Sunday, 12 April 2020

অনির ডাইরি, ১২ই এপ্রিল, ২০২০


#lockdown #lockeddown

অন্যদিনগুলোর থেকে আজকের দিনটা একটু আলাদা। আজ নীল। অন্যান্য বছর গুলোতে সকাল সকাল,দিদির (বাবার দিদি আসলে) সাথে ক্ষীরেরতলা মাঠের বুড়ো শিবের মাথায় জল ঢালতে যাই। দিন দুয়েক আগে থেকে টুকটুক করে সব যোগাড় করে দিদি। পাঁচ রকম ফল, সন্দেশ, বেল পাতা, কাঁচা দুধ, গঙ্গা জল, আকন্দ ফুলের মালা, কাঁটাওয়ালা ধুতরো ফল। ভোর থেকে তাড়া লাগায় দিদি, মন্দিরে ভিড় বেড়ে যাবে যে। স্নান করে, পাটভাঙা শাড়ি পরে, চুপড়িতে পুজোর উপকরণ সাজিয়ে, রওণা দি পিসি ভাইঝি। দিদির হাতে পিতলের কমণ্ডুলে টলটল করে কাঁচা দুধ। ভিড় বেড়েই যায় মন্দিরে। লাইন পড়ে পুরনারীদের। চলে গেরস্থালীর চর্চা। কেউ না কেউ পিসিকে ফিসফিসিয়ে জানতে চায়, “কে এটা?” পিসি সদর্পে বলে, “আমার মেয়ে। ”
জানুয়ারী পড়তে না পড়তেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল পিসি। ডান দিকটাই অসাড়। শুয়ে থাকত জড়বস্তুর মত। কি সেবাটাই না করত দুই খুড়তুতো ভাই। আজও করে চলেছে। কি যে হয়েছিল, কেউ বলতে পারে না। প্রেশার-সুগার-কলেস্টরেল সবই তো নর্মাল। বুড়ো পারিবারিক  ডাক্তার খালি বলে চলে, “ভয় পেয়েছে পিসিমা।” কিসের ভয় তোমার দিদি? জিজ্ঞাসা করলে, দুহাতে চেপে ধরত আমার হাত, “আমায় যেন ভুলে যাস নে। তোকে তো মানুষ করেছি বল-”। ভুল হয়ে যাচ্ছে না দিদি? শুধু আমায়? তুমি আসলে  মানুষ করেছো তিন প্রজন্ম, বাবা থেকে আমি হয়ে তুত্তুরী। প্রতিবছর নীলের দিন, শৌভিক তুত্তুরীর সাথে সাথে তোমার নামেও জ্বালাই বাতি। অষ্টমীর অঞ্জলিতে আলাদা করে লেখা থাকে কিছু চাটুজ্জে আর কিছু ভট্টাচার্যর নাম। এত সহজ নাকি ভোলা? কিন্তু ভয়টা কি? এই ভয় হল মৃত্যু হয়। চাটুজ্জে বাড়িতে জানুয়ারী মাসটা একাধিক মৃত্যু ডেকে এনেছে। প্রথমে ঠাকুমা, তারপর বড়পিসি, ছোটকাকু আর কাকিমাও পর্যায়ক্রমে তিনবছরষ একদিনের ব্যবধানে। তুমি বোধহয় ভেবেই নিয়েছিলে এটা তোমার বছর? এত সহজে আমরা তোমায় ছাড়ছি না দিদি। তোমায় খাড়া হতেই হবে। যেতেই হবে আমার সাথে বুড়ো শিবের কাছে। কথা দিয়েছিল পিসি। যাবে আমার সাথে। সত্যিই সেই খাড়া হয়ে উঠল। দোতলা থেকে আজকাল একাএকাই নেমে আসে। হাল্কা একটু হাত ধরলেই পেরিয়ে যায় উঠোন। অথচ আমিই যেতে পারলাম না। ভিডিও কলে হাসে পিসি ঝলমলিয়ে। আমরা তিন ভাইবোন ফোনের এপার ওপার চিৎকার করে উঠি, আসছে বছর আবার হবে। মরুক ব্যাটা করোনা। মরুক। নির্বংশ হোক করোনার গুষ্টি।

