#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা
বিগত দুই বছর ধরে রথটা কেমন যেন ঘেঁটে গেছে তুত্তুরী আর আমার জীবনে। Dবিশ্রী একটা পারিবারিক দুর্ঘটনা ঘটে যায় ২০২১ সালের রথের দিন। সে বছরও লফট্ থেকে ঝেড়েঝুড়ে বার করা হয়েছিল তুত্তুরী থুড়ি জগন্নাথ দেবের তিনতলা মজবুত কাঠের রথ। রথের মধ্যে উঠেও পড়েছিলেন ভাই বোন সমেত জগন্নাথ দেব। তারপরই যে কি হয়ে গেল। মেয়ে আর মেয়ের রথ ফেলে বেরিয়ে পড়তে হল দুজনকে। বাকি দিনটা কেটে গেল হাসপাতালের চক্কর কেটেই। দ্বিপ্রাহরিক আহার জুটল পড়ন্ত বিকেলে, আহার বলতে হাওড়ার সুরকি কলের কাছে, নর্দমার ধারে বসে ভাজা শুটকো কয়েকটা জিলিপি মাত্র।
লাটেই উঠতে বসেছিল সে বছরের রথ যাত্রা। যদি না উমারানি থাকত। আজও বলছিল তুত্তুরী, " তোমরা বেরিয়ে যাবার পর, কি কান্নাই না কেঁদে ছিলাম। একে তো বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি হয়েছে হাওড়ায়, তার ওপর পরের দিনই বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে Rতমলুক চলে যাবে বাবা। শোক উথলে উথলে উঠছিল। মাসি অনেক চেষ্টা করছিল ভোলাতে। পারেনি। দুপুর বেলা বেল বাজিয়ে যখন কাকিমা এসে ঢুকল, ফুল, মালা, গাছের পাতা নিয়ে কি যে আনন্দ হল। কাকিমা বসল, তবে ভাত খেয়েছিলাম সেদিন।" উমার সাথেই সেবার রথ টেনেছিল তুত্তুরী। বাড়ি ফিরে, শুকনো মুখে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সঙ্গী হয়েছিলাম বটে আমিও। তবে অনুভব করতে পারিনি কিছুই।
২০২২ সালে, আমরা তখন তাম্রলিপ্ত নগরীর বাসিন্দা। সবই ঠিক ছিল সে বছর, কোথাও কোন সমস্যা ছিল না, আমরাও Kমা-মেয়েতে অধীর ছিলাম জগন্নাথ দেবার রথ যাত্রার জন্য। বাংলোয় রান্না করতেন যে দিদি, ঝাড়পোঁচ করতেন যে দিদি, বাংলো পাহারা দিত যে ছেলে দুটি সবাইকে বলাও ছিল, রথের দিন এসো কেমন। সপরিবারে এসো। রথ টানব সবাই মিলে। সবই ঠিক ছিল শুধু বেঁকে বসলেন জগন্নাথ দেব স্বয়ং। গোটা তাম্রলিপ্ত নগরী ঢুঁড়েও মিলল না টানার মতন একখানিও রথ। আমরা সবে এসেছি, দোকান বাজার কিছুই চিনি না। সবকিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় শৌভিকের তৎকালীন ড্রাইভারের ওপর। তাকেই বলেছিলাম, একটা রথ কিনে আনতে। রোজই আশ্বস্ত করত ছেলেটি, "আজ পেয়ে যাব ম্যাডাম। আজ নিয়েই আসব ম্যাডাম।" দেখতে দেখতে রথ এল, চলেও গেল। জগুদা এণ্ড কোং আর এসে উপনীত হলেন না, তমলুকের মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসে।
