#অনিরডাইরি #কাঁথি_থেকে_তমলুক
একটা লাল বাস আসে, বাতানুকূল বাস। বাসের গায়েও বড় বড় করে লেখা, "রেড বাস"। ভিতরে লোকনাথ বাবার ছবি টাঙানো। এমন তিতো, বিরক্ত মুখের লোকনাথ বাবা ইতিপূর্বে দেখিনি। তাঁর মুখের সামনের রডে, একটা কালো প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝোলানো থাকে, ব্যাগ ভর্তি একই রকম কালো প্লাস্টিক। পাশেই দরজার উপরে বড় বড় করে লেখা, "বমি করলে প্লাস্টিক ব্যবহার করুন"। হরদমই কেউ না কেউ যায় আর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মুখের সামনে থেকে প্লাস্টিক নিয়ে আসে, বৃদ্ধের বিরক্ত হবার যথেষ্ট এবং যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
তবে, বাসটাতে বসে বড় আরাম। দুজনের সিটে আমার মত চেহারার দুজন আরাম করে ধরে যায়। কাউকে 'ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান' হয়ে সফর করতে হয় না। কন্ডাক্টার ড্রাইভার হেল্পারের ব্যবহারও খুব ভালো। মাত্র পঞ্চাশ টাকায়, এসির হাওয়া খেতে-খেতে, ঢুলতে-ঢুলতে, অফিস পৌঁছে যাই। যদি ঘুমিয়েও পড়ি, হেল্পার বা কন্ডাক্টর ঠিক ডেকে তুলে দেয়। তবে বাসটাকে পাওয়াই দুষ্কর। ব্যাটার কোন সময় জ্ঞান নেই, কোনদিন নটা ১৩য় ন্যাজ তুলে পালায়, তো কোনদিন নটা ২৪ এও তার দেখা মেলে না। কোন কোন দিন আবার থাকেও না অযথাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হয়রান হই আমি।
গতকালই যেমন বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। নূপুর বাবু, মহকুমা শাসকের ড্রাইভার যিনি প্রত্যহ 'দাবাং' স্টাইলে আমাকে বাসে তুলে, একটা সিটের ব্যবস্থা করে দেন, আশ্বাস দিলেন, "কুন ব্যাপার নয় ম্যাডাম, ঐ বাসটাই ধরিয়ে দেব আপনাকে।" অন্য দিন আমরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দীঘা বাইপাস থেকে বাসে উঠি, যাতে সিট পাওয়া যায়। বাসটা ওখান থেকে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড হয়ে রূপশ্রী বাইপাসে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। নুপুর বাবু আজ না পিছিয়ে সোজা গাড়ি ঘোরালেন রূপশ্রী বাইপাসের দিকে।
রূপশ্রীতে দুটো বাস দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে, তারা আমার লাল্টু বাসটা নয়। "হুঁ" বলে গাড়ি ঘুরে গেল সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের দিকে। পথে যদি দেখা মেলে তার। দেখতে দেখতে, পৌঁছেও গেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম লাল্টু বাসটার জন্য। বাস আসে, বাস যায়, আমার বাসটাই কেবল গরহাজির। একটা স্টেট বাস তাকাতে তাকাতে পাশ দিয়ে চলে গেল। নূপুর বাবু উঠতে দিলেন না, " দেখতেছেন ম্যাডাম কি ভিড়! এই গরমে নন এসি বাসে যাবেন কেমন করে? বসেন না আপনার লাল বাসটাই ধরাব আপনাকে।"
শেষমেষ অবশ্য জানা গেল যে আমার বাসটা আজ আদৌ যাবে না। তাড়াহুড়ো করে যে বাসটায় উঠলাম, সেটিও নন এসি। উঠে, বসে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, মনে হল, নন এসি বাসই ভালো। বাসের নিজস্ব লড়ঝড়ে আওয়াজে আর অন্য কিছু শোনা যায় না। এসি বাসের ভিতরে বাইরের শব্দ ঢোকে না বটে, সে অভাব পূরণ করে দেয় সজোরে বাজা গুটিকয়েক মোবাইল। ঝাড়া দু ঘন্টা রিলস্ দেখতে দেখতে যায় লোকে। এতটুকুও ভাবে না, সহযাত্রীদের মাথায় কেমন দমাদম হাতুড়ি পিঠছেন ওনারা।
