Thursday 2 April 2020

অনির ডাইরি, ২রা এপ্রিল, ২০২০

হ্যাঁ, দশটা-পাঁচটার দমবন্ধ করা আপিসের সীমারেখাটা আপাততঃ বিলুপ্ত। ঘুম ভাঙার তাড়া নেই, আমার আগেই ওঠে সূর্য। আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক মারতে বসে শুধু ছুঁয়ে যায় হাল্কা একটু দুশ্চিন্তা,বড় মূল্যবান এই সুগন্ধী চা। আপাততঃ দুষ্প্রাপ্য। মনে পড়ে যায় দোকানদারের দেওয়া হুঁশিয়ারি, “চা তো পাবেন দাদা। তবে টাটা টি। আর নইলে গ্রীন টি ব্যাগ।” দাদার চা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই, কফি নিয়ে আছে। কফির শিশি অমিল, আতঙ্কিত হয়ে দশটাকার কফির পাউচের মালা নিয়ে এসেছে শৌভিক। কেটে কেটে ঢেলে রাখতে হবে খালি হতে বসা শিশিতে। নইলে বড় জমে যায়। প্রথম প্রথম দুধ আনতে লাইন দিতাম। দুধ আর দইয়ের রেশনিং। এক প্যাকেটের বেশী কাউকে দেবে না। দইটা আবার শাশুড়ী মা আর তার ছেলে দুজনেরই বড় প্রিয়। নিয়ম মেনে দূরত্ব বজায় রেখে লাইন দি। পিছনের ভদ্রমহিলা, “আমার দুটো চাই” করতে করতে প্রায় উঠে আসতে চান ঘাড়ে। উনি মাস্ক পরেছেন। আমার নাকমুখ খালি। মাস্ক পরলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তুত্তুরী ঠিকই বলে, মাস্ক পরলে নিজের নিশ্বাসের যাবতীয় সুবাস মিশে যায় প্রশ্বাসে। দুবার বললাম, আরেঃ সরে দাঁড়ান না দিদি। কাকস্য পরিবেদনা। চেটে দেওয়া দিদিই এদের যথার্থ ওষুধ। এক্কেবারে বাঘা তেঁতুল।
আমাকে দুধের লাইনে দাঁড় করিয়ে, বাজার গেছে শৌভিক। চাল নাকি কমতির দিকে। ওদিকে মাছওয়ালা আবু সকাল সকাল কুর্নিশ ঠুকেছে,“ ভালো মাছ এনিছি দাদা। জলদি আসেন।” শাহদাবও নাকি ছবি পাঠিয়েছে, টাটকা শিম-বিন-বরবটি-পেঁপে আর উচ্ছে এনিছি দাদা। জলদি আসেন।
শৌভিক ঝানু বাজারু, এখন তো আরও বিকশিত ওর প্রতিভা। চাল পায়নি, দু কেজি বাসমতী চালের প্যাকেট কিনেছে। মাছ কিনে মাথাটা ভুলে এসেছে। এই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই শুনতে হচ্ছে পাতিলেবু দশটাকা পিস্। শাহদাব বলেছে, লেবু আসে চেন্নাই থেকে। এখন আসতে পারছে না, তাই আর কি-। অবশ্য কমলালেবু নাকি ভীষণ সস্তা এখন-। ভাতে মেখে খেলেই হয়। হায়রে মারিঁ আতোঁনিয়েৎ।

