Saturday 24 June 2023

অনির ডাইরি ২৪ শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

সেদিন মোদের বড়ই খুশির দিন, আজ আর অফিস ফেরতা একা বাড়ি ফিরব না। বাবা মাকে সঙ্গে করে নিয়ে ফিরব কাঁথি। কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে নড়তে চায় না বাবা। কোথাও যাবার কথা বললেই, সেন্টু দেয়। বলে, "এটা আমার বার্ধক্যের বারাণসী। আমাকে এখানেই থাকতে দাও।" দুটো পুকুর সহ সাড়ে সাত বিঘে বাস্তুভিটের, আজ কেবল মেরে কেটে সাতকাটাই দৃশ্যমান। যার আধ কাটার উপর উঠে দাঁড়িয়েছে পাড়ার দোতলা ক্লাব। বাবার ভাগে পড়েছে কাটা দেড়েক। খন্ডিত ভগ্নপ্রায় ভাগের বাস্তুভিটে সহ এই দেড় কাটা জমির উপর বাবার মায়া সাংঘাতিক।


এই ভিটেতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন আমার স্বর্গীয় পিতামহ-পিতামহী। জেঠু মারা যান হাসপাতালে, ছোট কাকু বাড়ি থেকে হাসপাতাল যাবার পথে। বাবার ইচ্ছে এই ভিটেতেই যেন চোখ বুঝতে পারে বাবা। প্রায়ই বলে," এই বাস্তুটুকু কে বাঁচিয়ে রাখতে কি অসীম লড়াই করতে হয়েছিল বাবা আর আমাদের তিন ভাইকে, তোরা জানিস না।" 

ব্যাপারটা বা কথাগুলো বাবার কাছে যতটা রোমান্টিক আমার কাছে ততোটাই বেদনাদায়ক।  সেকথা বলতে গেলেও হুলো বেড়ালের মত ফাঁসিয়ে ওঠে বৃদ্ধ। "কেউ কি সাধ করে মরতে চায়? তুমি বারবার এই কথাগুলো বলো আর আমার মনে হয় চলে যাবার দিন আগত বুঝি।" ঠিকই তো, আমিই বলি, বাবা তো মাছ ভাজার সোজা-উল্টোই চেনে না। 


এহেন জেদি, একবগ্গা বৃদ্ধকে, কিভাবে যে পটিয়ে হাওড়া থেকে কাঁথি যেতে রাজি করিয়েছি, সে কেবল আমিই জানি। মিথ্যে বলব না, আমার জন্য মোটেও বাড়ি ছাড়তে রাজি হয়নি বাবা। রাজি হয়নি প্রাণাধিকা তুত্তুরীর জন্যও। রাজি হয়েছিল কেবল মায়ের মুখ চেয়ে। কিছু দিন ধরেই বেশ মনমরা হয়ে পড়ছিল মা, ভুগছিল অপরিসীম নিঃসঙ্গতায়। তুত্তুরীর পড়াশোনা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যস্ততার জন্য আজকাল আর অত ঘনঘন হাওড়া যেতে বা গিয়ে থাকতে পারি না আমরা। একলা নিঃসঙ্গ জীবনে হাঁপিয়ে উঠছিল মা। মনের প্রভাব পড়ছিল শরীরে। এমতবস্থায় হাওয়া বদল আর অষ্টপ্রহর তুত্তুরীকে আলিঙ্গন_আঘ্রাণ করলেই যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে মা, এই বলেই পটিয়েছিলাম বৃদ্ধকে।


তাও নোটিশ দিতে হয়েছিল এক মাস আগে,  ঈশ্বরকে হাজির নাজির জেনে কথা দিতে হয়েছিল ঠিক কোন তারিখে কোন ঘটিকায় বাড়ি থেকে বের করব এবং কোন তারিখে কোন মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে আসব। তুত্তুরীর গরমের ছুটি চলছিল বেশ কিছুদিন ধরে, তখন ছুটি নিইনি। এখন চাইল্ড কেয়ার লিভ নিলাম শুধুমাত্র ওদের জন্যই। আহাঃ ওরা যে আমার তুত্তুরী থেকেও পুঁচকে ছানা। আর তেমনি অবাধ্য ছানা। 


