জঙ্গলের ভিতরে একটা গ্রাম আছে। নির্ঘাত আছে, কাল দেখেছি, কয়েকজন আদিবাসী মহিলা মাথায় শুকনো কাঠের ঝাঁকা নিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। পিছু ধাওয়া করতে গেলাম, সু হাতটা টেনে ধরল, “অনি, বেশী সাহস দেখিও না। এটা হাতি করিডর। বিপজ্জনক এলাকা।” জঙ্গলের রাণীর কথা কি আর, ফেলা যায়? সকাল সকাল হাতে গড়া রুটি আর পেঁপের তরকারি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে হাঁটতে বেরিয়েছি সবাই। চতুর্দিকে ঘন সবুজ ঢেউ খেলানো পাহাড়, আর গভীর জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে একফালি সরু পিচরাস্তা। চরাচর ব্যাপী অখণ্ড নিস্তব্ধতা, কেমন যেন চেপে বসছে কানের পর্দার ওপর। ফুসফুসকে চেপে ধরছে অজানা এক রহস্যময়তা। কি জানি কি হয় মার্কাD অদ্ভুত এক ভয়। বিদিশা দি আর দেবশ্রী দি হাঁটছে সবার আগে। দুজনের পিঠে পিট্টু টাইপ ব্যাগ। ব্যাগে ভরা জলের বোতল। আর বাদাম পাটালি। বাদামপাটালি গুলো আসার পথে এক ছোট্ট গুমটি থেকে কেনা। এক অনামী পাহাড়ি ঝর্ণা দেখতে সবকটাকে নামিয়েছিল অর্ণব দা। লাল কাঁকড়ে পাহাড়ের বুক চিরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুঁচকে জলরাশি। নভেম্বরের শেষ।R ক্রমশঃ শুকিয়ে আসছে জলধারা। ধারাপথে জেগে উঠছে বড় বড় গোলাকার পাথর। অনেকটা চড়াই-উতরাই ভেঙে ওঠানামা করে হাঁপিয়ে পড়েছিলাম সবাই।চাঙ্গা করতে ত্রিদিবেশ দার দাওয়াই ছিল, শশা। একটাই মাত্র গুমটিতে বসেছিল একজন কৃশকায় ব্যক্তি। গুটি কয়েক পাকা শশা আর সাতটা বাদাম পাটালি নিয়ে। ঝাল নুন মাখানো শশার ফালি সত্যিই ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রাণ। বাদাম পাটালি খেতে চাইছিল তুত্তুরী। আমি পয়সার ব্যাগ নিয়ে নামিনি। দরকারও নেই। ত্রিদিবেশ মামা আর অর্ণব কাকু থাকতে বাবা -মায়ের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না তুত্তুরীর। ত্রিদিবেশ দা একটা বাদাম পাটালি কিনছিল, দেবশ্রীদি তুলে নিল সাতটাই। দেবশ্রীদির দূরদৃষ্টিK সীমাহীন। কি অসম্ভব ভালো খেতে পাটালি গুলো। চিবোতে চিবোতেই হাঁটছি আমরা। গতকাল রাতেও হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। সুকন্যা আর আমি। চুপিচুপি। বরগুলো জানতে পারলেই চিল্লাবে।বাচ্ছাগুলো গল্প শুনছিল দেবশ্রীদির কাছে।খোলা বারন্দায় আলো নিভিয়ে গল্প জুড়েছিল ছেলেরা। বিদিশাদি বসেছিল কি যেন একটা বই নিয়ে। আমি আর সু কোন দলেই ঠিক ফিট হলাম না। তাই আর কি-
বেরিয়েছিলাম গল্প করব বলে, বাংলোর চৌহদ্দি ছাড়াতেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। আকাশে বিরাজমান পূর্ণচন্দ্র। শীতল বাতাসে জঙ্গলী ফুলের সুবাস, ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মনে হয়েছিল চতুর্দিকে কেউ যেন উল্টে দিয়েছে কালো কালির দোয়াত। আর সেই মসিকৃষ্ণ চরাচরের ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল জোছনার রূপালী দোপাট্টা। মোহিত মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটছিলাম আমরা। যেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর অন্তিম দুই মানবী। খেয়াল করিনি, কারা যেন পিছু নিয়েছিল নিঃশব্দ চরণে। একটা বাঁকের মুখে পথ আটকাল তারা, “মেমসাহেব এবার ফিরে যান। এটা হাতি করিডর তো।