বেলা বাড়ার সাথে সাথেই শুরু হবে অফিস। কটা কারখানা খোলা, কটা বন্ধ? যারা খোলা, তারা কি জেলাশাসকের অনুমতি নিয়ে খুলেছে? কতজন কাজ করে এই খোলা-বন্ধ কারখানায়? বেতন পেল কি তারা? পায়নি? কবে পাবে তাহলে? এরই মধ্যে ভেসে আসে কাতর আবেদন, “আমরা এতজন শ্রমিক, মজুরি পাই নাই ম্যাডাম। আমরা খাব কি?বউ ছেলে নিয়ে শুকিয়ে মরতে হবে আমাদের। ” ফোন ধরে না আপদ মালিক। অন্য নম্বর যোগাড় করতে বাড়ে বেলা। ধমকে ওঠে কোথাও ইন্সপেক্টর, কোথাও আমরা। “বেতন দেননি কেন?” ব্যাঙ্কের ওপর দায় চাপিয়ে পালাতে চায় মালিক। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের গলায় অসহায়তার সুর। দৈনিক দুজন কর্মী নিয়ে খোঁড়াচ্ছে চুঁচুড়ার বড় ব্যাঙ্ক। আপিসের সময় দশটা থেকে দুটো। অনুরোধ উপরোধ করে অবশেষে গৃহিত হয় ফাণ্ড ট্রান্সফারের আবেদন। সময় লাগবে দিন দুয়েক। তা হোক। তাতে আপত্তি নেই শ্রমিকদের।
জলখাবারে মাখন দিয়ে সেঁকা মুচমুচে পাঁউরুটি।  শৌভিক ফিসফিসিয়ে বলে বাজারে মাখন নেই কিন্তু। ডিমও মাত্র কটা পড়ে আছে। খেতে বসলেই মনে পড়ে সুকন্যার কথা। কালরাতেই বলছিল, “আমার খেতে বসলেই মনে পড়ে বাসন মাজতে হবে।” সত্যি ভিম আর প্রিলের সৌজন্যে রীতিমত খসখস করছে হাত। বাসনের হাত থেকে বাঁচতে, দুপুরে তুত্তুরীর প্রিয় পার্টি লাঞ্চ। প্রেশার কুকারে, চাল-মুসুর ডাল আর খামি খামি আলু নুন দিয়ে সিদ্ধ করে, গরম গরম ঘি ছড়িয়ে খাওয়া।  লক ডাউন উঠলে দরজা দিয়ে গলতে পারব তো?
দুটোর মধ্যে পাঠাতে হবে সব রিপোর্ট। বর্মন সাহেব আর শুভজিৎ সকাল থেকে পড়ে আছে রিপোর্ট বানাতে। রিপোর্ট পাঠাতে গিয়ে চোখ পড়ে, কোণে পড়ে থাকা এক রাজনৈতিক ব্যক্তির মেসেজ। অন্য সময় খুলি না। আজ পড়তে গিয়ে চোখ কপালে। অভুক্ত পড়ে আছে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা কয়েকজন শ্রমিক। বন্ধ নির্মাণকাজ। কে দেবে মজুরী? দীর্ঘ প্রচেষ্টায় তাদের চাল-আলু পৌছিয়ে দিতে পেরে, সামান্য স্বস্তি।
দিন ঢলতে বসেছে। একতাড়া অর্ডার লেখা বাকি।  ফাইল পড়তে বসেছি, মহকুমা শাসকের ফোন। অমুক জায়গায় নাকি চলছে কোন ফ্যাক্টরি। কিসের ফ্যাক্টরি? যিনি লুকিয়ে খবর পাঠিয়েছেন, সেটা বলতে পারেননি। শুধু বলেছেন দুই আড়াইশ লোক খাটছে। সর্বনাশ! জ্বালিয়ে খেল এরা। খোঁজ, খোঁজ কোন ফ্যাক্টরি। ইন্সপেক্টর সাহেবের নির্দেশে স্থানীয় এসএলও মুখে মাস্ক আটকে রীতিমত স্টিং অপারেশন চালিয়ে খুঁজে বার করে ব্যাটাদের। আরেঃ এরা তো আমাদের রীতমত জানিয়ে ঘটা করে বন্ধ করেছিল ফ্যাক্টরি। আপৎকালীন পরিষেবাও তো দেয় না এরা-। গলা চড়াতে গিয়েও পারি না। জানি কাজ না করলে বসিয়ে মজুরী এরা দেবে না। আবেগ আর কর্তব্যে লেগে যায় ঝটাপটি। রীতিমত ক্লান্ত অবসন্ন লাগে নিজেকে।
