেয়েদের দল। রামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের অঙ্কের শিক্ষক অজিত বাবুর  বিশাল নামডাক ছিল সেকালে। মল্লিকদের ঠাকুর বাড়ি ছাড়ালেই বাঁহাতে  ছিল একখানা ভাঙাচোরা ইয়ুথ হোস্টেল। সেটা যে কবে কোথায় হারিয়ে গেল-। কব্জা থেকে ভেঙে ঝুলছে সাবেকী ভারী লোহার গেট আর বাকি ফাঁকা এলাকার দখল নিয়েছে বর্ষার বেবাগা সবুজ জঙ্গল। 


একটু এগোলেই উত্তর খুরুট বারোয়ারির বিশাল রঙচঙে চারতলা ক্লাব ঘর। আরো খানিক এগোলে ডান হাতে একটি বাড়ির গায়ে আজও লাগানো আছে,  একটি ছোট বোর্ড।  যাতে লেখা, ‘এখানে দশম শ্রেণী অবধি যত্ন সহকারে পড়ানো হয়।‘ যোগাযোগের জন্য দেওয়া আছে শম্পার বাবার নাম। শম্পা শুধু আমার সহপাঠীই নয়, লতায়পাতায় তুতো বোনও বটে।  শম্পার ঠাকুমা দনুজদলনী দেবী সম্পর্কে ছিলেন আমার ঠাকুমা স্বর্ণলতা দেবীর মাসতুতো বোন। 


 তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে থাকাকালীন,  স্কুল ছুটি হলেই শম্পাদের বাড়ি যাবার প্রবল বায়না ধরতাম আমি। আর প্রতিদিনই ঢোঁক গিলে, একই কথা বলত শম্পা, ‘না রে অন্য সময় আসিস, এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে মা।’ চার পুত্রকন্যা সামলে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যাবতীয় গৃহকর্ম মিটিয়ে, কয়লা ভেঙে, গুল দিয়ে, বাতিল শাড়ি দিয়ে পর্দা বানিয়ে, শম্পার গৃহশিক্ষিকার দায়িত্বভার সামলাতেন যে মহীয়সী মহিলা, তিনি যদি ব্যস্ত না থাকেন তাহলে ব্যস্ত থাকবে কে? ব্যস্ত থাকতে থাকতেই একদিন মারা যান জেঠিমা, শুনেছি আছড়ে কাপড় কাছতে কাছতেই নাকি ঢলে পড়েন চিরঘুমে। 


জেঠু অর্থাৎ শম্পার বাবার কথাও খুব মনে পড়ে, চাকরী থেকে অবসর নেবার পরও, লম্বা লম্বা পা ফেলে, একটা মস্ত কালো ছাতা মাথায় দিয়ে  সারাদিন টিউশনি করে বেড়াতেন তিনি। পথেঘাটে দেখা হলেই ঢিপ করে প্রণাম করতাম আমি, হাজার হলেও বাবার তুতো দাদা বলে কথা- শেষ খবর পেয়েছিলাম,পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন উনি। কে জানে কেমন আছেন! কোথায় আছেন! 


শম্পাদের বাড়ি ছাড়ালেই আমার প্রাণ চায়, সারদামণি ক্লাবের পাশ দিয়ে ডান দিকে বাঁকতে। ঐ ডান হাতি গলি এঁকে বেঁকে গিয়ে দাঁড় করায় রুণাদের বাড়ির সামনে। এককালে কত যে গেছি ও বাড়িতে তার ইয়ত্তা নেই। বন্ধ হয়ে যাওয়া যোগমায়া সিনেমা হলের পাশে, রুনাদের বাড়ি খানা আজও রয়ে গেছে একই রকম। পৌনে দুই দশক হল, বিয়ে হয়ে চলে গেছে রুনা,  কাকুও চলে গেছেন ফিরে না আসার দেশে। তবে কাকিমা আর রুণার পিসিমা আজও আছেন। গিয়ে কড়া নাড়লে কি আদৌ চিনতে পারবেন আমায়? পিসির পরিচয় দিলে নির্ঘাত পারবেন। স্কুলে পৌঁছে দেওয়া-নেওয়ার সূত্রে বড় গভীর বন্ধুত্ব ছিল আমার পিসির সাথে রুণার মায়ের। 


