Wednesday 15 April 2020

অনির ডাইরি, ১৫ই এপ্রিল, ২০২০


ঠিক এই মুহূর্তে কুড়ি লাখ ছাড়াল বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত সোয়া লক্ষ। আঙ্কল শ্যাম যথারীতি সবার আগে,আক্রান্তের সংখ্যা ছাপিয়েছে লাখ ছয়েক, যার মধ্যে মৃত ছাব্বিশ হাজার। কোথায় যেন পড়লাম, প্রকৃতিগত ভাবে কোভিড ভাইরাস বেশ সদাশয়। আশ্রয়দাতাকে কোতল করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা এর নেই। বরং “হোস্ট” জীবিত থাকলেই কোভিডের লাভ-। প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যুকে যদি পাশাপাশি ফেলে হিসেব করা যায়, দেখা যাবে করোনায় মৃত্যুর হার মেরে কেটে ২-২.৫শতাংশ।  কিন্তু ঐ যে বললাম, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা, ঐ খানেই আছে প্যাঁচ, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা কত কেউ জানে না। কোভিড ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ইতিমধ্যেই আমাদের ঠোঁটস্থ, WHO যদিও বলছে গড়ে ৫-১৪দিন, মোটামুটি হপ্তা দুয়েকই ধরুন না। অর্থাৎ আপনার কোভিড আক্রান্ত হবার হপ্তা দুয়েকের আগে আপনি টেরও পাবেন না, আপনাকে “সে” ধরেছে। তারপরও না টের পেতে পারেন। WHO বলছে, কোভিডের আশ্রয়দাতা অথচ শরীরে ছিটেফোঁটাও করোনার লক্ষণাবলী প্রকাশ পায়নি, এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম কিছু নয়। আর এরাই সবথেকে বিপজ্জনক। এদের অজ্ঞাতেই এরা ছড়িয়ে দেয় এই সদাশয় মহামারী।এদের পোশাকী নাম, Asymptomatic।  WHO তো আরও বলছে, শতকরা ৮০ভাগ আক্রান্তের প্রয়োজনও হয় না কোন চিকিৎসার। প্রতি ছয় জনের মধ্যে মাত্র একজন ভোগে তীব্র শ্বাসকষ্টে, তিনি যদি ভাগ্যবৈগুন্যে immunocompromised হন, অর্থাৎ যাঁর অনাক্রম্যতার প্রাচীরে আগে থেকেই ধরেছে ফাটল, তাহলে অবশ্যই করোণা তাঁর পক্ষে মারাত্মক। বয়স্করা যেহেতু গণ হারে সুগার-প্রেশার-ডায়বেটিস ইত্যাদিতে ভোগেন, তাই বারংবার তাঁদের স্বাস্থ্যের দিকে ধ্যান রাখতে বলা।

