Tuesday 28 April 2020

অ্যালবেয়ার কামুর, দা আউটসাইডার থেকে কিঞ্চিৎ বঙ্গানুবাদ।

“বৃদ্ধাশ্রম থেকে পাঠানো টেলিগ্রামটায় শুধু লেখা ছিল, মা মারা গেছে, আগামী কাল তার অন্তেষ্টি। পড়ে ঠিক বুঝতে পারলাম না,মা কবে মারা গেল, আজ না গতকাল।
আমাকে ম্যারেঙ্গো যেতে হবে। অ্যালজিয়ার্স থেকে ম্যারেঙ্গো শহরের দূরত্ব প্রায় আশি কিলোমিটার। বেলা দুটোর বাসটা যদি ধরি, পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল হয়ে যাবে। তাহলে কাল মায়ের শেষ ক্রিয়াকর্ম সেরে কাল রাতের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। বসের কাছে দুদিনের ছুটি চাইলাম। এই পরিস্থিতিতে না বলতে পারল না হয়তো, তবে খুশি হল না মোটেই। আমি এটাও বললাম, যে এতে আমার কোন দোষ নেই, তাও কিছু বলল না। বলার পরেই মনে হল, এটা বলা আমার উচিৎ হয়নি। আমি কেন খামোখা ক্ষমা  চাইতে গেলাম, উল্টে ওণারই তো উচিৎ আমাকে সমবেদনা জানানো। হয়তো জানাবেনও,পরশু যখন ফিরে আসব, শোকের কালো  পোশাক পরে। এখনও কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে হয়তো মা মরেনি- কবর দেওয়া হয়ে গেলে অবশ্য আর এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কোন অবকাশ থাকবে না। তখন আক্ষরিক অর্থেই সব শেষ হয়ে যাবে-
আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতই সিঁলিস্টির রেঁস্তোরাতে খেয়ে বেলা দুটোর বাস ধরলাম। প্রচণ্ড গরম। সিঁলিস্টির রেঁস্তোরায় সকলে সমবেদনা জানালো, সিঁলিস্টি তো বলেই ফেলল, “মায়ের মত কেউ হয় না।” ওরা সবাই আমাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে এসেছিল, আমার একটু অস্বস্তি লাগছিল। কারণ যাবার আগে আমাকে ইমানুয়েলের কাছ থেকে কালো টাই আর আর্মব্যাণ্ড ধার করতে হবে। ওর কাকা মারা গেছে কয়েক মাস আগে-
দৌড়তে দৌড়তে বাসে উঠলাম। একে প্রচণ্ড রোদ আর গরম, তার ওপর দৌড়োদৌড়ি, ভিড়, খারাপ রাস্তা, বাসের ঝাঁকুনি সব মিলিয়ে প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙতে পাশের সহযাত্রী মৃদু হেসে জানতে চাইল, অনেক দূর থেকে আসছি কি না, কোনমতে দায়সারা জবাব দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কথা বলতে একদম ইচ্ছা করছে না।
গ্রাম থেকে বৃদ্ধাবাসটা দুকিলোমিটার দূরে। হেঁটেই গেলাম। পৌঁছেই মাকে দেখতে গেলাম, কিন্তু বৃদ্ধাবাসের কেয়ারটেকার জানাল, ডাইরেক্টরের সাথে আগে দেখা না করে, মাকে দেখতে পাব না। উনি ব্যস্ত মানুষ। আমাকেই বসতে হল।
ডাইরেক্টর একজন ছোটখাট চেহারার বয়স্ক মানুষ। করমর্দন করার সময় উনি দীর্ঘক্ষণ আমার হাতটা ধরে রইলেন, হাতটা টেনে সরিয়ে নেওয়া উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। ডেস্কের ওপর কয়েকটা কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “মাদাম মেঁরেশ আমাদের সাথে প্রায় তিন বছর ছিলেন। নিজের বলতে কেউই ছিল না আপনাকে ছাড়া। আপনি চাইলে তাঁকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারতেন- ”। উনি ভর্ৎসনা  করছেন ভেবে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে গেলাম, উনি থামিয়ে দিলেন। “তোমার কিছু বলার দরকার নেই বাবা। আমি তোমার মায়ের ফাইলটা ভালো করে পড়েছি। আমি জানি তোমার সামর্থ্যে কুলোয়নি। একজন নার্স রাখতে পারলে ভালো হত। তোমার সীমিত আয়ে তুমি পারোনি। তাতে কি? উনি আমাদের এখানে ভালোই ছিলেন।” মাথা নেড়ে সহমত প্রকাশ করলাম। “ওণার এখানে কত বন্ধু ছিল জানো?ওণার সমবয়সী লোকজন, যাদের সাথে উনি মনখুলে কথা বলতে পারতেন। ভাগ করে নিতেন অতীত। তোমার বয়স অল্প, তোমার সাথে থাকলে উনি নির্ঘাত একাতীত্বে ভুগতেন-”। 
এটা ঘটনা। যখন আমরা একসাথে থাকতাম,মা সারাদিন চুপচাপ একাই থাকত। বাড়ি থেকে বেরোতে বা ঢুকতে কেবল দেখা হত মায়ের সাথে। কিছু বলত না মা। বৃদ্ধাবাসে পাঠাবার পর,প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন খুব কান্নাকাটি  করত মা। হয়তো বদলে যাওয়াটার সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হত মায়ের। সে তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর তো দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিল মা। তখন হয়তো এই হোম ছেড়ে যেতে বললেই কেঁদে ভাসাত মা।  সেই জন্যই গত বছর খুব বেশীবার আসিনি আমি মাকে দেখতে। আসলে গোটা রবিবারটা নষ্ট হত। টিকিটের দাম, টিকিট কাটার ঝক্কি, বাসে চেপে দুই-দুই, চার ঘন্টা যাতায়াত, সবমিলিয়ে মনে হত বড় হ্যাপা- ”- অ্যালবেয়ার কামুর, দা আউটসাইডার থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ।

