"He was a spy, who had fallen in love with the land of his mission and remained its lifelong lover.- তিব্বত চিরকালই বহিরাগতদের সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। দুর্গম প্রাকৃতিক অবস্থান, সীমান্ত রক্ষায় সদাজাগ্রত দুর্দম, নৃশংস,শত্রুপরায়ন জনজাতি সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, অগম্য করে রেখেছিল তিব্বতকে। অগম্য বলেই হয়ত চরম রহস্যময়। উনবিংশ শতকের শুরু থেকেই সমগ্র এশিয়া জুড়ে ক্ষমতা বিস্তারে ব্যাপৃত হয় দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র বৃটেন আর রাশিয়া। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও আতঙ্কিত তথা সন্দেহপরায়ন হয়ে ওঠে তিব্বত। কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করা হয় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ। শ্বেতাঙ্গ ছাড়ুন, সমতলবাসী ভারতীয়দেরও প্রবেশানুমতি দিতে অস্বীকার করে তিব্বত।
যদিও, দুই দেশের মধ্যে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা ব্যবসাবাণিজে পড়েনি কোন প্রভাব। এই বাণিজ্য একতরফা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করত তিব্বতীয় আর সীমান্তে বসবাসকারী কিছু পাহাড়ি উপজাতি। এরা ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিল কেবল মাত্র বৌদ্ধ শ্রমণদের। কয়েক শ বছর ধরে, অগণিত বৌদ্ধ শ্রমণের পদধূলি ধন্য এই পথ, বৃটিশদের জন্য এটাই ছিল লোহার বাসর ঘরের একমাত্র ছিদ্র। এই পথেই, গোপনে পাঠানো হত শ্রমণের ভেকধারী গুপ্তচরদের। এদের বলা হত “পণ্ডিত।” মধ্য এশিয়ায় ব্যাপৃত বৃটেন আর রাশিয়ার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এরা ছিল পাতি ক্রীড়ানক। অধিকাংশই দরিদ্র অশিক্ষিত পাহাড়ি জনজাতির মানুষ। জমিজরিপ সম্পর্কিত সামান্য প্রাথমিক শিক্ষানবিশী করেই এদের ঠেলে দেওয়া হত, সাংঘাতিক বিপজ্জনক মিশনে।হাতিয়ার বলতে থাকত বিশেষ ভাবে তৈরি কিছু যন্ত্রপাতি, যা ঝোলার মধ্যে লুকিয়ে, সীমান্তরক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ওপারে নিয়ে যেত এই গুপ্তচরের দল। সেক্সট্যান্ট, থিওডোলাইটের মত মাপন যন্ত্র লুকোনো থাকত বাক্সের কোন গোপন কক্ষে, ছড়ির ভেতর লুকানো থাকত কম্পাস, ফাঁকা জপযন্ত্রের মধ্যে লুকানো থাকত পাকানো কাগজ আর উচ্চতা মাপার হিপসোমিটার। জপমালায় ১০৮ এর পরিবর্তে থাকত ১০০খানা পুঁতি। পা গুনে গুনে দূরত্ব মাপত এরা, পরিমাপ-জরিপ করত তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চল। কয়েকজন পণ্ডিত যেমন অসাধারণ দক্ষতা তথা সাহসের পরিচয় দিয়েছিল, তেমনি পরাভূত, নির্যাতিত, নিহত পণ্ডিতের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না। এমনি এক পণ্ডিত নয়ন সিং রাওয়াতকে, পরবর্তীকালে তাঁর অবিস্মরণীয় তথা দুঃসাহসিক কাজের জন্য স্বর্ণপদক দিয়ে সংবর্ধনা জানায় দা রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটি।
তবে এদের মধ্যে প্রথাগত শিক্ষার অভাব থাকার জন্য, এরা কখনই তিব্বতের ভূপ্রকৃতি, জনজীবন বা সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিশদ তথ্য যোগাড় করে উঠতে পারেননি। এই নিয়ে বৃটিশ সরকারের খেদ ছিল বরাবরই। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, বাস্তু প্রযুক্তিবিদ্ শরৎচন্দ্র দাস, তাই সরকার বাহাদুরের চোখে ছিলেন এই কাজের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। তিব্বতের প্রতি তাঁরও ছিল অদম্য প্রেম।"