সোজা এগোলে ডান হাতে স্বপ্নের মত একখান মস্ত তিনতলা হলদে রঙের ইস্কুল বাড়ি পড়ত, বাবার মুখে শুনেছি, স্বাধীনতার আগে আমার বড় পিসিমারা স্লেট বগলে এখানে পড়তে আসত, তখন এর নাম ছিল, ‘দুর্গা বাবুর পাঠশালা’। পরবর্তী কালে শ্রীদুর্গা ইস্কুল নামে অন্যত্র সরে যাবার পর, স্বপ্নের মত ইস্কুল বাড়ির দখল নেয়, বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশন। ওদের প্রাথমিক বিভাগটা দীর্ঘদিন এখানেই বসত। তাঁরা চলে যাবার পরও কি যেন একটা স্কুল বসত এই বাড়িতে। বর্তমানে খণ্ডিত ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে এক ফালি অংশ। বাকিটুকুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কুৎসিত বহুতল। ঐতিহ্য বেচে ফ্ল্যাট কিনেছে হাওড়া বাসী। নাকের বদলে নরুন। 


 আর এগোলে, মা কালীর মন্দির আর বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্যামাশ্রী সিনেমার গায়ে ধাক্কা খাব আমরা। এখান থেকে ডান দিকে বেঁকে যাব আমি। রিশেপশনের ছেলেটা বলেছে, আইসিইউ এর ভিজিটিং আওয়ার আধঘন্টা মাত্র।  অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় আছে জননী আমার। আসছি মা, আর দু মিনিট মাত্র। একটু দাঁড়াও প্রিয় শহর, আধেক ঘন্টা পর, ওষুধপত্র কিনে পৌঁছে দিয়ে আবার এ পথেই তো একলা ফিরব আমি। ফিরব অধীর আগ্রহে বসে থাকা এক ভীতু বৃদ্ধের কাছে, বউকে বড় ভালোবাসে যে সে, জানতে চায়, শুনতে চায় বিশদে,  কেমন আছে তার আব্দেরে আলুভাতে গিন্নি। খুব দ্রুত ফিরতে হবে আমায়, আর একলা ফিরতে আমার যে বড় ভয় করে-। প্লিজ পাশে থেকো-

Friday 9 July 2021

অনির ডাইরি ৯ই জুলাই, ২০২১



এই তো মার্চ মাসের কথা, মায়ের জন্মদিন ছিল সেদিন। বাবার অগোছালো ঘরে জামাই বরণের সঙ্কোচকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সদলবলে কেক কাটা হল।  উঠল গোছা গোছা ছবি, নিষেধাজ্ঞা জারি হল সামাজিক মাধ্যমের ওপর। সৌজন্য- মায়ের আজন্ম  লালিত সঙ্কোচবোধ। ছিঃ লোকে দেখলে কি বলবে? ভূতের আবার জন্মবার! 

মাতৃআজ্ঞা আমার শিরোধার্য বটে, তুড়ি মেরে, বাবা অবশ্য দিব্যি পোস্ট করেছিল ফাটিয়ে। নেহাৎ ট্যাগাতে জানে না। সোমাদির হোমবেকড ডার্ক চকলেট কেকের ওপর সাঁটানো আমার মা- আর আমার মেয়ের মিষ্টি মিষ্টি ছবি। প্রথম চোটে তো বাবা- মা বা পিসি বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে, ছবিটাও খাওয়া হবে। টুকরো টুকরো হবার পর, মায়ের ছবির অংশটার ওপর লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তুত্তুরী, হাত বাড়াবার আগেই, ‘আমার বউ’ বলে খপ করে তুলে নিল বাবা। 