ঢলে সন্ধ্যা।আকাশে মেঘেদের হুটোপাটি। কিছুটা ম্রিয়মান নবমীর চাঁদ।  গতকাল ছিল অন্নপূর্ণা অষ্টমী। সারা দিন সিদ্ধ মুগকড়াই খেয়ে কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী ছ মাস আর তড়কার পথ মাড়াব না। আজ রামনবমী। আজ থেকে শুরু রামঠাকুরের উপাসনা। রামরাজাতলা সন্নিবিষ্ট মধ্যহাওড়ায় আজ বিশাল উৎসব হয়। পুরনারীরা কাকডাকা ভোরে পদব্রজে রওণা দেয় পুজো দিতে। এবার যদিও কোন উৎসব হবে না। দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধের নোটিশ ঝুলিয়েছে কতৃপক্ষ। বাবাকে ফোন করি, ভিডিও কলের দৌলতে অন্তত প্রত্যহ একদুবার দেখা হয় আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাথে। ডানপিঠে বুড়ো বড়ই মনমরা। বাইরে বেরোতে না পেরে নাকি লকড্ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু। শৌভিক পাশ থেকে ইন্ধন দেয়, “ঠিক বেরোচ্ছে দেখ। সিগারেট পাচ্ছে কোথা থেকে-”। এটা একটা চিন্তা বটে। বিগ বাস্কেটে সিগারেটের আব্দার জানিয়েছিল বৃদ্ধ। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বিগ বাস্কেট। বৃদ্ধ বলে, “সিগারেট নেই বাজারে। রেশন করতে হচ্ছে-”। কি করে জানলে নেই? প্রশ্ন করলে অভিমান হয় বৃদ্ধের। বড় নিঃসঙ্গ বোধ করে আজকাল। একে একে ঝরে গেছে সব বন্ধু। প্রাণোচ্ছল শিবু কাকু চলে গেছেন অনেকদিন। চলে গেছে, আপদে বিপদে ছুটে আসা সমীরকাকু।চলে গেছে অকৃতদার নেপাল ওরফে নেপু কাকু।ব্রজেশ কাকু। যোগাযোগ রাখে না ভূতনাথ কাকু।  দেবা কাকু বড় অসুস্থ। ভবাই কাকু হয়ে পড়েছেন স্থবির। জানতে চাই, “আর সেই যে কাকুটা? যোধপুর পার্কে বাড়ি? ” শুনতে পাই, তিনি ভুগছেন চূড়ান্ত মানসিক অবসাদে। ব্যাচের অন্যতম সেরা ছেলে হওয়া সত্ত্বেও উপার্জনের দিক থেকে তেমন সবল হতে পারেননি কখনও। বরাবর রেজাল্টে পিছিয়ে থাকা অমুক কাকু সেখানে বানাতে পেরেছিলেন বিশাল ধনসম্পত্তি। অমুক কাকুর স্ত্রীও ছিলেন করণিক থেকে পদোন্নীত আমলা। আর বেহালার কাকুর স্ত্রী ছিলেন সরকারী হাসপাতালের নার্স। এটাও নাকি অবসাদের কারণ। রেগে বলি, ওটা অবসাদ নয়। ছিট কাপড়। সরকারী হাসপাতালের নার্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথা সম্মানীয় পদ। কত মানুষের জীবন বাঁচান ওণারা। পরিচিত বেশ কয়েকজন আমলা তথা অর্ধআমলার স্ত্রী নার্স। আর ঐ নার্স কাকিমাই তো এতকাল টেনে আসছেন সংসার।  বিরক্ত হয় বাবা। “আঃ আমি বলছি না। ও বলে। অমুকের সাথে পদে পদে নিজের তুলনা করে আর মশারি টাঙিয়ে বসে থাকে। ”
উত্তরবঙ্গ থেকে ফোন করে এক সার্ভিসতুতো ভাই। “কি ফাঁসান ফেঁসেছি দিদি”। বয়স্ক বাবা-মা পড়ে আছেন দক্ষিণবঙ্গে। আগামী কাল থেকে ছুটি নেওয়া ছিল। পরশু কাটা বিমানের টিকিট। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়ে কটা দিন ঘুরতে যাবার বন্দোবস্ত সব পাকা। খরচা হয়ে গেছে অনেকগুলো টাকা। আপাততঃ আপদকালীন পরিস্থিতিতে বাতিল ছুটি। আর ছুটি থাকলেই বা কি হত? “কি করে যেতাম গো দিদি? হেঁটে হেঁটে”। ব্যাপারটা কল্পনা করে হো হো করে হেসে উঠি দুজনায়। ফোন রাখতে রাখতে প্রার্থনা করি, জলদি মিলিত হোক, বিচ্ছিন্ন পরিবার যত। তৃপ্ত হোক তৃষিত আত্মা যত। ফুসফুসে আরেক ঝলক ভরেনি প্রিয়জনদের দৈহিক সুবাস। দূরত্ব রাখতে পারলাম না বলে ধমকে ওঠে বর। স্যানিটাইজারের বোতল উপুড় করে তুত্তুরী। ওসবে কান দিতে নেই। যাই রান্না বসাই- কাল আবার একটা কর্মব্যস্ত দিন।

No comments:

Post a Comment