#অনিরডাইরি
রাত দেড়টা বাজছে। পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে শৌভিক। কেবল আমিই তন্দ্রাহারা। মন আর মাথা জুড়ে গিজগিজ করছে কত যে স্মৃতি। বন্ধ চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে কাকু-কাকিমা- দাদা-বৌদি আর ওদের বাচ্ছাটার মুখ।
কাকু বাবার সহপাঠী ছিলেন এককালে। বিদ্যালয় জীবনে যদিও তেমন বন্ধুত্ব ছিল না দুজনের। স্কুল ছাড়ার পর দূরত্ব আরো বাড়ে। আগুনে সত্তরে বাবা যখন নকশাল নেতা, আর পাঁচজন সুবোধ বালকের মত কাকুও নাকি এড়িয়ে চলতেন বাবাকে। ভাগ্য বৈগুণ্যে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়ে গেলেও, না দেখার ভান করে পাশের গলিতে নাকি ঢুকে যেতেন কাকু।
একগাদা রক্ত ঝরিয়ে বিদায় নিল সত্তর। ব্যর্থ বিপ্লব আর দিন বদলের অলীক স্বপ্ন ছেড়ে রুক্ষ বাস্তরের মাটিতে আছড়ে পড়ল বাবা। বাধ্য হল ঘোরতর সংসারী হয়ে উঠতে। কাকু তো জন্ম সংসারী। এরই মধ্যে টাকা জমিয়ে একফালি জমিও কিনে ফেলেছেন। ব্যারাকের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়িতে উঠে আসা কেবল কয়েকটা দিনের গল্প। মুস্কিল হল সব গল্প গুলি যদি এমনিই সরলরেখা বরাবর চলত। ভিত তৈরি করতে গিয়েই হোঁচট খেলেন কাকু। সৌজন্য পাড়ার দাদারা এবং তাদের কেলাব। ক্রীত জমির গরিষ্ঠাংশ দাবী করে বসলেন তারা। বড় কেলাব বিল্ডিং বানাবেন। নিজের রক্ত জল করা পয়সায় কেনা জমি, কোন মধ্যবিত্ত বাঙালি ছাড়তে পারে। এই নিয়েই দ্বৈরথ। খিস্তিখেউড়।
সেটা ছিল রবিবার। হঠাৎ আমাদের বুড়ো সদর দরজায় এসে উদয় হলেন কাকু। পিছু হঠতে হঠতে হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, পাশের গলিতেই তো থাকে তাঁর ছোট বেলার বন্ধু। বিরাট নকশাল নেতা অলোক। থলে নিয়ে সাপ্তাহিক রেশন তুলতে যাওয়া আমার বাবার গায়ে ততোদিনে নকশালত্বের কোন গন্ধই আর অবশিষ্ট নেই। তবুও বলে না, মরা হাতি লাখ টাকা। বাবার বেশ কিছু ভক্ত অনুরক্ত তখনও হাওড়া এবং শহরতলী কাঁপায়। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কাকুকে বগলদাবা করে বাবা গিয়ে হাজির হল কেলাবে।
এতক্ষণের খিস্তিখেউড় পলকে মোলায়েম অনুরোধে বদলে যায়। “মাইরি বলছি হিটলারদা। জানতুম না, উনি আপনার ন্যাংটো বেলার বন্ধু। সরি দাদা। মাপ করে দেন দাদা। এতদিন ঐ জমিতেই আমরা বসতুম, আড্ডা মারতুম। ওখেনেই আমদের কালী পুজো হয়। যদি মায়ের নামে কিছুটা জায়গা দেন। কেলাব বানাব না, শুধু মায়ের আরাধনা করব, একটা পাকা মঞ্চ বানিয়ে। এইটুক কথা শুনুন লক্ষ্মী দাদা আমার। ”
