Monday, 19 June 2023

অনির ডাইরি ১৭ই জুন,২০২৩

 


#অনিরডাইরি 

যতদিন যাচ্ছে ক্রমেই ইউরোপীয় চলচ্চিত্র এবং ওয়েব সিরিজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। ইংরাজির পাশাপাশি মন কেড়ে নিচ্ছে স্প্যানিশ, ফরাসি, ইটালিয়ান শো গুলিও। 


কিছুদিন আগে এমনই একটা রোম্যান্টিক ইতালিয়ান সিরিজ দেখে এমনই চন্দ্রাহত হয়েছিলাম, যে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঐটাই দেখতাম। কিছু দৃশ্য, কিছু সংলাপ, কিছু অভিব্যক্তি। কি সাদামাটা গল্প, অথচ অভিনয়, পরিচালনা আর এডিটিং এর গুণে অনন্য। একেবারে যেন কাঁঠালের আঠা। একবার ইংরেজি ডাবিং এ শুনতাম তো, একবার হিন্দি। ঠিক কি বলতে চাইল অ্যালিচে(নায়িকা) দাভিদেকে(নায়ক)। তারপর শুনতাম ইটালিয়ান ভাষায়,  কেমন করে জবাব দিল দাভিদে, অ্যালিচেকে। 

না ঝাঁ চকচকে টেকনোলজির চমক, না মূল্যবান গাড়িবাড়ি, নাই ডিজাইনার পোশাক পরিচ্ছদ। একেবারে সাদামাটা, সোজাসাপটা জৌলুস বিহীন ঘরোয়া প্রেমের গল্পও যে কি আকর্ষণীয় হতে পারে, শিরশিরে রোমাঞ্চকর হতে পারে, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। নেশা ধরছিল বুঝলেন মশাই, নেশা। তুত্তুরীরা যাকে বলে ক্রাশ খাওয়া। 


খেলাম ক্রাশ। ফলো করলাম নায়ককে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়, যাকে বলে ঘড়ি ধরে  রীতিমত স্টক করা। প্রেমের মতোই ক্রাশও চাপা থাকে না বুঝলেন তো। এ পুলক চাপা যায় না। অন্তত Aquarian রা তো পারেই না। "বদনাম হবে জেনেও ভালবেসেছিলাম" থুড়ি ক্রাশ খেয়েছিলাম। টিনএজারদের মত, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নায়কের ছবি ডাউনলোড করে দিতে থাকলাম স্টোরিতে। পাঠাতে লাগলাম শৌভিক, সুকন্যা, সঙ্গীতা, বিদিশাদির মত প্রিয় বান্ধবীদের। দেখ কেমন লাগে।এমন শিরশিরে গোলাপি খোঁয়ারি যে শেষ কবে হয়েছিল। সামান্য ছদ্ম অপরাধবোধ যদিও কমলা ব্লাশ অনের মতন বুলিয়ে নিচ্ছিলাম মুখে। দেড় দশক পুরাণ বাঙালি বধূ, দ্বাদশী কন্যার জননীর বোধ হয় আর ক্রাশ খাওয়া চলে না। তারপর দেবশ্রীদি একদিন অভয় দিল,স্বভাব সিদ্ধ ভালোবাসা আর ধমকের ককটেলে বলল, " দূর ক্রাশ খাবার আবার বয়স আছে নাকি? ক্রাশই তো খাচ্ছ, পেট ভরে খাও।" 


নিষিদ্ধ ফলের মতোই যতদিন নিষিদ্ধ ছিল ক্রাশটা, ততদিনই বোধহয় ছিল তার উত্তেজনা। কিছুদিন বাদে কেমন যেন ফিকে হতে হতে কেটেই গেল সব খোঁয়ারি। ইনস্টা বা ফেসবুকে যে লোকটার হাজার অনুরক্তের একজন আমি ছিলাম,  সে কেবলই কেৎ মেরে ইটালিয়ান ভাষায় ঈশ্বর জানেন কি বলে। এই লোকটা আর যাই হোক আমার ক্রাশ নয়। আমার ক্রাশ তো দাভিদে, ওই চরিত্রটা। আর তাকে অ্যালিচের পাশেই ভালো মানায়।


সিরিজটার মোহও কেমন যেন ধীরে ধীরে কেটে গেল। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকফোঁকর গলে যেটুকু সময় বার করতে পারলাম মন দিলাম বই পড়ায়। নিঃসঙ্গ নেটফ্লিক্স বসে বসে কাঁদে, মাসে মাসে ঢাক ঢোল পিটিয়ে টাকা কেটে নেয় আমার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। ঐ অবধিই। কিগো হিরাশিনোর ডিটেকটিভ গ্যালিলিও সিরিজের নতুন একটা বই ধরেছি।  নেটফ্লিক্সকে হেব্বি না উঁচু করে কইলাম, আর জ্বালিওনি বাপু। দিনে একটা চ্যাপ্টারের বেশি পড়ারই টাইম পাচ্ছিনি, আর তুমি কইছু বিঞ্জ ওয়াচ করতে। কোন দেশের ক্যাবল বাপু তুমি।


