#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা
মোবাইলে যে টাওয়ার নেই খেয়ালই করিনি। দিব্য শান্তিতে কাজ করছিলাম। মাঝে হাত-পা ছাড়াতে, সেকশনে গিয়ে খানিক খোশগল্প ও করে এলাম সবার সাথে। আমাদের চঞ্চল বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। তিনবেলা আহ্নিক করে। টিকি রাখে। কপালে তিলক কাটে। আজকের তিলকটা বড়ই নিখুঁত কেটেছে। কিভাবে এমন সুন্দর তিলক কাটা যায়,সেই সংক্রান্ত খাণিক জ্ঞান আহরণও করে এলাম। তিলক নাকি শুধু মাথায় কাটলেই হয় না। শরীরের বারো জায়গায় কাটতে হয়। প্রতিটা তিলক শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন রূপের নামে কাটা হয়। সাথে সাথে পড়তে হয় সংস্কৃত মন্ত্র। যাতে বলা থাকে শরীরের কোন অংশের তিলক কোন রূপের উদ্দেশ্যে অঙ্কিত।
শরীরের কোথায় কোথায় তিলক কাটা হয়, ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। আমিও শুনব না। চঞ্চলও ছাড়বে না। “শুনুন না ম্যাডাম। শুনলে পূণ্যি হয়। কপালের তিলক কেশবের নামে। কণ্ঠে শ্রী গোবিন্দ। হৃদমাঝে থাকেন শ্রীমাধব। উদরের এক পার্শ্বে শ্রীবিষ্ণু, অন্যদিকে বামনাবতার। মধ্যে নারায়ণ। এক বাহুতে ত্রিবিক্রম আর মধুসূদন আর অপর বাহুতে হৃষিকেশ আর শ্রীধর। পিঠে থাকেন পদ্মনাভ। কোমরে দামোদর। আর মস্তকে বাসুদেব।” বললাম তেরো হল তো। উৎসাহ পেয়ে গুছিয়ে বলে চঞ্চল,‘ না বারোটাই কাটি। কাটার পর যে টুকু মাটি হাতে লেগে থাকে,সেটা মাথায় মুছেনি বাসুদেবের নামে।’ জানতে চাই কাটো কি দিয়ে? জবাব পাই, ছাঁচ আছে। আবার প্রশ্ন করি, কাটো কি দিয়ে, চন্দন কি? চঞ্চল মাথা নাড়ে গম্ভীর ভাবে। ‘না ম্যাডাম। এটা হল দ্বারকার মাটি। যাতে মিশে আছেন আমাদের প্রভু। কেউ কেউ বৃন্দাবনের মাটি দিয়েও কাটে। সেটা কালো হয়। এটা মঠ ভেদে, আচার ও ভিন্ন হয়।’
বেশ ভালো লাগছিল শুনতে। জিজ্ঞাসা করি, মাটিটা পায় কোথা থেকে? উত্তর পাই মায়াপুর থেকে কিনে আনে। ‘বেশি দাম না। একশ টাকা কেজি। একবার কিনলে অনেক দিন চলে যায়। ’ মায়াপুরের কোন মঠে দীক্ষা নিয়েছে চঞ্চল। ইসকন্ নয়।
বৈষ্ণব ধর্ম নেবার ফলে কি কি পরিবর্তন এসেছে, সে গল্পও শোনাল চঞ্চল। আমিষ ছেড়ে দেবার সাথে সাথে কমেছে তমঃ এবং রজ গুণ। সিগারেট ছেড়েছে। চায়ের নেশা ছিল তাও ছেড়েছে। গল্প আরো গড়াত, যদি না বড় সাহেব মেসেজ পাঠাতেন, “তোমাকে ফোনে পাচ্ছি না কেন?’ কি সর্বনাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখি কখন যে মোবাইলের সবকটা টাওয়ার পড়ে গেছে খেয়ালই করিনি। মোবাইলটা রিস্টার্ট দিলাম আর জহর বাবুকে বললাম এক কাপ চা খাওয়াতে।
জহর বাবু কোন এককালে আমাদের নাইটগার্ড ছিলেন। অবসর নিয়েছেন বছর ঘুরে গেল। কিন্তু তাও নিত্য অফিস আসেন। অবসর নিয়ে বাড়িতে থাকা বোধহয় এই সব লোকের পোষায় না। সোয়া নটায় অফিসে ঢোকেন। ঝাড়পোঁচ নিয়ে সুইপার মাসির সাথে এক চোট ঝামেলা করেন। তারপর শুরু করেন চা করতে। চায়ের লোভে কত যে বন্ধু আসে জহর বাবুর। আমি গরহাজির বা অন্যমনস্ক থাকলেই আমাদের ভিজিটর চেয়ার দখল করে তাঁরা বসে পড়েন চা খাবেন বলে। চা খেয়ে চলে গেলেও হয়, তা নয় এরপর শুরু হয় মজলিশি গল্প। ফলে কাকতাড়ুয়ার মত আমাকে চেম্বারের দরজা খুলে মুণ্ডু দেখাতেই হয়। এক ঝাঁকি দর্শনেই সব সাফ। ট্রেড ইউনিয়নের লোকেদের সাথেও ওণার হেব্বি ভাব। ডেপুটেশন দিতে এলেও তাদের বসিয়ে চা খাওয়ান, রসিয়ে সুখদুখ, ভূতভগবানের গল্প করেন জহর বাবু। ফলে আমার ঘরে যখন তাঁরা ঢোকেন, বিক্ষোভের বারুদ ততোক্ষণে ভিজে ন্যাতা।
