Friday, 17 April 2020

অনির ডাইরি, ১৬ই এপ্রিল, ২০২০


#lockdown #lockeddown
বেচারা তুত্তুরী, এখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। নতুন বইখাতা পায়নি। তাতে অবশ্য মহানন্দেই আছে তুত্তুরী। ইদানিং শুধু বাবা জবরদস্তি ব্যায়াম করাতে আর বই পড়াতে শুরু করেছে। পড়ার বই নয় অবশ্য, গল্পের বই। সকাল থেকেই ব্যায়াম করার সময় আর পাতার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে বাবা, অত পাতা পড়লে তবেই মিলবে মোবাইল। থুড়ি আজকাল মোবাইলও তো পায় না, ল্যাপটপে সিনেমা দেখায় বাবা। সোনার কেল্লা থেকে শুরু করে ফেলুদার সব সিনেমাই দেখে ফেলেছে বাপ-মেয়েতে। দেখে ফেলেছে আজব গাঁয়ের আজব কথা, আলিনগরের গোলকধাঁধা আরও কি যেন সব। সিনেমা শুরুর আগে অবশ্য প্রতিবারই শৌভিক রান্নাঘরে এসে এক প্রস্থ নাকে কেঁদে যায়। একা সিনেমা দেখতে চায় না তুত্তুরী। পাশে বসে দেখতে হয় বাবাকেও। বুঝিয়ে দিতে হয়। শুধু কি তাই? কেউ বন্দুক বার করলেই বাবার কোলে উঠতে চায় তুত্তুরী। কেউ খুন হলেই,সিনেমা ফেলে রান্নাঘরে ছুটে আসে তুত্তুরী।

অবসাদ হলেই আমার ঘনঘন খিদে পায়। আর বেশী খেয়ে ফেললেই ঘিরে ধরে তীব্র অপরাধ বোধ। মনেপ্রাণে চাই একটু অতিভোজন করুক না হয় শৌভিকও, তাহলে নির্ঘাত কিছুটা হাল্কা হবে অপরাধ বোধ। আমরা সবাই পাপী, সবাই হ্যাংলা, মার্কা স্বস্তির অনুভূতি হবে একটা। পেড়াপিড়ি করি, আর একটা রুটি বেশী খাও। আর এক হাতা ভাতা নাও অন্তত। আর একটু চাউমিন নেবে না? এ বাবা আমি যে আবার নিলাম। রেগে যায় শৌভিক। লকডাউনের আগে,রোজ ঘন্টাখানেক শরীরচর্চা করত। পাঁচটা জিনিস কিনতে পাঁচবার বাজার যেত। ইচ্ছে করে আবাসনের বাজারে ঢুঁ না মেরে ঘুরপথে, দূরের বাজারে যেত। রোদ পুড়ে তামাটে হয়ে ফিরত, ঘামে সপসপ করত গেঞ্জি। সেসব এখন ইতিহাস। কোভিড ভিজুয়ালাইজারে ক্ষণে ক্ষণে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে, তাও নাকি তার আজকাল খিদে হয় না। মাঝে মাঝে ভয় দেখায়, একাহারী হবে। বন্ধ করে দেবে রাতের খাওয়াটা। এসব শুনলেই মনে হয়, এর থেকে সন্ন্যাস নেওয়া ভালো। আজ বলেই ফেললাম, গৃহত্যাগী হব। খপ করে বাঁ হাতটা চেপে ধরল তুত্তুরী, “না মা। ” কন্যার সীমাহীন ভালোবাসায় আদ্র হয়ে ওঠে হৃদয়, সান্ত্বনা দি, না, না তুমি বড় হও, স্বনির্ভর হও তবে না। তখন যাব। কন্যার বাপকে খোঁচা দেবার জন্য বাঁকা সুরে বলি, “তখন বাবার আবার বিয়ে দিও। কেমন-”। গম্ভীরমুখে রুটি চিবোতে চিবোতে ঘাড় নাড়ে শৌভিক। প্রথম চোটে অবাক হয় তুত্তুরী, তারপর একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, “কিন্তু বাবা তো তখন বুড়ো হয়ে যাবে মা। আর বুড়ো লোককে কেউ বিয়ে করে না। ” জানালাম আলবাৎ করে।  শুনে খুশি হয়ে ওঠে তুত্তুরী, বলে, “হ্যাঁ। তাহলে একটা ফর্সা মোটা বুড়ি খুঁজতে হবে। তার সাথে বাবার বিয়ে দেবো। ” আবার ফর্সা আর মোটা? না বাবু, এটা বরং বাবাকেই বেছে নিতে দিস্। এঁটো হাতেই বুড়ো বাপের স্বয়ম্বর সভার পরিকল্পনা করতে শুরু করে তুত্তুরী। অলস মস্তিষ্ক হলে যা হয়-।

রাতের বাসন মাজা শেষ। শেষ হয়ে আসছে আর একটা তালাবন্ধের দিন। বিছানা করতে করতে হুঁশিয়ারি দেয় শৌভিক, খাট কাঁপিয়ে হাসা চলবে না।ওমন রোজই বলে-  ফ্রেন্ডস্ দেখা শুরু করেছি, নতুন করে। এই নিয়ে কত বার যে দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিটা চরিত্র হাতের তালুর মত চেনা। মুখস্থ প্রতিটা এপিসোড। নেটফ্লিক্সে প্রথম যখন ফিরে এসেছিল ফ্রেন্ডস্, ঠিকই করে নিয়েছিলাম, আর দেখব না। ঢের হয়েছে। স্কুলের শেষ ভাগ থেকে কলেজ ঘুরে চাকরী, প্রেম- বিরহ- বিবাহ জীবনযুদ্ধের প্রতিটা মুহূর্তে যারা ছিল সত্যিকারের দোস্ত, কবে যেন ছেড়ে দিয়েছিলাম তাদের হাত। বছর পাঁচেক আগে, একবার দেখার চেষ্টা করেছিলাম, তীব্র মনখারাপ নিয়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই দূরদর্শন যন্ত্রটা। কবে বেড়ে গেল এতটা বয়স? আর কিছুতেই একাত্ম হতে পারিনি ফুরফুরে চরিত্রগুলোর সাথে। বরং রীতিমত ঈর্ষান্বিত বোধ করেছিলাম। ফেলে আসা সময়, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের জন্য হাহাকার করে উঠেছিল হৃদয়। কি ভাবে বদলে গেল জীবন? সেক্স ইন দা সিটির সারা জেসিকা পার্কার আর তার গার্ল গ্যাং এর সাথে বরং খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক মিল। দেখতে বাধ্য করেছিলাম আমার প্রিয়বান্ধবীদের। তথাকথিত এক আঁতেল দিদি তো বিগলিত হয়েই বলেই ফেলেছিল, “ওরে,এতো পুরো আমরা রে!” তাহলে আবার ফ্রেন্ডস্ কেন? কি জানি? হয়তো লকডাউন জনিত অবসাদের জন্যই আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছিলাম প্রিয় বন্ধুদের কাছে- পুরোনো মদের মতই, হয়তো সম্পর্কগুলোও যত পুরোনো হয়, ততোই বাড়তে থাকে তাদের আবেদন। যাই হোক। আপাততঃ এইটুকুই, প্রতীক্ষারত আমার বন্ধুরা। চুপিচুপি বলি, যাদের একজনের প্রতি বরাবরই বিশেষ দুর্বল আমার হৃদয়। সে কে? সেটা বরং উহ্যই থাক-

No comments:

Post a Comment