Monday 19 June 2023

অনির ডাইরি, ১০ই জুন, ২০২৩

 


#বুনো_তেউড়ির_ফুল #অনিরডাইরি #টিমচুঁচুড়া


বছর দুই আগের কথা। বিশের বিষ নামতে না নামতেই, পুনরায় ফিরে এসেছে করোনা। ঘোষিত হয়েছে লক ডাউন। আকাশে বাতাসে এক মুঠো প্রাণবায়ুর জন্য হাহাকার। বোকা বাক্সের পর্দায়, প্রভাতী সংবাদ পত্রের প্রথম পাতা জুড়ে কেবলই মৃত্যু মিছিল। কি হৃদয় বিদারক সব ছবি!হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে শায়িত মরণাপন্ন  স্বামীর ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চরম আকুতি গৃহবধুর। সে চোখে দেখা যায় না। ভাবতে বসে আজও কেঁপে উঠছে বুক।


এরই মধ্যে নির্দেশ এল সূঁচ ফোটানোর। দায়িত্ব নিয়ে সূঁচ ফোটাতে হবে শ্রম দপ্তরের আপামর কর্মচারীকে। সেক্রেটারিয়েট ছাড়াও, শ্রম দপ্তরের আছে বেশ কয়েকখানা ডাইরেক্টরেট। সবাইকে দলবদ্ধ ভাবে সূঁচ ফোটাতে হবে। সূঁচ মানে ভ্যাকসিন, আশা করি বুঝতে পারছেন। হুগলী জেলার নোডাল বানানো হল অধমকে। অতঃপর সকলের নাম,ফোন নাম্বার জোগাড় করা, ডেটাবেস বানানো, তাই নিয়ে জেলা প্রশাসনের ছোটদা- ছোটদিদের সাথে কথাবার্তা বলা। বড়দা-মেজদার সাথে আমাদের বড়দি কথা বলছিলেন। তাঁদের নির্দেশ মত স্বাস্থ্য দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে দিন স্থির করা, ভ্যেনু বুক করা, লোকজনকে বাবা বাছা করে ডেকে আনা ইত্যাদি প্রভৃতি। যত সহজে লিখে ফেললাম, আসলে ব্যাপারটা ছিল ততোটাই জটিল। সবপক্ষকে খুশি করে, বাবা বাছা করে ডেকে এনে সূঁচ ফোটাতে আক্ষরিক অর্থেই উঠছিল নাভিশ্বাস। 


সরকারি চাকরগিরির বৈশিষ্ট্যই হল, বারংবার আপনার অপারগতাটুকুকেই বড় করে দেখা। আর সাফল্যটুকুকে চুপড়ি চাপা দিয়ে রাখা। ওটা তো আপনার কাজ মশাই,নিজের কাজটুকু করার জন্য আবার বাহবা চান নাকি? 


ভাগ্যে আমার ওপরওয়ালারা এমন ছিলেন না। প্রোবেশন পিরিয়ডের হাকুচ তেঁতো, পাঁচন এবং পিছন মার্কা অভিজ্ঞতা টুকু বাদ দিলে, বারবরই আমার ওপরওয়ালা এবং ওয়ালীরা যুগিয়ে গেছেন পূর্ণ সমর্থন, করে গেছেন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস। আর নীচের তলা প্রমাণ দিয়ে গেছে অখণ্ড নির্ভরশীলতার। তাই বোধহয় পেরেছিলাম, নাহলে আগের দিনেও তো  বলেছিলেন মগরার ইন্সপেক্টর অরুণ বাবু, ‘ম্যাডাম, এতো গুলো লোক, তারপর যখনই জানাজানি হবে, এখানে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, হামলে পড়বে আসেপাশের মানুষ। আগের দিন এনিয়ে ব্যাপক মারামারি হয়েছে। কি ভাবে সামলাব আমরা? আপনি সিভিক পুলিশ রিকুইজিশন করুন।’ করিনি আমি। ভরসা ছিল আমার টিমের ওপর, কতজন আসবে? শ পাঁচেক? কত লোক আসে আমাদের মেলায়? নূন্যতম হাজার?তারওপর থাকে ভিআইপি,মিডিয়া আর স্টলের লোকজনের ভিড়, যারা হেলায় ঐ জনপ্লাবন সামলে দেয়, তাদের কাছে এতো নিছক নস্যি।   


