Saturday, 1 July 2023

অনির ডাইরি ২৯ শে জুন, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি


ব্যাগ গোছাচ্ছি, জহর বাবু দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " ম্যাডাম চলি যাচ্ছেন?" ঘাড় নেড়ে জানালাম হ্যাঁ। আজ উল্টোরথ, 'জগু এন্ড কোং'কে ফেরত আনতে হবে মাসির বাড়ি থেকে। নাহলে আমার যা গুণধরী মেয়ে, এই বৃষ্টিতে আজ আর আনতে যাব না, বলে বসে থাকবে। তাই একটু তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছি। জহর বাবু আবার প্রশ্ন করলেন, "ম্যাডাম কাল ছুটি তো?" হেসে বললাম, "হ্যাঁ, কাল ঈদুজ্জোহা তো। আপনি আবার ভুলে গিয়ে, অফিস খুলে বসে থাকবেননি যেন।" একাধিক বার ওমন করার রেকর্ড আছে ভদ্রলোকের। শুনে একগাল হাসলেন জহর বাবু, তারপর  জিজ্ঞাসা করলেন, " ম্যাডাম, তাহলে হক বাবু খাওয়াবেন তো?" প্রশ্নের গুঁতোয় হাসি চাপা দায়। জহর বাবু একটু খেতে ভালোবাসেন, একদম আমারই মতো।  হক বাবু এই কিছুদিন আগের ঈদেই সবাইকে পেট পুরে খাইয়েছেন। আবার খাওয়াতে বললে নির্ঘাত মারবেন।সেটাই জানালাম বৃদ্ধকে।


ঘন মেঘে ঢাকা হাই রোড ধরে বাড়ি ফিরছি, উপর্যুপরি বৃষ্টিতে ঝাপসা জানলার কাঁচ। একই প্রশ্ন করল উত্তমকুমার, "ম্যাডাম কাল ছুটি তো? নাকি কোথাও বেরোবেন?" ঈদের দিন আবার কোথায় বেরোবো রে? উত্তম জিভ কেটে বলল," না জেনে রাখতেছি। আসলে কালকের দিনটা একটা ছুটি নিব আর কি, কুরবানি করব তো।"

বিষম খেয়ে বললাম, তুমি কুরবানী করবে? মানে? উত্তম জিভ কেটে বলল," না না আমি না। আমার এক বন্ধু করবে।ওদের কি নিয়ম আছে, কুরবানীর পর মাংস বিলি করে গরীব-দুঃখীকে, পাড়া-প্রতিবেশীকে দেয়, কিছুটা ফ্রিজে রেখেও ৩-৪ কিলো মতো থেকে যায়। ওটাই বন্ধুরা সবাই মিলে রেঁধে খাই। ওদের ভাড়া বাড়ির ছাদে প্লাস্টিক টাঙানো হয়ে গেছে। কড়া-খুন্তি-হাতা ভাড়া করে নিই আমরা, বাজারে বলাও হয়ে গেছে। ও কুরবানী করে মাংস বিলি করতে যায়, আমরা বাকি বন্ধুরা মিলে রান্না করি।  শুধু মাংস আর ভাত, আর কিচ্ছু নয়। মাথা পিছু সাত আট পিস করে হয়, দুপুর বেলা সবাই মিলে ওদের ছাদে বসে একসাথে খাই।"


মাংস বিলি করার ব্যাপারটা আগের দিনই হক বাবু বোঝাচ্ছিলেন বিশদে। দুদিন ছুটি চাইতে এসেছিলেন ঈদ উপলক্ষে, আমিই প্রশ্ন করেছিলাম কি কুরবানী দেন আপনারা? চার্চ লেনের বুড়ো হুসেন মিঞা বলত, সবাই গরু দেয় না। যার যেমন সামর্থ্য তেমনি দেয়। ধনীরা উট বা দুম্বা দেয়, ভেড়াও দেয় বোধ হয়। ছাগল দেয়। গরু ও দেয়। হুসেন মিঞার বক্তব্য অনুসারে, গাঁয়ের গরিবগুর্বো মানুষজন বেশ কয়েকজন মিলে একটা গরু দেয়। একে তো সস্তা হয়,তারওপর মাংসটাও একটু বেশি পাওয়া যায়। এই আর কি-। 


সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হক বাবুকে জিজ্ঞাসা করছিলাম। হক বাবু বললেন,' আমি দিই না ম্যাডাম। আমার দাদার ঘরে দেওয়া হয়।ওখানেই যাব। ছাগলই দেওয়া হয়।" জিজ্ঞাসা করলাম, ছাগল ছাড়া এখানে আর কি কুরবানি দেয় লোকজন। উট দেয় কি? হক বাবু বললেন," উট তেমন প্রচলিত নয় এদিকে। কেন বলুন তো, এখানে যে উটগুলো বেচতে আসে সেগুলো এমনিতেই বাতিল। অকর্মণ্য। বুড়ো উট। কেবল লোক দেখাতেই কেনা আর বেচা। আমি একবারই খেয়েছিলাম, ভালো লাগেনি। আমার দুম্বাও এমন আহামরি লাগে না। দিশি ছাগল দেয়, আর বড় বড় ছাগল যেগুলোকে রামছাগল বলে ওগুলো দেওয়া হয়।"


একটু থেমে বললেন, " ম্যাডাম, আমাদের নিয়ম কি জানেন! কুরবানী হয়ে গেলে মাংসটা তিনভাগ করা হয়। একভাগ বিলি করা হয় গরিব-দুঃখীদের, একভাগ যায় পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজনদের,  বাকিটা আমরা খাই। সেই জন্যেই ম্যাডাম, এই ঈদে আমি কাউকে বাড়িতে ডাকি না। এত মাংস আসে, গরুও আসে, যদি মিলেমিশে যায়।"


