Saturday 11 February 2023

অনির ডাইরি ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


ছোট থেকে বাবা শিখিয়েছে,‘প্রত্যাশাতেই যন্ত্রণা’। এতদসত্ত্বেও কেন যে বারবার প্রত্যাশা করেই ফেলি। সিস্টেমের কাছে প্রত্যাশা করি সংবেদনশীলতা, সময়ের কাছে কখনও প্রত্যাশা করি দ্রুততা, তো কখনও বা ধীরতা। খেতে বসে প্রত্যাশা করি মুখরোচক কিছু। যা স্বাদে হবে অমৃতসম অথচ ক্যালরি থাকবে গ্রীন টি তুল্য। বাসের কাছে প্রত্যাশা করি সিট। রাতের কাছে প্রত্যাশা করি নিশ্ছিদ্র ঘুম। কিন্তু তার কি যো আছে।


 ভগবান জানে রোজ রাতে কার কার মনে পড়ে আমার বরের কথা। গতরাতেই তো পৌনে বারোটা নাগাদ  ফোন করেছিলেন জনৈক উকিল বাবু। কি অসাধারণ জাঁকিয়ে এসেছিল ঘুমটা। ধড়মড় করে উঠে বসে ভাবলাম নির্ঘাত কোন মাতাল। অচেনা নম্বর দেখে শৌভিকও বলল,‘তাই হবে।’ ধরার পর দেখা গেল ভদ্রলোক শৌভিকের পূর্ব পরিচিত। তমলুকে থাকতে নিত্য যোগাযোগ ছিল। ফোন ধরা থেকে ছাড়ার মধ্যে সময় কাটল পাক্কা দশ মিনিট। পুরোটাই চলল আমার কানের গোড়ায়। কি নাকি সাংঘাতিক কেস ঠুকেছে কে, বিবাদী পক্ষের অগ্রগণ্য মহকুমা শাসক কাঁথি। ফোন রেখে শুতে শুতে আমার বর বলল,‘লোকটা ভালো। বুঝলি তো।’ 


এরকম হাড় জ্বালান ভালো লোকেই ভর্তি আমার বরের জীবন। আমার জন্য সময় কোথা। যেটুকু সময় পায়, সেটাও কাটে আমার খুঁত ধরে, যেমন ধরুন -'বিছানায় ভিজে তোয়ালে রাখলি কেন?' 'সেই আমার চশমার ওপর ব্যাগটা রাখলি!' যেমন ধরুন 'তুই তো বসিস না, তোর পতন হয়। তাই বলে আমার ফোনের ওপর পড়বি?' ইত্যাদি প্রভৃতি। ঘুরিয়ে আমি যেই মুখ খুলি ওমনি শুনতে হয়,‘ তুই কিন্তু একটুও ঘ্যানঘ্যান করছিস না।’ ধুর ধুর। শাশুড়ী মা ঠিকই বলেন, বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই। 


আমার বদমেজাজ, আমার ধমক, আমার বকবক শোনে একমাত্র উত্তমকুমার। প্রতি তিনদিনে একবার যাকে আমি তাড়িয়ে দিই পাঁচমিনিটের জন্য। পাঁচ মিনিট পর অবশ্য আবার ডেকে আনি এবং রসগোল্লার পায়েস খাওয়াই। আজ বাস থেকে নেমে গাড়িতে উঠতেই উত্তমকুমার বলল, ‘এই বেলা ফাঁকায় ফাঁকায় নিমতৌড়ির ঠাকুরটা দেখে আসবেন চলুন ম্যাডাম।’ অফিসের পাশেই বিশাল ভীম পুজো। সন্ধ্যে নামলে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। সকাল বেলা অবশ্য ফাঁকা ময়দান। তবে গাড়ি ঢুকল না। নেমে খানিক হেঁটে ঠাকুর দেখতে হল। দুপাশে অসংখ্য দোকান। সাজিয়ে বসেছে পসরা। ভাজা হচ্ছে গরম জিলিপি,বোঁদে, গুড় কটকটি আর খাজা। ফেরার পথে লোভ সংবরণ করতে না পেরে কিনেই ফেললাম এক কিলো। উত্তমকুমার যদিও আপত্তি করছিল,‘ কিনবেননি ম্যাডাম। আজ আবার ওবেলায় অমিয়দার বাড়ি নিমন্ত আছে।’ 


অমিয় বাবু আমাদের গাড়ির মালিক। গত সপ্তাহে একদিন কাঁচুমাচু মুখে এসে নিমন্ত্রণ করে গেছেন বটে। ওণার বাড়িতে প্রভুপাদ আসবেন। নামগানের আসর বসবে। তার সাথে সাথে ওণার মেয়েরও জন্মদিন। যদি লেবার দপ্তরের লোকজন একটু পদধূলি দেয়। আমি ভেবেছিলাম বিলের কথা বলতে এসেছেন বুঝি। গরীব শ্রম দপ্তর। ধারবাকিতে অফিস চলে। সব সময়ই পাওনাদারদের ভয়ে শঙ্কিত থাকি। তাগাদার পরিবর্তে নিমন্ত্রণ পেয়ে রীতিমত গলে গেলাম। শুধু নামগান হলে যেতাম না হয়তো, মেয়ের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করি কেমনে। 


চাঁদা তোলা এবং উপহার কেনার দায়িত্ব সামলান মূলতঃ আমাদের হক বাবু। কিছুদিন ধরে সুগারে প্রেসারে কিঞ্চিৎ কাবু লোকটা। মাঝে দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে ভুবনেশ্বর গিয়েছিলেন, এইমস্ এ দেখাতে। এদিকের লোকজন স্থানীয় ডাক্তার বা কলকাতার হাসপাতাল- ডাক্তারদের থেকে অনেক বেশী ভরসা করে এই এইমস্ কে। অফিসে ঢুকে হক বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম  ভুবনেশ্বরের এইমস্ কি ওণাকে মেলার খাজা খাবার অনুমতি দিয়েছে।


আহাঃ, যেমন গরম তেমনি মোলায়েম খাজাগুলো। মুখে দিতেই যেন মিলিয়ে যায়। দোকানদারের কাছে প্রত্যাশা ছিল দুটো ফাউ দেবে। যথারীতি প্রত্যাশাতেই যাতনা। তিনি বললেন, ‘কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে দোকান দিইছি দিদিমনি। ফাউ দি কেমনে?’ বাপরেঃ। জিজ্ঞাসা করলাম এত টাকার আদৌ বিক্রি হয় কি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,‘ সেই তো।’ উত্তমকুমার যদিও বলল,‘এই বুড়া গুলোর কথায় একদম বিশ্বাস করবেননি ম্যাডাম। অবশ্যই লাভ হয়। নইলৈ কেউ ঘরের টাকা দিয়ে দোকান দেয়-’।


দুপুরে খাবার নিমন্ত্রণ। পূব মেদিনীপুরে এই সময় বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরণের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও কৃষ্ণ তো কোথাও কালির নামে। সারা গ্রামের নিমন্ত্রণ থাকে। উত্তম বলে এই সময় নিমন্ত্রণ কর্তা ছাড়া অন্য কারো বাড়ি হাঁড়ি চড়ে না। কুটুম এলেও তাকে নিয়ে চলে আসে নিমন্ত্রিত বর্গ। নিমন্ত্রণ কর্তা যা খাওয়ান, তাই সবাই মাটিতে বসে তৃপ্তি করে খায়। গ্রামের ছেলে পিলেরাই পরিবেশন করে দেয়। উত্তম যেমন সকাল থেকেই বলছে,‘আজ যদি আমি থাকতাম নি ম্যাডাম, অমিয়দার বাড়ি, সব পরিবেশন আমিই করে দিতাম। হুহু করে পরিবেশন করতাম, হুহু করে পাতা গুড়াতাম।’ পাতা গুড়ানো মানে এঁটো পাতা তোলা। 


আমি আজ অবধি ঐ কাজটায় স্বচ্ছন্দ নই। প্লেট যাও বা তুলে নিতে পারব,উচ্ছিষ্ট ফেলতে বমি এবং কান্না পায়। ‘না না বিয়ে শাদি ঐসবের পাতা গুড়াতে হলে আমারও বমি পায় ম্যাডাম। ওসব করি না। পুজো- নামগানের সময় গুড়াই। পূণ্যি হয় কি না।’ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উত্তমকুমার। বেরোতে একটু দেরী হয়েছে। সূর্য মধ্য আকাশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পশ্চিমের দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন। শুধু আমার জন্যই সবার লেট হল। ভুলে গিয়েছিলাম মিটিং ডাকা ছিল। কি ভাগ্যি বেরোবার একটু আগেই এসে হাজির হয়েছিল দুই পার্টি। 


বিগত দশ না পনেরো বছর ধরে অমিয় বাবুর গাড়ি খাটছে এই অফিসে। ফি বছর নিমন্ত্রণ করেন, কিন্তু এর আগে কোন সাহেব/মেম নাকি ওনার গৃহে পদার্পণ করেনি। আমরা সদলবলে খেতে যাব, বলে ওণার আনন্দের সীমা নাই। আমাদের ছোট গাড়িতে সবাই ধরবে না বলে ওনার বড় গাড়িটাও পাঠিয়ে দিয়েছেন।  উত্তমকুমারের গাড়িতে চারজন, বাকিরা পিছনের বড় গাড়িতে। তাও স্থান সংকুলান হয় না।  উপহারের বড় পুতুলটা কোলে নিয়ে বসেছি আমি। বড় মিষ্টি পুতুলটা। উত্তম সমানে বলছে, ‘অমিয়দার মেয়েকে দেখবেন চলুন না, একেবারে অমনি দেখতে। ওর নামও মিষ্টু।’ 