একেবারে অসহ্য না হওয়া অব্দি দাঁতে দাঁত চিপে সয়ে যাই। মনে মনে খিস্তি মেরে গুষ্টি উদ্ধার করে দিই। তারপর মুখ খুলতেই হয়। "একটু আসতে শুনুন না, প্লিজ-"। বললে কেউ কেউ, "হাঁহাঁ" বলে আওয়াজ কমিয়ে দেয়। কেউ আবার পাত্তাও দেয় না। দীঘা থেকে ছুটি কাটিয়ে কলকাতা ফেরা জনৈকা যাত্রী তো আমাকে গুচ্ছের জ্ঞানই দিয়ে দিলেন গতকাল, "বাবাঃ। এটা বাস দিদি, একটু এ্যাডজাস্ট করতে শিখুন।না পারলে গাড়িতে যান।" এমন ভয় পেয়ে গেলাম যে বাকি পথ মুখে কুলুপ এঁটে ওনার মোবাইলের আওয়াজ শুনতে শুনতে মাথা ধরিয়ে অফিস গেলাম। রাতে খেতে বসে শৌভিক শুনে বলল, " আরে এটা তো তোর ডায়লগ। ও বলল কেন? বলবি তো, আপনি গাড়িতে যান মোবাইল শুনতে শুনতে-"। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে আর কি।
আজ অবশ্য সে যন্ত্রণা নেই, ঐ হুব্বা পাবলিক গুলো নন এসি বাসে চড়ে না। বাইরে থেকে হু হু করে ছুটে আসছে বোশেখের তপ্ত বাতাস। ড্রাইভারের কেবিনের পিছনে, ছোট্ট স্ক্রিনে পরিমিত ভল্যুমে চলছে, বাংলা কোন সিনেমা। বছর চল্লিশের প্রসেনজিৎ ছলছল চোখে কার দিকে যেন তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে শুভাশিস মুখোপাধ্যায় উদয় হয়ে বললেন,"-আমার বাবা। পাগল হয়ে গেছেন। তাই ওইসব কথা বলে বেড়ান।" নায়ক জানতে চান কিভাবে পাগল হলেন উনি, শুভাশিস বাবু গোল গোল জবাব দেন বটে, মাঝখান থেকে দেখতে শুরু করেও আমার বুঝতে অসুবিধে হয় না, " তুঝে সব হ্যায় পতা" প্রসেনজিৎ।
অজ্ঞ শুভাশিস বাবু, কলির মহানায়ক কে চিনতে পারেন না। তাই জানতে চান, তিনি কে এবং গ্রামে কেন এসেছেন। নায়ক নাম বলতে গিয়ে, ঢোঁক গিলে, চোখ ঘুরিয়ে বলেন, " সু -, সুরেশ। আমার নাম সুরেশ।" শুভাশিস বাবু বিশ্বাস করলেও, আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। ওনার নাম আর যাই হোক না কেন, সুরেশ নয় বাপু।
সুরেশ গ্রাম দেখতে এসেছেন এবং হোটেল খুঁজছেন শুনেই ধরণী দ্বিধা হয়। এক গলা জিভ কেটে, শুভাশিস বাবু এক অজ্ঞাত কুলশীল বছর চল্লিশের শহুরে ছোকরাকে( তখনও জানি না যে এই শহুরে ছোকরা সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছেন) বগলদাবা করে নিয়ে যান তাঁর গৃহে। "আমার বাড়ি থাকতে হোটেলে থাকবেন কেন- হেঁঃ হেঁঃ।"
বাড়িতে ওনার উন্মাদ পিতাকে দেখতে পাই না বরং দর্শন পাই এক অতীব রূপসী তন্বী ভগিনীর। নাম বোধহয় রীনা। অভিনেত্রী অপরিচিতা। রীনা এখনও পুতুল খেলে, পুতুলের বিয়ে দেয়। ঠিক যেমন শৈশবের সাথীর সাথে খেলত। সেই সাথী নিরুদ্দেশ বহু বছর, কিন্তু "করণ-অর্জুন" সিনেমার রাখির মত রীনাও বিশ্বাস করে যে, সে ‘আয়েগা। জরুর আয়েগা। ’ ঢ্যাং করে ঘন্টা পড়ে। মঞ্চে ছলছল চোখে সুরেশের প্রবেশ দেখে আমি মাঝ পথেই বুঝে যাই, যে ইনিই তিনি। রীনা অব্যশই বোঝে না। বুঝে গেলেই তো গপ্প শেষ।
