Monday 19 June 2023

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


আজ ২৫শে বৈশাখ সরকারি ক্যালেন্ডার এ লাল থাকার সৌজন্যে আমার আজ ছুটি। শৌভিক অবশ্য বেরোবে। দিনভর নানা অনুষ্ঠানে হাজিরা দিয়ে বেড়াবে। প্রথমেই যাবে কাঁথি উপসংশোধনাগারে। পাতি বাংলায় জেল। পদাধিকার বলে এই জেলের সুপার কাঁথির মহকুমা শাসক। কেবলমাত্র বিচারাধীন বন্দিরাই থাকেন এই জেলে। বিচার শেষে হয় মুক্তি, নয়তো যতদূর জানি, মেদিনীপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয় আবাসিক বন্দীদের।এই আবাসিক বন্দীদের নিয়েই রবীন্দ্রজয়ন্তীর সামান্য আয়োজন। 


আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে খুব একটা যে উৎসুক ছিল শৌভিক তা নয়, বলতে পারেন গায়ে পড়েই সঙ্গী হয়েছি। জেল পরিদর্শনের লোভ আমার বরাবরই। আমার পূর্বতন দুই প্রজন্মের একাধিক পুরুষ তাঁদের তারুণ্যের বেশ কিছুটা করে অংশ জেলে কাটিয়েছেন, রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে। বাবা আর ছোট কাকুর সময় ছিল নকশাল আন্দোলন। ছোট দাদুর ক্ষেত্রে ছিল," ইয়ে আজাদি ঝুঠা হ্যায়"। আর পিতামহ ছিলেন অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য, বাঘা যতীনের অনুরাগী। স্থান হয়েছিল খাস মান্দালয় জেলে। ছেলেকে দেশে ফেরাতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হতে হয়েছিল প্রপিতামহকে। তাই আমাকে নিরস্ত করা অত সহজ নয়।


 মহকুমা শাসকের নিবাসের ঢিল ছোড়া দূরত্বেই জেলটা। বর্তমান জেলার সাহেবের তীব্র অনুরাগী আমার বর। কথায় কথায় ওনার প্রশংসা করে, উনি নাকি অত্যন্ত উদ্যোগী পুরুষ। জেলারের কাজটাকে নিছক গতানুগতিক ভাবে নয় বরং প্রগাঢ় ভালোবেসে করেন। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই এমনকি কখনও কখনও নিজের পকেট থেকে পয়সা দিয়েও আবাসিকদের দিয়ে নানা রকম হাতের কাজ করান। বর্তমানে মুক্ত এমনই এক আবাসিকের স্বহস্তে তৈরি মূর্তি শোভা পায় শৌভিকের অফিস চেম্বারে, উপহার দিয়েছিলেন জেলার সাহেব। 


নামকাওয়াস্তে গাড়িতে ওঠা আর নামা। রাস্তা পেরিয়েই দাঁড়িয়ে গেল গাড়িটা। শৌভিকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী যেহেতু অস্ত্র বহন করেন, তাই জেলে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ। যুগলে ঢুকলাম জেলের মস্ত গেটটা দিয়ে। ভিতরে এক সহাস্য ভদ্রলোক প্রতীক্ষা করছিলেন আমাদেরই জন্য। শৌভিক আলাপ করিয়ে দিল, ইনিই জেলার সাহেব। ভদ্রলোক বয়সে আমাদেরই সমান হবেন। মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি চেহারা। চোখে চশমা, পরনে চেক শার্ট আর প্যান্ট। জেলারের উর্দি না থাকাতেই আমি চিনতে পারিনি ওনাকে।


নমস্কার -প্রতিনমস্কারের পালা মিটতে উনি হাসিমুখে জানালেন," ম্যাডামকে এনেছেন, এতে আমরা ভীষণ খুশি হয়েছি।" অতঃপর ওনার ইশারায় খুলে গেল মস্ত তালা লাগানো, "কারার ঐ লৌহ কপাট।" ভিতরটা ঝকঝক করছে, কেয়ারি করা ফুলের বাগান। সর্বত্র যত্ন আর আন্তরিকতার ছাপ। শৌভিক ফিসফিস করে বলল, " এই সমস্ত গাছের বীজ এবং চারা জেলার সাহেব ওনার পকেট থেকে টাকা দিয়ে কিনিয়েছেন। বাগান করলে আবাসিকের সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটবে শুধু সেই জন্য। বলেছিলাম না এই লোকটা অত্যন্ত উদ্যোগী এবং ভালো।"