ঘুরে ফিরে আবার পাতা গুড়ানোর গল্পে ঢোকে উত্তমকুমার।‘ আজকাল তো লোকে অনেক ভালো করে খায় ম্যাডাম। ছিবড়া গুলো পাতের এক পাশে রাখে। পাতায় জল ঢেলে হাত ধোয় না। ওসব করলে দেখতেন। পাতা গুড়াতে সব থেকে সমস্যা কোথায় হয় জানেন? মাঠে যখন খাওয়ায়। এবড়ো-খেবড়ো মাটির ওপর পাতা পেতে খায় তো মানুষ-’।  কি হয়? জল পড়ে কাদা হয়ে যায়? জানতে চাই আমি। ‘ হ্যাঁ কাদা তো হয়ই। তারপরে ভাত যেগুলো পড়ে, মাটির সাথে মিশে যায়। একটা একটা করে গুড়ানো, ওরে বাবারে বাবা। কি চাপের কাজ ম্যাডাম।’ 


শহর ছাড়িয়ে শহরতলী থেকে আরো একটু ভিতরে ঢুকি আমরা। বড় গাড়িটা দাঁড়িয়ে যায় খোলা মাঠে। বাকি পথ টুকু সওয়ারিদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। উত্তম বলে,‘বেশী নয়। পাঁচশ মিটার মাত্র। আমার গাড়ির পিছন পিছন হাঁটতে থাকো সবাই।’ আমাদের গাড়িটা যাবে? প্রশ্ন করি আমি। জবাব পাই, ‘আগে তো গাড়িটা এখেনেই রেখে যেতাম ম্যাডাম। এখন বাড়ি লিয়ে যাই।’ উত্তমের বাড়ি কাছেই। ওদেরও সপরিবারে নিমন্ত্রণ। কাল রাতেও ছিল। উত্তমের মা, বউ, ছেলে সবাই নামগান শুনতে এসেছিল। আজও এসেছে। তবে আমাদের যা বেলা হল, নির্ঘাত এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে। 


সরু ঢালাই রাস্তা ধরে টলমল করতে করতে এগোয় গাড়ি। দুদিকে পুকুর। একটু বেসামাল হলেই কেলো। উত্তম বলে,‘এ কি দেখছেন ম্যাডাম। এক পশলা বৃষ্টি হতে দেন। এই রাস্তা এক ফুট জলের তলায় চলে যাবে।’ এখনই পুকুরগুলো যা টলটল করছে, তা হওয়া বিচিত্র নয়। শীতের শেষ দুপুরে মাটির উঠোনে, কমলা-সোনালী রোদের ওমে চুল খুলে গল্প করছে পল্লীবালার দল। যেন পটে আঁকা ছবি। তাদের পাশ কাটিয়ে অমিয় বাবুদের বাড়ি যখন পৌঁছালাম শেষ ব্যাচ খেয়ে উঠছে।


আগে ঠাকুর দেখতে নিয়ে গেলেন অমিয় বাবু। রাধাকৃষ্ণ ততোক্ষণে নিদ্রা গিয়েছেন। কাপড়ের মশারি দিয়ে ঘেরা তাঁদের চারিধার। দোতলায় নিয়ে গেলেন অমিয় বাবু। জুতো খুলতে গেলাম, সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিষেধ করলে। অমিয় বাবুর গিন্নী ভয়ানক রূপসী, মিষ্টি হেসে বললে,‘আজকে সব চলে। এমনিতেই বাড়ির যা অবস্থা। জুতো পরেই আসুন।’ দোতলাটা ভারি সুন্দর, লাল টুকটুকে দালানের একদিকে দু-তিনটে ঘর আর অন্যদিকটা খোলা বারন্দা। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। 


আমাদের আর নীচে বসে খেতে হল না। আমাদের জন্য দোতলায় চেয়ারটেবিল সেট করা হল। অমিয় বাবু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ালেন। ফুলকপি, মটরসুটি,কাজু বাদাম আর চেরি দেওয়া ফ্রায়েড রাইজ, ফুলুরির মত ভেজ পকৌড়া, আলু পটলের দারুণ সুস্বাদু তরকারি, পনীর, সাদা ভাত, ডাল, ইঁচড়ের তরকারি, চাটনি, পাঁপড়, রসগোল্লা আর নবদ্বীপের দই। প্রভুপাদের ঠিক করে দেওয়া মেন্যু। ঠাকুর, এরা বলে পূজারিও কোন বড় আশ্রম থেকে আনা। যোগাড় যন্ত্র অবশ্য প্রতিবেশিনীরাই করে দিয়েছে। জীবনে প্রথম বার নবদ্বীপের দই খেলাম। দারুণ লাগল। সবথেকে ভালো লাগল ওণাদের আতিথেয়তা। বাইরে অবধি ছাড়তে এলেন সপরিবারে। অমিয় বাবুর স্ত্রী আর মা বোধহয় সাড়ে সতেরো বার বললেন, ‘আবার এসো কেমন।’ 


ফেরার পথে আবার সেই একদল গাড়িতে, একদল পদব্রজে। সেই উত্তমকুমারের বকবকম। " আমাদের পাড়ার ভীমটা দেখবেন চলুন।" গতবারও বুরারীর ভীমের দর্শন পেয়েছিলাম, এবার অবশ্য দেখা পেলাম না। সামনেই কি যেন কালি পুজো হবে বলে, উত্তমের ভাষায়, " হায়, ঠাকুরটাকে ফেলে দিইছে?" বার দুয়েক সংশোধন করে দিলাম, বলো বিসর্জন দিয়েছে বা জলে ফেলে দিয়েছে। কে কার কথা শোনে। উত্তমকুমার ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবার কালি পুজোর বিশেষত্ব বর্ণনে। সাতদিন ধরে পুজো হবে, গোটা গাঁয়ের লোক খাবে ইত্যাদি, প্রভৃতি।  ফাঁক পেয়ে ফোন করলাম তুত্তুরীর বাপকে, " হ্যাঁ গো, আজ জেলায় আসবে নাকি?" প্রশ্নের জবাবে ওদিক থেকে ভেসে এল প্রশ্ন, "কেন?" নাহ তাহলে এক পেট খেয়ে আর বাসে করে ফিরতে হয় না। তোমার সাথেই -।" ভেসে এল মৃদু ধমক, " খামোখা তোকে আনতে আমি জেলায় যাব কেন? আমার কাজ নেই? অত খায় না। বাসে ওঠ, রূপসীতে নাম। ওখান থেকে বরং তোকে নিয়ে আসব।" রূপসী বাইপাস থেকে আমাদের নীড়, হেঁটে ১০/১৫ মিনিট, গাড়িতে ৫। ঐটুকু কষ্টই বা কেন করবে আমার বর। আহা গো,তাঁর কি কাজ নেই? করুক,করুক, দেশোদ্ধার করুক মন দিয়ে। শাশুড়ি মা কি সাধে বলেন, কোনই লাভ নেই বুঝলেন কি না।



অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 

যাঁর জন্য এত কিছু। 

গত বছর পুজোর পর বিসর্জন দেওয়া হয়নি ঠাকুরটাকে। আহা কেমন মিষ্টি দেখ মুখটা। বৃষ্টি মাথায় ছোট বাচ্ছার মত কোলে করে নিয়ে এসেছিল তমলুকের মহকুমা শাসকের ড্রাইভার পলাশ। ঝুপ করে যখন এল বদলির অর্ডার, অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের মত স্থানান্তরের প্রয়োজন হল এনারও। আমরা পড়লাম মহা আতান্তরে। কি করি এই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত কি রূপনারায়ণ এর জলেই ভাসিয়ে দিতে হবে তুত্তুরীর সাধের প্রতিমাকে। বাধ সাধল পলাশ। " আমি নিজে পৌঁছে দিয়ে আসব স্যার।" 


 কথা দিল বটে, কথা রাখতে পারল কই! অফিসার বদলে যাবার সাথে সাথে যে হাত বদল হয় গাড়িরও। নতুন মহকুমা শাসকের ডিউটি সামলে ঠাকুর নিয়ে কাঁথি আসা কি অত সোজা। দূরত্ব ও তো কম কিছু নয়। হরেগড়ে প্রায় সত্তর কিলোমিটার। নিরূপায় হয়ে ভাসিয়েই দিতাম হয়ত,যদি না কাঁথি মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবু আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী মান্ডি বাবু বাধা না দিতেন। " অসময়ে বিসর্জন দিবেন কেন ম্যাডাম। আমরা আছি তো। আমরা নিয়ে যাব।" 


আজ ২৬ শে জানুয়ারি, ঠিক সকাল সাড়ে আটটা থেকে বন্ধ গলা পরে, পতাকা তুলবে আমার বর। পতাকা উড়বে বাংলোয়, অফিসে, হেথায়-হোথায়, না জানে কোথায় কোথায়। পাইলট কার এসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে অরবিন্দ স্টেডিয়াম। ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো জিপে চেপে সেথা অভিবাদন নেবে আমার বর। পাবে ২১ টা gun salute। হবে কুচকাওয়াজ। হবে নাচ,গান, বাজনা, আবৃত্তি। ঘুরবে বিভিন্ন দপ্তরের রঙচঙে ট্যবলো। সবার ব্যস্ততা চরম। তাই বলে, এতদূর থেকে এত কষ্ট করেও যিনি আমাদের ছাড়েননি, বছর ভর নীরবে বসে থেকেছেন ঘরের কোণায়। তার অর্চনা না করলে কি চলে? আসুক না পুরুত ঠাকুর ভোর ছটায়। পড়ুক না মায়ের মুখে প্রথম আলো - ভয়ভক্তি না, ভালোবাসায় হোক মায়ের আবাহন।


অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ২৬শে জানুয়ারি, ২০২৩

(পর্ব - ২)