✍🏼 অ্যালবেয়ার কামুর, দা আউটসাইডার থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ- আজ দ্বিতীয় পর্ব

(আগের পর্বের লিঙ্ক-কমেন্ট বক্সে)


“ডাইরেক্টর সাহেব একনাগাড়ে বলেই চলেছেন, সবকথা যে মন দিয়ে শুনছি তা নয়। অবশেষে উনি বলে উঠলেন, “মাকে দেখবে তো? চলো। ” চেয়ার ছেড়ে উঠে, নীরবে ওণাকে অনুসরণ করলাম। চেম্বার থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে উনি বললেন, “আমাদের একটা ছোট মর্গ আছে, আজকের মত ওণাকে আমরা ওখানেই রেখেছি। যাতে আবাসিকরা খুব বেশী কাতর না হয়ে পড়ে, আসলে যখনই এখানে কেউ মারা যান, বাকি আবাসিকরা সাময়িক ভাবে, দুই-তিন দিনের জন্য শোকে এমন বিহ্বল, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, যে আমাদের কাজ করতে খুব সমস্যা হয়।”

নীচে ছোট উঠোনে অনেক বয়স্ক মানুষ, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে, বসে বসে গল্প করছিলেন, আচমকা আমাদের দেখে সবাই থমকে গেল। আমরা দৃষ্টির আড়াল হতেই, আবার শুরু হয়ে গেল কিচিরমিচির। একটা ছোট বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন ডাইরেক্টর সাহেব, “মসিয়েঁ মেরেশঁ, আপনি যান। আমি আর ভিতরে যাচ্ছি না। আমি আপিসেই রইলাম, যদি কোন প্রয়োজন হয়, জানাবেন। আর একটা কথা, আপনার মা তাঁর বন্ধুুদের প্রায়ই বলতেন, উনি মারা গেলে যেন সমস্ত আচার মেনেই যেন ওণাকে কবর দেওয়া হয়-। ওণার শেষ ইচ্ছানুসারেই,  আপনার অনুমতি না নিয়েই, আমরা সব ব্যবস্থা করেছি, আগামী কাল সকাল দশটায় ওণাকে কবর দেওয়া হবে।” ডাইরেক্টর সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগোলাম। মা নাস্তিক ছিল না বটে, তবে ধর্ম নিয়ে কোন আদিখ্যেতাও তো কখনও দেখিনি।  