কে বলবে লক ডাউন? চলছে না গাড়িঘোড়া? পৌনে দশটার মধ্যেই চুুঁচুড়ার হাইমাদ্রাসায় জমায়েত হয়ে গিয়েছিল আমার টিম চুঁচুড়া। নাঃ আমি যাইনি। আমি বসেছিলাম অফিসে। জনৈক স্নেহশীল বড়দা বারবার বলছিলেন ফোন করে, ‘তুই একবার যা। গিয়ে দেখ তো, কোন সমস্যা হচ্ছে কি না?’ আমি যাইনি। কারণ, জানতাম আমি গেলেই তৈরী হবে সমস্যা। উথলে উঠবে অভিমানের ঝাঁপি। ওরা জানে, আমি পাশেই আছি, যে কোন সমস্যায় শুধু একটা ফোনের দূরত্ব।  


আমার কাজ শুধু মাথা ঠাণ্ডা রাখা, আর ফোন করে যাওয়া পরপর। লোক জমায়েত হল কি? ভ্যাকসিন এল কি? কি বলছেন আরো ল্যাপটপ লাগবে? ওয়াইফাই লাগবে? এই আশঙ্কাই করেছিলাম, কপালের নাম গোপাল। দিন দুয়েক আগের দমকা ঝড় আর বজ্রপাতে দেহ রেখেছেন আপিসের অর্ধেক কম্প্যুটার আর যাঁরা জীবিত তাঁরা ইন্টারনেট কি বস্তু বুঝতেই পারছেন না। বাধ্য হয়ে তুত্তুরীর ক্লাশ করার জিওফাইটা ব্যাগ বন্দি করে নিয়ে এসেছি। ও রমেশ (এসএলও), এসে নিয়ে যা বাবা। পাসওয়ার্ড কেবল সোমনাথের(সিকেসিও) মোবাইলেই পাঠাব। বড় ভালো ছেলে আমার সোমনাথ। সাঁওতাল বলেই বোধহয় এত ভালো, এমন সাদাসিধে- ‘সোমনাথ দেখো বাবা,ঐ ওয়াইফাই দিয়ে ইস্কুল করে তুত্তুরী, এমন কিছু কেউ খুলো না,যে তুত্তুরী আমায় প্রশ্ন করে, ‘মা এটা কি বস্তু?’ লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় সোমনাথ।  


এগারোটা বেজে যায়, রমরমিয়ে শুরু হয়ে যায় শ্রীরামপুর আর আরামবাগের ছুঁচ ফোটানো কর্মসূচী। চুঁচুড়ার কি হল? নির্মল? অরুণ বাবু? চালু করলেন আপনারা? রমেশ আর বর্মন সাহেবের ল্যাপটপ আর তুত্তুরীর ওয়াইফাই নিয়ে প্রস্তুত আমাদের সোমনাথ আর বাদল, বাইরে জমে উঠেছে জনপ্লাবন, কিন্তু পোর্টালের মুখ ভার যে। ঢুকতেই দিচ্ছে না আমাদের। তা হ্যাঁ পোর্টাল, আমাদের ওপরই কেন এত ক্ষোভ বাপু তোর? শুরু হতে হতে সাড়ে বারোটা বাজালি? আর একটা ল্যাপটপ হলে ভালো হত, শুনে মাটিতে মিশে যাই আমি, আমার ল্যাপটপ খানা আনলেই হত, কিন্তু প্রথম কথা তাতে ক্লাশ করছেন কেউ আর দ্বিতীয়তঃ তার কিবোর্ড থেকে B এবং Z অক্ষর দুটি কে জানে কি ভাবে যেন গায়েব হয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রতি দিনই চলে দোষারোপ তথা পাল্টা দোষারোপের পালা। যতক্ষণ না তিতিবিরক্ত শৌভিক চিৎকার জোরে, ‘তোরা দুটোই সমান অলম্বুষ। ’ 