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 

বিয়ের পর মাঝেমধ্যে আমার বরকে রামচন্দর বলে খেপাতাম। শ্রীরাম যেমনি পিতৃসত্য পালনে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছিলেন, ঠিক অতটা না হলেও বাবাই ছিল শৌভিকের পরম গুরু। জীবনের আদর্শ। এই চাকরিতে আসাও তো বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই। অথচ ভাগ্যের এমনি পরিহাস শৌভিকের জীবনের কোন গুরুত্বপূর্ণ দিনেই আজ অবধি হাজিরা দিতে পারেননি শ্বশুরমশাই। এমনকি আমাদের বিয়ের দিনও ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। আজকের এই বিশেষ লগ্নে, যখন বন্ধগলা পরে অভিবাদন নিতে যাবে আমার বর, হয়তো আজও গরহাজিরই থাকতেন বৃদ্ধ, যদি না আচমকা শ্বাসকষ্টে কাবু হয়ে পড়তেন। 


কর্কট রোগকে দু-দুবার হাঁকিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাতে পারলেও শ্বাসকষ্টটাকে কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারেন না শ্বশুরমশাই। ডাক্তার বলেই দিয়েছে, ফুসফুসের অবস্থা সুবিধের নয়। নিষেধ করেছে রাস্তায় বেরোতে। বেরোতেনও না ভদ্রলোক, কিন্তু কাছের জন যদি হাসপাতালবাসী হয়ে পড়ে,রাস্তায় না বেরিয়ে উপায় কি। যতদূর সম্ভব রূঢ় ভাষায় নিষেধ করেছিলাম আমি। ‘বাবা আপনি প্লিজ হাসপাতালে যাবেন না। আপনি কিন্তু মোটেই সুস্থ নন। ভগবান জানে কি ব্যধি বয়ে আনবেন। আগে তমলুকে ছিলাম, যখনই কিছু হয়েছে শৌভিক বা আমি ছুটে আসতে পেরেছি। কাঁথি কিন্তু অনেক দূর।’ 


বৃদ্ধ যে শোনার চেষ্টা করেননি তা নয়। কিন্তু অভিমানী কণ্ঠে স্নেহের পাত্র যখন অনুযোগ করে, ‘আমায় তোমরা দেখতে আসছ না কেন?-’ বৃদ্ধকে যেতেই হয়। পরিণাম যা হওয়ার তাই হয়েছে। তীব্র শ্বাসকষ্ট। বাড়িতে অক্সিজেন সিলিণ্ডার এনে, স্টেরয়েড নিয়েও কোন লাভ হয়নি। অফিস কাছারি সামলে সপ্তাহের মাঝে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার মত অবস্থায়ও ছিলাম না দুজনের কেউই। সপ্তাহান্তের জন্য অপেক্ষা করতে পারেনি বৃদ্ধ। অনুজ ফুলকাকাকে নিয়ে হাজির হয় ডাক্তারের কাছে। সোজা হাসপাতালে ভর্তি হবার নিদান দিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলে ডাক্তার। এবার হাসপাতালে ভর্তি করবে কে? করলেও শাশুড়ী মার কি হবে? বৃদ্ধার কানের অবস্থা তো কহতব্য নয়। আর দুটো হাঁটুই মচমচ করে। তিনি যতই বলুন না কেন, ‘আমি একা দিব্যি থাকতে পারব।’ আমরা পারব কি? আর কাঁথি থেকে কলকাতা রোজ ভিজিটিং আওয়ারে গিয়ে হাজিরা দেওয়াও অসম্ভব। ইশ্ একটু যদি আমার কথাটা শুনত বৃদ্ধ। 


এসব বলতে, বলতে, ভাবতে, ভাবতেই মনে হল, আমরা যদি না যেতে পারি, বৃদ্ধ তো আসতে পারে। আসতে পারে নয়, আসতেই হবে। এসব ক্ষেত্রে মহানগরের বিলাসবহুল হাসপাতালে দৈনিক লাখ টাকা খরচা করে যে চিকিৎসা হবে, মহকুমা হাসপাতালে তার থেকে খুব খারাপ কিছু হবে না। তড়িঘড়ি স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলল শৌভিক। তারপর বৃদ্ধকে জানানো হল,‘কোন রকম ওজর আপত্তি চলবে না। দরকার হলে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাচ্ছি আমরা। আসতে তোমাদের হবেই।’ শাশুড়ী মা যথারীতি সেই একই গান ধরেছিলেন, ‘নারে আমি পারব না। এতটা রাস্তা। তোরা বাবাকে নিয়ে যা। আমি দিব্য-’।  


পঁচিশে জানুয়ারী রাতে সোজা দুজনকে তুলে এনেছে শৌভিক। দিব্যি এসেছে দোঁহে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু দেখেও নিয়েছেন। ছেড়েও দিয়েছেন। বলেছেন ‘বাড়িতেই থাকুন। ওষুধ চলুক। সেরে উঠবেন জলদি। অক্সিজেন চলুক যদি দরকার পড়ে। ’ আজ সকাল থেকে বৃদ্ধ বলছেন,‘আমি তো ঠিকই আছি। শ্বাসকষ্টও নেই।’ শ্বাসকষ্টকে ঠিক বিশ্বাস নেই আমার। ব্যাটা কখন যে আবার এসে উদয় হবে ভগবান জানে। তবে আপাততঃ এই শ্বাসকষ্টের জন্যই ছেলের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিনে হাজিরা তো দিতে পারলেন বৃদ্ধ। অতীতেও অনেকে পরেছেন বন্ধগলা, ভবিষ্যতেও অনেকে পরবেন। কিন্তু ভট্টচার্য এবং চাটুজ্জে বাড়ির ইতিহাসে প্রথম কেউ পরল এই পোশাক। তাই নিয়ে শৌভিক এর তেমন তাপ উত্তাপ না থাকলেও বৃদ্ধ এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূর গর্বের সীমা নেই। ভাগ্যে আমার অবাধ্য হয়েছিল বৃদ্ধ।


অনির সরস্বতী পুজোর ডাইরি, ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৩

(পর্ব -৩)

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারটা সন্ধ্যে থেকে পরিণত হয় শ্রীমতী তুত্তুরীর পড়ার ঘরে। টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বই, খাতা,পেন, জ্যামিতি বক্স আরও না জানি কি কি। সন্ধ্যের পর হঠাৎ করে কোন জরুরী ভিসি ডাকা হলে বা ফাইলপত্র বগলে কেউ যদি বাংলোয় এসে হাজির হয়, তবেই ঐ ঘর ছেড়ে নড়ি আমরা। 


দিন দুয়েক আগে তেমনি কোন কারণে চটজলদি বইপত্র গুছাতে গিয়ে দেখি টেবিলের একপাশে দুপাতার কিসের যেন প্রিন্ট আউট পড়ে আছে। জলদি পাতাতাড়ি গুটানোর জন্য তাড়া দিতে শিয়রেই দাঁড়িয়ে ছিল শৌভিক। জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি? জবাব এল,‘আমার স্পিচ। সাধারণতন্ত্র দিবসের জন্য লিখে দিয়েছে।’ বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘বাবা রে, তোকে স্পিচ লিখে দেবারও লোক থাকে!’ ব্যস্ত হাতে কম্পুটর অন করতে করতে শৌভিক বলল,‘ ওটা বলব না। কিছু একটা ভেবে বলে দেব।’ 


তারপর যতবারই জিজ্ঞাসা করেছি, কি রে ভাবলি? একটাই জবাব পেয়েছি, ' আরে ভাববো। ভাববো। অনেক সময় আছে তো।' দেখতে দেখতে এসে পড়ে ২৬ তারিখ। সূর্যোদয়ের আগে থেকে ব্যস্ততার শেষ থাকে না আমাদের। তুত্তুরী আর আমি উভয়েই সেই ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেছি। ছটায় পুজো করতে আসবেন ঠাকুরমশাই। আমাদের স্নান করা, সাজগোজ, পুজোর যোগাড় সব হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটাও ছটার ঘর ছাড়িয়ে সাড়ে ছটার দিকে গড়িয়ে এল। না এল ঠাকুরমশাই, না উঠল শৌভিক। যত তাড়া দিই,‘ওরে ওঠ রে।আর কত ঘুমাবি?’ ততোবারই লাল চোখ খুলে, মাথাটা বালিশ থেকে আধ ইঞ্চি তুলে, ঘুম জড়ানো স্বরে শৌভিক বলে,‘ আমার শ্বশুরটা ঘুমোচ্ছে। আমি তো জেগেই আছি। স্পিচ ভাবছি।’ সব কথায় আমার বাপকে না টানলে পোষায় না আপদটার। 


সময় গড়ায়। একঘন্টা লেটে আসেন ঠাকুর মশাই। পুজো শুরু ও হয়ে যায়। ঘড়ি বলে সাড়ে সাত। শাঁখ বাজাতে বাজাতে আর ধুনুচিকে বাতাস করতে করতে পলকের অবসরে ফোন করি,‘ওঠ রে বাবা। প্যারেডে কি আমার বাবা যাবে? স্পিচটাও তো লিখলি না।’ কি যে হবে। পুরাণ প্রিন্টআউটটা পেলেও হত। কিন্তু শ্রীমতী তুত্তুরী গত পরশু ওটাতেই ফুসফুস আর হৃদপিণ্ড আঁকা প্রাকটিশ করছিলেন। তারপর তাকে কোথায় রেখেছেন, কেউ জানে না।  


আটটা পনেরোয় ধপধপে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে ফুলবাবু সেজে শৌভিক এসে হাজির। ‘রেডি হয়ে গেছি। শ্বশুরটাকে আর প্যারেডে যেতে হবে না।’ সেই আমার বাপকে ধরে টানাটানি করা। উদয়াস্ত আমার বাপের পিছনে পড়ে থাকে আপদটা।


 পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তড়িঘড়ি লুচি তরকারি খেয়ে, নটা বাজতে দশে মাঠে চলে যাই আমরা। ঠিক নটায় এসে হাজির হয় শৌভিক। সর্বপ্রথমে পতাকা উত্তোলন হয়। অতঃপর জাতীয় সংগীত। তারপর ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো জিপে চেপে প্লাটুন পরিদর্শন। জিপ ফিরে আসে। এবার ভাষণ দেবার পালা। উদ্বিগ্ন হই, কি বলবে কে জানে। মাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শৌভিক, গলা ঝেড়ে, ‘সুপ্রভাত। সকলকে নমস্কার’ দিয়ে যে বক্তব্য শুরু করে, পাক্কা ন মিনিট কয়েক সেকেণ্ড পরে যখন শেষ হয়, করতালিতে ভেসে যায় মাঠ। তুত্তুরী শুদ্ধ বলে ওঠে, “কিচ্ছু না দেখে কি সুন্দর বলল বাবা।” আমিও বললাম, কি ভালো বললি রে। স্টেজ থেকে নেমে, দর্শকাসনে বসে, টুপি খুলে, মাথার ঘাম মুছে শৌভিক বলল,‘হ্যাঁ, তবে আমার শ্বশুরটার মত তো নয়।’ এই জন্যই এই লোকটার প্রশংসা করি না। উদয়াস্ত আমার বাপের পিছনে পড়ে


থাকে মাইরি।

অনির (জন্মদিনের) ডাইরি ২০শে জানুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip 


জন্মদিন নিয়ে আমার আদিখ্যেতা বরাবরই। সমস্ত প্রিয়জনের শুভ জন্মদিনে ঠিক মধ্যরাত্রে ফোন করে উৎপাত করি আমি। আর নিজের জন্মদিনে বসে থাকি ‘উৎপাতিত’ হব বলে। ঘড়ির কাঁটা মধ্য রাত্রিকে স্পর্শ করার সাথে সাথে যদি কেউ শুভ জন্মদিন বলে আলিঙ্গন না করে, ফোন/মেসেজ না করে তো হেব্বি দুঃখু পাই, জানেন তো।  


 সত্যি কথা বলতে কি আমার আগে আমার পিতৃ বা মাতৃকুলে সেভাবে কোনদিন কোন মেয়ের জন্মদিন পালিত হয়নি। ছেলেদেরই বা হত কোথায়? মনে থাকলে মায়ের হাতের এক বাটি পায়েস, খুব জোর একখান নতুন জামা। ব্যাস্ ঐটুকুই। 


ওরই মধ্যে অবশ্য ছোটদা আর আমার জন্মদিনটা পালিত হত বেশ জবরদস্ত ভাবে। আট বছর তফাতে হলেও একই দিনে জন্মেছিলাম যে মোরা। গুণু আর ঝুনু। সেই দিনটাও কোন যে-সে দিন নয়। খাস ২৩শে জানুয়ারী। 


ঘুম ভাঙত প্রভাতফেরীর আওয়াজে। ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই এক গাদা মিষ্টি আর পেস্ট্রি সাজিয়ে মুখের কাছে ধরত আমার জ্যাঠাইমা। ঠাকুমার নির্দেশ মত শীতলা তলায় আমার নামে পুজো দিয়ে প্রসাদ নিয়ে আসত পিসি।  তারপরই সাইকেল নিয়ে চলে আসত বড়দা বা সেজদা। সাইকেলে চেপে পা দোলাতে দোলাতে সোজা বড়মাসির বাড়ি। বড়মাসির রান্নাঘরের ছাতে পতাকা তোলা হত, উফঃ সে কি উত্তেজনা। উপহার দিত ছোট আর সেজ মাসি। বেশির ভাগ বছরেই উপহার বলতে ওদের হাতে বোনা সোয়েটার। কদাচিৎ নতুন জামা। মেজদা দিত বই। আর সারা বছর চুলোচুলি করা ছোটদা, ওই দিন পকেটমানি বাঁচিয়ে ছোটবোনকে কিনে দিত চকলেট। 


উপহার এবং জলখাবার পর্ব মিটলে, বড়দার হাত ধরে সোজা অবসরের মাঠে। জানি না আজও হয় কি না,সেই সময় ঠিক মধ্যাহ্নে নেতাজীর বয়স ধরে বোমা ফাটাত হাওড়া ইছাপুরের অবসর সম্মিলনী।  মাঠের সীমানা জুড়ে ঝোলানো থাকত পাটের পেটো বোম। বাতি না লম্ফ জানি না কি দিয়ে যেন আগুন লাগানো হত বোমাগুলোয়, সে কি আওয়াজ, সাথে ‘জয় হিন্দ’ আর ‘বন্দেমাতরম’। শক্ত করে ধরে থাকতাম বড়দার হাত। 


কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী আমার মা, ছুটি পেত না আমার জন্মদিনে। কাউন্টার ডিউটি সামলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঘনাত সন্ধ্যে। দুই ভাইবোনের জন্য জন্মদিনের পায়েস রাঁধত বড়মাসি। বোতলে করে আসা হরিণঘাটার দুধ দিয়ে, বেঁটে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে। মধ্যাহ্ন ভোজন  বলতে চাকা চাকা বেগুন ভাজা, মুগের ডাল, ভাত আর খাসির মাংস। যার মেটেটা বড়মাসি প্রতিবারই তুলে রাখত শুধু আমার জন্য। ভাড়া বাড়ির ছোট্ট দালানে, বড়মাসিকে ঘিরে গোল করে খেতে বসতাম আমরা পাঁচভাইবোন আর বড়মেসোমশাই। সেই আনন্দ আর উত্তেজনার স্মৃতি আজও অমলিন। 


বহু বছর চলেছিল আমাদের যুগ্ম জন্মদিন পালন। তারপর যা হয় আর কি। সবাই বড় হয়ে গেলাম। স্বাবলম্বী হলাম। একা থেকে হলাম দোকা। ইদানিং জন্মদিন মানেই ছিল গুরুজনদের আশির্বাদ সুলভ ফোন। উমার হাতের পায়েস।  চৈতালীর ‘জয়তু অনিজী’ সম্ভাষণ। ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, ইন্সাগ্রাম,মেসেঞ্জারে আসা গুচ্ছ গুচ্ছ শুভকামনাপূর্ণ  বার্তা। বেলা শেষে  বাবা-মা আর পিসিকে প্রণাম করতে যাওয়া আর অবশ্যই পার্কস্ট্রিটে ভুঁড়ি ভোজ। 


এবছর সব কিছুই কেমন যেন ঘেঁটে গেছে। কোথায় আমি আর কোথায় উমা। আমি বাড়ির সবার জন্মদিনে পায়েস রাঁধব,  আর আমার জন্য রাঁধবে উমা এই প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখতে পারলাম কই আমরা। বরেদের কর্মসূত্রে একজন কাঁথি আর একজন দুর্গাপুরের বাসিন্দা। পার্কস্ট্রিট ও বহু বহু দূর, দেড়শ কিলোমিটারেরও একটু বেশী। 


ডিনার করতে কোথায় যাওয়া যায় এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই মস্তিষ্ক প্রক্ষালণ করছিল শৌভিক। মাঝে মাঝে এসে জিজ্ঞাসা করছিল,‘মান্দারমণি যাবি কি?’ ঘরের পাশেই মান্দারমণি, বিগত দেড় বছরে বিশেষতঃ এখানে এসে অবধি অগুণতি বার গেছি। আর ওখানে মোটেই মোহিত বা সিজলার পাওয়া যায় না। ‘তাহলে দীঘা?’ জানতে চায় শৌভিক। ‘ভাব। ভাব। ভাবা প্রাকটিশ কর।’ জবাব দিই আমি। তোদের জন্মদিনে কি তোদের জিজ্ঞাসা করি আমি? যা কিছু ভাবনা-চিন্তা-কর্ম সবই তো থাকে আমার। 


অনেক ভেবে চিন্তে একটা পরিকল্পনা বানায় আমার বর। এ বছর বার্থ ডে ট্রিট নয়, বার্থ ডে ট্রিপ দেবে আমায়। ‘ভেবে দেখ, এ বছরের জন্মদিনটা এমন কোথাও কাটাতে চাস কি না, যেখানে না ককটেল থাকবে না কন্টিনেন্টাল খাবার-দাবার। না থাকবে ফেসবুক না হোয়াটস্অ্যাপ। এমনকি হয়তো থাকবে না ফোনের টাওয়ারও। থাকবে কেবল জঙ্গল আর পাহাড়। যাবি কি? 


ঠিক এক পায়ে লাফিয়ে না উঠলেও রাজি হয়ে যাই। টিকিট কাটে শৌভিক। জঙ্গলের মধ্যে নেচারক্যাম্প বুক করে শৌভিক। দিন যায়। বিশে জানুয়ারী রাত দশটা কুড়িতে আমাদের ট্রেন। উনিশ তারিখ রাত অবধি কিছুই গোছাই না আমরা। কি হবে গোছগাছ করে। শেষে যদি অনুমতি না পেলে। শেষে সেই মান্দারমণিতেই যেতে হবে হয়তো। 


শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনুমতি মিলেই যায়। শুক্রবার রাতের ট্রেন, শনি-রবি-সোম তো এমনিই ছুটি। মঙ্গলবার কাক না ডাকা ভোরেই ফিরে আসছি আমরা।এই অবসরে আর কিই বা সমস্যা হতে পারে।  বিশে জানুয়ারী ভোরে স্কুল যায় তুত্তুরী। অফিস যায় শৌভিকও। ব্যাগ পত্তর গোছানোর দায়িত্ব পড়ে এই অধমের ওপর। কি আর করা, জন্মদিনটাও আমার যে। 


ব্যাগ পত্র সহ রাতের খাবার গুছিয়ে নিয়ে কাঁথি থেকে ত্রয়ী যখন বেরোলাম ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে ছটা। শুক্রবার অঙ্কুরহাটি আর সাঁতরাগাছির জ্যাম কাটিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ঘোষিকার মধু ঢালা কণ্ঠ জানিয়ে দিল, কুড়ি নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসতে চলেছে আমাদের ট্রেন। ট্রেনের নাম সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস। চটজলদি কয়েক বোতল জল কিনে, ব্যাগপত্র এবং শ্রীমতী তুত্তুরীকে টানতে টানতে আমরা যখন ট্রেনে উঠলাম ঘড়িতে দশটা দশ। বাঙ্কের নীচে সুটকেসটা ঢুকিয়ে সবে যে যার বাড়িতে ফোন করতে যাব, মাননীয় মহকুমা শাসকের মুঠো ফোনটি সজোরে চিৎকার করে উঠল। এত রাতে আবার এ অত্যাচার কেন রে বাবা। উল্টোদিক থেকে ভেসে এল সংবাদ, কেন্দ্রীয় দল আসছে, তাঁরা পর্যবেক্ষণ করতে আসবে কাঁথির বিভিন্ন ব্লক। সেখানে হাজিরা দিতে হবে মহকুমা শাসককেও। যে গাড়িতে হাওড়া এসেছি, তার ড্রাইভার বোধহয় বেশী দূর যায়নি। তাহলে কি নেমেই পড়তে হবে ট্রেন থেকে।