একটা বেশ বড়, আলো ঝলমলে ঘরে রাখা হয়েছে মাকে, দেওয়াল গুলো ধপধপে সাদা, চুনকাম করা। ছাতটা কাঁচের। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলো চেয়ার রাখা। ঘরের মাঝখানে একজোড়া “ X” আকৃতির কাঠের পায়ার ওপর ডালাবন্ধ কফিনটা রাখা। দেখেই বোঝা যায় যে, আখরোট কাঠের পাল্লার গায়ে চকচকে পিতলের স্ক্রুগুলো আলগা করে আটকে রাখা। কফিনের পাশে,কুঁচি দেওয়া ঢলঢলে সাদা পোশাক পড়া একজন আরবী নার্স দাঁড়িয়ে ছিল। উজ্জ্বল রঙা একখণ্ড কাপড়  দিয়ে চোখ বাদে গোটা মাথা-মুখ ঢাকা। 

দৌড়তে দৌড়তে ঢুকলেন কেয়ারটেকার ভদ্রলোক, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন “আমরা ডালাটা ফেলে রেখেছি আপনার জন্য। আপনি এলেই যাতে খুলে দেওয়া যায়। ” বলতে বলতে এগিয়েই যাচ্ছিলেন কফিনের ঢাকাটা খুলতে, মাঝপথে থামিয়ে দিলাম অামি। “থাক। দরকার নেই। ” থতমত খেয়ে বললেন, “মানে? খুলব না?” বললাম, “নাঃ”। বলেই কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল, এভাবে বলাটা বোধহয় উচিৎ হল না। উনি হতভম্ব হয়ে জানতে চাইলেন, “কেন?” এর জবাব আমারও অজানা। উনি বোধহয় আরো কিছু জানতে চাইছিলেন, সংযত কিন্তু দৃঢ় ভাবে জানালাম, “আমি জানি না। ” ভদ্রলোকের গায়ের রঙ লালচে, ফ্যাকাশে নীল দুই চোখ, অন্যমনস্কভাবে পাকা গোঁফে হাত বোলালেন এক দু বার, তারপর বললেন,“বুঝতে পারছি। ” তারপর তড়িঘড়ি একটা চেয়ার টেনে আনলেন আমার জন্য। ইঙ্গিতে বসতে বলে, বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলেন আমার থেকে। 

একটু পরেই উল্টোদিকের নার্সটা ঘর ছেড়ে যেতে উদ্যত হল, উনি আমার দিকে হেলে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, “মেয়েটার কুষ্ঠ হয়েছে জানেন তো”। প্রথম চোটে ওণার কথাটা মাথায় ঢুকল না, তারপর ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, রঙীন হিজাবের তলায়, মেয়েটার গোটা মুখটা, চোখের তলা থেকে সাদা ব্যাণ্ডেজে মোড়া। নাকটা গলে গেছে বোধহয়, নাকের জায়গায় ব্যাণ্ডেজটা টানটান। 


কিছুক্ষণ পর উনি বললেন, “তা-হ-লে আমি আসি-”।বললেন বটে,তবে গেলেন না। আমার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়েই রইলেন, ঘাড়ের কাছে কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ভয়ানক অসোয়াস্তি হয়। বাইরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে, কাঁচের ছাতের ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে শেষ বিকালের মনোরম আলো। জানলার বাইরে গুঞ্জনরত দুটো ভ্রমর- সবমিলিয়ে কেমন যেন ঘুমপাড়ানিয়া আবহ। জুড়িয়ে আসছে চোখ, প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। মাথা না ঘুরিয়ে ভদ্রতাবশতঃ জানতে চাইলাম, “অনেকদিন আছেন এখানে?” উনি বোধহয় আমার প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলেন, ঝটিতি জবাব দিলেন, “তা প্রায় বছর পাঁচেক তো বটেই। ” 