কোন এক দুর্বল মুহূর্তে, আমার সুড়সুড়িতে রাজি হয়ে গেলেও আবার পিছু হঠছিল বাবা, দেখাচ্ছিল নানা ওজর আপত্তি। যেমন ধরুন কিভাবে প্যাকিং করবে, কিসে প্যাকিং করবে, কি কি নেবে কিছুই নাকি বাবার মাথায় ঢুকছিল না। ভিডিও কলে বলতে পারেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম, কোথায় রাখা আছে চাকা লাগানো ঝকঝকে ট্রলি ব্যাগ। এমন দিনের কথা ভেবেই উপহার দিয়ে ছিলাম প্রায় অর্ধ দশক পূর্বে। এখনও কাটা হয়নি তার ট্যাগ। রীতিমতো লিস্ট বানিয়ে দিলাম এত জোড়া জামাকাপড়, যার মধ্যে এতগুলি বাইরে পরার আর অতগুলি ঘরে পরার। এছাড়া চার্জার ( এবাড়িতে বেশ অনেকগুলি চার্জার আছে,কিন্তু কোনটাই ওদের ফোনে গলবে না), টুথব্রাশ আর ওষুধ। ব্যাস এইটুকুই আর কিছু না আনলেও চলবে। উৎসাহের আতিশয্যে শ্রীমতী তুত্তুরী বললেন, টুথব্রাশও না আনলে চলবে, এ বাড়িতে বিস্তর আছে।


ছুটিতে থাকা সত্ত্বেও কিছু দপ্তরী কাজের ধারবাকি ছিল, তাই নিয়েই গিয়েছিলাম মহানগর। ঠিক ছিল ফেরার পথে তুলে আনব, মিঃ অ্যান্ড মিসেস চ্যাটার্জিকে। সেই মোতাবেক কাঁথি থেকে রওনা হবার শুভ মুহূর্তে যখন ফোন করলাম, বাবা বলল, " কি সর্বনাশ! এখনও তো কিছুই গোছানো হয়নি-"। এত কি যে গোছাচ্ছে, ভাবতে ভাবতেই কাঁথি থেকে কলকাতা পৌঁছে গেলাম। কাজকর্ম মিটে ও গেল সব।ভেবে ছিলাম কাজ মিটতে মিটতে বুঝি গড়িয়ে যাবে বেলা, দেড়টার মধ্যেই মিটে গেল সব কাজ। এখান থেকে হাওড়া বড়জোর ঘন্টা আধেক। এতক্ষণে নির্ঘাত মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিয়েছে বৃদ্ধ বৃদ্ধা, একটু জিরিয়ে নিক বরং। অনেকটা রাস্তা। তিনটে নাগাদ যদি বেরোতে পারি, দিনের আলো থাকতে থাকতেই  ঢুকে যেতে পারব কাঁথি। 


এত কিছু ভাবার পর বাড়িতে ফোন করে জানতে পারলাম, এখনও স্নান পর্যন্ত করেনি বাবা। মা ঝেঁঝে বলল," তোর বাবা সকাল থেকে সারা বাড়ি গোল গোল করে ঘুরছে, আর সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। দশ পনেরো প্যাকেট সিগারেট ছাড়া, আর কিছুই গোছায়নি এখনও পর্যন্ত। আমার গোছানো শেষ। ওকে ফেলে রেখেই চলে যাব আজ।" 

 মায়ের কথার ফাঁকেফোকরে শুনতে পাচ্ছিলাম, ফোনের ওপারে তীব্র চিৎকার জুড়েছে বাবা, মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে বলে। হাওড়া পৌঁছালাম যখন, ঘড়ির কাটা ২ আর আড়াই এর মাঝামাঝি। স্নান সেরে নিয়েছে বটে বাবা, বসেনি মধ্যাহ্নভোজে। জেদ ধরেছে, আমি না এলে খাবে না নাকি। দুপুরে ভাত খাব বলে জানিয়ে রাখিনি, এখন হঠাৎ করে এদের ভাতে ভাগ বসালে হয় নাকি। তাছাড়া ব্যাগে করে টিফিন এনেছি আমি।  