বাঁদিকে বেঁকে একতলা মস্ত হল ঘর। সেখানেই অনুষ্ঠানটি চলছে। লম্বাটে হল ঘর, মাটিতে কালো কম্বল পাতা। বাইরে অনেকগুলি জুতা ছাড়া ছিল, আমরা জুতো খুলতে গিয়েও জেলার সাহেবের আপত্তিতে খুলতে পারলাম না। দেওয়ালের চুনকাম সময়ের অভিঘাতে বিবর্ণ। ইতি ইতি দেওয়ালে এবং ছাদে ফাটল ধরেছে। দৈর্ঘ্য বরাবর দুই দিকেই নির্দিষ্ট দূরত্ব ছাড়া ছাড়া মানুষ সমান বেশ অনেকগুলি লম্বা জানালা। ফলে ঘরটা তেমন গরম নয়। রংবেরঙের বেলুন টাঙ্গানো হয়েছে জানলা জুড়ে যার কয়েকটা মাঝেমধ্যেই সশব্দে ফাটছে। 


প্রস্থ বরাবর একদিকের দেয়াল হলুদ সাদা সস্তার কাপড়ে মোড়া। তার সামনে, একদম বাঁদিকে একটি কাঠের চেয়ারের ওপরে বসে আছেন রবি স্বয়ং। তার ডানদিকে দুটি পালিশ চটা কাঠের টেবিল জুড়ে একটি উত্তরীয় পেতে তৈরি হয়েছে মঞ্চ। টেবিলের উপর রাখা রেকাবিতে গুটি কয়েক পুষ্পহার সাজানো আছে। টেবিলের পিছনে গোটা চার পাঁচ চেয়ার রাখা, তারই দুটি দখল করে বসলাম দোঁহে। আরো মান্য-গণ্য অতিথিরা আসতে পারেন ভেবে, ভয়ে এক কোনায় বসে ছিলাম শৌভিক ইশারায় পাশের চেয়ারটি দখল করতে বলল। সামনাসামনি বসে আছেন আবাসিক বৃন্দ। সংখ্যায় খুব কম নয়। মাথা গুনে দেখলাম ১১ জন মহিলা আর শতাধিক পুরুষ। দশটা থেকে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান, এখন সোয়া এগারোটা। উপস্থিত শ্রোতা এবং দর্শকদের মুখে চোখে ক্লান্তি বা বিরক্তির কোন চিহ্ন নেই।


প্রথমে মাল্যদান পর্ব। মহকুমা শাসকের জায়া হিসেবে গৌরবার্থে বহুবচন, আমাকেও মালা পরানোর অনুরোধ করা হল। দাড়ি বুড়োর গলায় মালা পরিয়ে, প্রণাম সেরে বসতেই শুরু হল অনুষ্ঠান। আমাদের জন্যই থমকে ছিল কিছু ক্ষণ।  মঞ্চের ডান দিকে একটি বিবর্ণ টেবিল এর উপর হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন এক প্রৌঢ়। তার পাশে ঢোলক বাজাচ্ছেন এক অতি বৃদ্ধ বন্দী, তার পাশে দাঁড়িয়ে করতাল বাজাচ্ছে একটি অল্প বয়সী ছেলে। ঘোষক ঘোষণা করতেই করতাল বাজানো ছেলেটি গান ধরল, " মন মোর মেঘেরও সঙ্গী"। সঙ্গে "নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাইরে" র যুগলবন্দী। কতই বা বয়স হবে ছেলেটির, খুব জোর ২৫-২৬।  শ্যামলা দোহারা চেহারা, ওষ্ঠের ওপর সরু গোঁফের রেখা, তেল দিয়ে, সাইডে সিঁথি কেটে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। পরণে সস্তার ফুল প্যান্ট এবং হলুদ মেরুন টি শার্ট। দেখে দেখেই পড়ল এবং গাইল ছেলেটা, উচ্চারণে সামান্য জেলার টান থাকলেও এত ভালো গাইল যে আমরা দুজনে অভিভূত হয়ে পড়লাম। গান শেষে শৌভিক শুধাল, " তুমি আগে থেকে গানটা জানতে? কবিতাটা আগে পড়েছ?" ছেলেটি ঢিপ করে প্রণাম করে বলল, "কবিতাটা ছোট বেলায় ইস্কুলে পড়েছিলাম আজ্ঞে। গানটাও শুনেছিলাম মনে হয়। তবে গাইনি কখনও। এই অনুষ্ঠানের জন্য স্যারই শেখালেন।" 


দুজোড়া সার্চ লাইটের মত, শৌভিক আর আমার চোখ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল জেলার সাহেবের দিকে। শৌভিক মুগ্ধ হয়ে জানতে চাইল, " আপনি শিখিয়েছেন? আপনি গান বাজনা করেন?"  উনি লাজুক হেসে বললেন,"ঐ আর কি? কয়েকদিন রিহার্সাল দিইয়েছিলাম ওদের নিয়ে।"  শৌভিক আবার প্রশ্ন করল, " এখানে যারা আজ পারফর্ম করছেন, তারা কি সবাই আপনার জেলের আবাসিক বন্দী?" উনি ঘাড় নেড়ে বললেন, "আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। বাইরের বলতে কেবল আমাদের এক সহকর্মীর ভাইঝি। বাচ্ছা মেয়ে। সেজেগুজে এসেছে, নাচবে বলে।  বাকি সবাই এই জেলের বাসিন্দা।"