দুজনের ন্যাকা প্রেম, খুনসুটি, চা বাগানে নাচানাচি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে ভাবছিলাম একটু ঘুমিয়ে নিই, ঠিক এই সময়, "কোন সাপের বাচ্ছা মহিম হালদারের ছেলের গায়ে হাত তুলেছে রে? যা গিয়ে সাপের বাচ্ছাটার ল্যাজ ধরে টেনে আন।" বলে গর্জে ওঠে কে যেন। চোখ রগড়ে উঠে বসে দেখি যে মঞ্চে মহিম হালদার রূপী দীপঙ্কর দে প্রবিষ্ট হয়ে খেলা জমিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গতে লাল পাড় সাদা শাড়ি, এলো চুল, ধ্যাবড়া সিঁদুরের টিপ পরা কটা চোখের অনামিকা সাহা। কতদিন বাদে দেখলাম ভদ্রমহিলাকে। সাধারণতঃ খলনায়িকার চরিত্রচিত্রন করতেন, এখানে যদিও মহিম হালদারের সাধ্বী স্ত্রী তথা বিবেকের ভূমিকায়। “ওগো এমন করো না গো। গরীব মানুষের চোখের জল সইবে না-“ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার মতই দীপঙ্কর দেও শেষে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করো না তো। যাও ছেলের জন্য এক গ্লাস মাল নিয়ে এসো। বেশ কড়া করে।” বাসের পিছনের সিট থেকে পটাপট কয়েকটা তালি পড়ে গেল।
বাস গড়ায়, নাটক জমে। আরো একজন নায়িকার উদ্রেক হয়। মহিম হালদারের কন্যা তথা সুরেশের কলেজের প্রেমিকা। দুই নায়িকা মিলে সুরেশকে নিয়ে ব্যাপক দড়ি টানাটানি করে। মাঝখান থেকে জানা যায় সুরেশের আসল নাম সূর্য। মহিম হালদার সূর্যর বাপের হত্যাকারী। তাই প্রতিশোধ নিতে গাঁয়ে ফিরেছে সূর্য। একা ফেরেনি সঙ্গে রঞ্জিত মল্লিক সহ আরো চার বৃদ্ধকেও নিয়ে ফিরেছে। যাদের একজন দেবেশ রায়চৌধুরী, আরেকজন রাজেশ শর্মা। মাথায় গোঁফে ট্যালকম পাউডার ঢেলে পাকা চুলদাড়ি বানালেও, যাদের বৃদ্ধ বলে হজম হয় না। তো এই তরুণ বুড়োর দল আর্মির পোশাক আর টুপি পরে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় আর ডিস্যুম ডিস্যুম করে। জানা যায় এরা আসলে সূর্যর স্বর্গীয় পিতৃদেবের দাস (পড়ুন গৃহপরিচারক) ছিলেন। শৈশবে সবাই মিলে স্টিলের দুধের গ্লাস নিয়ে শিশু প্রসেনজিৎকে তাড়া করতেন। দুষ্টু মহিম হালদার নিজে খুন করে সবকটাকে জেলে পাঠান।
এরপর আরো অনেক কিছু হয়, প্রেম, কান্না, ত্যাগ, আত্মবলিদান, চোখের জল এমনকি মার্ডারও। মহিম হালদার আর তার কুপুত্রকে কোতল করে, এক ডজন চেলাচামুণ্ডাকে ঠেঙিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে, মহিম হালদারের স্যাঙাত থানার ওসিকে বেল্ট পেটা করে মাথা ফাটিয়ে মাননীয় জেলা শাসক মহোদয়ের ভূয়সী প্রশংসা পায় প্রসেনজিৎ। ঠিকই তো, দুষ্টের দমন তো করারই কথা। যার ল্যাজে আগুন লাগবে সেই তো লঙ্কা পোড়াবে। ওসব আইন- আদালত- পুলিশ থাকার দরকারটাই বা কি। এই তো জীবন কালি দা।
দিব্যি খোশ মেজাজে নিমতৌড়ি স্টপে নামলাম। আহা এমন সিনেমা কতদিন দেখিনি গো। আফসোস কেবল একটাই, রঞ্জিত মল্লিক একবারও বেল্টটা খুললেন না, এই যা। ঠিক করলাম আজ আমার সাথে যারই দেখা হবে তাকেই এই গপ্পটা শোনাব। কারা যেন ডেপুটেশন দিতে আসবে বলে ভয় দেখিয়ে রেখেছে, আসুক ব্যাটারা। আগে আমার গল্প শুনতে হবে, তবে অন্য কথা।
আর রাত টা নামতে দিন, কি যেন বলছিল শৌভিক, বিলি ওয়াইল্ডারের ডবল ইনডেমনিটি দেখাবে? যা কিনা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সিনেমা গুলির মধ্যে অন্যতম? সত্যজিৎ রায়ের প্রিয়তম সিনেমা? যেটা দেখে বিমোহিত হয়ে উনি বিলি ওয়াইল্ডারকে ১১ পাতার এক খানা চিঠি লেখেন, ওনার জীবিত অবস্থায় যার কোন প্রত্যুত্তর আসেনি। অস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রচারিত ওনার ভাষণে উনি সেই কথা জানাতে, বিলি ওয়াইল্ডার সাহেব চিঠি লিখতে বসেন বটে,তবে সে চিঠি পাবার আগেই ইহলোক ত্যাগ করেন সত্যজিৎ। অবশ্যই দেখব, তবে তার আগে আমার গপ্পটা শুনতে হবে।
No comments:
Post a Comment