বাইরে থেকে ক্রমেই ঢুকে আসছে অন্য মানুষজন, প্রিয়াঙ্কা-সমীর-প্রদীপ-শান্তনু-আশিস সামলাতে সামলাতে বেদম, ‘দাদা আজ এখানে শুধু লেবার দপ্তরের লোকজনেরই ভ্যাকসিনেশন। ছুঁচ তো গোনাগাঁথা। আপনারা বরং সদর হাসপাতাল বা পৌরসভায় চলে যান। ’ তাও আসতে থাকে অনুরোধের ঠেলা, ‘আমি লেবারের লোক না হলেও, আমার মামাতো কাকার পিসেমশাই লেবারে চাকরি করেন। ’ প্রিয়াঙ্কা গম্ভীর মুখে জানায়,লিস্টে নাম নেই।  কখনও বা আসে মৃদু হুমকি, ‘আমি অমুক দাদার লোক।  দাদা বলে দিয়েছেন।’ দাদা দেখালেই এগিয়ে যায় নির্মল, ‘ভাই আমাদের হাতে তো ছুঁচ নেই, ওটা স্বাস্থ্যদপ্তর দেখবে। আপনারা বরং দাদাকে বলুন, ওণাদের জানাতে।’ আবার কখনও বা আসে মরমী অভিমান, ‘আমি লেবারের নই বলে কি আমায় দেবেন না? তাহলে শুধু আপনারাই বাঁচুন। আমার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। ’ এত করুণ-কঠোর বাক্যবাণ হজম করতে পারে না আমার টিম। নির্মল তাকে আদর করে বসায়, ‘ভ্যাকসিন নেবেন তো? একটু বসুন। দেখছি।’ তারপর ফোন করে আমায়, ‘একে ফেরাতে পারব না ম্যাডাম। ’ 


সাড়ে বারোটা বেজে যায়। সকাল সকাল এক কৌটো ঘরে তৈরি আমসত্ত্ব দিয়েছিল সায়নী, টেনশনে তার অর্ধেক সাফ করে ফেলি আমি। উপহার হিসেবে পাওয়া যায় এক কৌটো সূর্য মোদকের পান্তুয়া আগেভাগে সরিয়ে রাখে ধীমান। ‘ম্যাডাম এটা খুলবেন না কিন্তু। এটা তুত্তুরীর জন্য। ’


পৌনে একটা বাজে। পোর্টালের বাঁদরামির জন্য এখনও শুরু হয় না ভ্যাকসিনেশন। আর এক কাপ চা পেলে ভালো হত, কিন্তু কালেক্টরেটের দুই চাওয়ালাকেই জবরদস্তি ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে গেছে ধীমান। স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিকর্তা আশ্বস্ত করেন, ‘ঘাবড়াচ্ছেন কেন, আধঘন্টায় আপনার লাইন ফাঁকা করে দেবো আমরা।’ তবে পোর্টালের অভিমান তখনও হয় না দূর।  আপাততঃ ম্যানুয়াল এন্ট্রি মারতে থাকে সোমনাথ আর বাদল। দুটোর মধ্যে ময়দান সাফ। হোয়াটস্অ্যাপ ভরে ওঠে টিম চুঁচুড়ার বিখ্যাত, ‘ভি-সেলফি’তে।  মাম্পি এসে দিয়ে যায় এক ব্যাগ চারাগাছ আর নদীর পলিমাটি।  কি নেই তাতে-মানিপ্ল্যান্ট থেকে লতানে পান, সিঙ্গোনিয়ামের ঝাড় থেকে ক্যালাঞ্চো। কারি পাতা থেকে ইংলিশ ক্রিপার আর একগাদা গুঁড়ি গুঁড়ি ফুলের গাছ। সাথে এক বস্তা বালিও বয়ে এনেছে মেয়েটা, অল্প করে ছড়িয়ে দিতে হবে শিশিতে রাখা গাছের জলে। পাগল মেয়েটার জন্যই এই গরমেও আমাদের অফিসে ডানা মেলেছে থোকা থোকা পুদিনা। লতিয়ে বাড়ছে পার্পল হার্ট। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কি যেন একটা পাতা বাহার গাছ। এক হাতে গাছ,অন্য হাতে বালি আর বগলে খোন্তা নিয়ে আমার চেম্বারে ঢোকে মেয়েটা। ঢোকার আগে আপিসের গাছগুলোর মাটি খুবলে এসেছে। তিনবার প্রশ্ন করে মেয়েটা, ‘বালি নেবেন না?’ না রে বাবা। এতো গাছ নিয়ে যাবার অপরাধেই হয়তো নির্বাসন দেবে বর আমার-। তারওপর এককলসি বালি কোথায় রাখি? 