ঐ দূরে দেখতে পাচ্ছেন ঐটা দলমা পাহাড়। ঐখান থেকে সটান নেমে আসেন তেনারা। মানুষ দেখলে খেপে যান আইজ্ঞা। ” কোন পাহাড়টা যে দেখালো বুঝলাম না, তবে মেমসাহেব অর্থাৎ সুকন্যার নিরাপত্তা নিয়ে ওরা যে বিশেষ উদ্বিগ্ন সেটা বুঝলাম। বিনা বিবাদে ফিরে গিয়ে ছিলাম আমরা। আজ তাই খোঁজার চেষ্টা করছি দলমা পাহাড় কোনটা। যেদিকে আঙুল দেখিয়েছিল সেদিকে ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়েছে সবুজ সবুজ পাহাড়। এদেরই কোনটা দলমা হবে-
পিছন ফিরে দেখলাম তিনটে বাচ্ছাকে গাছে চড়তে শেখাচ্ছে অর্ণব দা। উটো ফার্স্ট। প্রায় মগডালে উঠে বসে আছে শাখামৃগের মত। উজান অতি সাবধানী। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, মোটা দেখে ডালে বসেছে। তুত্তুরী এবার হাঁচোরপাঁচোর করে উঠছে। উটো কি যেন একটা বলল, রেগে গিয়ে হাওয়াতে হাত পা ছুঁড়ল তুত্তুরী। সবার পিছনে এত্ত বড় লেন্স নিয়ে ত্রিদিবেশ দা, ছবি তোলা নিয়ে কি যেন শেখাচ্ছে শৌভিককে। বাধ্য ছাত্রর মত ঘাড় ঘুরিয়ে শুনছে শৌভিক।
সুকন্যা কি যেন বলে উঠল, ওর দিকে ফিরে তাকালাম। অন্যমনস্ক ভাবে সুকন্যা বলছে,“আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমি এই পথ ধরে আগেও হেঁটেছি। সেটাও তোমার সঙ্গেই।” বলতে গেলাম ডেজা ভ্যু। বলতে পারলাম না। সত্যিই তো এই দৃশ্যগুলো বড় বেশী চেনা। যেন মনে হয় আদি অনন্তকাল ধরে হেঁটে চলেছি এই পথ ধরে। ভাবতে ভাবতে অজানা আতঙ্কে কাঁটা দিয়ে উঠল গায়ে।
“ওঠ রে। বেড়াতে এসে কেউ এত ঘুমোয় নাকি। ” বলে ধাক্কা মারল শৌভিক। স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলে। চটজলদি তৈরি হয়ে নীচে নেমে দেখি, অর্ণবদা বাদে বাকি সবার স্নান সারা। ক্যাসারোলে করে প্রাতঃরাশ দিয়ে গেছে। হঠাৎ ভীষণ শীত করতে লাগল আমার। আমি জানি কি আছে,ঐ ক্যাসারোলে। রুটি আর পেঁপের তরকারী। কালও তাই ছিল। তার আগের দিনও। তার আগের দিনও। না জানি কত শত সহস্র বছর ধরে তাই থেকে আসছে। আমি জানি, কেন আসে না কোন খবরের কাগজ। কেন চলে না মোবাইল। কেন চলে না টিভি। আমি জানি খেয়ে উঠেই হাঁটতে বেরোব আমরা। বিদিশা দি আর দেবশ্রীদি পিঠে নেবে পিট্টু। তাতে থাকবে জল আর বাদাম পাটালি। তিনটে বাচ্ছাকে গাছে চড়াবে অর্ণবদা। শৌভিককে ফটোগ্রাফি শেখাবে ত্রিদিবেশ দা। আমি জানি দীর্ঘপথে আসবে না একটাও গাড়ি। চোখে পড়বে না অন্য কোন জনমানব। ঠিক একটা বাঁকের মুখে সুকন্যা আবার বলে উঠবে, “আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে আমি এই পথ ধরে আগেও হেঁটেছি।” আর তারপরই আবার ঘুম ভাঙাবে শৌভিকের ডাক। আবার প্রস্তুত হয়ে নামব আমি-। কাঁধে হাত রাখল সুকন্যা, “অত ভেবো না। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারত-”।
পুনশ্চঃ সব চরিত্র কাল্পনিক। শুধু ধার নিয়েছি কিছু প্রিয়জনের নাম।
No comments:
Post a Comment