বিপদ কালে বুদ্ধিমানরা অর্ধেক পরিত্যাগ করে। কাকু সেখানে কয়েক ছটাক জমি পরিত্যাগ করলেন বটে, তবে বাবার সাথে সম্পর্কটা বাঁধিয়ে নিলেন সোনা দিয়ে। এরপর থেকে গোটা আশি- নব্বইয়ের দশকে এমন একটা দিন, একটা সন্ধ্যে যায়নি যেদিন কাকু এসে বাবার খবর নিয়ে যায়নি। দেখা গেল কাকিমার সাথে মায়ের পরিচয় ছিল আগে থেকেই। মা যখন শিবপুর পোস্ট অফিসে ডিউটি করতে যেত, ঠিক তখনি, ঐ একই বাসে করে কাকিমাও যেতেন প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে।
কাকু-কাকিমার সাথে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠলেও দাদার সাথে কোনদিনই বন্ধুত্ব হয়নি আমার। একে তো বয়সে অনেক বড়, তারপর কেমন যেন ছিল। গম্ভীর, ভোম্বল প্রকৃতির। ঢলঢলে হাফ প্যান্ট পরে, বগলে ট্যালকম পাউডার ঢেলে ইয়া বড় ভুঁড়ি বার করে ঘুরত। বিকম পাশ করার পর কাকুর পরিচিত একটি কারখানায় আ্যাকাউন্টসের কাজ করত দাদা। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ছেলের বিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন কাকু। কারণ ওণার মা যাতে নাতবৌয়ের মুখ দেখে যেতে পারেন। ১৯৯৯ এর মার্চ বা এপ্রিলে সম্বন্ধ করে বিয়ে ঠিক হল দাদার। পাত্রী আমাদের পিছনের পাড়াতেই থাকে। পাত্রীর বাবা আবার ছোটকাকুর বন্ধু।
বিয়েতে আমি যেতে পারিনি। বউভাতেও নয়। পরীক্ষা চলছিল। বাবা মা যদিও ঘরের লোকর মতই সবেতে হাজিরা দিয়েছিল। বউভাতের পরের দিন সন্ধ্যে বেলা পড়তে বসেছি, হঠাৎ দেখি নবোঢ়া পুত্রবধূকে বগলদাবা করে কাকু হাজির। “এই যে ঝুনু,তুমি বিয়েতে যেতে পারোনি বলে বউদি নিজেই এসেছে তোমার সাথে আলাপ করতে।” বেশ লম্বা, ফর্সা, একটু ভারীর দিকে চেহারা বৌদির। ঘোর কৃষ্ণ দুই ভ্রুর নীচে এক জোড়া ফুরফুরে অতিকায় চোখ, একটা মস্ত থ্যাবড়া নাক আর একটু পুরু হাসিহাসি দুই ঠোঁট। প্রথম আলাপেই আপন হয়ে গিয়েছিল বউদি। জানলাম বৌদিও তারা সুন্দরীর ছাত্রী। যদিও আমাদের থেকে বছর চারেক সিনিয়র। সম্পর্ক বিহীন এক সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম আমরা চারজন। বাবা-মা- আমি আর বৌদি।
প্রথম প্রথম কাকুর অনুগামী হয়ে আসলেও ধীরে ধীরে বউদি একাই চলে আসতে শুরু করল। বাপের বাড়ি যাচ্ছি, বলে সোজা আমাদের বাড়ি। মা প্রায়ই বলত,‘মিথ্যে কথা বলে কেন আসিস বাপু। মাঝেমধ্যে বাপের বাড়িও যা।’ বললেই হেসে গড়িয়ে পড়ত বৌদি। ‘ওবাড়িতে আমায় কেউ ভালোবাসে না কাকিমা। কিছু বললেই মা বলে,‘ বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। এবার তোমারটা তুমি বুঝে নাও।’