মাত্র কমাসেই বদলে গেছে কত কিছু। না, লকডাউন বা বর্ধিত তেলের দাম নয়, বদলে গেছে আমাদের বাচ্ছাগুলো, তালগাছের মত লম্বা হয়ে গেছে বুল্লুটা।  খোলতাই হয়েছে গায়ের রঙ, বেপাত্তা হয়েছে শরীরের যাবতীয় স্নেহ পদার্থ। গলা না ভাঙলেও, আমাদের জেলার ভাষায়  সিড়িঙ্গে, তাল ঢ্যাঙা হয়ে উঠেছে ছেলেটা। বললেই বুল্লুর বাপের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে আমার বাপ বলে, ‘হবে না। পড়া পড়া করে পেঁদিয়েই লম্বা করে দিল ছেলেটাকে-’।  যেন মা আমাকে কম ইয়ে করেছে, তাও যে কেন ----(দীর্ঘশ্বাস)। কত যে ভুল ধারণা থাকে মানুষের, তুত্তুরীর যেমন মনে হয়, ওর গালের যাবতীয় বেবি ফ্যাট নাকি আমার চপেটাঘাতেই ঝরে গেছে। যেন মা আমাকে চপেটাঘাত কিছু কম করেছে- তাও তো----(দীর্ঘশ্বাস)। এখন এসব বলতে বসলেই তো গোঁসা হবে মায়ের,  ছিটকে আসবে যাবতীয় তির্যক মন্তব্য,  ‘হ্যাঁ, জানি তো। মা খুব খারাপ। যত দোষ তো মায়েরই। দাঁড়া, মা যেদিন থাকবে না- ’। কি আশ্চর্য শুনতে শুনতে বড় চেনা মনে হয় শব্দ গুলো, আজ সকালেই কাকে যেন বলছিলাম- ‘মা না থাকলে বুঝবি-’।

Thursday 8 July 2021

অনির ডাইরি ৭ই জুলাই,২০২১

 

    ‘চা খাবে দিদি?’ দিদি অর্থাৎ বাবার দিদি, আমার সবে ধন নীলমণি একমাত্র পিসি। বাপের বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই খুড়তুতো ভাই শ্রীমান অয়ন চিৎকার জোড়ে, ‘ও দিদি, তোমার ঝুনু এসেছে-’, আর পিসিও ওমনি ধড়মড় করে নেমে আসে দোতলা থেকে। এসেই প্রথম প্রশ্নটাই করে, ‘কখন এলি? কটা দিন থাকবি তো?’ এই ‘কটা দিন থাকবি তো’ তে মাখানো থাকে বুড়ি পিসির একরাশ আকুতি। বেশীর ভাগ দিনই ঝটিকা সফরে যাই, আর যেদিন থাকব বলি, পলকে পিসির মুখে জ্বলে ওঠে সাবেকী একশ ওয়াটের এক ডজন বাল্ব। 


 এই তো সেদিন পর্যন্ত, জমজমাট প্রভাতী চায়ের আড্ডা বসত আমাদের একতলার বৈঠকখানায়, বাবা-মা আর পিসি। কথায়, কথায় লেগে যেত দুই ভাইবোনের তুলকালাম, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে উদ্যত হলেই, ভাইবোনের উত্তপ্ত বাদানুবাদের ওপর গরম চা ঢেলে দিত মা। চাটুজ্জে বাড়ির ছেলেপিলেরা বড্ড চাতাল। আজও পরিস্থিতি মেঘলা দেখেই চায়ের প্রস্তাব দিলাম আমি, যত বেয়াড়া-বেখাপ্পাই হোক না সময়, এক কাপ চায়ে সব ঠাণ্ডা।  


টলটলে কাঁচের কাপে সোনা সোনা রঙা সুগন্ধী চায়ের  লিকার ঢালছি, সিগারেট ধরানোর অজুহাতে বাবা এসে কানে কানে বলে গেল, ‘দিদি কিন্তু জিঞ্জার বিস্কুট খেতে খুব ভালোবাসে। নিষেধ করলেও শুনবি না। আর একটা নয়, দুটো করে দিস। ’ কিটকিটে মিষ্টি আদা গন্ধী বিস্কুট আমার দু চক্ষের বিষ, কিন্তু এ বাড়িতে সবার প্রিয় মশলাই হল আদা। ঠাকুমা যে কিসে আদা দিত না, ভগবান জানে, মায় টমেটোর চাটনিতেও। একবার তো পিসি আমার অমলেটেও এক ছটাক আদা দিয়েছিল বলে যা হল্লা করেছিলাম, বাপরেঃ।  


