ঘুম ভাঙলেই ছুটে যাই বারন্দায়। সূর্যের আলো তখন সদ্য এসে পড়ে সোনালী পয়সা পাতার ওপর। অকাতরে ঘুমায় আমার ঘৃতকুমারী। জলের ঝাপটায় আড়ামোড়া ভাঙে আধ ঘুমন্ত গোলাপ আর জবা।ঘুমঘুম চোখে মাথা তুলে তাকায় ঘণ সবুজ পয়সা পাতা। নয়নতারার শাখায় তখন গোলাপী আবিরের আঁকিবুকি। ভেজা মাটির সুবাসে মিশে যায় বেল ফুলের সৌরভ।এই মুহূর্ত আমার বড় প্রিয়। করিডরে রাখা ক্যাকটাস্, যাকে তুত্তুরী আদর করে নাম দিয়েছে ক্যাকটু, কে যেন ভেঙে দিয়ে গেছে তার শাখা প্রশাখা। শৌভিকের মতে গৃহবন্দী থাকতে থাকতে পাগলে গেছে মানুষজন। তাদেরই কেউ আর কি-
যবে থেকে রজার ফেডেরার দেওয়ালে বল পেটানোর ভিডিও আপলোড করেছে, শৌভিক পদে পদে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। মুখে একটাই বুলি, “লকডাউনে পাগলে গেছে সবাই।” সাধের ক্যাকটাসের দুঃখ এত সহজে মরে না। দীর্ঘ অভিসম্পাতের ফাঁকেফোকরে মাথায় ঘোরে জটিল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। হত্যাকারী কে? দোতলায় সদ্য ভাড়া আসা অবাঙালি পরিবারের হনুমান মার্কা দুলাল, নাকি তিনতলার নিঃসঙ্গ বিধবা ভদ্রমহিলার সর্বক্ষণের সঙ্গী অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা? তুত্তুরীর মতে এটা লেলো-কেলোর কাজ। শৌভিক গ্যালারিতে বসে উপভোগ করে আমাদের চাপানউতোর। “দোতলা থেকে লোক সিঁড়ি ভেঙে আসবে, তোর গাছ ভাঙতে? হোঃ হোঃ।” নাঃ কুকুর নয়, কোন মানুষ অথবা মানুষীরই কাজ। এসেছিল একটা ডাল ভেঙে নিয়ে যেতে। জানে না তো আমাদের ক্যাকটু কি জিনিস। এমন কাঁটা ফুটিয়েছে বাপঃ বাপঃ বলে পালিয়েছে বাছাধন।
বাজারওয়ালার একগাল হাসিতেও যায় না বিরক্তি। মুড়ো ফেরৎ চাই আবুর কাছে। গোটা মাছ কেনা সত্ত্বেও কেন মুড়োটা দাওনি বলে ধমকাইও। আবু একগাল হেসে জানায়, “বিশ্বাস করেন বউদি, আজ একটাও মুড়া নাই। কাল সকালে আমি নিজে মুড়া দিয়ে আসব আপনার বাড়ি। ”
মার্কেট আজ বেশ ফাঁকা। জনগণও নিরাপদ দূরত্বে লাইন দিয়ে শান্ত ভাবে কেনাকাটা করছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কি একটু বাড়ল? অখণ্ড নীরবতার মাঝে দু একটা গাড়ির হর্ণের আওয়াজ আরও বিরক্তিজনক। কেত মারা হাফপ্যান্ট আর হাতকাটা টি শার্ট পরা দোকানীর গা ভর্তি ট্যাটু। বিগলিত হেসে জানতে চায়, “বউদি, এ মাসের মাসকাবারিটা আমার থেকেই নিচ্ছেন তো?” দাদাকে আগেই পটিয়ে রেখেছে। আমাকে পটাতে পারলেই কেল্লা ফতে। মাল না দিয়ে মুণ্ডপাত করে বিগবাস্কেট আর গ্রোফার্সের। জানায় যা চাইব, তাই পাব ওর কাছে। দাদাকে এত ভালোবাসে, যে এই দূর্মূল্যের বাজারেও এমআরপির থেকে কমই নেবে সবকিছু। কাকুতি-মিনতি করে বলে চলে, “তেমন হলে বউদি চাল-ডালটা ওদের থেকে নিন। বাকি সব আমিই দিয়ে দেব”। ঠিক এই কথাটাই গত রাত্রে শৌভিক বলছিল, বাতাসে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাই। ব্যাগের মধ্যে মালপত্র গুলো গোছাতে গোছাতে বলে চলে দোকানদার, “সব ভ্যারাইটি পাবেন বউদি। সব কিছুতে এমআরপির থেকে চার পাঁচ টাকা কম নেব। মাল গুছিয়ে আপনার বাড়ি পৌঁছে দেব, শুধু একবার জানিয়ে দেবেন কি চাই-”। একহাত দূরে দাঁড়ানো ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে বলে ওঠেন, “তাই? আমাকে এক বোতল ভ্যাট আর একটা ওল্ড মঙ্ক দিও তাহলে। ” এক গলা জিভ কাটে ট্যাটুওয়ালা। “আরেঃ দাদা। ওটাই তো পারব না। সব খালি দাদা। আমার আবার রোজ একটু না খেলে পেট সাফ হয় না। কন্সটিপেশন হয়ে গেছে দাদা বিশ্বাস করুন। দুঃখের কথা কি জানেন? আমার বাড়িতে দুটো বোতল রাখা আছে, একটা টিচার্স আর একটা ডবল ব্ল্যাক। আমার এক বন্ধু কিনে রেখে গেছে। লকডাউনের জন্য ও আসতেও পারছে না বেচারা, নিতেও পারছে না। রোজ ফোন করে আর ধমকি দেয়, ‘সালে হাত ভি লাগায়া না, তো তেরা শির ফোড় দেগা।’কি মুস্কিল দাদা। ঘরেই আছে, অথচ খেতে পারছি না। পেট সাফ হচ্ছে না দাদা।” খুচরো পয়সা ফেরৎ নিতেও ভুলে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। মুদির দোকানে লোকে মদ খুঁজছে? হরি হরি। পয়সা মিটিয়ে চলে আসছি, দোকানি ষড়যন্ত্রের সুরে বলেই চলেছে, “তবে ব্ল্যাকে পাওয়া যাবে দাদা। আপনি বলেন তো এনে দেব। তবে দাম একটু বেশী। এক বোতল ব্লেন্ডারস্ প্রাইড তিন হাজার মত পড়বে-”। ভদ্রলোকের জবাবটা আর শোনা হল না, বেলা বেড়ে যাচ্ছে। শৌভিক বোধহয় ঠিকই বলেছিল, লক ডাউনের বাজারে জনগণ সত্যিই পাগলে গেছে রে বাবা।
No comments:
Post a Comment