ওসব ওজর আপত্তি টিকলো না, ভাত নাকি অঢেল আছে। ডাল তরকারি বন্যা বয়ে যাচ্ছে নাকি এই বাড়িতে। বাবা বলল তোর টিফিনটা সেরকম হলে আমি খেয়ে নেব। তুই ভাত খা। হাত ধুয়ে খেতে বসে চোখ ফেটে জল এল, ঠিক কয়েক চামচ ভাত নিয়েছে বাবা। মায়ের পাতে তার থেকে গোটা দুই/চার চামচ বেশি ভাত। একটা ছোট্ট মুরগির ডিম,, আধাআধি করে পাতে নিয়েছে দুজনে। আমার পাতে উপচে পড়ছে ভাত, আমার থালায় জ্বলজ্বল করছে, একটা গোটা ডিম।


বেশ বুঝতে পারলাম কদিন থাকবে না বলে ফ্রিজ ফাঁকা করে ফেলেছিল মা। যা ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাই খেতে বসেছিল দোঁহে। রান্না করে যে মেয়েটি সে আমাকে অনুযোগের সুরে বলল," দেখুন না দিদিভাই, বললাম প্রেসারকুকারে দুটো ভাত বসিয়ে দিই, দোকান থেকে একটা ডিম কিনে আনি। তো মেসোমশাই বললেন, এই রোদে আর কত খাটবি? কত ছুটবি?  যা আছে, তাই ভাগ করে খাব সবাই। বলে নিজেদের ভাতগুলো সব আপনাকে তুলে দিল। বললাম আমার থেকেও একটু দিই তো কি চিৎকার। বলল, বেশি পাকামি করিস না।"


জেদি বৃদ্ধের ভালোবাসাকে অমর্যাদা করা আমার সাধ্যাতীত। মোটামুটি চোখের আন্দাজে সমান ভাগ করার চেষ্টা করলাম ভাতের। পুরোপুরি সফল হলাম না যদিও। ঘড়িতে তিনটে বাজে। তাড়া লাগালাম। আর এক ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই বেরোতে হবে।

বাবা বেজার মুখে এক গ্লাস জল আর ওষুধের বাক্স নিয়ে বসল। মা তৈরি হতে গেল, আর আমি হাঁক পাড়লাম পিসিকে। যারা আমার পিসিকে চেনেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি পিসি হল বাবার দিদি। যদিও আমরা সব খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, এমনকি আমাদের ছানাপোনারাও ওনাকে দিদি বলে সম্বোধন করে।


এ হেন দিদির বয়স অষ্টাশি। কিন্তু আপাততঃ, তিনিই এ বাড়িতে সব থেকে সুস্থ। আমার ঠাকুমার আত্মজা কি না, জরা, ব্যধিকে তিলমাত্রও পাত্তা দেয় না আমার পিসি। হ্যাঁ উপর্যুপরি কয়েকবার পড়ে যাওয়ার জন্য হাঁটু গুলো ইদানিং কিঞ্চিৎ মচমচ করে,কানেও সামান্য কম শোনে পিসি। ব্যাস ওইটুকুই। তেমনি মানসিক জোর। বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করা সত্ত্বেও আমার বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি কেউ আসে নি তমলুকে, শুধু পিসি এসেছিল। এক ডাকে বেরিয়ে পড়েছিল আমার সাথে।  


 দুই খুড়তুতো ভাই প্রায়ই খোঁচা দেয়, আমি নাকি পিসির নয়ন মনি। যদিও তা সর্বৈব মিথ্যা। পিসির কাছে তার চার ভাইপো ভাইঝিই সমান আদরের।  আজও যেই দিদি বলে চিৎকার জুড়েছি, অয়ন লাফিয়ে এসে বলল, " ওরে খেতে বসেছে। খাওয়া হোক বলছি। না হলে তুই এসেছিস শুনে, খাওয়া ফেলে এঁটো হাতেই ছুটবে।" তা অবশ্য পিসি করে।


অয়ন কখন খবর দিয়েছিল জানিনা, পাঁচ মিনিট বাদেই দেখি টলমল করতে করতে পিসি এসে হাজির। টেনে আমার পাশে বসালাম। সাদাসিধে করে পড়া বিবর্ণ সুতির শাড়ি, হাত কাটা রঙ চটা ব্লাউজ, দুহাতে দুটো সরু সোনার চুড়ি, এক পিঠ কাঁচা পাকা খোলা চুল, এক মুখ হাসি এই আমার পিসি।