সেই গল্প শুনতে শুনতে পিসির গালে লাগে লালিমা। ‘ ধন্যি মেয়ে ছিলি বাবা তুই। চান না করালেই নাক দিয়ে রক্ত পড়ত, আর ভালো করে তেল মাখিয়ে চান করালেই জ্বর আসত তোর। আর মা (মানে আমাদের স্বর্গীয়া ঠাকুমা) আমায় ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিত।’ আমরা তিন খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন আমাদের ঠাকুমা-পিসির কাছেই মানুষ। মা এবং ছোট কাকি উভয়েই ছিলেন সরকারী কর্মচারী, মাতৃত্বকালীন অবকাশ শেষ হবার সাথে সাথেই দুধের বাচ্ছাকে শাশুড়ী-ননদের কাছে রেখে আপিস যেতে বাধ্য হতেন তাঁরা। উভয়েই বাচ্ছা দেখার লোক রাখতে চেয়েছিলেন, এমনকি মা তো আমাকে একদিন নীল রঙা বালতি ব্যাগে করে আপিসেও নিয়ে গিয়েছিল নাকি। বাড়ি ঢুকতেই ঠাকুমার সেই বিখ্যাত ঝাড়। 


একটা বাচ্ছা সামলাতেই লোকজন নাকের জলে, চোখের জলে হয়ে যায়, আমাদের ঠাকুমা-পিসি তিন-তিনটে ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’  কি ভাবে যে সামলাত ওরা বাপরেঃ। 


অতীতের গল্পে কেমন যেন হারিয়ে যাই আমরা, সেই যে সেবার ঝুটো মুক্তোর হারটা ছিঁড়ে ফেলে কেঁদে ভাসিয়ে ছিলাম আমি। একটাই তো ইমিটেশন গয়না ছিল আমার, পাঠশালার মোড়ের সোনা ইমিটেশন থেকে মায়ের কিনে দেওয়া তিন ছড়া মুক্তোর মালা। সব বিয়ে-শাদি অনুষ্ঠানে ঐটাই গলায় পরিয়ে নিয়ে যেত মা, সেটাই ছিঁড়ে ফেললাম? হায়!হায়! বেঁচে থেকে আর লাভ কি?  এমনিতেই আপিস থেকে ফিরে কোতল করবে মা। ঠাকুমাকে একটু ভয় পেতাম থুড়ি সমীহ করতাম আমি, যা প্রবল ব্যক্তিত্ব ছিল ভদ্রমহিলার, কিন্তু পিসি, পিসি ছিল আমার সবথেকে নরম কুশন, সারাদিন পিসির পিছনে ঘুরছি আর কাঁদছি, ‘ও দিদি, কি হবে গো?’ পিসি ভুলোনোর অনেক চেষ্টা করে, শেষে বলল, ‘কি আর হবে? তোর মা এলে বলবি, আমি ছিঁড়ে দিয়েছি। ’ শুধু কি হার? আমার মেয়েবেলায় করা যাবতীয় অপাটের দায়ভার স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিত পিসি। ‘মা এলে বলিস, আমি করেছি’ এর থেকে বড় স্বস্তিবচন কিছু ছিল না আমার ছোটবেলায়। মা অবশ্য একটিবারও বিশ্বাস করত না এবং যথারীতি উদোম ঠ্যাঙাত। তবে সে তো অন্য গল্প। 