অনির (জন্মদিনের) ডাইরি ২১শে জানুয়ারি, ২০২৩

পর্ব -২

#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip 


যদিও ট্রেনের নাম সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস, যাবে বহুদূর। সেই জগদলপুর। পথে অবশ্য আমাদের নামিয়ে দিয়ে যাবে যথাস্থানে। নটা নাগাদ সম্বলপুর পৌঁছানোর কথা,বেশি না মাত্র আধ ঘন্টা লেটে নামাল ট্রেন। তখনও কুয়াশার চাদরে মোড়া চরাচর। ভালো করে রোদ ওঠেনি। কুয়াশার জন্যই সামান্য লেট করেছে ট্রেনটা। 

সম্বলপুর বেশ বড় স্টেশন। জংশন। খুব পরিচ্ছন্ন। মিনিট পনেরো দাঁড়ায় ট্রেনটা, ফলে আড়ামোড়া ভেঙে ধীরে সুস্থে নামা যায়। সম্বলপুরেও থাকা যায়, হোটেল এমনকি পান্থ নিবাসও আছে। আমাদের গন্তব্য অবশ্য ডেবরিগড়। 


জঙ্গলের মধ্যে নেচার ক্যাম্পে থাকব আমরা। সম্বলপুর স্টেশন থেকে নেচার ক্যাম্প এর দূরত্ব গোটা চল্লিশেক কিলোমিটার। স্টেশনের বাইরেই ট্যাক্সি মেলে। আমরা যদিও নেচার ক্যাম্পেই বলে রেখেছিলাম গাড়ি পাঠাতে। পরিকল্পনা ছিল গাড়িতে মালপত্র তুলে প্রাতরাশ সেরে নেব আমরা। তারপর রওণা দেব ডেবরিগড়ের পথে। 


সেই মত ড্রাইভারকে নির্দেশ দেবার আগেই বেজে উঠল মহকুমা শাসকের মুঠো ফোন। ওপারে মাননীয় জেলাশাসক স্বয়ং। সাময়িক ভাবে স্তব্ধ হয়ে এল আমাদের হৃদস্পন্দন। এই রে, ফিরে যেতে হবে নাকি? গতরাত্রে কেন্দ্রীয় দলের আসার সংবাদ দিয়ে যিনি ফোন করেছিলেন, তাঁকে তো, ‘আমি তো বেরিয়ে পড়েছি। ট্রেনে উঠে পড়েছি। ডিএম সাহেব ছেড়ে দিয়েছেন' ইত্যাদি প্রভৃতি বলে কোন মতে নিরস্ত করা গেছে। কোনটাই মিথ্যে নয়। কিন্তু তবুও একটা চাপা ভয় কাজ করে। ডিএম সাহেবের যদি মনে না থাকে। 


রোদ ওঠার সাথে সাথে যেমন কুয়াশা কাটে, তেমনি সমস্ত শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করলেন ডিএম স্যার। ওণার দিব্যি মনে আছে, প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশ দিয়ে দিলেন কেবল। আর বললেন,‘ দেখে নিও। ফোনে থেকো।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানলার বাইরে যখন তাকালাম, সম্বলপুর ছাড়িয়ে এসেছি আমরা। শুরু হয়ে গেছে পাহাড় আর মহানদীর খাত। গতকাল রাতে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে গলদ্ধকরণ করা স্যাণ্ডউয়িচ হজম হয়ে গেছে কখন। যেহেতু আজ থেকে বুকিং তাই আজকের প্রাতরাশটা মিলবে না নেচার ক্যাম্পে। পথে আর কোন খাবারের দোকান ও নেই। বয়ে আনা বিস্কুট আর কাজুই ভরসা। 


আচমকা বাঁক ঘুরতেই সামনে হীরাকুদ ড্যাম। সম্বলপুর থেকে এই ড্যামের দূরত্ব মোটামুটি ষোল- সতেরো কিমির মত। হীরাকুদ হল পৃথিবীর দীর্ঘতম মাটির বাঁধ। দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার। বাঁধের একদিকে যতদূর চোখ যায় কেবল জল আর জল। প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলাধার প্রায় সমুদ্র সম। জলের রঙ গাঢ় নীল। অগুনতি পাখপাখালি আর জলজ প্রাণীর নিবাস। শোনা যায়, এই জলাধারের নীচে নাকি ডুবে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক মন্দির। এমনকি ঐতিহাসিক শীলালিপিও। উন্নয়নের কাছে পিছু হটেছে ইতিহাস। মে জুন মাসে যখন জল কমে আসে, মাথা চাড়া দেয় অনেকে। বর্ষা নামার সাথে সাথেই মুখ লুকোন তাঁরা। স্কুবা ড্রাইভিং এর জন্য তাই অত্যন্ত উত্তম এই জলধার। জলাধারের উল্টোদিকে আর পাঁচটা ড্যামের মতই চোখে পড়ে উষর জমি, এঁকেবেঁকে চলা রাস্তা, অবিন্যস্ত জঙ্গল। 


হীরাকুদের বুকের ওপর দিয়ে এঁকে বেঁকে আমরা গিয়ে হাজির হলাম ডেবরিগড় অভয়ারণ্যের চেক পোস্টে। এখান থেকে ছাড়পত্র মিললে তবে প্রবেশ করা যাবে জঙ্গলে। নেচার ক্যাম্প এখান থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূর। ঘড়িতে সোয়া দশটা সবে। অফিস থেকে জানাল সাড়ে এগারোটার আগে জঙ্গলৈ প্রবেশ করতে পারব না আমরা। তেমনি নাকি নির্দেশ আছে ওদের ওপর। একটা চায়ের দোকান আর একটা স্যুভোনির শপ ছাড়া আর কিছুই নেই। এক প্রচণ্ড গম্ভীর দিদিমণি বসে আছেন সেই শপে। গুটি কয়েক টি শার্ট আর টুপি ছাড়া তেমন কিছু নেই।


চায়ের দোকানে বয়াম ভর্তি সুজির বিস্কুট, দিলখুশের মত মিষ্টি আর কেক রাখা। চা আর ঐ কেক দিয়েই প্রাতরাশ সারলাম আমরা। হলুদ কেকগুলি যে সাম্প্রতিক কালে তৈরি নয় বেশ বোঝা যায়। পেট খারাপ না হলেই বাঁচি। চাটা যদিও অতি উত্তম ছিল। 


একটা পায়ে চলা লালচে পথ ঢুকে গেছে জঙ্গলের মধ্যে। সময় কাটাতে ঐ পথ ধরে বেশ খানিকটা ঘুরে এলাম আমরা। যারা শিমলিপাল গেছেন এই জঙ্গল তাদের ভয়ানক চেনা লাগবে। একই ধরণের গাছপালা। একই রহস্যময় আবহ। এককালে এই জঙ্গল ছিল সম্বলপুরের সিংহ বীর সুরেন্দ্রসাইয়ের চারণ ভূমি। সম্বলপুরের রাজা নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কে হবেন তাই নিয়ে বৃটিশদের সাথে সুরেন্দ্র সাই এবং তাঁর পরিবারের সংঘর্ষ লাগে। এই জঙ্গলের ভিতর ঘাঁটি গড়ে বৃটিশদের সাথে তুমুল লড়াই করেন সুরেন্দ্র সাই। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শক্তির বিরুদ্ধে তীরধনুক, তরবারি নিয়ে লড়াই করলে যা হবার তাই হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। কাকতালীয় ভাবে তাঁরও জন্মদিন ছিল ২৩শে জানুয়ারী।


অফিস থেকে আমাদের জঙ্গলের বেশী ভিতরে ঢুকতে নিষেধ করল। ডেবরিগড় বন্য বরাহদের নিবাস স্থল। ব্যাটারা যখন তখন, যেখানে-সেখানে দল বেঁধে আবির্ভূত হয়। হয়তো আমাদের ছটফটে স্বভাবের জন্যই, সাড়ে এগারোটার বদলে এগারোটা নাগাদ জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতি মিলে গেল। জঙ্গলে প্রবেশের সাথে সাথেই অভ্যর্থনা জানাল গুটি কয়েক ময়ূর। খানিক এগিয়ে আবার থমকে দাঁড়াল গাড়ি, পথ জুড়ে আসর বসিয়েছে এক দঙ্গল হনুমান। জঙ্গলে হর্ন বাজানো নিষেধ। ওরাই এখানকার ভূমিপুত্র, আমরা নিছক বহিরাগত। ফলে তাড়া দেওয়াও অসঙ্গত। বেশ খানিকক্ষণ চলল মিটিং। তারপর কি মনে হল, আড়মোড়া ভেঙে একে একে সরে গেলেন তেনারা রাস্তা ছেড়ে। 


