Sunday, 26 March 2023

অনির দোলের ডায়েরি ৬ই মার্চ, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


প্রতিবছর ন্যাড়াপোড়াটা আমাদের দোলের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর ন্যাড়াপোড়া মানেই হাওড়া। আমার বেড়ে ওঠার শহর। যে শহর দিয়েছে আমায় শৌভিক। যে শহরে প্রথম ঘুম ভেঙেছে আমার তুত্তুরীর।দূষিত হলেও, ঘিঞ্জি হলেও, আমার প্রাণের শহর। 


দোলের ছুটি পড়ার আগের শেষ কর্ম দিবসে, এক আঁচল রঙ খেলে, ঠিক সন্ধ্যের নামার মুখে সকন্যা হাওড়ায় গিয়ে হাজির হতাম আমি। বৈঠকখানার বড় কাঠের দরজাটা খুলে, উন্মুখ হয়ে আমাদের প্রতীক্ষায় থাকত বাবা আর মা।


ঢুকেই আগে হাঁকতাম, ' মা চা করো।' তারপর কোন মতে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে, আবিরে ফাগে জবরজং শাড়িটা বদলে, আমরা লেগে পড়তাম ন্যাড়াপোড়ার জোগাড় করতে। ওই স্বল্প আলোতেই, দুটো ঝাঁটা নিয়ে, পূব আর পশ্চিমের বাগান ঝাঁটিয়ে যত শুকনো পাতা জোগাড় করত তুত্তুরি আর বুল্লু বাবু। অনেক সময় প্রতিবেশীদের বাগান থেকেও চুরি করে আনতো, ঝরে পড়া শুকনো নারকেল পাতা। চোখের সামনে দিয়ে, ঝরা পাতা নিয়ে যেত চোরেরা, দাঁত বার করে হাসত গেরস্ত। আজব পাড়া মাইরি আমাদের। আজব শহর মাইরি, আমাদের হাওড়া।


 অতঃপর, পশ্চিমে দিকে,  বাবার এক ফালি ছোট্ট বাগানে, মরে যাওয়া বেলগাছের একপাশে, স্তূপাকারে জমা করা হতো সেই সব শুকনো পাতা। তার ওপরে ফেলা হতো যত অপ্রয়োজনীয় কাগজ, পুরানো খাতা, দস্তাবেজ, ফেললু জিনিসপত্র। আর তারপর? তারপরের সময়টা ছিল শুধুই প্রতীক্ষার।


থেকে থেকে আমার দুই খুড়তুতো ভাই, অয়ন আর অনিন্দ্যর মোবাইল নম্বরে ফোন করতো তুত্তুরী। "ও বড় মামা। ও ছোট মামা। বলি কখন আসবে তোমরা? জলদি এসো প্লিজ। নাহলে যে আমরা চাঁচড় পোড়াতেই পারছি না।"  সেই যে সেবার অয়ন গিয়েছিল বাঁকুড়া। কথা ছিল বিকাল বিকাল পৌঁছে যাবে বাড়ি। ট্রেন লেট করে, ঢুকতে ঢুকতে গড়িয়ে গেল রাত দশটা, রাত দশটা অবধি আমরা সপরিবারে গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করে গেছি, কখন আসবে অয়ন, তবে পুড়বে শ্রীমান বা শ্রীমতী ন্যাড়া।


ন্যাড়াপোড়ার সময় হলে, একত্রিত হত বাড়ির প্রতিটি সদস্য। বাবা,মা,পিসি,অয়ন,চৈতি,অনিন্দ্য বুল্লু বাবু, তুত্তুরী এবং আমি। বেচারা ন্যাড়া, দোল পূর্ণিমার আগের রাতে, হালকা বাতাসে অল্প একটু শরশর্ শব্দ করা ছাড়া,  মোটামুটি নীরবেই দাঁড়িয়ে থাকত। খবরের কাগজ গোল করে পাকিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে তার গায়ে আগুন লাগাতো শ্রীমান অয়ন। দেশলাই বা লাইটার সরবরাও করত আমার বাপ। ধীরে ধীরে একটু একটু করে জ্বলতো ন্যাড়া, তুত্তুরী আর বুল্লুবাবুকে সটান পাঁচিলের ওপরে তুলে দিত অনিন্দ্য, আর সপরিবারে আমরা জুড়তাম প্রবল হল্লা। 


আমরা হাওড়াবাসীরা বলতাম

" আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল। 

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরি বোল।" 


আর আমার মুর্শিদাবাদী মা বলতো, 

" আজ আমাদের নেড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল।

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, পাড়ায় গন্ডগোল।"


হাওড়া আর মুর্শিদাবাদের উদ্দাম ঝগড়ায় রেফারির হত আমার বাবা। আমাদের সম্মিলিত চিৎকার ছাপিয়ে শোনা যেত বাবার উল্লাসী আওয়াজ, " লে পচা----"। এক চোট থমকে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত সকলে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতো পিসি, " তোর যত উল্টোপাল্টা কথাবার্তা কেবল হিটলার।"


ইদানিং কানে আর তেমন কিছুই শুনতে পায় না পিসি। একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে বললে তবে হয়তো বুঝতে পারে। বাবারও ফুসফুসের সে যোশ আর নেই। স্বাস্থ্যটা ভালো যাচ্ছে না মায়ের ও। এবারে দোলে হাওড়া যায়নি আমরাও। 


আসলে মনটাই ভেঙ্গে গেছে। এইতো সেদিন দেখা হল মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। সম্পর্কে আমার ভাই বউ, চৈতীর বাবা। বুল্লু বাবুর পৈতেতে এসেছিলেন সপত্নিক। ছিলেন বেশ কয়েকটা দিন। বুল্লু বাবুর পৈতের যাবতীয় আচার তো আমরা মাসিমাকে অনুসরণ করেই পালন করলাম। উনি যে ভাবে বললেন,উনি যা বললেন, উনি যখন বললেন। বাড়ি ফিরে যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই যে এইভাবে একবেলার জ্বরে যে চলে যাবেন ভদ্রলোক আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। বিনা মেঘে বজ্রপাত একেই বলে বুঝি। 


এমতবস্থায় শ্রীমতি তুত্তুরীর,মন ভালো রাখার জন্যই ন্যাড়া পোড়ার কথাটা তুলেছিলাম। বাগানে প্রচুর শুকনো পাতা তো পড়েই থাকে, তাদের কয়েকটাকে একত্রিত করে আগুন ধরিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে গেল। ন্যাড়াও পুড়ল, নটে গাছটিও মুড়াল। সমস্যা বাধালেন মহকুমা শাসক স্বয়ং। ওনার অনুমতি ছাড়া, ওনার লোকজন কি আর আমার কথা শুনবে? সকাল থেকে লিটার-লিটার, গ্যালন-গ্যালন তৈল মর্দনের পর অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় গররাজি হলেন তিনি। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে, সাধ্যাতীত করলেন আমাদের রঞ্জিত বাবু আর তুত্তুরীর মাসি।এত ভালো ভাবে, এত উপাচার সহযোগে কোনদিন পোড়েনি আমাদের ন্যাড়া। পুড়ল বটে, আনন্দও হল খুব।কিন্তু কোথায় যেন রয়ে গেল খানিকটা বিষন্নতা আর অনেকটা অসম্পূর্ণতা। পরিবার ছাড়া কি আর উৎসব জমে? 

যাই হোক, সকলকে দোল পূর্ণিমার অগ্রিম শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই। ভালো কাটুক আপনাদের দোল। রঙিন হোক আগামী প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।

No comments:

Post a Comment