 আমার আর পিসির বৈঠকী গল্পে বারবার ঢুকে পড়ে বাবা, আমরা বিশেষ পাত্তা দিই না, তাও। খালি হয়ে যায় চায়ের কাপ, এঁটো কাপ তুলে নিয়ে যায় মা, নামে ক্ষণিক বিরতি। সবাই নিজের নিজের মত করে হারিয়ে যাই অতীতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে পিসি, ‘আমি তোর বাবাকে জন্মাতে দেখলাম সেদিন, আর আজ তোর মেয়ে কত বড় হয়ে গেল রে-। তাহলে ভাব, কত বয়স হল আমার! ’ বয়স বাড়ানোটা ঠাকুমা এবং তাঁর পুত্রকন্যাদের বৈশিষ্ট্য। ঠাকুমার বয়স মাসে মাসে বাড়ত। শেষে বাবা একবার ধমকে বলেছিল, ‘আচ্ছা মা, তুমি কি বাবার থেকেও বয়সে বড় ছিলে? বাবার জন্ম ১৯০৫ সালে, বেঁচে থাকলে বাবার বয়সই ৯০ হত না। তোমার হয়ে গেল কি করে?’ 


অভিমান ভরে এত ক্ষণ দূরে বসেছিল বাবা, ছদ্ম মনোযোগ দিয়ে ব্যস্ত ছিল হিসেবনিকেশে। ধীরে ধীরে উঠে এসে জমিয়ে বসল আমাদের সামনে, আয়েস করে ধরালো আরেকটা সিগারেট। ‘দূর!বিরক্তিকর’ বলে উঠে গেল মা। বাবার এই সারাদিন ধরে গোছা গোছা সিগারেট টানাটা আমাদের সবথেকে বড় অশান্তির দ্যোতক। বলে বলে ক্লান্ত সবাই।  বাবা যথারীতি পাত্তা দিল না, এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘তবে আমারও একটা গল্প আছে, যেটা কেউ জানে না। এমনকি দিদিও নয়।’ একটু আগের তর্কাতর্কি ভুলে উদগ্রীব হয়ে বসল দিদি, বাবা আবার ধোঁয়া ছেড়ে বলল,‘ তখন আমি বোধহয় ক্লাশ নাইন বা টেন এ পড়ি। একদিন সন্ধ্যে বেলা হঠাৎ হাবু এসে হাজির। হাবু আমার সাথে স্কুলে পড়ত, ক্লাশ ফোর এ ফেল করে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়।  আমাদের  বাড়ির পিছন দিকের গলিতেই তখন থাকত ওরা। হাবু ছিল মেজো ভাই। ওর বড় দাদা, সুকুমার দা থিয়েটার করত। তাকে দেখতেও ছিল তেমন সুপুরুষ। টকটকে গৌর বর্ণ, ছিপছিপে চেহারা, তিরতিরে চোখ-নাক-মুখ। শ্যামলী নাটকে, খোদ উত্তম কুমারের সাথে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিল। যদিও সাইড রোলে। 


সুকুমার দার ইচ্ছে ছিল সিনেমায় নামার। পরিচিতিও হচ্ছিল একটু একটু করে।  তারপর কি যে হল, হঠাৎ একদিন বেপাত্তা হয়ে গেল সুকুমার দা। হাবুদের বিশাল পরিবার, কোন মতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আসেপাশে সামান্য খোঁজখবর করল কদিন। তারপর ধামাচাপা পড়ে গেল। 


 বছর কয়েক বাদে হঠাৎ একদিন উদয় হল সুকুমার দা।সঙ্গে এক অপরূপা রমণী। জানাল ওর স্ত্রী। সঙ্গে দামী দামী বিলিতি  উপহার এনেছিল সুকুমার দা। আমরা সব দলবেঁধে দেখতে গিয়েছিলাম। বউদি আমাদেরও সবার হাতে একটা দুটো করে বিলিতি চকলেট দিয়েছিল। 


কদিন থেকে, আবার ওরা ফিরে গেল কর্মস্থলে। সেটা কোথায়? কেউ জানে না। এর কিছুদিন পর, এক বর্ষার সন্ধ্যায় হাবুদের বাড়িতে কড়া নাড়ে ব্যাঁটরা থানার পুলিশ। গঙ্গার ওপাড়ে ওয়াটগঞ্জে এক বেওয়ারিশ লাশ উঠেছে, তাকে সণাক্ত করতে যেতে হবে। বাড়িতে পুরুষ বলতে হাবু একা। তার বয়স কতই বা হবে? আমারই সমান।বড়জোর বছর ষোল। 