গঙ্গাপাড়ের বুড়ো ডাচ কলোনিতে নামে মেঘলা বিকেলের স্নিগ্ধতা । নির্মল জানায়, স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মীবৃন্দ বিদায় নিলেন, এবার আমাদের পোর্টালে এন্ট্রি করা আর মেসেজ পাঠানোর পালা। তাতে লাগবে ঢের সময়। রাত আটটা তো বটেই। জেলাতুতো আধিকারিক বোন আর স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের মেসেজে ধন্যবাদ জানাই। এতদিন ধরে আমাকে সহ্য করা কি কম বড় কথা! আর বড়দির কাছে জানাই, রাত আটটা বাজবে মনে হচ্ছে। দুটো ল্যাপটপ আর তিনটে মোবাইল মিলিয়ে কাজ করছে আমার টিম তাও-। বড়দি জানেন, মাঝেমধ্যে অমন সুখী সুখী ঘ্যানঘ্যান করি আমি। বড়দি বলেন ,‘সাবধানে থেকো, ছেলেমেয়েগুলো কিছু ভালোমন্দ খাইয়ে দিও। ’ সে তো দেবোই,তবে আজ না। অন্যদিন, যেদিন কাজের অজুহাতে শুধু খেতেই জমায়েত হব সবাই, আজ খাওয়ালে উপভোগ করতে পারবে না কেউ। আজকের জন্য বড়জোর ঘড়ির মোড়ের ব্যানার্জীর দোকানের রুটি তড়কা বা প্রাক্তন বড় সাহেবের প্রিয় নৈশ ভোজ, রুটি আর আলুপোস্ত। তবে তার আগে, একপ্রস্থ ছবি তোলা হবে না, তা আবার হয়? সারাদিনের উত্তেজনায়, গায়েগতরে খাটুনিতে সবার মুখে জমেছে পুরু তেলের আস্তরণ, অবিন্যস্ত কেশবাস- তবে মুখে ঝলকাচ্ছে খুশির দীপ্তি। এই ছবির নাম থাক, ‘বুনো তেউড়ির ফুল।’ 


পুনশ্চঃ নামটা আমার খুড়তুতো ভাই শ্রী অয়ন চট্টোপাধ্যায়ের থেকে ধার নেওয়া। আমাদের বুড়ো চাটুজ্জে বাড়ির এবড়োখেবড়ো আঙিনায় অযতনে ফুটে থাকা থোকা থোকা রঙবেরঙের একরাশ বুনো ফুলের নাম, অয়ন বাবু রেখেছে বুনো তেউড়ির ফুল। এরাও তেমনি আমার বুনো তেউড়ির ফুল। আর এই ডাইরি হল, উপরওয়ালা হিসেবে আমার কৃতজ্ঞতা। প্রায় দুবছর হল ছেড়ে এসেছি ওদের। বদলি হয়ে গেছে অনেকে। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে অনির টিম চুঁচুড়া। সময়ের ধুলো জমেছে স্মৃতিগুলির ওপরেও। কিছু ভুলেছি আমি, ওরাও গেছে ভুলে। আজ আমি অন্য টিমের অধীশ্বরী, অন্য এক দলের নয়নমণি।সরকারি নির্দেশনামা মোতাবেক আজ আমার কোন অধিকারই নেই সেদিনের সহকর্মীদের ওপর। তবুও বলি, খুব খুব ভালো থেকো আমার বুনো তেউড়ির ফুলেরা। তোমাদের ভালোবাসাই এই চাকরি জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। বাকিটা তো নিছক চাকরানী গিরি।

No comments:

Post a Comment