“ঁশরৎচন্দ্র দাশের জন্ম, অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত চট্টগ্রাম জিলায়। প্রেসিডেন্সী কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কালীনই, তাঁর বুদ্ধিমত্তা আর অধ্যাবসায়, গোরা শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ডিগ্রী লাভের পূর্বেই তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়,সুদূর দার্জিলিং জেলার ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলে।
পাণ্ডববর্জিত জায়গায় পাহাড়ি ছেলেদের বোর্ডিং স্কুল, আর তার প্রধান শিক্ষক হিসেবে এক তরুণ বাঙালী ইঞ্জিনিয়ারের নিয়োগ আসলে ছিল বৃটিশ সরকারের এক গভীর চক্রান্তের সূচনা।
সিকিমের রিনচেনপং বৌদ্ধ বিহার থেকে আগত লামা উগেন গ্যাৎসো ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। রিনচেনপং বিহারের সাথে, তিব্বতের শিগাটযের তাসিলহুনপো বিহারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। মূলতঃ উগেনের উদ্যোগেই তাসিলহুনপো থেকে পাওয়া যায়, শরৎচন্দ্রের তিব্বতে প্রবেশের ছাড়পত্র। শুধু তাই নয়, শরৎচন্দ্রের তিব্বত যাত্রার অন্যতম সহযাত্রীও ছিলেন লামা উগেন গ্যাৎসো।
গোপন মিশনে যাবার প্রাক্কালে শরৎচন্দ্রের মাসিক বেতন এক ধাক্কায় ১৫০টাকা থেকে বেড়ে হয় ৩০০ টাকা। রওনা হবার পূর্বে, শরৎচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে শুধু জানিয়েছিলেন, যে তিনি আপিসের জরুরী কাজে দিন কয়েকের জন্য শিগাটযে যাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী জানতেনও না, এই শিগাটযে কোথায়, বা কি তাঁর এই জরুরী কাজ। তিনি জানতেনও না যে, শরৎচন্দ্রের অকালমৃত্যু হলে তাঁর জন্য মাসিক ১০০টাকা পেনশন ধার্য করেছেন সরকার বাহাদুর।
শরৎচন্দ্র দুবার তিব্বত যান। প্রথম বার ১৮৭৯ সালে চার মাসের জন্য, আর দ্বিতীয়বার ১৮৮১ সালে চোদ্দ মাসের জন্য। মূলতঃ দ্বিতীয় অভিযানে তিনি যে বিশদ তথ্য যোগাড় করেছিলেন, তার উপর নির্ভর করে দুটি রিপোর্ট জমা করতে হয় তাঁকে, একটি রিপোর্ট গোয়েন্দা দপ্তরের জন্য আর দ্বিতীয়টি জমা করেন সার্ভে দপ্তরে। উনবিংশ শতকের অন্তিম ভাগেও এই দুইটি রিপোর্টই ছিল অত্যন্ত গোপনীয় এবং সংরক্ষিত। অবশেষে ১৯০২ সালে পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়, “Journey to Lhasa, The Diary of a Spy”।
তাঁর পূর্বসূরী ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের থেকে শরৎচন্দ্রের অভিজ্ঞতা ছিল অনেকটাই আলাদা। বলাইবাহুল্য শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশী। খুব সহজেই তিনি মিশে গেছেন স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে। শ্বেতাঙ্গ অভিযাত্রীদের তুলনায় ন্যূনতম বাজেটে,স্বল্প রশদ আর লোকবল নিয়ে যাত্রা করতে হয়েছে তাঁকে। কোথাও রাত্রিবাস করেছেন মেষপালকের কুটিরে,কোথাও বা পথের ধারে গ্রাম্য বিহারে। পথে সহযাত্রী ভৃত্য তথা কুলিদের সাথে গড়ে উঠেছে উষ্ণ সম্পর্ক। নভেম্বরের শীতে,সামান্যতম গরম পোশাকে, যন্ত্রপাতি বা আধুনিক উপকরণ ছাড়াই, যে ভাবে তাঁরা পার হয়েছেন একের পর এক দুর্গম গিরিখাত, তা রীতিমত বিস্ময়কর। তাজ্জব করে দেয় পেশাদার পর্বতারোহীদেরও।
যদিও দুর্গম পথের থেকেও বহুগুণ বিপজ্জনক ছিল, দুই দেশের সীমানা বরাবর বসবাসকারী উপজাতির দল। সর্বদাই অভিযাত্রীদের উপর যাদের ছিল তীক্ষ্ণ নজর। তিব্বতী ভাষায় তাঁর দক্ষতা আর বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞানের দৌলতে, এই প্রহরী উপজাতিদের হাত থেকেও সহজেই গলে বেরিয়ে যান শরৎচন্দ্র। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া তথা একাত্ম হবার তাঁর ছিল এক অস্বাভাবিক সহজাত প্রবণতা।" -শ্রী পরিমল ভট্টাচার্যের ভূমিকা থেকে খানিকটা বঙ্গানুবাদ। Journey to Lhasa, The Diary of a Spy by Sarat Chandra Das
No comments:
Post a Comment