বাড়ির সামনে পুলিশের জিপ দাঁড় করিয়ে আমায় ডাকতে এসেছে হাবু। বাবাকে বললাম, বাবা বলল, ‘অবশ্যই যাবে। ফেরার সময় পুলিশের জিপটাকে বোলো যতটা বাড়ির কাছে পারে যেন নামিয়ে দেয়-’। আমরা গেলাম, অত রাতে ওয়াটগঞ্জ থানা। বডি থানায় নেই, বডি আছে মর্গে। বড়বাবু আমাদের বসতে বলে সবাইকে বার করে দিল। তারপর দরদী সুরে বলল, ‘মর্গে গিয়ে দেখো। যদি পরিচিত কারো হয় ও, তাও স্বীকার করার দরকার কি? তোমার বাড়িতে চারটে আইবুড়ো বোন- কখন কার কি বিপদ হয়ে যায়-’। 


আমরা পুতুলের মত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম। বর্ষার ভিজে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে জিপ ছুটল মর্গে। কেমন যেন ভৌতিক পরিবেশ। একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে, গম্ভীর মুখে এক সেপাই  আমাদের নিয়ে গেল লাশ আইডেন্টিফাই করাতে।সাদা কাপড়টা সরাতেই, চোখের সামনে উলঙ্গ সুকুমার দার দেহ। জায়গায়, জায়গায় খুবলে খেয়েছে মাছে, তবুও দিব্যি চেনা যায়। হাবু খানিক টলে গেল, তারপর হড়হড় করে বমি করে দিল। নিজেকে সামলে বলল, মৃত ব্যক্তিকে চেনে না। ’ 

‘সেকি?’ এক সাথে বলে উঠলাম পিসি আর আমি। তাহলে তো লোকটার নূন্যতম সৎকারও হবে না। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পুড়িয়ে দেবে বা গর্তে পুঁতে দেবে। সিগারেটে লাস্ট টান মেরে বাবা বলল, ‘সে রাতে বড়বাবুর মুখেই শুনেছিলাম যে, সুকুমার দা আর ঐ ভদ্রমহিলা দুজনেই নানা বেআইনি কাজের সাথে জড়িত ছিল। ওদের কাজই ছিল স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন হোটেলে ওঠা, তারপর সেখান থেকে অপারেশন চালানো। এই করতে করতেই দুজনের মধ্যে প্রেম। বিয়ের পর ওরা ঠিক করে ঐ পাপের কাজ ওরা আর করবে না। যা টাকাপয়সা আছে তাই দিয়ে সাধারণ, শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করবে। কিন্তু গ্যাং এর লোকেরা সেটা আর হতে দেয়নি। পুলিশের ধারণা, দুজনকেই মেরে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ভদ্রমহিলার দেহ আর মেলেনি। হয়তো ভেসে গেছে সাগরে, অথবা-। ’ আমাদের সাধের চায়ের আড্ডায় নামে থিকথিকে মনখারাপী কুয়াশা। বহুযুগ আগে মৃত এক তরুণ দম্পতির জন্য ব্যথায় মুচড়ে ওঠে হৃদয়।  কেন যে এমনি হয়, ফিরে আসতে চাইলেও, কেন যে ফিরে আসতে পারে না মানুষ। কেন যে সুযোগ দেয় না জীবন- কে জানে!

