#lockdown #lockeddown
মেঘলা সকাল, জানলার ওপারে ভিজে কাঞ্চন আর দেবদারু পাতায় তখনও টলটল করছিল স্ফটিকের মত জলের দানা।বারন্দায় টবগুলোর মাটি ভিজে ভিজে, আজ আর জল দেবো না। পাতি লেবুর বীজ ফেলেছিল তুত্তুরী, দুটি কচি চারা বেরিয়েছে। ছাতে একটা মাটি ভর্তি ভাঙা টব পড়েছিল অনেকদিন ধরে, নামিয়ে আনলাম। বাছার কাকুর টব। ওণার খুব গাছের শখ ছিল।একরাশ লালিমা ছড়িয়ে সূর্য যখন ঢলে পড়ত পশ্চিমে, উনি ছাতে যেতেন জল দিতে।ওৎ পেতে থাকত তুত্তুরীও। ছাতের ওপর বসত গপ্পে দাদুর আসর। ওণার স্ত্রীর শখ ছিল, আর একটু বড় ফ্ল্যাটের। যেখানে একটা ঘর থাকবে শুধু ঠাকুরের। অবসর নেবার পর ফ্ল্যাট তো কিনেছিলেন, কিন্তু কাকিমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকত ফ্ল্যাটটা। তারপর একদিন চলেই গেলেন,ছেলেমেয়েকে নিয়ে। একই তো আবাসন,স্থানান্তরিত হবার পরও আসতেন গাছের টানে। ইদানিং আর আসেন না। শুকিয়ে যাওয়া গাছ আর ফাঁকা টবগুলো পড়ে আছে একাকী। তারই একটায় বসালাম কচি লেবু চারা। শৌভিক যথারীতি বিরক্ত। চিবিয়ে চিবিয়ে জানতে চাইল, টবটা কোথায় থাকবে? আর আমরা কোথায় থাকব?
আমাদের আবাসনটা বার্ধক্যের বারাণসী। বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশী। কিছুদিন আগেও রেড যোন এরিয়া ছিল। আপাততঃ কন্টেনমেন্ট এলাকা। আজ থেকে গেটের মুখেই রোবটের মত পোশাক পরা মানুষজন ঘুরছে, কাউকে দেখতে পেলেই কপালে তাক করছে বন্দুক। থার্মাল স্কিনিং এর বন্দুক।
মানুষ জন বেরোচ্ছেও কম। দোকানপাটও ফাঁকা। রাজা রোজই গল্প দিচ্ছে, “সওব আছে বৌদি। শুধু আনতে পারছি না। এট্টু টাইম দিন। কালকেই ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। ” কালকের গল্প চলছে সপ্তাহ জুড়ে। মনিহারি দোকানে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকুক না থাকুক, চোরাগোপ্তা সুরা যোগান দেবার গুজব কান পাতলেই শোনা যায়। সেদিন ফোন করেছিল হুসেন। সেই সুদূর উত্তরবঙ্গের এক অনামী গ্রাম থেকে। কোন আদ্দিকালের সহকর্মী হুসেন মিঞাঁ, রোজ ধমক খেত। ধমকাতাম আপন করে, কান চুলকে ধমক খেত হুসেন আর ভালোবাসত মেয়ের বয়সী ম্যাডামকে। আজও বাসে, হিন্দু-মোছলমান যারই পরব হোক না কেন, হুসেন তার পুরোনো ম্যাডামকে ফোন করবেই। এবারে যেমন বলল, “বাড়িতে আটকে গেছি ম্যাডাম।এরা বেরুতে দিচ্ছে না। বলছে তুমি বুড়া না, বাইরে গেলেই রোগ বাঁধাবে। উঠানেই হাঁটাচলা করছি একটু। ” শ্যামল যেমন দিন কয়েক আগে বলছিল, “ম্যাডাম! আমি বাড়িতে আটকে গেছি ম্যাডাম। কি হবে?” বাড়িতে আটকে গেলে ম্যাডাম কি করবে রে বাপ? আমি তো নিজেই আটকে গেছি। লাল-নীল-সবুজের বাঁধনে। শ চারেক মিটার দূরত্বেই কোয়ারান্টাইন সেন্টার- স্যানিটাইজ করার জন্য তালাবন্ধ নার্সিং হোম।
বহুদিন বাদে পট্টনায়ক কাকুর সাথে দেখা। মাস্ক পরে চেনাই দায়। ডিভিসির ইঞ্জিনিয়র ছিলেন। স্বেচ্ছাবসর নিয়ে মহানন্দে অবসর জীবন যাপন করছেন। শ্বশুরমশাইয়ের বিশেষ অনুগত তথা স্নেহধন্য মানুষ। এমন পরোপকারী মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। অসহায় নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ আবাসিকদের কত কাজ যে করে দেন কাকু- অনলাইন বিল দিয়ে দেন, ওষুধ, সব্জি, দুধ, মাছ পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করেন। কেউ আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়লে, নিজেই গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। অবসর নিয়ে এইসবই করেন। সব সময় পজিটিভ এনার্জিতে টগবগে প্রৌঢ় আজ বেশ বিমর্ষ মনে হল। আজ শুধুই দুঃসংবাদ ছিল ওণার ঝুলিতে,জনৈক আবাসিক বৃদ্ধ মারা গেছেন। কাকুর বিশেষ পরিচিত। বছর আশি-বিরাশি বয়স হবে, পণ্ডিত তথা বিদগ্ধ মানুষ। প্রতিষ্ঠিত সন্তানরা বিদেশবাসী। হঠাৎ গলার গ্ল্যাণ্ড ফুলেছিল, সামনের নার্সিংহোম স্যানিটাইজ করার নামে তালাবন্ধ, গিয়েছিলেন সল্টলেকের এক নামী বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হতে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে হাসপাতাল। আগে কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট আনুন, তবে বাকি কথা-। বৃদ্ধাকে নিয়ে দৌড়েও ছিলেন বেলেঘাটা। পাঁচশ সাতশ লোকের লম্বা লাইন। ঘন্টা তিনেক লাইনে দাঁড়িয়ে, ধড়ফড় করে মারা গেছেন-।