দাদা অবশ্য জানত। অফিস ফেরৎ বউকে নিতে আসত। এমনি একদিন হঠাৎ চলে এসে হাপুস নয়নে কাঁদছিল বউদি। বাবা, মা, আমি তো হতভম্ব। দীর্ঘক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মা। অনেক আদর করল মা। আদা দিয়ে ঘন দুধের চা করে আনল মা। তারপর মুখ খুলল বউদি,‘জানেন সরমা কাকিমা, বিয়ের আগে আমি বাবাকে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম, আমাকে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দিও, যে মাসে অন্তত ১০ হাজার টাকা বেতন পায়। আমাকে বলা হয়েছিল ও নাকি তাই পায়। আজ রামরাজাতলা গিয়েছিলাম আমরা, ফেরার পথে স্টেশনে বসে জিজ্ঞাসা করলাম তো বলল, ওর বেতন মাত্র দুই হাজার টাকা। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ”
একজন পুরুষকে শুধু মাত্র তার উপার্জন দিয়ে বিচার করা হয় না আমাদের বাড়িতে। তাহলে তো একজন কেন্দ্র সরকারী কর্মচারী হিসেবে জেলখাটা লোককে বিয়ে করারই কথা নয় আমার মায়ের। সেটাই বোঝাল বাবা আর মা। আজকের বাজারদরে সংসার চালানোর দায় পুরুষের একা নয়। তুমিও কিছু কর। দুজনে মিলে রোজগার করে নাও দশ হাজার। দাদা ও ছুটে এসেছিল বউয়ের পিছু পিছু, মাথা নত করে তিনিও শুনলেন।
সেরাতে দুজন চুপচাপ বাড়ি ফিরে গেলেও, অল্প দিনের মধ্যেই আবার এসে হাজির হল বৌদি। বাইরে সেদিন অঝোর ধারাপাত। একই ধারাপাত বৌদির দু নয়নে। হাতে একটা গাঁটরিতে কয়েকটা শাড়ি। দুর্মুখ শাশুড়ি পাঠিয়েছে। “জানো অনিন্দিতা বিয়ের আগে আমি একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াতাম। বেশি না পাঁচশ টাকা বেতন দিত। তাও তো আমার নিজের উপার্জন। তোমার ঐ কাকিমা আমাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করল। চাকরি করলে নাকি ভালো করে সংসার করা যায় না। আমি সংসার সামলাব আর উনি পড়াতে যাবন। সেই মহিলা আজকাল কথায় কথায় খোঁটা দেয়। বলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুটো শাড়ি বিক্রি করলেও তো পারো।’
সেদিন দাদাকে খুব বকেছিল বাবা।" ও শাড়ি বিক্রি করতেই পারে,যদি ও চায়।" নাঃ শাড়ির ব্যবসাটা চলেনি বৌদির। একটাও বোধহয় বিক্রি করতে পারেনি। চায়ওনি। এর কিছুদিন পর বাটিকের কাজ শেখার ক্লাশে ভর্তি করে দেয় কাকু। বেশ ভালোই শেখে কাজটা। মাকে একটা বাটিকের ব্যাগ, বাবাকে বাটিকের শার্ট পিস, আমার জন্য রুমাল বানায় বৌদি। ‘হ্যাঁরে তোর মাকে দিয়েছিস? শাশুড়িকে দিয়েছিস?’ প্রশ্ন করে মা। মুখ বেঁকায় বৌদি। ‘কেন দেব কাকিমা? যাদের ভালোবাসি তাদের দেব। ’
“ জানেন কাকিমা কি দেখলাম আজ রাস্তায়? আমার বোন একটা ছেলের সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। পিছন পিছন আসছে আমার মা। ভাবতে পারেন? আমি কোন ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকালেও গায়ে হাত তুলত মা। যাতা বলে অপমান করত বাবা। আর বোনের বেলায় সব বজ্র আঁটুনি খুলে গেল?” বোনকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসলেও, খুব কড়া অনুশাসনে বড় হওয়া বউদি কিছুতেই মানতে পারত না, তার ঘোরতর রক্ষণশীল পিতামাতার এই দ্বিচারিতা।
