Monday 19 June 2023

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #হাওড়ারগপ্প 


আমার বাবা-মায়ের কোনদিনই ঠিক সেই ভাবে বিবাহবার্ষিকী পালন করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আশি/নব্বইয়ের দশকে আমাদের রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে কারই বা সেভাবে পালন করা হত।

বছরের আর পাঁচটা দিনের মতোই আসত বিশেষ দিনটা আর নীরবে বিদায় নিত। বাবা-মায়ের রুদ্ধশ্বাস রোমান্সের গল্প যদিও চলত সারা বছর। কিভাবে জেলে প্রথম দেখা, বাবা তখন বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দি। কিভাবে বাবার অজান্তে, গ্রামে ফিরে গিয়ে ফসল বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে বাবার জামিন করিয়েছিল সদ্য পরিচিত মা, সেই গল্পটাই ছিল আমার শৈশবের রূপকথা।


ঐতিহাসিক মে দিবসের দিন বাবা মায়ের ছোট্ট করে আইনানুগ বিবাহ, বাবার কিনে দেওয়া নীল বেনারসি শাড়ি আর বড় মাসির কাছ থেকে ধার করা গয়নায় লাজবন্তি মা আর বাবার যুগল সাদাকালো ছবিটা, সপ্তপদীর থেকে কম রোমান্টিক লাগত না আমার। ভালোবাসায় মোড়া ছিল দিনগুলো, ছিল না কেবল ভালবাসার দিনটার উদযাপন।


আশি- নব্বইয়ের দশককে পিছনে ফেলে, Y2K এর যাবতীয় জটিলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট প্রদর্শনপূর্বক হুড়মুড় করে এসে পড়ল সহস্রাব্দ। আশেপাশে ঝুপঝুপ করে ভেঙে পড়ল কত যে রক্ষণশীলতার প্রাচীর। কত কিছু যা এককালে দৃষ্টিকটু বা অবাস্তব গণ্য হত, স্বাভাবিক হয়ে দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল, তার ইয়ত্তা নেই। বদলে গেল অনেক কিছুই, বদলানো না কেবল আমার ফুটো কপাল। আশেপাশে যতদূর চোখ যায়, চাকরি পেয়ে গেল, বিয়ে হয়ে গেল, এমনকি বাবা মাও হয়ে পড়ল না জানি কতজন তুতো ভাই বোন, সহপাঠী, সমবয়স্ক বন্ধুবান্ধব। আমিই রয়ে গেলাম নিঃসঙ্গ কাঠ বেকার। 


কানাঘুষো শুনি,"আমাদের মধ্যে কেবল অনিন্দিতাটারই কিছু আর হল না।" আর মাটিতে মিশে যাই। হল নাই তো, মায় একটা টিউশনিও জোটে না মাইরি। বাস ভাড়ার জন্যও হাত পাততে হয় অবসর নেওয়া প্রৌঢ় বাপের কাছে। অন্তর্বাস, ন্যাপকিনটাও কিনে দিতে হয় মাকে। আমার মত ব্যর্থ অপদার্থ মেয়ের জন্য কেন যে ধরিত্রী দ্বিধা হত না। 

 এমন সময় আমার অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য জনে জনে কুম্ভীরাশ্রুপাত করা এক প্রাক্তন সহপাঠী প্রস্তাব দিল তার কোচিংয়ে পড়ানোর জন্য। সপ্তাহে একটা ক্লাস, অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়াতে হবে, বেতন মিলবে দেড়শ টাকা।


টাকার অঙ্কটা শুনে তাচ্ছিল্য করতেই পারেন, বিশেষতঃ আজকের বাজার দরে। তবে মূল্য তখনই বুঝবেন যদি আপনি কখনও বেকারত্বের জ্বালা অনুভব করে থাকেন। সাদা ছোট্ট খামে মোড়া একটা ১০০ আর একটা ৫০ টাকার নোট। রবিবার সকালের ফাঁকা ৫২ নম্বর বাসের লেডিস সিটে বসে, জনগণের চোখ বাঁচিয়ে কতবার যে শুঁকে ছিলাম টাকার গন্ধটা। "শালা ম্যায় তো সাহাব বান গ্যয়া" মার্কা কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছিল। বাসের জানলা দিয়ে চোখ গেল রাস্তার ধারের একটা ছোট্ট দোকানে ঝোলানো হলুদ সাদা একটা পাঞ্জাবির দিকে। আজ আমার বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী না, ঝট করে বাস থেকে নেমে পড়ে কিনেই ফেললাম পাঞ্জাবীটা বাবার জন্য। দাম পড়ল ৯০ টাকা। আর মায়ের জন্য পাড়ার দোকান থেকে কিনলাম এক লিটারের একটা মেট্রোর বাটারস্কচ আইসক্রিম। চকলেট ফ্লেভার মায়ের ঘোরতর নাপসন্দ ছিল যে। কোচিং সেন্টার থেকে বাড়ি এই পৌনে তিন কিলোমিটার পথ আসতেই উড়িয়ে দিলাম সারা মাসের মাইনে।