অয়ন অনিন্দ্য মাঝেমধ্যে চিৎকার করে, " ও দিদি,  ওই শাড়িগুলো এবার ফেলে দাও।" পিসির শাড়ির অভাব নেই তা সত্ত্বেও কিছু ফেলে না। দেরাজ খুললে থরে থরে সাজানো না জানি কবেকার সব শাড়ি। ছোটবেলায় বাবা বলত," এটা লর্ড ক্লাইভ দিয়েছিল দিদিকে, ওটা বাদশা আকবরের দেওয়া। শুধু সম্রাট অশোক যে জামাটা দিয়েছিলেন ওইটা ছিড়ে গেছে।" মনে করে অজান্তেই হাসির রেখা ফুটে উঠলো ওষ্ঠাধরে। এককালে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতই চূড়ান্ত অভাবে দিন কেটেছে পিসিরও। সেই সব দিনের কথা ভেবেই হয়তো কিছু ফেলে না পিসি। কিছু অপচয় করে না। 


টুকটাক কুশল বিনিময়ের ফাঁকফোকরে পিসি বলে, " খুব ভালো করেছিস তোর বাবা-মাকে নিয়ে যাচ্ছিস। আমাকেও আরেকবার নিয়ে যাস তো। কি ভালোই না লেগেছিল সেবার তোর ওখানে গিয়ে। তবে আমি গেলে কিন্তু সাত দিন থাকব  -।" বলতে বলতে আচমকা থেমে যায় পিসি। বাবার দিকে ঘুরে বলে," হিটলার ওটা দে?" বাবাকে নাম ধরে ডাকার মত মানুষ আর খুব কেউ নেই। তখনও জামাকাপড় পরেনি বাবা। তখনও বেজার মুখে জলের গ্লাস  আর ওষুধের বাক্স নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল বাবা, যেন কতই না ওষুধ খাচ্ছে। পিসির ধমক খেয়ে আচমকা ধড়মড় করে উঠে, একটা খাম এনে পিসির হাতে দিল। খামটা মুড়ে আমার হাতে দিয়ে পিসি বলল, " এটা শৌভিককে দিস। জামাইষষ্ঠীতে তো আসতে পারেনি।"


বাড়ি ফিরে শৌভিকের হাতে খামটা দিয়ে বললাম, এর মধ্যে যা আছে, সেটাকে টাকার অঙ্কে যদি ফেলিস তবে খুবই নগন্য কিছু হবে। কিন্তু এক সম্বলহীন বৃদ্ধার অন্ধ ভালোবাসা আর আশিস মিশিয়ে যদি দেখিস তবে এত মূল্যবান কিছু আদানি- আম্বানিদের ঘরেও পাবি না। যত সামান্যই হোক প্লিজ এটা দিয়ে কিছু কিনিস, বুড়ি খুব খুশি হবে। 

  টাকাটা বার করে নেবার পর খামটাকেও ফেলতে পারিনি আমি, রেখে দিয়েছি শৌভিকের ঝুলন্ত এক কোটের পকেটে। চূড়ান্ত আবেগপ্রবণতা Aquarian দের বৈশিষ্ট্য।  তারপর যা হয় ভুলেই গেছি, আজ অফিস বেরোচ্ছি, একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল শৌভিক, "এই দেখ,তোর পিসির দেওয়া টাকায় এটা কিনেছি। পিসিকে জানাস।" ভিতরে খলখল করছে একটা বডি স্প্রে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের শত ব্যস্ততার মাঝেও ভোলেনি, ঠিক মনে রেখেছে। মুখ ফুটে কোনদিন ভালোবাসি শব্দটা বলে না আমার বর, চেপে ধরলে বলে, "ভালো টাটকা হতে পারে, বাসি কেন হবে।" তবে এই ভাবে আমার প্রতিটা ঘ্যানঘ্যানে কথা কান করে শোনা, আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে শ্রদ্ধা সম্মান করা, এগুলো যদি ভালো টাটকা হয়, তো আমার টাটকাই ভালো, বাসি কে চায়।

No comments:

Post a Comment