বাটিকের নেশাও একদিন ফিকে হয়ে গেল। বউদি পাগল হয়ে উঠল সন্তানের মুখ দেখার ইচ্ছেয়। কিছু শারিরীক জটিলতা ছিল, সেসব কাটিয়ে কোন এক বছর জুলাই মাসে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করল বৌদি। ছেলেই চেয়েছিলও। বলত, ‘আমার শাশুড়িকে তো জানোই। মেয়ে হলে কত যে কথা শুনতে হবে। এমনিই উঠতে বসতে বলে, ‘দেখো যেন মেয়ে না হয়।’ কাকিমার আশঙ্কা দূর করে দক্ষিণ কলকাতার এক বড় নার্সিং হোমে জন্মাল বাবু। নাতির জন্মের যাবতীয় খরচ বহন করল বৌদির বাবা। ততোদিনে কাকুর মধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে দেখা দিয়েছে অ্যালঝাইমার্স আর পার্কিনসন ব্যধি। মাঝেমধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলছেন কাকু। ঐ অবস্থায়ও ধুমধাম করে অন্নপ্রাশন হল ছেলেটার। ব্যয়ভার বহন করলেন কাকু।
অনেক সাধনার ফসল বাবু, দেখতে যেন মাখনের তাল। প্রায় দিনই ছেলে কোলে আমাদের বাড়ি পালিয়ে আসে বৌদি। মুণ্ডপাত করে কাকিমার। হাহুতাশ করে উঠতি বাজারদরের। চাকরির পরীক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছি আমি। স্কুলসার্ভিসের ক্লাশও তার মধ্যে ধরা। যদিও শিক্ষিকা হওয়ার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। তবুও বৌদির জন্য ক্লাশ করতে রাজি আমি। নোটস্ এনে দেব, তুমি পরীক্ষাটা তো দাও। তখন হুড়মুড়িয়ে লোক নিচ্ছে স্কুল সার্ভিস কমিশন।
‘না অনিন্দিতা। আমার ছেলেটাকে কে দেখবে?’ আর বললাম না। মা শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বলল,‘ছেড়ে দে। ওর চাকরি করার কোন ইচ্ছেই নেই।’ আমার কথাটা সেদিন শুনলে হয়তো ভালো করত বৌদি। অচীরেই চোখ বুঝলেন কাকু। অবসর নিলেন কাকিমাও। সংসার চালানোর দায়ভার কিছুটা এসে বর্তাল দাদার ওপর। এতেই ঘোরতর আপত্তি বৌদির। ‘সারা জীবন কেবল সংসারই করে যাব? একটু আনন্দ ফূর্তি করব না? আর কটাদিনই বা বাঁচব, কাকু।’
কাকুর মৃত্যুর পর হঠাৎ করে জরা এসে গ্রাস করল কাকিমাকে। খিটখিটেও হয়ে গেলেন খুব। সংসারে নিত্য অভাব। নিত্য অশান্তি। বৌদির শান্তিনিকেতন কেবল আমাদের বাড়ি। যাবতীয় অনুযোগ কেবল আমাদের কাছে। কতবার যে বাবা ধমকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আবার চলে এসেছে ছেলে বগলে। পুরী গিয়ে নিজে নিজেই পুজো দিয়ে এসেছে আমার নামে। ‘তোমার চাকরি হচ্ছে না বলে কাকিমা কষ্ট পাচ্ছেন কিনা। দেখবে জয় জগন্নাথ সব ঠিক করে দেবে। ’