গতকাল রাত্রে তা সত্ত্বেও কিভাবে যেন পদস্খলন ঘটেই গেল। মতি নন্দী বোধহয় একেই হৃদিস্খলন বলে গেছেন। কেলোটা করলাম প্রোমো দেখতে গিয়ে, সংক্ষিপ্ত বিবরণে লেখা ছিল, "space-time rift with unimaginable consequences"। টাইম ট্রাভেল আমার আদি অকৃত্রিম, চিরন্তন এবং নিখাদ ভালোবাসা। তার সাথে যদি মিশে থাকে রহস্য রোমাঞ্চ আর ত্রিকোণ প্রেম তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

দক্ষিণ ফ্রান্সের বাঁয়াস্ত (Brest) নগরী। ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসের কোন এক প্রাতে, নিদ্রিত কয়েক মাসের শিশু কন্যা আর বরকে বাড়িতে ছেড়ে, দৌড়তে বেরোয় মেঁল্যু। আর ফিরে আসে না। ঘরের পাশের সৈকতে আবিষ্কৃত হয় তার নিথর দেহ। প্রাতঃকালীন শরীরচর্চা করতে গিয়ে, পা ফস্কে পাশের টিলা (cliff) থেকে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছে মেঁল্যু এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে কেসটা বন্ধ করে দেয় বাঁয়াস্ত পুলিশ। স্ত্রীর মৃত্যুতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ল্যুঁডো। যে নিজেও পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। 


তারপর কেটে যায় অনেক গুলো বছর। ঠিক ২৭ বছর পর আবার এক জুলাই মাসে,  ঠিক ওই জায়গাতেই আবিষ্কৃত হয় আরেক মহিলার দেহ। ময়না তদন্তে দেখা যায় মৃত মহিলার ফুসফুস ভর্তি জল। জলে ডুবে মৃত্যু বলে আবার হাত গুটিয়ে নিতে চায় বাঁয়াস্তের পুলিশ। ভুলতে পারে না, ছাড়তে পারে না কেবল ল্যুঁডো। আজ তার বয়স ৫২। আজ সে প্রৌঢ়। মুখে বলিরেখা, চোখে চালশে চশমা, চোখের তলায় পুরু কালি। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচাপাকা চুল। সেদিনের দুর্যোগ আজ অতীত। আজ সে এক সুখী গৃহকোণের অধীশ্বর। মেঁল্যুর মৃত্যুর ১২ বছর পর, নতুন করে আবদ্ধ হয়েছে বিবাহ বন্ধনে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা এক আফগানি রমণী পারভানা ভরিয়ে তুলেছে তার জীবন। পারভানা নিজে নার্স, তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে মেঁল্যু আর ল্যুঁডোর কন্যা জুলিয়েট ওরফে জুঁজু আজ ডাক্তার। ঘর আলো করে এসেছে নতুন অতিথি। ছেলে হয়েছে ল্যুঁডো আর পারভানার, সেও প্রায় বছর দশেকের ছোকরা। 

এরই মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়ে যায় ল্যুঁডোকে। ফিরিয়ে দেয় যাবতীয় অতীত দুঃস্বপ্ন। অকুস্থলের ছবি, ভিডিও, ড্রোন রেকর্ডিং ইত্যাদি মিলিয়ে এক থ্রিডি ক্রাইম সিন তৈরি করা হয় ইদানিং বাঁয়াস্ত শহরে। যাতে বারবার ঘটনাগুলি দেখতে পারে, শুনতে পারে, যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় বারবার পর্যবেক্ষণ করতে পারে পুলিশ।  কেস স্পেসিফিক বিশেষ চশমা পরে, VR অর্থাৎ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি রুমে ঢুকে কেস স্টাডি করে পুলিশ। নতুন কেসে তেমনি করতে গিয়ে ল্যুঁডো দেখতে পায়  মেঁল্যুকে। 


১৯৯৮ এর মেঁল্যু, কানে সেই পুরাণ হেডফোন। আপন মনে দৌড়াচ্ছে নিরালা সৈকতে, ঠিক যেমন দৌড়ত সেই সকালগুলোয়। হতভম্ব হয়ে যায় ল্যুঁডো। এটা কি করে সম্ভব? মেঁল্যুর কেস ওভারল্যাপ হয় কি করে এই কেসের সাথে? তার থেকেও বড় কথা মেলুর মৃত্যু রহস্য তো সেই বিগত সহস্রাব্দের কেসগুলির মধ্যে পড়ে, যা এখনও ডিজিটাইজ করাই হয়নি। অবহেলায় পড়ে আছে কোন ধুলি মলিন ক্যাবিনেটে। 