Monday 5 July 2021

অনির ডাইরি ৫ই জুলাই,২০২১

 অনির ডাইরি ৫ই জুলাই,২০২১


মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা, তখন আমি এএলসি খড়্গপুর। সুকন্যা ঝাড়গ্রামের রাণী আর দেবুর ভাগ্যে শীলাবতী আর ঘাটাল।  ডিএলসি স্বর্গীয় শৈবাল বিশ্বাস সাহেব। শুক্রবার করে শৈবাল দা মিটিং ডাকলে সে যে কি পৈশাচিক আনন্দ হত, তা বলার নয়। ভুজুং ভাজুং দিয়ে চারটের মধ্যে, বা পারলে তারও আগে যদি মিটিংটা শেষ করা যায়, তাহলে খড়্গপুরের বিখ্যাত পূজা মলে ঢুঁ মেরে, টুকটাক উয়িন্ডোশপিং সেরে, মাসের শুরুতে হলে, গলা কাটা সিসিডি, না হলে সস্তা ফুড কোর্টে সর্ষের তেলের গন্ধ ওয়ালা সেউ ভাজা দিয়ে পাপড়ি চাট সাঁটিয়ে, দেশ দুনিয়ার পরনিন্দা আর পরচর্চা করতে করতে সোজা কলকাতা। তেমনি ফিরছি, নতুন বরের ফোন। ' আমার লালবাগ অর্ডার হচ্ছে। ' 


অ্যাঁ? সে কি? অর্ডার অর্থাৎ বিডিও পোস্টিং এর অর্ডার। সে তো অনেকদিন ধরেই শুনছি, এই বেরোল বলে-এই বেরিয়েই গেল- আজ অবশ্যই বেরোবে- যাক আজও বেরোল না। অবশেষে তিনি প্রসূত হচ্ছেন বটে, তাই বলে লালবাগ? একজন খড়্গপুর- আর একজন লালবাগ? 


নাঃ, আর পাঁচটা বিবাহিত দম্পতির মত গার্হস্থ্যজীবন বোধহয় আমাদের স্বপ্নই থেকে যাবে। লালবাগে  আমার পোস্টিং জীবনেও হবে না।  ২০০৯ সালে লালবাগ মহকুমায় আমাদের কোন অফিসই ছিল না যে। সবথেকে কাছের লেবার আপিস বলতে বহরমপুর এবং সেখানেও কোন জায়গা ফাঁকা নেই। 


মনে হয় এই তো সেদিন, দীর্ঘ রুদ্ধশ্বাস নাটকের পর অবশেষে স্পাউজ-পোস্টিংকে মান্যতা দেখিয়ে বিডিও খড়্গপুর-২ হিসেবে জয়েন করল শৌভিক। হিমেল পয়লা ডিসেম্বরের সন্ধ্যায়, এক ব্যাগ জামাকাপড় নিয়ে মাদপুরের বিডিও কোয়ার্টরে আমাদের গৃহপ্রবেশ। এই তো সেদিন ভাগ করে বাসন মাজতাম আমরা। ভোর বেলা ঘুম ভেঙে উঠে রাতের এঁটো বাসন মাজার দায়িত্ব ছিল আমার, আর সন্ধ্যা ঘনালে, আপিস থেকে ফিরে দিনের ভিজিয়ে রাখা বাসন মাজতে বসত শৌভিক। এমনি এক সন্ধ্যায়, চিত্রদীপদা ফোন করেছে, শৌভিকের হাত ভর্তি ভিম লিক্যুইডের ফেনা। আদিষ্ট হয়ে ফোন ধরে যেই না বলেছি,‘শৌভিক বাসন মাজছে, হয়ে গেলে ফোন করবে তোমায়-’, সে কি হাসি চিত্রদীপদার। বাপরেঃ

ব্লক উইথড্রয়াল নিয়ে, প্রতি সন্ধ্যায় কি হিসেব নিকেশই না করত দুই ব্যাচমেটে। কবে শেষ হবে এই বিডিওগিরি। 


দেখতে দেখতে দু-দুটো ব্লকের বিডিওগিরি শেষ করে, হুগলীর ওসি ইলেকশন গিরি সামলে, উত্তর কলকাতার ইলেকশনের গুরু দায়িত্ব সামলে এবার তমলুকের এসডিও হবার পালা। সত্যি কি ঝড়ের মতই না কেটে যায় সময়। অনেক অনেক শুভেচ্ছা, Shouvik Bhattacharya  । দেখো, পাক্কা এক যুগ পেরিয়ে জীবন কেমন আবার আমাদের এনে দাঁড় করিয়েছে সেই একই পথের বাঁকে-।