দিয়েও ছেন। চাকরী পেলাম। রাইটার্সে কমার্স ইন্ডাস্টিজ্ দপ্তরে। সেদিন ১৯শে জুলাই, বউদির ছেলে বাবুর জন্মদিন। বছর ঘুরল না লেবার সার্ভিস পেয়ে গেলাম। চাকরীর দুশ্চিন্তা ফেলে মায়ের মাথায় চাপল আমার বিয়ের ভূত। আবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জয় জগন্নাথদেবের শরণাপন্ন হল বৌদি। বিয়ে হল। বিয়ের পর জানতে পারলাম, শৌভিকের দাদুর দেওয়া নাম,‘জগন্নাথ। ’ যদিও তিনি চলে যাবার পর ঐ নামে আর কেউ ডাকে না।
আমার বিয়ের তত্ব সাজানো থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে ছেলে ট্যাঁকে হাজির বৌদি। সঞ্চিতা আর পম্পার সাথে হাত মিলিয়ে সব কাজ করল। পরের দিন ভোরবেলা আয়লা মাথায় ছুটে এল, শুধু বিদায়ের আগে আমাদের আশির্বাদ করবে বলে। দুটো মস্ত ক্যাডবেরি দুজনের হাতে দিয়ে মস্তক চুম্বন করল বৌদি। বাবা মাকে ছেড়ে যেতে যেতে একটা সান্ত্বনা নিয়ে গেলাম, আর কে কি করবে জানি না, এই ভদ্রমহিলা অন্তত নিয়মিত মায়ের খোঁজ নেবে। বকে বকে মায়ের মাথা ধরিয়ে দেবে। যতক্ষণ না বাবা ধমকে বলবে,‘ এবার বাড়ি যা।’
জীবনের গল্প যদি সত্যিই নির্দিষ্ট ফর্মুলা মেনে চলত। পরের এক দশকে কি যে হয়ে গেল। কাকিমা চলে গেলেন। বাবার পই পই করে নিষেধ করা সত্ত্বেও, কাকুর অত সাধের বাড়ি প্রমোটারকে দিয়ে দিল দাদা আর বৌদি। বারো লাখ টাকা আর একটা ফ্ল্যাটের বিনিময়ে। সেই বারোর আটই ওরা পেয়েছিল। বাকি চার, দালাল যিনি আবার সম্পর্কে ওদের আত্মীয় সিম্পলি ঝেঁপে দেয়। বাবার কাছে ছুটে এসেছিল দোঁহে, কিন্তু বাবার সেই ম্যাজিক এখন আর কই। পরিচিত সব লোকই প্রায় মৃত। দুঃখ ভুলে মনের মত করে ফ্ল্যাট সাজায় বৌদি। বিশাল ঝাঁকজমক করে গৃহপ্রবেশ হয়। আর তারপরই দাদার চাকরিটা চলে যায়।
আমি সদ্য চুঁচুড়ায় বদলি হয়েছি। একদিন দুপুরে অফিসে মায়ের ফোন। অসময়ে বাড়ির ফোন এলে বুক কেঁপে ওঠে এমনিই, তার ওপর আবার মায়ের ক্রন্দনোন্মুখ কণ্ঠস্বর,‘এই মানা শোন না, অমুকের বরের চাকরিটা চলে গেছে। তুই ওকে একটা চাকরি দেখে দে। ’ করজোড়ে নিজের জননীকে বললাম, আর কেউ না জানুক,তুমি অন্তত জানো আমি অত বড় কেলেমবক্স নই। কাউকে চাকরি পাইয়ে দেওয়া আমার সাধ্যাতীত। মা তাও দমে না। ফোন করতে থাকে একে ওকে তাকে। বারবার। শেষ পর্যন্ত আমার মাসতুতো দাদা একটা চাকরি খুঁজেও দেয়, অ্যাকাউন্টিং এর কাজ। অফিস নিউটাউন। বেতন আট/নয় হাজার।