সোজা ডেবরিগড় নেচার ক্যাম্পে গিয়ে থামল গাড়ি। নেচার ক্যাম্পের একদিকে জঙ্গল আর অন্যদিকে হীরাকুদ জলাধার। জঙ্গলের দিকটা জাল দিয়ে ঘেরা। বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত এই নেচারক্যাম্পে কটেজ আছে বেশ কয়েকটা। কটেজগুলোর নাম খুব সুন্দর জল, অগ্নি, বায়ু ইত্যাদি। আর ডাইনিং কটেজটার নাম পঞ্চতত্ত্ব। দলবল নিয়ে এলে কটেজে থাকতেই পারেন, অন্যথা বড় নিরিবিলি। আমরা থাকব বাইসন ব্লকে। বাইসন ব্লক একটা দোতলা বাংলো। যার দুই তলা মিলিয়ে সাত- আটটা সুইট আছে। প্রতিটা সুইটের সামনে এবং পিছনে আছে বারন্দা। প্রতিটি সুইটের প্রতিটি বারন্দায় রাখা বেতের সোটা এবং সেটি। কাচের টেবিল। সামনের বারন্দাটা কমন এবং খোলা। পিছনেরটা আপনার নিজস্ব এবং জাল দিয়ে ঘেরা যাতে পাখি বা বাঁদর না ঢুকে আসে। সামনেরটা খোলে জঙ্গলের দিকে আর পিছনেরটা জলাধারের দিকে। 


ঘরগুলি বিশাল বড়। বিছানাটাও সাফ সুতরো, কিং সাইজ। ঘরেও দুটি বেতের কেদারা টেবিল রাখা। আছে ওয়ার্ডরোব এবং ড্রেসিং টেবিল। বাথরুমটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তবে ঝাঁ চকচকে নয় অবশ্যই। জঙ্গলের ভিতরে এর থেকে বেশী আশা করাও অন্যায়। শিমলিপালের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে ফোনের টাওয়ার থাকবে না। সেই মত অন্তত বার দুশো যে যার বাপ-মাকে বলেছি সাবধানে থাকতে। নিজেদের খেয়াল রাখতে। ২৩তারিখ জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে টাওয়ার পেলেই আমরা ফোন করব। তাতে কতখানি আশ্বস্ত হয়েছে ওরা ভগবান জানে। আমার বাবা তো বলেই দিল,‘তোমার টাওয়ার থাকুক না থাকুক, নির্দিষ্ট সময় অন্তর আমি ফোন করতেই থাকব।যদি কানেক্টেড হয় ভালো, নাহলে আর কি (দীর্ঘশ্বাস)। ’ 


পুরো নেচার ক্যাম্পে কোথাও টাওয়ার না পেলেও পিছনের বারন্দায় গিয়ে দেখি টিমটিম করছে দুটি টাওয়ার। যাক বাবা। শান্তি। ঝপাঝপ যে যার বাড়িতে ফোন করতে লাগলাম শৌভিক আর আমি। রীতিমত ভিডিও কল করে ঘর- জঙ্গল- জলাধার দেখাতে লাগলাম বাবাকে। আচমকা তুত্তুরী চেঁচিয়ে উঠল,‘মা দেখো এক পাল বন্য বরাহ।’ তাকিয়ে দেখি, সত্যিই আমাদের ঝুল বারন্দার অদূরে একটা গুল্মের নীচে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে সত্যিই একপাল শুয়োর। আমিও চিৎকার করে উঠলাম,‘সত্যিই ওয়াইল্ড বোরস্ তো রে।’ যুগপৎ বাংলা এবং ইংরাজিতে উল্লাসের দাপটে বোর থুড়ি বরাহরা তো ঝুপঝুপ করে লুকিয়ে পড়লেন গাছের পিছনে। ওদিকে বাবার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে আব্দার জুড়ল আমার জননী,‘শুয়োর দেখা।’  

প্রসঙ্গতঃ - ডেবরিগড় নেচার ক্যাম্পের ভিডিও লিঙ্কটা নীচে দিলাম। যদি মনে করেন দেখে আসতে পারেন।

https://youtu.be/yFmTLi1TJ_U



অনির (জন্মদিনের) ডাইরি, ২১শে জানুয়ারি, ২০২৩

(পর্ব-৩)

#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip 


যাঁরা নেচার ক্যাম্পে এর আগে থেকেছেন তাঁরা জানেন, অন্যদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে, যখন আপনি নেচার ক্যাম্পে রুম,কটেজ বা সুইট বুক করবেন, ঘর ভাড়ার সাথে সাথেই আপনার প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজ, সান্ধ্যকালীন জলখাবার এবং নৈশভোজের মূল্য ওরা আপনার থেকে নিয়ে নেবে। 


তাছাড়া আর উপায়ই বা কি? গভীর জঙ্গলের মধ্যে অন্য কোন হোটেল বা রেস্তোরাঁ তো আর পাবেন না। খাবারদাবার খুব সাধারণ মানের এবং সবার জন্য এক। চাইলেও কালিয়া- কোপ্তা পাবেন না। শুধু তাই নয়, খাবার সময় এবং স্থানও নির্দিষ্ট। বড়জোর সকাল-বিকেলের চা ছাড়া রুম সার্ভিস পাবেন না।  


ডাইনিং হল বা কটেজে গিয়েই আপনাকে খেতে হবে। আজকের মেন্যুতে ছিল মোটা চালের ভাত, অরহড় ডাল, চাটমশলা ছড়ানো ভয়ানক মুচমুচে করলা ভাজা। একেবারে প্যাকেটের চিপসের মত সুস্বাদু। সাথে মোটা মোটা আলুভাজা, মিক্সড ভেজ মার্কা একটা পাঁচমিশালী তরকারি এবং মাছ। মাছ না খেলে পনীর পাবেন। 


শিমলিপালের বড়েইপানি নেচারক্যাম্পে যা খেয়েছিলাম সে তুলনায় রীতিমত অমৃত বলতে পারেন। ডাইনিং হলটা নেচার ক্যাম্পের এক কোণে। শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লাল মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতে হয় অনেকটা। নামটাও ভারি সুন্দর পঞ্চতত্ত্ব। ডাইনিং হলটার তিনদিকই খোলা এবং জাল দিয়ে ঘেরা। বর্ষাকালে কি হয় ভগবান জানে। জাল দিয়ে ঘেরা খোলা জানলা/ বারন্দার ধার ঘেঁষে পরপর বেশ কতকগুলি টেবিল পাতা। সাথে বাঁশের চেয়ার। বেশ মজাদার দেখতে চেয়ারগুলো। 


খেতে খেতে আপনি স্বচ্ছন্দে হীরাকুদ জলাধারের শোভা দেখতে পারেন। হু হু করে ছুটে আসবে জঙ্গলেয় গন্ধ মাখা জোলো হাওয়া। জলের কাছে যাবার পায়ে চলা লালচে পথটাও চোখে পড়বে। চোখে পড়বে জলে ভাসমান জেটিটাও। ঐ জেটি থেকেই আজ দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ নৌবিহারে রওণা দেব আমরা। আর চোখে পড়বে এক দঙ্গল রাজহাঁস। আমরা যখন খেতে আসছিলাম, বেজায় গম্ভীর মুখে বসে/দাঁড়িয়ে ছিল ব্যাটারা। মনে হয়েছিল মূর্তি বুঝি। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য গোড়া থেকেই দাবী করেছিলেন উহারা জ্যান্ত বটেক। ডাইনিং হল ( https://youtu.be/yFmTLi1TJ_U ) আর রাজহাঁসেদের ভিডিও ( https://youtu.be/3CgLaOJYKUg ) লিঙ্কটা দিলাম, যদি আগ্রহী হন দেখে আসতে পারেন। 


দ্বিপ্রাহরিক গুরু ভোজ সেরে হাল্কা গড়িয়ে নিয়ে আমরা বেরোলাম নৌকা বিহার করতে। এটা নেচার ক্যাম্পের অতিথিদের জন্য বুক করাই থাকে। হীরাকুদের বিশাল জলাধারের মধ্যে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে তিনটি দ্বীপ। এই দ্বীপ গুলি আদতে ছিল অনুচ্ছ পাহাড়। জলাধারের জলে যখন প্লাবিত হল চরাচর, স্থানান্তরিত/পুনর্বাসিত হল স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ, ডুবন্ত পাহাড়ের মাথা গুলি জেগে রইল কেবল নিঃসঙ্গ দ্বীপ হয়ে। প্রতিটি দ্বীপই ঘন জঙ্গলে ঢাকা। 


তিনটি দ্বীপের মধ্যে ব্যাট আইল্যাণ্ডেই কেবল নিয়ে যায় নেচার ক্যাম্পের স্পিড বোটটি। দিনে কেবল দুইবারই সওয়ারি করে বোট গুলো, একবার সকালে আর একবার বিকেলে। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে নৌযাত্রা করায় অতিথিদের। ব্যাট আইল্যান্ডে দ্রষ্টব্য বলতে প্রচুর বাদুড়। আর আছে গোটা সাতেক মৎসজীবী পরিবার। যারা এখনও মাটি আর বাঁশের কুঁড়ে ঘরে থাকে। ব্যাপারটার মধ্যে আদৌ কোন দ্রষ্টব্য আছে বলে আমার মনে হয়নি। খামোখা একদল মানুষের দুর্দশা দেখে যে কেন লোকজন এত আনন্দ পায়। 


 অপর একটি উল্লেখযোগ্য দ্বীপ হল ক্যাটল আইল্যাণ্ড। যেখানকার আদি অধিবাসীরা স্থানান্তরিত হবার সময় ছেড়ে গিয়েছিলেন তাদের গবাদি পশু গুলিকে। সময়ের সাথে সাথে শুধু যে তাদের সংখ্যাই বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়, ছেড়ে যাওয়া ভীরু গৃহপালিত পশুগুলির উত্তরসূরিরা হয়ে উঠেছে বন্য এবং দুর্দম। আকারেও নাকি বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ অনেকটা। পরবর্তীকালে আসেপাশের গ্রামের মানুষ অনেক চেষ্টা করেছে ওদের কব্জা করার, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে বারেবারে। ক্যাটল আইল্যান্ড প্যাকেজে থাকে না। অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে ওরা নিয়ে যায় বটে, তবে বলেই দেয় নৌকা থেকে নামবেন না। বিপদ ঘটে যাবে। 