হয়তো এই Dজেলার এমনিই নিয়ম। আমাদের হাওড়া-কলকেতার মত পথেঘাটে ঢেলে বিক্রি হয় না রথ, এই ভেবে এবারে তাই আর কোন আশাই রাখিনি Rতুত্তুরী আর আমি। ছিল না,রথ টানার বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা। সাম্প্রতিক তাপ প্রবাহের সৌজন্যে, ইদানিং মাত্রাতিরিক্ত ভোরে স্কুল বসছে তুত্তুরীর। ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে Kস্কুলে ছেড়ে এসে আর এক দফা ঘুমিয়ে, কপালে করাঘাত করে, চটজলদি নাকে মুখে গুঁজে অফিস বেরিয়েছি, দেখি মহকুমা শাসকের করণ ছেড়ে বেরোতেই রাস্তার দু'ধারে সারি সারি সাজানো রয়েছে রথ। অধিকাংশই শোলা থুড়ি থার্মোকলের। কি অপূর্ব দেখতে সবকটা। মেয়েটার জন্য কেঁদে উঠল মন। বাইরে থেকে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে, আমার মাথায় ছুঁইছুঁই প্রায়, তবে ভিতরে তো এখনও তেমনি ভোম্বলই রয়ে গেছে।
Dমহকুমা শাসকের বাহনচালক নূপুর বাবুই নিয়ে যাচ্ছিলেন বাসে তুলে দিতে, থাকতে না পেরে হ্যাংলার মতই তাকে বলে বসলাম," নূপুর বাবু, আমার মেয়েটাকে একটা রথ কিনে দেবেন গো?"
নূপুরবাবু জিভ কেটে বললেন, "এ বাবা ম্যাডাম, কেন কিনে দেবোনি! এ আর এমন কি ব্যাপার, আমরা তো অমুক সাহেবের মেয়েকেও কিনে দিতুম। রথ টানা হত,জিলিপি খাওয়া হত।"
এ আর এমন কি ব্যাপার, রথের দিন জিলিপি তো হবেই। পৃথিবী উল্টে গেলেও হবে। তবে তার আগে একবার মহকুমা শাসকের অনুমতি নেওয়া, বাধ্যতমূলক। তারও আগে এ ব্যাপারে শ্রীমতী তুত্তুরীর কি অভিমত তা জানা জরুরী।
Rতুত্তুরীর ছুটির সময় হিসেব করে, মাসির ফোনে, ফোন করলাম। প্রসঙ্গত কাঁথির মহকুমা শাসকের নিবাসে একখানি ল্যান্ড ফোনের দেহাবশেষ পড়ে আছে বটে, তবে তা সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ। বিগত ৮ মাসে তিনি একটি বারই ধড়মড় করে জীবিত হয়ে উঠে ছিলেন। অতঃপর কিছুক্ষন প্রবল ক্যাঁওম্যাঁও করে পুনরায় দেহ রাখেন। ল্যান্ডফোন আজকাল কেউই ব্যবহার করেন না, আর তুত্তুরীর নাগালের মধ্যে একখানি জ্যান্ত ফোন রাখা সমীচীন নয়, বলে আমরা আর তাকে খোঁচাইনি। অগত্যা মাসির ফোনই ভরসা।
এমনিতেও আমাদের Kঅনুপস্থিতিতে মাসির ফোনটা আর মাসির থাকে না। অন্য কারো কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। যথারীতি তিনিই ধরলেন ফোনটা এবং রথ কিনে আনার কথা শুনে বেশ উদাস স্বরে বললেন "আমার কি আর রথ টানার বয়স আছে মা?" বেশ তবে টানিস না, বলে ফোন রেখে দিলাম। যার জন্য চুরি করব মনস্থ করেছি, সেই যদি চোর ভাবে তাহলে আমি নাচার।