দাদা জাস্ট গেলই না। কারণ হাওড়া থেকে নিউটাউন নাকি অনেক দূর। মায়ের মুখ পুড়ল। ভেবেছিল আর ওদের সমস্যা নিয়ে ভাববে না, কিন্তু কমলি যে ছাড়ে না। নিত্য কেঁদে কেঁদে ফোন করে বউদি, “কাকিমা সংসার চলবে কি করে?” শাড়ির ভাঁজে, আলমারির কোণে লুকিয়ে রাখা মায়ের সীমিত পুঁজি ভেঙে বৌদির হাতে তুলে দেয় মা। মায়ের রেস্ত শেষ হলে, এগিয়ে আসে বাবা। আমিও। ফোন করে সাহস দিই, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে নাকি। সবটা দাদার ওপর ছেড় না। তুমিও কিছু কর। বাটিকের কাজ শুরু কর। এত ভালো রাঁধো, হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করতে পারো। ছেলেকে একাই এতদিন পড়িয়ে এসেছ, সেই বিদ্যেটা কাজে লাগাও। টিউশ্যনি করো। মূলধনের চিন্তা আমার।
সবই কাকস্য পরিবেদনা। দিনের শেষে সেই,“ কিছু টাকা ধার দাও।ছেলেটাকে পাঁচদিন শুধু আলু সিদ্ধ ভাত ছাড়া কিছু খাওয়াতে পারিনি। দাদা চাকরি পেলে শুধে দেব।“ধার দেওয়া টাকার অঙ্ক পাঁচ সংখ্যা ছাড়িয়েছে বহুদিন। ওগুলো ধার হিসেবে দেখিও নি আমরা। ফেরৎ পাবার আশা/ আকাঙ্খাও রাখিনি। কিন্তু এভাবে কত দেওয়া যায়। আর কতদিন বুকফাটা হাহাকার শোনা যায়। সদুপদেশ দিলেও শোনে না। ব্যবসা শুরু করবে বললে তাও একটা কথা ছিল। ধারের পয়সায় কতদিন সংসার চলে- ইদানিং বউদি নিজেও আসত না। দাদা বা বাবুকে পাঠিয়ে টাকাটা নিয়ে যেত।
আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ছিল। টাকা দিতে পারব না বললে এমন কাঁদত যে ভয়ে বার তিনেক ওর ফোন ধরিনি আমি। তারপর একদিন হঠাৎ ফোন আসা বন্ধ হয়ে গেল। মা বলল,‘ছেলেটা মনে হয় চাকরি পেয়ে গেছে। ঠাকুর। ’ কোন যোগাযোগই আর করল না দাদা বৌদি। বাবা বলল,‘পাছে টাকা ফেরৎ চাই তাই এড়িয়ে যাচ্ছে। যাক। ওরা ভালো থাকলেই হল।’ ভালো যে নেই অচীরেই জানতে পারলাম। আমার এক সহকর্মী একদিন ফোন করে বলল,‘ দিদি তোমার ঐ বউদি না আমায় এক্ষুণি ফোন করেছিলেন। বললেন খুব বিপদে পড়েছেন। ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। চল্লিশ হাজার টাকা ধার চাইছেন। বললেন তোমায় না জানাতে। তাও আমি ভাবলাম-’।
বউদির সাথে দু একবারই দেখা হয়েছিল মেয়েটার। আমিই পাঠিয়েছিলাম বৌদির কিছু কাজের জন্য। তার কাছেও টাকা চাইছে? ছি ছি। লজ্জায় মাথা কাটা গেল যেন। রূঢ় ভাবেই বললাম,‘পাড়াতুতো বৌদি। ওর বরের চাকরি চলে যাবার পর আমাদের কাছেও ধার করেছে। এবার তুমি যা বুঝবে।’ কি বুঝেছিল মেয়েটা, কি হয়েছিল তারপর জানি না। এরপর একদিন বৌদির বাবা মা এসে হাজির আমাদের বাড়ি। ওদের থেকেও নিয়মিত টাকা চাইত বৌদি। যতদিন পেরেছেন ভদ্রলোক দিয়েছেন। আর দিতে পারবেন না জানাতেই অশান্তি। দাদা নাকি বুড়ো শ্বশুরকে মারতে গেছে। বুড়ি শাশুড়ি মাকে বাজারের মেয়েছেলে বলে খিস্তি করেছে। সবটুকুই হয়েছে বৌদির সামনে। তিনি নাকি নূন্যতম প্রতিবাদ ও করেননি। অসহায় বুড়োবুড়ি অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছে আরেক বুড়োবুড়ির কাছে। ওনারা আসার পর যেটা হল, নির্মম ভাবে মন থেকে কেটে ফেলে দিলাম সব অনুভূতি দাদা বৌদির প্রতি।