ব্যাট আইল্যান্ডে মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে থেকে বোটটা আবার ফিরে যায় মূল জলাধারে। অতঃপর ভেসে থাকে আরো মিনিট পনেরো। ঠিক এই সময়ই একরাশ লালিমা জড়িয়ে পাহাড়ের পিছনে লুকিয়ে পড়েন দিনমণি। 


সত্যি কথা বলতে কি যাঁরা আমাদের মত অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন বা যাঁরা ইতিপূর্বে রম্ভা বা চিল্কায় এই ধরণের নৌকায় চড়েছেন তাঁরা হয়তো একটু হতাশই হবেন। ঐ ধরণের রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা হেথায় দুর্লভ। মোচার খোলার মত স্পিড বোটের দুলুনিও তেমন ভাবে টের পাবেন না। হীরাকুদে নৌবিহার বড়ই রম্য, বড়ই মোলায়েম। আপনি যাবেন, আপনার সাথে সাথে, আপনার আসেপাশে ঘুরে বেড়াবে, উড়ে বেড়াবে,ছুটে বেড়াবে হরেকরকম পাখির দল। পলকে পলকে রঙ বদলাবে হীরাকুদের জল। সূর্য সাদা তো জল ঘোলাটে নীল। সূর্য সোনালী তো জল আরেকটু বেশী নীল। সূর্য কমলা তো জলও ঘোলাটে কমলা, সূর্যের রঙ লাল তো ঝুপ করে জলের রঙ হয়ে যায় কালো। জল থেকে উঠে আসতে থাকে থোকা থোকা কুয়াশা। ঘিরে ধরে বোটটাকে। হীরাকুদে নৌবিহারের ভিডিও লিঙ্কটা দিলাম যদি দেখতে চান- https://youtu.be/ltUg-OpmWwU 


বোট থেকে যখন নামলাম একে একে জ্বলে উঠেছে নেচারক্যাম্পের আলো। হয়ে এসেছে চায়ের সময়। সঙ্গে টা বলতে জিভ পোড়ানো চিকেন পকোড়া। ডিনার টাইম রাত আটটা থেকে। দেরী করলেই ডাকতে চলে আসে ক্যান্টিনের ছেলেগুলো। যাদের প্রত্যেকের ব্যবহার অসম্ভব ভদ্র এবং মিষ্টি। 


শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাতের বেলা খেতে যাওয়াটা রীতিমত গা ছমছমে অভিজ্ঞতা। নির্দিষ্ট দূরত্ব ছাড়াই জ্বলছে সাদা বাল্ব। তাও যেন ঘোঁচে না আঁধার। প্রতিটি ঘর ভর্তি, তাও যেন অখণ্ড নীরবতায় মোড়া চরাচর। আওয়াজ বলতে উৎকট স্বরে ঝিঁঝি পোকাদের কলতান আর পেঁচার ডাক। মাঝে মধ্যে ডিহি-ড্ডুহু করে ডেকে উঠছে কোন অচেনা পাখি। 


জঙ্গল আর নেচার ক্যাম্পের মধ্যে লক্ষণরেখা বলতে কেবল কাঁটাতারের বেড়া। তার ওধারে কারা যেন ঘোরাফেরা করছে, অস্পষ্ট মচ্-মচ্, শর-শর আওয়াজ ভেসে আসছে অন্ধকার থেকে। শিমলিপালে আমাদের গাইড দাদা একবার বলেছিলেন, ‘স্যার আপনি জঙ্গলে এসে জীবজন্তু নাও দেখতে পেতে পারেন, কিন্তু জেনে রাখবেন ওরা ঠিক আপনাকে দেখছে। নজর রাখছে আপনার গতিবিধির ওপর।’ এই নিকষ আঁধারে সেই কথাগুলি মনে পড়ে কে জানে কেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। 






অনির (জন্মদিনের) ডাইরি, ২২ শে জানুয়ারি, ২০২৩

পর্ব- ৪

#অনিরডাইরি #birthdaygift_birthdaytrip 


মোবাইলের ঘড়ি বলছে, রাত সাড়ে তিনটে, ঘুমের ঘোরে গায়ের কম্বল খুলে ফেলেছে তুত্তুরী। ঠিক করে দিতে গেলাম তো, মায়ের মুখে সোহাগী হাত বুলিয়ে, তিনি বললেন, ‘ হ্যাপ্পি বাড্ডে মমি”। বাবার অগোচরে তিনি মাঝে মাঝে মা’কে ‘মমি’ বলে সম্বোধন করেন বটে, বিশেষতঃ যখন মায়ের ওপর সোহাগ উথলে ওঠে। 


ডেবরিগড় নেচার ক্যাম্পে আজই আমাদের শেষ রাত। এই সুইট গুলোর একটা দিক পুরো কাঁচের। শোবার আগে পর্দা সরিয়ে দিয়েছে শৌভিক, এক নজর দেখলে মনে হচ্ছে কাঁচের ওপারে নিকষ কালো যবনিকা টেনে দিয়েছে কেউ। একটু চোখ সয়ে গেলেই বোঝা যায়, যার অর্ধেকটা জুড়ে আকাশ। আকাশ ভরা ঝিকমিকে হীরের কুচির মত অগণিত তারা। কালো কালো পর্দার বাকি অর্ধেকটা জুড়ে জল আর জঙ্গল। শুক্ল পক্ষ পড়ে গেছে যদিও, আজ দ্বিতীয়া, তাই চাঁদের দেখা নাই। তারার আলোকে দিব্যি বোঝা যাচ্ছে জঙ্গল আর জলের সীমানা এমনকি বড় বা মাঝারি গাছ গুলোর আকৃতি। 


 গত কাল একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিলাম আমরা, সাড়ে নটার মধ্যে। সারাদিনের পথশ্রমে এত ক্লান্ত ছিলাম সকলে, যে ঘুম আসতে দেরী হয়নি। দিনের বেলা নৃসিংহনাথের মন্দির, গন্ধমর্দন পাহাড় আর কপিলধারা দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। সব মিলিয়ে প্রায় তিনশ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটারের পথ যাত্রা। সত্যি কথা বলতে কি এটা আমাদের পরিকল্পনা বহির্ভূত ট্রিপ ছিল। উড়িষ্যা বনদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে নেচার ক্যাম্প বুক করাতে গেলেই ওরা জানতে চাইবে, আপনি সাফারি করতে ইচ্ছুক কি না। সাফারি দুই ধরণের হয়, অর্ধ দিবস এবং পূর্ণ দিবস। বউয়ের জন্মদিনের উপহার বলে কথা, কোন কার্পণ্য রাখেনি আমার বর। বুক করিয়ে ছিল ছয় ঘণ্টার সাফারি। আমাদের ধারণা ছিল, সারাদিন জঙ্গলেই ঘোরাবে হয়তো। বাস্তবে দেখা গেল জঙ্গল সাফারি আলাদা করে বুক করাতে হয়। আমাদের ওরা জঙ্গলে ঘোরার থার জিপে করেই ঘোরাবে বটে, তবে ডেবরিগড়ের জঙ্গলে নয়।


 উড়িষ্যার বলাঙ্গির আর বারগড় জেলার সীমানা বরাবর বিস্তৃত গন্ধমর্দন পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নৃসিংহনাথের মন্দিরটির নির্মাণ কাল খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতক। নির্মাতা পাটনার রাজা বৈজল দেব। ছয়শ বছরের বুড়ো এই মন্দিরে শ্রীবিষ্ণু মার্জার কেশরী রূপে পুজিত হন। লোকগাথা অনুসারে গন্ধমর্দন পাহাড় সংলগ্ন এই অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর এককালে প্রবল অত্যাচার চালাত মূষিক দৈত্য। অত্যাচারিত, নিপীড়িত ভক্ত কুলের পরিত্রাণার্থে মার্জার রূপে প্রকট হন শ্রী বিষ্ণু। কথিত আছে যে, তাঁকে দেখেই ছুট্টে গর্তে ঢুকে পড়ে মূষিক দৈত্য। সেই যে ঢুকেছে, আজও বেরোয়নি। মার্জারকেশরী আজও তার জন্য সজাগ এবং প্রতীক্ষারত। 


নৃসিংহনাথের মন্দির থেকে গন্ধমর্দন পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে প্রায় চার কিলোমিটার ট্রেক করে উঠতে হয় কপিলধারায়। বনদপ্তরের গাড়ি অবশ্য ওঠে। তবে কেবলমাত্র অনুমোদিত সরকারি গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ির প্রবেশ নিষেধ। বাইকের অবশ্য ছাড়পত্র আছে। 


পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটাটা বেশ মনোরম অভিজ্ঞতা। প্রায় জনবিহীন, একদিকে পাহাড় আর জঙ্গল আর অন্যদিকে খাদ। স্থানীয় লোক গাথা অনুসারে, গন্ধমর্দনই হল রামায়ণে বর্ণিত গন্ধমাদন পাহাড়। রামানুজের প্রাণ বাঁচাতে জাম্বুবানের নির্দেশ মত বিশল্যকরণী আনতে গিয়েছিলেন হনুমান। একদিকে বিশল্যকরণীকে শনাক্তকরণে অপারগতা অপরদিকে সময়ের স্বল্পতা, রিস্ক নেননি বজরংবলী, কাঁধে করে তুলে আনেন গোটা পাহাড়টাকেই। কার্যসমাধা হবার পর, পাহাড়টিকে আর যথাস্থানে রেখে আসেননি। এখানেই ফেলে যান উড়িষ্যার বলাঙ্গিরে। 


মহাভারতের যুগে, এখানেই নাকি শিষ্যদের অস্ত্র শিক্ষা দিতে আনতেন পাণ্ডবগুরু দ্রোণাচার্য। কে জানে হয়তো আসেপাশের কোন গ্রামেই ছিল একলব্যের নিবাস। এমন কি হিউয়েন সাং এর লেখাতেও নাকি এই পর্বতের উল্লেখ আছে। ট্রেকিং এর ভিডিও লিঙ্কটা দিলাম, যদি মনে করেন দেখে আসতে পারেন- https://youtu.be/9ce8I6Dkj6k