ভিজে সাবু চটকে আজ সেরেছি প্রাতরাশঃ। নারকেল কোথা পাব, শুধু কলা আর চিনিই ভরসা। বাতাসা গুলো চকলেট মনে করে  আগেই খেয়ে নিয়েছি আমরা মা-মেয়ে। দুপুরে সোনামুগ ডাল দিয়ে সাবুর খিচুড়ি। ভুরভুরে ঘি গন্ধী। আধখানা ফুলকপি আর গুটি কয়েক বিন ফ্রীজের কোণে পড়ে শুকোচ্ছিল, এই মওকায় সদ্ব্যবহার হয়ে গেল। রাতে পরোটা খাবার আব্দার করছে, বাপ-মেয়ে। আমার ব্রততিরেস  হলে এদের খুব আনন্দ হয়, দেখি-

টিভিতে কি যেন দেখছে তুত্তুরী। এক ভুষো কালি মাখা বাক্ষুসী চোখ গোল গোল করে, এক রূপসী নেকু রাজকন্যাকে কি যেন বলছে। একা দেখতে ভয় পায়। তাই আমাকে বসিয়ে রেখেছ তুত্তুরী। শ্বেতকপোত সাবানের বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যার দাম ছিল তিরিশ টাকা। সেই বাজারে আগুনছোঁয়া দাম। আমার এক তুতো ভাই, আব্দার করে কিনিয়েছিল কাকুকে দিয়ে। শুধুমাত্র বিয়ে বাড়ি পড়লেই, মুখে মাখার অনুমতি ছিল। বিজ্ঞাপনে ঘোষণা হচ্ছে, ১০টাকা- ২০টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে এখন। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে রীতিমত প্রচারের মুখ হতে পারে এই সাবান।
বিজ্ঞাপনের সুন্দরী লাজুক হেসে বলছে, শ্বেত কপোতের আদরে গাল এত কোমল, এত মোলেম হয়েছে, বর নাকি রীতিমতো মোহিত। গালের নাম দিয়েছে রসগোল্লা। কাদের বরেরা এসব বলে ভাই? 

এই বুড়ো বয়সে রাক্ষুসী আর রাজকন্যা ন্যাকামি দেখতে দেখতে রীতিমত কান্না পাচ্ছে মাইরি- বাসি কাগজটায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। বাচ্ছারা নাকি আজকাল খুব রেগে যাচ্ছে। জনৈকা বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন দেখলাম, বাচ্ছাগুলো "ফ্রি টাইম" পেলেও, "মি টাইম" পাচ্ছে না। বাবামায়েদের নজরদারিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে-। কোন বাচ্ছা ভাই এরা? কাদের বাচ্ছা? তুত্তুরী কিছুটা মি টাইম কাটালে আমি আর শৌভিক তো বেঁচে যাই। যাকেই ফোন করি একই কথা শুনি, সেদিন অন্তরা বলল, “কি ভালো বল পিটতে শিখে গেলাম ভাই। রান্নাবান্না, ঝাড়পোঁচ, বাসনমাজার পর, আজকাল ছেলের সাথে বল পিটতে হয় কি না?” এক দাদা, গতকালই বলল,“এদের কবে স্কুল খুলবে বলতো? গৃহবন্দী হয়ে গৃহের কাজ মন্দ লাগছে না। তবে এই মেয়েটা বড় জ্বালাচ্ছে। উফ্ খালি খাইখাই। পনেরো মিনিট ছাড়া ছাড়া এসে বলছে, ‘খিদে পেয়েছে বাবা। আমি কি খাব?’” সত্যিই বাবা, স্কুল কবে খুলবে? “আমার সময় কাটছে না। আমি কি করব?” এই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি শৌভিক আর আমি। রীতিমত  তুত্তুরী রেশনিং চলছে বাড়িতে, সকালে শৌভিক ছানা সামলেছে, এবেলা আমার পালা। অগত্যা রাজকন্যা আর রাক্ষুসীই ভরসা- অন্তত ভয় পেলেও মুখটা তো বন্ধ আছে 🙏🏼😒।

No comments:

Post a Comment