তালাবন্ধ হাসপাতালের এমন মহিমা যে আরেক বৃদ্ধ,নিয়মিত ডায়ালিসিসের পেশেন্ট কোথাও ভর্তি হতে পারছেন না। পুরোনো কাগজ ঘেঁটে যখনই দেখা যাচ্ছে, উনি বন্ধ হাসপাতলের প্রাক্তন রোগী, পত্রপাঠ ফেরৎ পাঠাচ্ছে নামী এবং দামী হাসপাতাল- নার্সিংহোম।
মনখারাপের মধ্যেও কাকু মাস্ক পরে বেরিয়েছেন জনৈক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে নেশার রসদ পৌঁছে দিতে। বৃদ্ধের সুরার ভাঁড়ার খালি। পট্টনায়ক কাকুর কাছে গোটা দুয়েক দুই না আড়াই শ মিলিলিটারের শিভাস রিগ্যাল ছিল। তারই একটা দিতে যাচ্ছিলেন। নাম শুনেই চমকে উঠলাম। তার তো অনেক দাম! জানতে চাইলাম আপনি শিভাস রিগ্যাল খান নাকি? জানালেন দু বোতল সিগনেচার কেনা ছিল নাকি।একটি শেষ, অবশিষ্টটা চলছে। থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, সিগনেচারের দাম কি শিভাস এর থেকে বেশী? উনি হেসে উঠলেন হো হো করে।
আবাসিকদের হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপে এবার চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দেখাল শৌভিক।সিকিউরিটি আর সিসিটিভির নজর বাঁচিয়ে, এখনও কেউ কেউ চোরাগোপ্তা ডেকে আনছেন কাজের মাসিদের। বৃদ্ধাদের এত কায়িক পরিশ্রমে কাহিল হয়ে পড়ছেন তাদের গৃহকর্তারা। আমার শ্বশুরমশাইও ফোন করেছিলেন, সমবায়ের সভাপতিকে। যদি অনুগ্রহ করে ঝাড়পোঁছের মেয়েটিকে আসার অনুমতি দেন ওণারা। উনি অপারগতা জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। আমাদের সবিতা মাসিকে অবশ্য ডেকে নিয়েছে একঘর বুড়োবুড়ি। মাসি মাঝেমাঝেই এসে দরবার করেন, “আসতে দাও না গো বওদি। না খাইটলে খাবো কি?” আশ্বস্ত করি, বেতন কাটব না, তাও মাসির অবুঝ মন ভয় পায়। এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বড়ই অসহায়। বৃদ্ধ কাহিল হয়ে পড়েছেন, রোজের কাজের চাপে। মাসি রাজপথ ধরে আসতে গিয়ে প্রথম দিনই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। “মন্নিঙ ওকে বেরিয়িছি রে বাবা” বলে ছাড় পায় সে যাত্রা। পরের দিন থেকে গলি গলি দিয়ে সাত পাড়া ঘুরে কাজে যেতে শুরু করে। এবার আটকায় সিকিউরিটি। বেতন আনতে যাচ্ছি বলে মুকুব হয় মাসির অপরাধ। তৃতীয় দিনে অন্যান্য আবাসিকরা ধরে ফেলে, যাচ্ছেতাই অপমান করা হয় মাসি এবং বুড়োবুড়িকে-
গত রবিবার মালপোয়া বানিয়েছিলাম। ছবিটা আর পোস্ট করা হয়নি। জনৈক রাজকুমারের অভব্যতায় বেশ আহত তথা বিরক্ত হয়েছিলাম। আমাদের জঙ্গলের রাণীকে অপমান করা? বা বলা ভাল অপমানের প্রচেষ্টা? বলি কি, আপনার বয়স অল্প, তবুও সার্ভিস তুলে খিস্তি মারাটা, মাইরি রাজকুমার বাবু বড়ই বালখিল্যচিত ব্যাপার। আপনি হয়তো আপিসের চেয়ারটা মাথায় নিয়ে ঘোরেন, তা ঘুরুন, তবে ব্যাপারটা বুঝলেন কি না, নাম আপনার রাজা-গজা- রাজকুমার যাই হোক না কেন, দিনের শেষে আপনিও এক পাতি রাজকর্মচারী মাত্র। সরকারী চাকর। খাস হতেই পারেন, তবে চাকর তো বটেই। ঈশ্বর আপনাকে কিঞ্চিৎ ধুসর বস্তু প্রদান করুন, এই কামনা করি।
জঙ্গলের রাণী যে ভাবে লোপ্পা বলটাকে গ্যালারির পার করেছে, ছবিটা এবার পোস্ট করাই উচিৎ। শুধু চোখের সামনে কেন যে বার বার ভেসে উঠছে এক বছর বারোর না খেতে পাওয়া মেয়ের মুখ। মাত্র ১২। তিনদিন ধরে না খেয়ে, অপরিচিত একদল মানুষের সাথে, লুকিয়ে, পুলিশের নজর বাঁচিয়ে বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যখন হেঁটে আসছিল বোকা মেয়েটা- কি ভাবছিল? মায়ের কথা ভাবছিল কি?
No comments:
Post a Comment