অনেকক্ষণ ধরে একতরফা বকেই চলেছেন ভদ্রলোক। বললেন ওণার বয়স ৬৪। উনি কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি, কয়েকবছর আগেও যদি কেউ বলত, উনি বিশ্বাস করতেন না, যে এইভাবে সুদূর ম্যারেঙ্গোতে এক বৃদ্ধাবাসের কেয়ারটেকার হিসেবে কোনদিন ওণাকে জীবিকা-নির্বাহ করতে হবে। মাঝপথে থামিয়ে জানতে চাইলাম, “আপনি স্থানীয় বাসিন্দা নন?” বলার সাথেসাথেই মনে পড়ে গেল, ডাইরেক্টর সাহেবের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন উনি বলেছিলেন বটে, এখানে ভীষণ গরম। যত তাড়াতাড়ি মায়ের দাফন-কাফন শেষ করা যায় ততোই মঙ্গল। তখনই উনি বলেছিলেন, উনি কাজের জন্য প্যারিঁ থেকে এখানে এসেছেন বটে,তবে নিজের শহরকে একদণ্ডের জন্যও ভুলতে পারেননি। প্যারিঁতে মৃতদেহ তিন থেকে চার দিন খুব সহজেই রেখে দেওয়া যায়, আর এখানে? একদিন রাখলেই পচে দুর্গন্ধ বেরোবে। আমার শুনতে মন্দ লাগছিল না, তবে ওণার স্ত্রী মাঝপথে ধমকে উঠেছিলেন, “তুমি থামবে? বেচারার সামনে এখন এসব কথা কেউ বলে?”এই মুহূর্তে এই ছোট মর্গে বসে উনি বলে চলেছেন, কি ভাবে কপর্দকশূন্য অবস্থায় উনি এখানে এসে পৌঁছান, নেহাৎ শরীরস্বাস্থ্য মজবুত ছিল, তাই এই বৃদ্ধাবাসের কেয়ারটেকারের কাজটা পেতে কোন সমস্যা হয়নি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, “তারমানে শেষ বিচারে আপনিও এই বৃদ্ধাবাসের একজন অধিবাসী, তাই তো?” উনি বলে উঠলেন, “না। না। ” অবাক হলাম বেশ, এখানকার অনেক আবাসিকই ওণার সমবয়স্ক। তাদের সম্পর্কে কিছু বলার সময়, উনি বারবার, “ওরা”, “বাকিরা”, “আবাসিকবৃন্দ” এই ধরণের শব্দবন্ধ ব্যবহার করছিলেন, কখনই “বুড়োমানুষ” বা “বুড়োবুড়ি” মার্কা সম্বোধন করছিলেন না। শেষ বিচারে তারা অবশ্য নিছক আশ্রিত আর উনি তাদের তত্ত্বাবধায়ক, কেয়ারটেকার। ওণার কতৃত্ব অবশ্যই বেশী, নির্ঘাত সুযোগসুবিধাও।”


✍🏼অ্যালবেয়ার কামুর "দা আউটসাইডার" থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ। আজ তৃতীয় পর্ব। 

(আগের-পরের পর্বের লিঙ্ক কমেন্ট বক্সে)


"ঝপ্ করে সন্ধ্যা নামল। মর্গের কাঁচের ছাতের ওপর   নিকষ আলো আকাশের চাঁদোয়া। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক উঠে আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলেন, অকস্মাৎ তীব্র আলোয় ধাঁধিয়ে গেল চোখ। উনি আমাকে এইবেলা নৈশ ভোজ সেরে নিতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু একদম খিদে নেই। অন্তত এককাপ কফি খাবার জন্য পিড়াপিড়ি করছিলেন ভদ্রলোক, জানালাম কফিতে আমার আপত্তি নেই। নিজেই দৌড়লেন এককাপ সাদা কফি আনতে, কফিটা শেষ করার পর, একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছিল। মায়ের সামনে এই অবস্থায় সিগারেট ধরানোটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে বুঝতে পারলাম না। তারপর মনে হল, এই মুহূর্তে সিগারেট ধরানো বা না ধরানোয় মায়ের খুব একটা কিছু আসে যায় না। 

কেয়ারটেকারকে সিগারেট অফার করতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন,  দুজনে নীরবে ধূমপান করছিলাম, এমনসময় উনি বললেন, “ আমি এবার উঠি বুঝলেন। এখুনি আপনার মায়ের বন্ধুরা এসে পড়বে। কয়েকটা চেয়ার আর কফির ব্যবস্থা করি। ওঁণারাও আজ রাতটা এই ঘরেই কাটাবেন, আপনার সাথে। এখানে এমনই হয়। ”  উনি উঠে যাচ্ছিলেন, আমি অনুরোধ করলাম, যাবার আগে যদি অনুগ্রহ করে কয়েকটা আলো নিভিয়ে দিয়ে যান, রীতিমত চোখে লাগছে। উনি কাঁচুমাচু মুখে জানালেন, সেটা সম্ভব নয়। সুইচ একটাই, ফলে একটা নেভাতে গেলে সবকটাই নিভে যাবে। 

কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, তারই মধ্যে উনি বেশ কয়েকবার ঢুকলেন, বেরোলেন,চেয়ার গুলো সাজালেন, কয়েকটা কাপ আর পট ভর্তি কফি এনে একটা চেয়ারের ওপর রাখলেন, তারপর কফিনের ওপারে আমার মুখোমুখি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমার পিছনের দরজাটা খোলা, ঠাণ্ডা শিরশিরে একটা বাতাস বারবার এসে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরের মধ্যে। বাতাসে একটা চাপা মিষ্টি ফুলেল গন্ধ। গরম কফিটা খেয়ে ছিলাম বলেই হয়তো বেশ আরাম লাগছিল- কখন চোখ জুড়ে গেছে বুঝতে পারিনি। 

গায়ে হাল্কা কিছুর স্পর্শে ঘুমটা ভেঙে গেল, তড়িঘড়ি চোখটা খোলা মাত্রই ধাঁধিয়ে গেল। সাদা দেওয়াল গুলোর জন্য আলোর উজ্জ্বলতা আরো বেড়ে গেছে। মায়ের বন্ধুরা আস্তে আস্তে ঢুকতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে জনা দশেক হবে। মহিলারা সকলেই বেঢপ মোটা, কোমরে টাইট করে বেঁধে রাখা অ্যাপ্রনের জন্য পেটগুলো ঢাউস বলের মত ফুলে আছে। পুরুষরা অপরদিকে পুরুষরা সকলেই সিড়িঙ্গে, সকলেই লাঠি ঠুকঠুক করে হাঁটে। ওণারা নীরবে প্রবেশ করে, পেতে রাখা চেয়ারগুলিতে বসে পড়লেন। প্রত্যেকের মুখ বলিরেখায় ঢাকা, চোখই দেখা যায় না। চোখের কাছটা সামান্য চেরা, যার ভিতর থেকে একটা ফ্যাকাশে মরা মরা আলো বেরিয়ে আসে। ওণারা সকলেই আমাকে দেখে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালেন। আমাকে দেখে কি না জানি না,মনে হল সামান্য বেঁকে গেল মুখগুলো, অবশ্য ভুলও হতে পারে, কারোরই তো দাঁত নেই, ঠোঁটগুলো   এমনিতেই চুপসে গিয়ে মুখগহ্বরে ঢুকে গেছে। তখনি খেয়াল করলাম, আমার পাশে কেউ বসেনি। সকলে একজোট হয়ে কেয়ারটেকারকে ঘিরে আমার উল্টোদিকে গিয়ে বসেছেন। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য মনে হল, এনারা আমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যই আজ এখানে জমায়েত হয়েছেন বুঝি- 

তখনি এক বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করলেই, দ্বিতীয় সারিতে বসেছেন ভদ্রমহিলা, এপাশ থেকে আমি ওণাকে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু একঘেঁয়ে মৃদু ফোঁপানির আওয়াজ পাচ্ছি। উনি কেঁদেই চলেছেন, কখন থামবেন কে জানে। অন্যান্য সকলেই নির্বাক, শোকস্তব্ধ,  গুটিসুটি  মেরে বসে আছেন যে যার চেয়ারে। হয় একদৃষ্টিতে কফিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, অথবা তাকিয়ে আছেন হাতের লাঠিটার দিকে। মহিলা কেঁদেই চলেছেন। একটু খারাপ লাগছিল ওণার জন্য, উনি কে আমি জানি না, আমি চাই উনি শান্ত হন, কিন্তু সেকথা বলার মত সাহস জোটাতে পারছিলাম না। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক ওণার পাশে বসে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন খানিকক্ষণ। ফিসফিস করে কিছু কথাবার্তাও হল। মহিলা মাড়া নেড়ে কিছু বললেন, তারপর আবার ফোঁপাতে শুরু করলেন। হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়লেন কেয়ারটেকার। কফিনটাকে ঘুরে আমার পাশে এসে বসলেন, বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে, আমার দিকে না তাকিয়ে, আস্তে আস্তে বললেন, “ আপনার মায়ের সাথে খুব ভাব ছিল ওণার। উনি বলছেন, এই আশ্রমে আপনার মা’ই ওণার একমাত্র বন্ধু ছিলেন। আর ওণার আপন বলতে কেউ রইল না। ”

No comments:

Post a Comment