গন্ধমর্দন পাহাড় এখনও ওষধি গাছের জন্য বিখ্যাত। বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতে এই পাহাড়ে দুই শতাধিক ওষধি গাছ পাওয়া যায়। স্থানীয় অধিবাসীদের মতে অবশ্য এই সংখ্যাটা অন্তত পাঁচশ। গন্ধমর্দন পাহাড়ের দুই ঢালে গড়ে উঠেছে দুই খানি আয়ুর্বেদিক কলেজ হাসপাতাল। আশেপাশের প্রায় ৫০,০০০ আদিবাসীর চিকিৎসার হয় যেথায়। শুধু তাই নয় ডাবর, ঝান্ডুর মত কোম্পানি গুলি কাঁচামাল সংগ্রহ করে এই পাহাড় থেকে। 


গন্ধমর্দন পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে যখন কপিলধারায় পৌঁছালাম, বেশ হতাশ লাগছিল। শীতের শেষ বলে জল বেশ কম। যেটুকু ধারাপাত হচ্ছে, তাকে ঘিরে স্থানীয় পুণ্যার্থীদের ভিড়। তেমনি নোংরা চারিধার। প্লাস্টিকের মোড়ক আর খালি জলের বোতলে ছয়লাপ। আমরা হেঁটে উঠলেও, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করছিল বনদপ্তরের গাড়িটা। ড্রাইভার দাদা বলছিলেন, গন্ধমর্দনের ঢাল নাকি সাংঘাতিক। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই ঘুষ দিয়ে ঢুকে পড়ে ট্যুরিস্ট গাড়ি। তেমনি একটা গাড়ি নাকি কিছুকাল আগে খাদে পড়ে যায়। আজও তাকে তোলা যায়নি। গাড়িটাও দেখালেন। টাটা সুমো। ভিতরে শাখা মেলেছে বন্য গুল্ম। 


আমাদের মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা ছিল নৃসিংহনাথের মন্দিরে। মন্দিরের বাইরে বেশ খানিকটা দূরে জুতো খুলে খালি পায়ে প্রবেশ করতে হয় মন্দিরে। ভিতরে থিকথিক করছে পুণ্যার্থীদের ভিড়। যত জন মানুষ, প্রায় ততোগুলি বাঁদর। রয়েছে গোটা কয়েক গরুও। ড্রাইভার গিয়ে কুপন কেটে আনল। জন প্রতি ৬০ টাকা। হাত ধুয়ে পংক্তি ভোজনে বসলাম আমরা। পাশাপাশি দুটি হল ঘর, মাঝের দেওয়ালে জাফরি কাটা। একদিকে পরিবেশন শুরু হচ্ছে, অন্য দিকে শেষ। মানুষ উঠে গেলে এঁটো পাতা গুলো শুধু ঝেঁটিয়ে বার করে দিচ্ছে একদল মহিলা। মোছার কোন বালাই নেই। বসার জায়গায় ডালের ফোঁটা, ভাতের কণা পড়ে আছে। ফেলে দেওয়া এঁটো পাতা চাটছে বাঁদরে, গরুতে। কিছু থেকে আবার পচা গন্ধ আসছে ভুরভুর করে। 


ঠাকুরের কাছে এসেছি, কোন কিছুতে ঘৃণা করা মহাপাপ, তবুও গা গুলিয়ে উঠছিল। শৌভিক জন্ম নাস্তিক, ব্যাপারটা যে এমন হবে জানতও না। অপরাধী মুখে বার বার বলতে লাগল, ‘চল উঠে যাই।‘ তুত্তুরীও বাবার দলে। সাহসে কুলোচ্ছিল না কেবল আমার। যদি ঠাকুর পাপ দেন? নির্ঘাত দেবেন। আর দ্বিতীয়ত ড্রাইভার বা পঙক্তিভোজে বসা অন্যান্যরা যদি কিছু মনে করেন? মিনিট পনেরো ঐ যাতনা সহ্য করে আর পারলাম না। তখনও এই ঘরে পরিবেশন শুরুই হয়নি। ক্রমশ বাড়ছে ভিড়। মার্জার কেশরীর কাছে মার্জনা চেয়ে উঠেই পড়লাম। বয়স্ক ড্রাইভারটির কাছেও কর জোড়ে মার্জনা চাইলাম। স্থানীয় অধিবাসীদের ভাবাবেগে আঘাত হানার কোন অভিপ্রায়ই আমার নেই। 


ড্রাইভার দাদা যদিও বললেন, বাঙালি ট্যুরিস্টরা এখানে কোন বারই খেতে চায় না, কে জানে কেন। মার্জার কেশরীর ভোগের অবমাননা করেছিলাম বলেই হয়তো, মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে সারতে বেজে গিয়েছিল, বিকাল সাড়ে চারটে। একে তো দিনভরের ধকল, তারওপর কাল আবার উঠতে হবে খুব ভোরে। কাল সত্যিই জঙ্গলে যাব আমরা, সাফারি করতে। তবে আজকের দিনটা যা গেল, খুব বেশি আশা আর রাখিনি কালকের দিনটা নিয়ে। কাল আবার আমার জন্মদিন,কে জানে কেমন কাটবে কালকের দিনটা।   

(চলবে)






অনির ডাইরি ১৭ই জানুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


Happiness is, যখন পুরাণ বন্ধু ফোন করে বলে, ' শোন না, তুত্তুরীর একটা দশ বছর বয়সের ছবি পাঠা না।' প্রথম আলাপের দিনটা ছাড়া, জীবনেও ভদ্র ভাষায় সম্বোধন করিনি হতভাগাকে। আজও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা একই রকম ঝাঁঝালো ছিল। ‘কেন রে শালা, আমার হাড় জ্বালিয়ে আশ মিটছে না-’। উল্টো দিক থেকে ধমকে ওঠে বন্ধু,‘ বাজে বকিস না। আমার মেয়ের স্কুলে প্রজেক্ট দিয়েছে, ‘বেস্ট ফ্রেণ্ড।’ অফিস আসার সময় বলে এসেছি, দাঁড়া, ফেরার পথে দিদির ছবি নিয়ে আসব। একটু বাচ্ছা বয়সের ছবি পাঠা।’ রোজ খিস্তোই যাকে, আজ I'm honoured ছাড়া কিছু বলতে পারলাম না। ঠিক করলাম এবার থেকে, নো খিস্তি। যথোচিত সম্মান দিয়ে কথা বলব এবং অমুক বাবু ভাই ছাড়া আর কিচ্ছু বলে সম্বোধন করব না। 


Happiness is, যখন জনৈকা ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী এসে এক গাল হেসে জানান,‘ম্যাডাম আমি এসেছি।’ ততোধিক হেসে, ওণার সুর নকল করে, ছদ্ম বিগলিত কণ্ঠে জানাই,‘বেশ করেছেন।’ অতঃপর সুর বদলে মজার সুরে বলি, জানি তো আপনি আসছেন। বাস স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন তো। সাময়িক ভাবে ভড়কে গিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনি কি করে জানলেন ম্যাডাম।’ বাসে আসার পথে দেখেছি ওনাকে। সেটাই জানালাম,  ঠিক কোন জায়গায়,কখন দাঁড়িয়ে  থাকতে দেখেছি। উনি আশ্বস্ত হয়ে বললেন,‘ও ঐ কালো গাড়িটা আপনার ছিল!’ হেসে বললাম, গাড়ি নয় দিদি, বাস। বাসটা আমার ছিল বটে। জানলার ধারেই বসতে পেয়েছিলাম আজ। 


‘আপনি রোজ বাসে আসেন ম্যাডাম?’ ইশঃ, আহাঃ চলল খানিকক্ষণ। সমব্যথী মানুষ পেয়ে গলে গিয়ে মনের দুঃখ উজাড় করে দিলাম আমিও। ‘ তাও রোগা হই না, দেখছেন তো।’ আড়ে বহরে উনিও আমারই মতন। ফলে আমার দুঃখটা ভালোই অনুধাবন করতে পারলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মাথা নাড়িয়ে কইলেন,‘তা হবেননি। তবে ম্যাডাম, কিছু মনে করবেননি,আপনি তো ফেসবুকে আছেন, আমি আপনাকে নিয়মিত ফলো করি আর কি।’ একদফা অপ্রস্তুত হাসি হেসে,‘খুব ভালো লাগে আর কি। আপনাকে। আপনার মেয়েকে, স্যারকে। সেদিন যে সিঁড়িতে বসা ছবিটা দিয়েছিলেন, তাতে তো দেখলাম, আপনার পরিবারের সবাই, ইয়ে মানে আপনারই মত আর কি।’ ছবি একটা দিয়েছিলাম বটে, স্টোরিতে। এক বন্ধুর জন্মদিনে তার বাড়ির সিঁড়িতে বসে অন্য একদল বন্ধু পরিবৃত হয়ে। আমার আগে-পিছে- ডাইনে- বাঁয়ে যারা ছিল, সবাই তন্বী এবং রূপসী। ব্যাপারটা দাঁড়াল, আমার জন্য আমার বন্ধুদেরও লোকে মোটা দেখে। হে ভগবান, এই তো আমি চাই, ‘ if you can't make me thin, make my friends fat’। 


Happiness is, যখন বেলা একটা থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ছটা অবধি একটানা মিটিং করে, বিস্তর চিল্লিয়ে, বকে, ধমকে, অনুনয়, বিনয়, বাবা-বাছা করে অবশেষে সই করাতে পারি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি। কোলাঘাট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেস ওয়ার্কারদের  সঙ্গে ম্যানেজমেন্টের শেষ বার এগ্রিমেন্ট হয়েছিল ২০১২সালে। তাও দ্বিপাক্ষিক। ঠিক এগারো বছর পর সই হল ত্রিপাক্ষিক চুক্তিপত্র। পড়ল সরকারি মোহর। ম্যানেজমেন্ট, মেস ওয়ার্কার এবং ট্রেড ইউনিয়নকে অনেক ধন্যবাদ অধমের ওপর ভরসা রাখার জন্য।