এবার গান ধরলেন বুড়ো ঢোলক বাজিয়ে। কাঁপা কাঁপা হালকা বিষাদ মাখানো সুরে, "এ মণিহার আমায়, নাহি সাজে-"। নুব্জ চেহারা, মাথা ভর্তি পাকা চুল, গালে বেশ কয়েকদিনের না কাটা খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি,পরণে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। চোখে কালো ফ্রেমের  পুরু কাঁচের চশমা। চশমার পিছনে একজোড়া ঘোলাটে চোখ। ঈষৎ ধরা গলায়, সামান্য ঝুঁকে গেয়ে চলেছেন বৃদ্ধ, 

" ফুলমালার ডোরে বরিয়া লও মোরে--

তোমার কাছে দেখাই নে মুখ মণিমালার লাজে",   বৃদ্ধের গান শুনতে শুনতে কেন যে করকর করে ওঠে দুই চোখ। কে জানে কি অপরাধে এই বয়সে বিচারাধীন বন্দীর তকমা জুটেছে লোকটার।  


 ছোট মেয়েটি এসে নেচে গেল বার দুয়েক। অনুষ্ঠান শেষে সেলফি তোলার আব্দার জানিয়ে গেল। তারপর গান ধরল আরেকটি আবাসিক ছেলে। বয়স কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে। পরণে সস্তার জিন্স আর গোলাপি রঙের ক্যাজুয়াল শার্ট। হাতে গলায় নীলচে ট্যাটু। মাথায় পাঁশুটে রঙের খাড়া খাড়া চুল। হাঁটেও অল্প বয়সী মিঠুন চক্রবর্তীর মত করে। স্টিলের বালা পরা হাতে মাইক্রোফোন ধরে ছেলেটা গান ধরলো, " যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,তবে একলা চল রে।" সুস্পষ্ট উচ্চারণ, অটুট সুর, তাল এবং লয়। আবার বিমোহিত হলাম দুজনে।


অনুষ্ঠান চলতে লাগল, জেলার সাহেব ফাঁকে ফাঁকে জানালেন, " এখানে যোগব্যায়ামও হয় জানেন তো ম্যাডাম। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছটা থেকে। ওদের দিয়ে বাগান করাই, এই দেখুন ওদের জন্য লাইব্রেরী করেছি।" আমার পিছনে রাখা কয়েকটি আলমারিকে দেখিয়ে বললেন, "ওদের নিয়মিত বই পড়তে দিই। তবে অনেকেই আছেন, যাঁরা লিখতে পড়তে পারেন না, তাদের আমরাই পড়ে শোনাই। আপনাদের একবার ডাকব, আমাদের গল্প বলার আসরে।"  করজোড়ে বললাম, প্লিজ ডাকবেন। অবশ্যই মনে করে ডাকবেন। ব্যক্তিগতভাবে আপনার এই কর্মযজ্ঞের সামান্যতম অংশ হতে পারলেও আমি অন্তত নিজেকে ধন্য মনে করব। তুত্তুরীকেও সঙ্গে করে আনব। 


বেলা গড়ায়। শৌভিকের নিজের অফিসেও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন হবে। মহকুমা তথ্য এবং সংস্কৃতি আধিকারিক বারবার ফোন করছেন।  ওখানে আজ আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হবে স্থানীয় একটি সরকারি হোমের দশ থেকে বারো বছর বয়সী মেয়েদের নিয়ে। জীবনে প্রথমবার জনসমক্ষে রবি ঠাকুরকে আবৃত্তি করে শোনাবে মেয়ে গুলো। দর্শক হিসেবে আমাকেও নিয়ে যাবার বায়না করে রেখেছি আগে থেকেই। তবে সে তো অন্য গল্প। মোদ্দা কথা, অনুষ্ঠান মনোজ্ঞ হলেও আমাদের এবার উঠতে হবে।


জেলার সাহেব বাইরে অব্দি আমাদের ছাড়তে এলেন। ভিতরে তখন গান ধরেছে জনৈক আবাসিক, " গোধূলি গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা-"। মানুষ সমান লম্বা জানালাগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে বেরোতে বেরোতে এক ঝলক ভিতর দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন, চোখ মুচছে কোন কোন বন্দী। লুঙ্গি পরা একটা লোক তো দুই আঙ্গুলে চোখ টিপে মাথা নীচু করে বসেই রইল। কি জানি, কার জন্য ছল ছলিয়ে উঠছে এই বিচারাধীন বন্দীদের চোখ। সে যেখানেই থাকুক, যেন খুব ভালো থাকে।


পুনশ্চঃ ছবির পুতুল গুলি কাঁথি উপ সংশোধনাগারের এক প্রাক্তণ আবাসিকের হাতে তৈরি। বর্তমানে শোভা পায় মহকুমা শাসকের টেবিলে


No comments:

Post a Comment