ঘটনাটা কাউকে বলতেও পারে না ল্যুঁডো। সমস্ত ব্যাপারটা চোখের বা মনের ভুল কিনা দেখতে,  অফিস ফাঁকা হতেই পুনরায় বিশেষ চশমা পরে ভিআর রুমে ঢোকে লুডো, আবার দেখতে পায় মেঁল্যুকে। এখন আর দৌড়াচ্ছে না মেঁল্যু, বরং চুপ করে বসে আছে সাগরের অসীম জলরাশির দিকে তাকিয়ে। ল্যুঁডো ডাকতেই চমকে ওঠে মেঁল্যু।  চিনতে পারেনা যদিও। ল্যুঁডো হতবাক হয়ে যায়, কোনভাবে দুটো ফাইল ওভারল্যাপ হলেও ওকে দেখতে বা শুনতে পাবার তো কথা নয় মেঁল্যুর।তাহলে কি অন্য কিছু হচ্ছে, কোনভাবে সময়ের আবর্তে কাছাকাছি চলে এসেছে ১৯৯৮ আর ২০২৫ এর দুটো টাইম লাইন, তৈরি হয়েছে কোন "Vortex"। 

প্রথমদিকে ল্যুঁডোর কথায় অবিশ্বাস করে, ভয় পায় মেঁল্যু। ধীরে ধীরে সরে যায় অবিশ্বাসের আস্তরণ। মেঁল্যু জানতে পারে তার আয়ু আর মাত্র কয়েকটা দিন। মেঁল্যুকে নির্দিষ্ট দিনের আগে, কোথাও চলে যেতে বলে ল্যুঁডো। যাতে এড়ানো যায় দুর্ঘটনা। ১৯৯৮ এর মেঁল্যু সেই মতন টিকিটও কেটে ফেলে বাইরে যাওয়ার। কিন্তু তাতে ২০২৫ সালের ফাইলে মেলুর মৃত্যু এগিয়ে আসে দুই দিন। টাইমলাইন নিয়ে খেলা করার পরিনাম কি ভয়ংকর হতে পারে তা প্রত্যক্ষ করে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ল্যুঁডো।


 মেঁল্যুকে বাঁচানোর পাশাপাশি নিজের বর্তমান স্ত্রী পুত্রকে হারানোর ভয়ে শঙ্কিত হয়ে ওঠে ল্যুঁডো।পাছে মেঁল্যু কোনো অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাই ল্যুঁডো তাকে খুলে বলে নিজের নতুন জীবন, নতুন পরিবারের কথা। আশ্বস্ত করে মেঁল্যুকে বাঁচাতে জান দিয়ে দেবে ল্যুঁডো, শর্ত একটাই- প্রাণ বেঁচে গেলেও ল্যুঁডোকে ছেড়ে চলে যেতে হবে মেঁল্যুকে। আর সেটাও যেদিন তার মৃত্যু হয়েছিল, ঠিক সেই দিনেই। যাতে অটুট থাকে ল্যুঁডো আর পারভানার সংসার।


একজন স্ত্রী এবং মা হিসেবে কখন যেন একাত্ম হয়ে পড়ি মেঁল্যুর সাথে। তার দুঃখে, তার অসহায়তায়, তার চাপা কান্নায় উপচে যায় আমারও নয়নসরসী। সবার সব অটুট থাকবে, সব হারিয়ে যাবে কেবল মেঁল্যুর? বেঁচে থাকলেও কি আর মরে গেলেও কি? রাগ করতে পারি না  ল্যুঁডো বা পার্ভানার ওপরও। নিরপেক্ষ ভাবে দেখলে দোষ যে ওদেরও নেই।  গল্প এগোয়, গল্পের নিজস্ব গতিতে। শেষ ও হয়ে যায় এক সময়,রেখে যায় কেবল একটা মিষ্টি মনখারাপের অনুভূতি আর ভিজে বালিশটা। ভাগ্যে এমন ক্যাথারসিস রোজ রোজ হয় না।


পুনশ্চঃ- প্রথম সিরিয়ালটির নাম "An Astrological Guide for Broken Hearts" আর দ্বিতীয়টি "VORTEX"। নীচে দাভিদের ছবিটা দিলাম। যদিও ভদ্রলোক আর আমার ক্রাশ নন। আর ওনার আসল নাম হল মিশেল রোজেলিও।

No comments:

Post a Comment