এখন কথা হচ্ছে যে ব্যধিতে মৃত্যুর হার এত স্বল্প, তাই নিয়ে এত মাতামাতি কেন? হয় যদি করোণা হোক না। বরং একবার আক্রান্ত হয়ে বেঁচে গেলে, শরীরে তৈরি হয় অ্যান্টিবডি, ফলে হিসেব মত আর দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার থাকে না কোন সম্ভবনা। এই তথ্যকে মাথায় রেখেই লকডাউন করেনি সুইডেন। খোলা আছে, সিনেমা-থিয়েটার, হোটেল-রেস্তোরাঁ- পাব। জনগণের সুমতির ওপর ভরসা রেখেছে সরকার, আপনারা সাবধান হোন। দূরত্ব বজায় রাখুন। বাকি জীবন চলুক আপন ছন্দে।  আমেরিকা থেকে ট্রাম্প খুড়ো জুড়েছে বেজায় হল্লা, গোটা বিশ্ব যার ভয়ে থরথর, যে ব্যধির হাত থেকে মুক্তি পায়নি খোদ বৃটেনের বুড়ো যুবরাজ এবং প্রধানমন্ত্রী, বা কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ঘরনী, যে রোগের কোপে ভুগছে খোদ সৌদি আরবের রাজপরিবার, মারা গেছেন স্পেনের রাজকুমারী, হেন রাজরোগ নিয়ে এই ভাবে ছেলেখেলা? আমেরিকা অবশ্য খোদ বসে আছে আগ্নেয়গিরির মাথায়। সারা দেশে এই মুহূর্তে আক্রান্ত সোয়া ছয় লক্ষ ছাপিয়েছে। আক্রান্ত পড়লেন কি? পড়বেন না, পড়ুন সনাক্ত। আক্রান্ত কত কে জানে? সনাক্তকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে আমেরিকার ফল আসে 0.19%। আর সুইডেনের আসে 0.11%। তাহলে কি দাঁড়াল? কোনটা বেশী কার্যকর লকডাউন না তালা খোলা?
বড় জটিল এই হিসেব, ঘরে বসে তথ্যের কচকচি করাই যায়, কিন্তু কথা হল,  স্বয়ং WHO যেখানে ঘেঁটে আছে। আমরা কোন ছাড়। আমরা তো এই আকালেও স্বপ্ন দেখি। কেটে যাবে কালো মেঘ, খুলে যাবে বাতায়ন। শৌভিকের চাপে, কদিন আগেই পড়া অ্যালবেয়ার কামুর প্লেগ উপন্যাসটার কথা থেকে থেকে মনে পড়ে। মনে পড়ে যায়, উত্তর অ্যালজিরিয়ার ওরাণ শহর আর তার অধিবাসীদের কথা। যেখানে প্রথমে মরছিল ইঁদুর, ইঁদুর থেকে সংক্রামিত হল মানুষে। গড়িমসি করতে করতে অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হল কতৃপক্ষ, হ্যাঁ ফিরে এসেছে প্লেগ। রাতারাতি অবরুদ্ধ হল শহর। কোন কাজে যারা বাইরে গিয়েছিল, বন্ধ হয়ে গেল তাদের ফেরার পথ। আর যারা ভিতরে আটকে গেল- তারা ভিড় করতে লাগল নগরীর বন্ধ গেটের সামনে। অনুনয়-বিনয়- উৎকোচ। কিছুই খোলাতে পারল না নগরীর প্রবেশ দ্বার। দিন যায়, হপ্তা কেটে মাস ঘুরে যায়। ঘুরে যায় মরশুম। নগরবাসীরা প্রতিনিয়ত ভাবে, আর তো কটা দিন- তারপরই মূল স্রোতে ফিরবে জীবন। পাঠক পড়ে আর অজানা আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে ওঠে। অবশ্য ওরানের ডাক্তার বা নার্সদের কেউ পিটিয়েছিল কি না কোথাও লেখা নেই। লেখা নেই জবরদস্তি উচ্ছেদের কথাও। এতটা নির্বোধ বোধহয় ছিল না ওরানবাসীরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ছয় বছরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে মারা গিয়েছিল সাড়ে আট কোটি মানুষ। করোনার বয়স সবে মাস তিনেক। প্রত্যক্ষ শিকার ছাপিয়েছে সোয়া লক্ষ। আর পরোক্ষ? সে অঙ্ক কষতে পারে হয়তো বান্দ্রায় পড়ে থাকা ধুলিমলিন সস্তা আধছেঁড়া চপ্পলের দল। কষতে পারে দিল্লীর ক্রন্দসী জননী, খালি পেটে থাকতে থাকতে যার শুকিয়ে আসছে অমৃতধারা। কষতে পারি,হয়তো কষবও, আমরা।আপনার করোনা হোক বা নাহোক, নিশ্চিত থাকুন আমূল বদলে যেতে বসেছে আপনার আমার জীবন। ২০২০ সত্যই জলবিভাজিকার বছর, সন্ধিক্ষণ, যাকে টপকে কখনই আর ফিরে যাওয়া যাবে না- ফিরে পাওয়া যাবে না পুরোনো জীবনকে।

No comments:

Post a Comment