ফোনটা রাখার পর দুই মিনিটও কাটল না। পুনরায় ঝনঝনিয়ে উঠল মুঠোফোন। নম্বরটা তুত্তুরীর মাসির হলেও, ফোনের ওপারে তিনি স্বয়ং। "এই মা, ভাবছি রথটা টেনেইনি।" বেশ, এর পরের ধাপ মাননীয় মহকুমা শাসক মহোদয়কে পটানো। তিনি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে ইদানিং যা ব্যস্ত থাকছেন, তাঁকে ফোন করার উপরেও চেপেছে হাজার খানেক বিধিনিষেধ। যেমন ধরুন জীবনমরণ সমস্যা হলে তবেই যেন তার অফিসিয়াল নম্বরে ফোন করা হয়। তাহলে যে পরিস্থিতিতেই থাকুন না কেন, তিনি ফোনটা ধরবেন। অন্য যাবতীয় সমস্যার জন্য ফোন করতে হবে তার ব্যক্তিগত নম্বর। সেটি তিনি ধরতেও পারেন, নাও ধরতে পারেন। আর দরকার ছাড়া নিছক খোশ গল্প করার জন্য কোন অবস্থাতেই যেন তাকে ফোন না করা হয়।
অনেক ভেবেচিন্তে, ফোন করা না করার উপপাদ্য সম্পাদ্য তত্ত্বটা মাথার মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝালিয়ে, শেষে ব্যক্তিগত নম্বরেই ফোন করলাম। তিনি ধরলেন, গলায় সামান্য ব্যস্ততার ছোঁয়া থাকলেও বিরক্তি বা ধমক নাই। বললাম," ওগো তুমি কি এখন কোথাও বেরোবে? যদি না বেরোও তাহলে নূপুর বাবুকে একটি বার বাংলোয় পাঠাও না, তুত্তুরী একটা রথ কিনতে যাবে। বেশি দূর নয়, এই তো তোমার অফিসের সামনের বাজারে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে।"তিনি কইলেন," অ। আমি নূপুরকেই বলছি বরং, একটা রথ কিনে দিয়ে আসতে।"
বাতাস অনুকূল দেখে নিজের কাজে মন দিলাম। কাজ করার কি যো আছে, কাকে যেন সাঁকো নাড়ানো দেখাতে নেই, কি কুক্ষণে যে রথ কেনার কথাটা বলেছিলাম। শ্রীমতী তুত্তুরী আক্ষরিক অর্থেই ফোন আর মেসেজের বন্যা বইয়ে দিলেন। "মা, নূপুর কাকু শোলার রথ কিনে এনেছে। এটা টানব কি করে?" বললাম, তোর বাপকে বল। নূপুরকে পাঠিয়ে বদলে আনবে। সেটুকু সাহসটুকুও তার নেই। যত জোর কেবল মায়ের উপর।
যাইহোক সন্ধ্যা নামার আগে শোলার রথ বদলে যা আনা হল, তিনি পাতলা কাঠ বা পিচবোর্ডের হলেও তার চাকাগুলি মাটির। সামনে ঘোড়াটিও নেই, দড়ি বাঁধা হবে কোথায়? আর বাঁধলেও টানবে কি করে, বুঝতে পারলাম না। কারণ টানতে গেলেই তিনি সটান উল্টে যান। সন্ধ্যাবেলায় পাকশাল সামলায় যে ছেলেটি, সে আশ্বস্ত করল, "ও আমি কাল এসে সব ঠিক করে দেব সোনা মা(তুত্তুরী)। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।"
আজ সত্যিই বিকাল তিনটে থেকে একগাদা পেরেক, সুতো, রাংতা, মার্বেল পেপার, সোনালী জরি কিনে এনে রথটা সাজাল ছেলেটা, সঙ্গতে ছিল তুত্তুরীর মাসি। শ্রীমতী তুত্তুরী কয়েকবার মাতব্বরি করতে গিয়েছিলেন বটে, তেমন পাত্তা পাননি। বাগান থেকে তুলে আনা টাটকা ফুলে সেজে উঠলেন তিন ভাইবোন। এবার রথ টানার পালা। তুত্তুরীর হাতে তুলে দেওয়া হল রথের দড়ি থুড়ি জরি।
দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মারল তুত্তুরী, রথের চাকা গুলো দাঁড়িয়ে রইল অনড় হয়ে, রথ ফেলে ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইল তিন ভাইবোন। কোন মতে,তাদের শান্ত করে, পুনরায় রথে প্রবিষ্ট করা হল। ছেলেটা পর্যায়ক্রমে রথের সামনে-পিছনে, চাকার উপরে-নীচে সর্বত্র পেরেক আর দড়ি বেঁধে দিল। তাও টলমল করেন তিন ভাই বোন। শেষে আমি বললাম, "চল বাবু তুই রথ টান। আর আমি রথের মাথাটাকে ধরে থাকি। দেখি যদি নড়ানো যায় তেনাদের।" তাও তাঁরা দোদুল্যমান। তখন মাসি বলল, " দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে দক্ষিণা দিই। দক্ষিণা না নিয়ে নড়বেন না মনে হচ্ছে।" দক্ষিণা দেওয়া হল, নকুলদানার প্রসাদ বিতরণ করা হল, অতঃপর জয় জগন্নাথ ধ্বনি সহ যাত্রা শুরু করলেন তাঁরা।
জগন্নাথ দেবের টলমলে রথের জন্য খোলা হল বাংলোয় গাড়ি ঢোকার মস্ত সবুজ ফটক খানি। রাস্তায় নামলাম আমরা। এবার যাব কোথা। "বাবার অফিসে যাবে মা?" প্রশ্ন করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে রথ টানতে লাগল তুত্তুরী। জগুদাদা এন্ড কোং এরও মনে হয় বাবার অফিস দেখারই ইচ্ছে ছিল, তাই দিব্য টলটল করতে করতে এগিয়ে গেলেন তেনারা। কে বলবে, একটু আগে এনাদের নড়ানোই ছিল দুষ্কর। বাংলোর গেট থেকে শৌভিকের অফিস সাকুল্যে আড়াইশো মিটার হবে। অফিসের ঢুকতে হয় ঢালু রাম্প ডিঙিয়ে। সেখানে আর রথ টানার সাহস হল না কারো। কোলেই নিলাম তিন গুড়গুড়ে ভাইবোনকে সবাহন।
শৌভিকের চেম্বারে ঢুকতে যাব, নূপুর বাবু দৌড়ে এলেন, "ম্যাডাম স্যার তো মিটিং করছেন। ইলেকশনের মিটিং, এডিএম স্যারও রয়েছেন।"
অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) মহোদয় প্রেস দেখতে আসবেন বলেছিল বটে শৌভিক। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করব, ফিরে আসব কিনা, ততক্ষণে চেম্বারের দরজা খুলে ধরেছে মহকুমা শাসকের আর্দালি কানাই বাবু। আমার সম্মতি ছাড়াই দিব্য গটগট করে ঢুকে গেল তুত্তুরী সহ তিন ভাই বোন। এডিএম স্যার এবং মহকুমা শাসক দুজনেই দেখলাম অত্যন্ত সহরষে স্বাগত জানালেন চারজনকে। নকুল দানার প্রসাদও হাত পেতে গ্রহণ করলেন দোঁহে। এমন কি দক্ষিণাও পাওয়া গেল বেশ। যা নাকি যে রথ টানে কেবল তারই প্রাপ্য। যে রথ ঠেলে বা সামলায় বা কোলে নেয় তার ভাগ্যে কচু ঘেঁচু এবং টিকটিকি।
এবার ফিরে আসার পালা। আমরা বাংলো প্রত্যাবর্তন করলাম বটে, তিন ভাইবোন রয়ে গেলেন মহকুমা শাসকের চেম্বারের এক পরিচ্ছন্ নকোণায়। ওটাই নাকি ওদের মাসির বাড়ি। অন্তত শ্রীমতি তুত্তুরী তাই ঘোষণা করলেন। কন্যার আব্দার দেখলাম হাসিমুখে মেনেও নিল শৌভিক। বাইরের আবরণটা যতই জাদরেল অফিসারের হোক না কেন, ভিতরে তো নিখাদ স্নেহপ্রবণ মধ্যবিত্ত বাঙালি বাপ।
No comments:
Post a Comment