এমন কপাল, সেই বছরই নভেম্বর মাসে নিউমোনিয়া বাঁধাল বাবা। এক সপ্তাহ ধরে যমে মানুষে টানাটানি। সুযোগ পেয়ে গেল মাও, "দেখলি তো,ওই সব বিবাহবার্ষিকী- টার্ষিকী করলে কি হয়।" তারপরের কয়েকটা বছর সত্যিই কিছু করিনি। করার সুযোগ ও পাইনি। ওই বছর গুলো ছিল আমার লড়ার এবং জেতার বছর। কিচ্ছু না হওয়া থেকে একসাথে অনেক অনেক  কিছু হবার বছর। থিতু হতেই আবার শুরু হল বিশেষ দিনের বিশেষ উপহার কেনা। সবাই মিলে সামান্য খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, গল্পগুজব, সামান্য স্মৃতিচারণ এই আর কি। ব্যাপারটা যে বাবা বা মা খুব ভালো ভাবে নেয়, এমন ভাবার কিন্তু কোন কারণ নেই। বেশ বিরক্ত হয় বুড়োবুড়ি। প্রতিবারই বলে, ও সব আদিখ্যেতা এবার বন্ধ কর। নেহাৎ আমি শুনি না।


এটা বৃদ্ধ বৃদ্ধার ৪৯ তম বিবাহবার্ষিকী, কিন্তু এবার কিছু করাটা ছিল বেশ দুষ্কর। বাড়ি থেকে প্রায় শ দেড়েক কিলোমিটার দূরে রয়েছি। এত স্বল্প অবসরে বাড়ি যাই যে বাজার দোকান, রান্নাবাড়া কোন কিছুই আমার একার পক্ষে করে তোলা সম্ভব নয়। তারওপর আবার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাজগোজ। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতে বললে, কিছুই নাকি খুঁজে পায় না বাবা। আর মা অনেক খুঁজে বার করে একটা ন্যাতা শাড়ি। কারণ, " ওরে বাবা কি গরম! তুমি কি চাও, এই গরমে আমি বেনারসী পরব নাকি?" 


ভাগ্যে অয়ন ছিল। শ্রীমান অয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায় আমার বাবার ভ্রাতুষ্পুত্র। মেন্যু নির্ধারণ আমি করে দিলেও, আগের দিন রাত থেকে বসে লিস্ট করে, নিজে বেছে সব থেকে ভালো মালপত্র কিনে এনে, এই গা চিড়বিড় গরমে যা রাঁধল ছেলেটা, আহা অসাধারণ। দুটো মালাও কিনতে বলেছিলাম, সেটা অবশ্য কেনেনি, " এই বয়সে মার খাওয়াবি নাকি? মালা দেখে মেজ জেঠু রেগে ফায়ার হয়ে যাবে জানিস না। আসল বিয়ের দিনই মালা পরল না, সে নাকি বিবাহবার্ষকীতে পরবে।"

দই মিষ্টিটা অবশ্য আমার ফরমায়েশ মত কাঁথি থেকে নিয়ে গিয়েছিল শৌভিক। ভাগ্যে গিয়েছিল,তাই না ওমন সোনা মুখ করে সাজুগুজু করল বুড়ো বুড়ি। ভগিনী, কন্যা, জামাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনী পরিবৃত হয়ে এক কথায় কেকটাও কেটে ফেলল। দেদার নকল বরফ ওড়ালো বুল্লু বাবু আর তুত্তুরী। বৃদ্ধ দম্পতির মাথায় হাত দিয়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করল সাতাশি বছরের তরুণী তন্বী পিসি। " তোরা দুজনেই তো আমার শিব রাত্রির সলতে। আর তো সবই হারিয়ে গেছে আমার। খুব ভালো থাক। আরো আরো ঝগড়া কর। ঝগড়া করলে ফুসফুসের জোর বাড়ে, আমি পড়েছি।"  সময় ও আজব খেলা খেলে মাইরি, বছর বিশেক আগে এ দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। এমনিই থাকুক না, এমনিই চলুক না। বাকি সব অঙ্ক সময় আর কর্মফল ঠিক মিলিয়েই দেবে। অন্তত জীবন তো আমায় তাই শিখিয়েছে।

No comments:

Post a Comment