গত বছর আবার ফোন করেছিল মেয়েটি,‘ দিদি শুনেছ? তোমার ঐ বৌদির হাজব্যান্ড মারা গেছেন। সাহায্য চাইছিলেন।’ শুনে কেঁপে উঠলাম। আকাশ থেকে পড়লাম। চটজলদি বৌদির পরিচিত আরেক বন্ধুকে ফোন করলাম। কথাটা কি সত্যি? এটা কি আদৌ সত্যি হতে পারে? দাদা কতই বা বড় আমার থেকে? বছর দশেক মেরেকেটে। শুনলাম সত্যিই উনি চলে গেছেন। বেশ কিছুদিন আগে। হার্ট ফেল। কিছু করা যায়নি।
বন্ধুটির কাছে, তার শাশুড়ি মায়ের কাছেও টাকা ধার করেছিল বৌদি। বন্ধুটি শোনাল সে কথা। খবরটা শুনেই মনে হয়েছিল ছুটে যাই বৌদির কাছে। জড়িয়ে ধরি। সাহস হয়নি। কি বলব গিয়ে? আর সেই বা কি বলবে? খবরটা শুনে মা খুব কেঁদেছিল। দীর্ঘক্ষণ হাতে মাথা রেখে বসেছিল বাবা। আমাদের কাছে যতগুলো নম্বর ছিল সবই ঘোরানো হল। কোনটাই লাগল না। তারপর যা হয়, কলকাতা থেকে তমলুক। তমলুক থেকে কাঁথি। মায়ের হসপিটালাইজেশন, বাবার অসুস্থতা, শাশড়ি মায়ের আছাড় খেযে ফিমার ভাঙা, ২/৩ এ নেমে যাওয়া হিমোগ্লোবিন, ডাক্তার কতৃক শ্বশুরমশাই এর দেহে পুনরায় কর্কট রোগের আশঙ্কা সব মিলিয়ে এমন ঘেঁটে গেলাম, ভুলেই গেলাম বিপদের দিনের বন্ধুকে।
আজ সন্ধ্যেয় জনৈকা সহপাঠিনীর ফোনটা যখন হঠাৎ এল, মনে পড়ে গেল এর ছেলে তো বৌদির ছেলের সাথে পড়ত। বৌদির খুব ঘনিষ্ঠ ছিল মেয়েটি। কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, বৌদি কেমন আছে রে? ওদিক থেকে জবাব এল,‘ও তো মারা গেছে।’ ধপ করে বসে পড়লাম সোফায়। কি বলছিস? ওর বর মারা গেছে। বন্ধুটি বলল,“ হ্যাঁ। গত বছর ওর বর মারা গেছে যে দিন, এ বছর ঠিক সেদিন নিউমোনিয়া নিয়ে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চারদিন বাদে ও মারা যায়। একমাস হল-। জানিস অনি, আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। শেষের দিকে টাকা পয়সা নিয়ে এমন করল। সবার কাছে এত ধার করে ফেলল যে আমরা ওকে এড়িয়ে যেতাম। এভাবে যে চলে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি । এত অপরাধ বোধ হয় কি বলব। কেন ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করলাম -’।
রাত সোয়া চারটে। খবরটা শোনা ইস্তক এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না। চোখের সামনে কেবল বৌদির মুখটা ভেসে উঠছে। কানে ভাসছে,‘ গরীব বলে একটু আনন্দ ফূর্তিও করব না? আর কটাদিনই বা বাঁচব অনিন্দিতা। “ যেখানেই থাকো বৌদি, খুব ভালো থেকো। অনেক অনেক আনন্দ, ফুর্তি করো। আর যদি পারো তো এই অপদার্থ ননদটাকে ক্ষমা করে দিও।
No comments:
Post a Comment