এ হেন জহর বাবুর চায়ের কোয়ালিটি নিয়ে কোন কথা হবে না। আমার অধিকাংশ ইন্সপেক্টর সাহেব ও চা ছোঁয়ও না। ঐ চা বর্জন করার বদবুদ্ধি আমাকেও দেয়। নেহাৎ আমি খানদানী চা-তাল। জলে চা মোটামুটি একবার দেন জহরবাবু। বাকিটা ঐ চা পাতাতেই চলে। জলটা বারবার পড়ে নতুন নতুন করে। চিনি থাকলে ভালো, নাহলে কোথা থেকে হরির লুঠের বাতাসা যোগাড় করে চায়ে ফেলে দেন জহরবাবু। চড়াম্ চড়াম্ গুড় বাতাসাও থাকে অনেক সময় চায়ে। থাকে কদমা বা বীরখণ্ডিও। সে যে কি ভয়ানক মিষ্টি, বাপরে।
মিষ্টি ছাড়াই দিতে বলি আমি। বেশী বেলা হলে অনেক সময় বলি, জহরবাবু এটা চা? না আপনার হাত মোছাটা ফুটিয়ে দিয়েছেন। রাগ করে না বুড়ো। শুধু মাঝেসাঝে বেপোট চিৎকার করে, ‘জয় গৌরনিতাই’ বলে। ‘ইয়া আল্লাহ’ বলেও চিৎকার করেন অনেক সময়। বেলা তিনটে বাজলেই, আমার অগোচরে মোবাইলে সজোরে হয় কালিকীর্তন নয়তো হরিনাম চালান। সাথে নিজেও গলা মেলান। আমি বেরোলেই, সব চুপ। আসেপাশের দপ্তরের লোকজন নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ওণার গান শোনে।
তো যাই হোক, কাগজের কাপে চা দিয়ে গেলেন জহর বাবু। এক চুমুক দিতেই মনে হল চায়ে জোয়ান দিয়েছেন আজ। এ আবার কি নবতম সংযোজন রে বাপু। এমনিতেই চাটার কোন স্বাদ গন্ধ নাই, নিছক লালচে গরম জলের মত সোয়াদ। তারওপর জোয়ানগন্ধী। ডেকে জানতে চাইলাম, চায়ে জোয়ান দেবার দুর্বুদ্ধিটা কে দিল মশাই আপনাক? জহরবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। ‘জোয়ান, আজ্ঞে?’ বললাম জী আজ্ঞে। উনি সাফাই দিলেন, ব্যাগে চাও ছিল,পুজোর বেলপাতাও ছিল। চায়ে নির্ঘাত পুজোর বেলপাতা মিশে গেছে। বেলপাতায় এমন জোয়ানের গন্ধ বেরোয়, বাপের জন্মে শুনিনি বাপু। বললাম, আরেকবার ভালো করে চা বানিয়ে আনুন দেখি। বেলপাতা -চাপাতাটা তার আগে সটান ময়লার বালতিতে ফেলুন।
আবার চা এল। আবার জোয়ানের গন্ধ। এবার বোধহয় একটা জোয়ানও পড়ল মুখে। জহর বাবুর এক কথা। চায়ে পুজোর বেলপাতা মিশেছে। হতে পারে। আর একটা জিনিস ও হতে পারে,যেটা আমার পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি বলেছিল কিছুদিন আগে, ‘জহরবাবু পান চিবোন তো। হয়তো সেই চিবানো পানই খানিক চায়ে পড়ে গেছে ম্যাডাম।’ আবার ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, জহরবাবু আপনার পান কোথায়? একগাল হেসে বললেন, ‘পান আজ্ঞে?পান তো পকেটে?’ জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, পানে জোয়ান দিয়ে খান না। করলাম না। কিছু প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাত থাকাই শ্রেয়। আপদ বেদজ্যোতি, যত কুচিন্তা ঢোকায় আমার মাথায়। থেকে থেকে চা-পানের পিক আর জোয়ান এই ঘুরতে লাগল সারাটা দিন মাথায়। জহরবাবু যতদিন না মাস্ক পরে চা বানাচ্ছেন, আমি আর চা খাচ্ছি না এই অফিসে।
No comments:
Post a Comment