শুনতে শুনতে চার্চ লেনের নাজিম সাহেবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঈদ এলেই খাওয়াতেন নাজিম সাহেব, কিন্তু মুর্গি। আর প্রতিবারই জনৈক বৃদ্ধবড়দা, "বড়খাসি" খাওয়ানোর জন্য ঝোলাঝুলি করতেন। প্রতিবারই এক কথা বলতেন নাজিম সাহেব, "কেন গো, আপনাদের ধর্মে এই একটা জিনিসই তো খেতে নিষেধ আছে, সেটাই মানুন না। তাছাড়া আমার ধর্মেও নিষেধ আছে। কাউকে জোর করে বা না জানিয়ে খাওয়াতে নেই।" 


তাই জন্যই বোধহয় মইনুদ্দিন মামা মাংসের ঝোলাটা মায়ের হাতে ধরিয়েই বলতেন, " এটা কিন্তু খাসির মাংস।" মায়ের সহকর্মী ছিলেন ভদ্রলোক,  গোঁড়া বিহারী মুসলমান। পূর্বপুরুষ খাস সৌদি আরব থেকে এসেছিলেন বলে দাবি করতেন। নিয়মিত ইসলামী তত্ত্ব আর ইসলামী শাস্ত্র চর্চা করতেন আমার মায়ের সাথে। সুদূর মুর্শিদাবাদের রামনগর হাই স্কুলের ছাত্রী আমার মায়ের মাথার উপর দিয়ে যেত সেই সব জটিল তত্ত্ব। আকারে, ইঙ্গিতে, চিল্লিয়ে, ঘুমিয়ে পড়ে, চেয়ার নিয়ে সটান ঘুরে বসে, এমনকি ওনার স্ত্রীর কাছে নালিশ করে তা প্রকাশও করত মা। তাও দমানো যেত না বুড়োকে। ধর্মচর্চা না করলেই অংক করাতেন,  রীতিমতো বেত্রাঘাত করে। ওনার অংকের গুঁতোয় কি যেন একটা ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা এক লপ্তেই পাশ করে গিয়েছিল মা। 


এহেন মইনুদ্দিন মামা প্রতি ঈদে, চার পাঁচ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে আসতেন, তার পাতানো বোনকে মাংস দিতে। স্টিলের ঝোলায় ঝরঝরে কাঁচা মাংস, দুপুরবেলায় মায়ের হাতের গুণে কি যে খুশবু ছড়াতো বাড়ি ময়। সেই দশক গুলোই বোধহয় ছিল অন্যরকম। যুগটাও ছিল আলাদা। উনি গোঁড়া মুসলমান আমরা বর্ণ হিন্দু। যে যার, সে তার ধর্ম নিয়ে নিষ্ঠাবান এবং সোচ্চার। উভয়ের চোখেই তার তার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল তার নির্দিষ্ট ক্ষেত্র মধ্যে। মানবিক সম্পর্ক গুলোর  মাঝে কখনো নাক গলাবার সুযোগ পেত না সে। আর আজ কাউকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গেলেও তিনবার ভাবতে হয়। আমাদের বা ওদের কোন ধর্মীয় অনুশাসন ভাঙছি না তো? নেটিজেনরা আবার সেকু/ সেকুলাঙ্গার বলে গাল পাড়বে নাতো। 


ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, উত্তমের গলার আওয়াজে যখন হুঁশ ফিরল, কালিনগরের খাল পেরোচ্ছি। মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ' কি বলছ?' উত্তমকুমার গাড়ি চালাতে চালাতে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, " আপনি কখনও কুরবানীর মাংস খেয়েছেন ম্যাডাম?" ব্যাটা বলে কি? গুছিয়ে জবাব দিতে যাব, তার আগেই উত্তম বলল, "এমনি দোকান থেকে ওই নলি কাটা (হালাল) মাংস কিনে খেয়ে দেখবেন,আর কুরবানীর মাংস খেয়ে দেখবেন। একদম আলাদা। কি যে কানে ফিসফিস করে মন্ত্র পড়ে দেয়, স্বাদটাই আলাদা হয়ে যায়। ঠিক যেমন আমাদের বলির মাংসের স্বাদ একদম আলাদা হয়। এমনি ছাগল কাটুন ওই স্বাদই পাবেন না। কি ভাবে যে হয়। সবই বোধহয় ভগবানের মহিমা বুঝলেন তো ম্যাডাম।" 


দূর কি এতক্ষণ উল্টোপাল্টা ভাবছিলাম, কিচ্ছু বদলায়নি আমার দেশ।  গুটি কয়েক নেটিজেনের বাইরে যে বৃহত্তর খেটে খাওয়া ভারতবর্ষ, ছিটে ফোঁটা ও বদল হয়নি তার চরিত্রে। একই আছে আমার দেশ। বড় করে একটা শ্বাস ফেলে আঙ্গুলের ইশারায় বললাম, তুই সামনে ফিরে গাড়ি চালা বাপ, এখনই মরতে চাই না। রথ সমেত তিন গুড়গুড়ে ভাইবোনকে বাড়ি আনতে হবে, জিলিপি খেতে হবে, কাল সকাল হলেই জনগণকে ঈদ মুবারক করতে হবে, একটু বেলা হলেই সব গোঁসা করে বসে থাকবেন নয়তো নিজেরাই লাফাতে লাফাতে ফোন করে বসবেন। শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব মিটলে বাসি জিলিপি গুলোও সাবাড় করতে হবে, কাজ কি কম। মরার কি ফুরসৎ আছে বাপু।

No comments:

Post a Comment