মৃদু হলেও, মুখোমুখি ধাক্কা। দোষ আমারই, টিকিটটা পড়তে পড়তে হাঁটছিলাম যে। শশব্যস্ত হয়ে মার্জনা চাইতে গিয়ে থমকে গেলাম। বড় চেনা, বড় প্রিয় এক জোড়া চোখ। বরাবরের মতই চোখ ভর্তি হাল্কা বিরক্তি। কবেই বা আমার দিকে প্রসন্ন হয়ে তাকিয়েছে ঐ চোখের মালিক। থতমত খেয়ে, ক্যাবলার মত হেসে জানতে চাইলাম, সব ভালো কি না। জানতাম উত্তরে ‘হ্যাঁ’ই আসবে। তারপর আর একটু হেসে ভিড়ে মিশে যাব আমি। যদিও মধ্যাহ্ন, তবুও বড়দিন তো বটে। আশেপাশে ক্রমেই জমে উঠেছে উৎসবমুখর রঙবেরঙের সুখী মানুষের ভিড়। ওই ভিড়েই হারিয়ে যাব আমি, মুখকে এবার কিছুতেই আর মনের আয়না হতে দেব না।
প্রশ্নের উত্তরে ভেসে এল প্রশ্ন। নাঃ আমি কেমন আছি, জানতে চাইল না সে। স্বভাবসিদ্ধ উদাসীন হয়তো বা সামান্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবেই জানতে চাইল,‘একা?’ অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে জানালাম, দোকা আর পাই কোথায়? মেয়েটাকে বলেছিলাম বটে আসতে, এল না। তার চলন্ত সিঁড়িতে উঠতে দারুণ ভয়। অথচ ছোটবেলায় কি ভালোই না বাসত চড়তে, বলত ‘মজার সিঁড়ি।’ বলতে বলতে ব্রেক কষলাম,বড় বেশি ব্যক্তগত কথা বলছি। সে তো জানতেও চায়নি। প্রশ্ন ছিল, আমি একা এসেছি কি না। জবাবে শুধু হ্যাঁ বলে দিলেই তো মিটে যেত। এতক্ষণে বাড়তে থাকা জনারণ্যে মিশে যেতাম আমি। তা নয়, কেন যে নিজেকে এত ছ্যাবলা প্রমাণ করি, বার-বার।
‘কোন সিনেমা?’ জানতে চাইল সে। জবাব দিলাম। ‘এর টিকিট কাটতে হলে আসতে হয় নাকি? বাড়ি বসেই তো-’। বললাম, তা যায় বটে, তবে খামোখা কনভিনিয়েন্স ফি’র নামে অনেকটা টাকা কেটে নেয় ব্যাটারা। বলেই জিভ কাটলাম। কি আনস্মার্টের মত যে কথা বলি আমি। অন্য কিছুও তো বলা যেত। এত স্বচ্ছ হবার দরকারটাই বা কি? মেয়েরা যত রহস্যময়ী হয়, ততোই বাড়ে তাদের আবেদন। আর আমায় দেখো-। এতগুলি বছর কিছুই শেখাতে পারল না আমায়। শিখে উঠতে পারেলাম না কি করে বুনতে হয় আলোআঁধারি মায়াজাল।
ওদিক থেকে অবশ্য ভেসে এল সমর্থনের সুর। ‘হ্যাঁ প্রায় একশ টাকা কাটল বটে।’ তারপর বেশ অনেকখানি নিস্তব্ধতা। শুধু বুকের মধ্যে বিষম যুদ্ধ। নির্বোধ হৃদয় চাইছে, খানিক থমকে দাঁড়াক না এ সময়। আরো কিছু বলুক সে, ফুসফুসে আর একটু ভরেনি তার সৌরভ। অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া মস্তিষ্ক বলছে, আবার কেন?
একই সিনেমা দেখতে এসেছি দুজনে, নাঃ পাশাপাশি সিট পড়েনি। এটা তো আর সিনেমার স্ক্রিপ্ট নয়। সবথেকে সস্তার টিকিট কেটেছি আমি, একদম সামনের রো এর পরের-পরেরটা। ‘ঠিক আছে’ বলে পিছন দিকে এগিয়ে গেল সে। হলের বাতি তখনও নেভেনি, অথচ কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু। দম নিতেও চাপা কষ্ট। অঝোর গালি দিচ্ছে পোড় খাওয়া মাথা। বলেছিলাম না, এবার এই ব্যথা সারতে কে জানে লাগবে আরো কত-কত বছর। কি সব বিজ্ঞাপন চলছে পর্দা জুড়ে, বিস্বাদ লাগছে সবকিছু। আলো নিভলে, উঠে যাব কি?
আলো নেভার আগেই পাশে এসে দাঁড়াল, ইশারায় বলল, পাশের সিটে যেতে। বোকার মত বললাম, এটা যাঁর সিট, তিনি যদি আসেন? জবাব এল,‘এলে অন্য কোথাও বসবে। ম্যাটিনি শো, সবই তো ফাঁকা-’।
আলো নিভল, বুকের ভেতর অকারণ বড় ছটফট করছে হৃদয়, মন বসাতে পারছি না একদম। কি যে হচ্ছে পর্দা জুড়ে। মন থেকে মনে কোন সিগন্যাল যায় কি না জানি না, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল সে, ‘এটা পি আর মান সিং, ওদের ম্যানেজার, প্রায় ফাদার ফিগার ছিল গোটা টিমের কাছে।’ গল্প এগোচ্ছে, সাথে ফিসফিসানিও। গুলিয়ে ফেলছি, কোনটা কে। বলে দিচ্ছে সে, ‘এটা মদনলাল। ওটা কীর্তি আজাদ। মহিন্দর অমরনাথের বাবার রোলে খোদ মহিন্দর অমরনাথ।’ ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে মন আর মাথার দ্বৈরথ, ডুবে যাচ্ছি আমিও শৈশবের একরাশ স্মৃতিতে। সমবয়সী আমরা। ঘটনাপ্রবাহ যে সময়কার, তখন নিছক অবোধ শিশু আমরা। ক্রিকেট কি কিছুই বুঝতাম না কেউই। কিন্তু এই দিনগুলোর গল্প তো কম শুনিনি আমাদের বাবা-কাকা-জেঠাদের কাছে।
উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে বলেই যাচ্ছে সে, ‘ একদম ক্লাইভ লয়েডের মত ভাবভঙ্গী। হাঁটছেও অমনি সামান্য কুঁজো হয়ে। বকের মত। পুরো ভিভ রিচার্ডস্ এর মত করে ব্যাট চালাচ্ছে।’ গলায় ঝরে পড়ছে উত্তেজনা। আমী জানি লোকটার প্রাণের প্রতিটা তন্ত্রিতে মিশে আছে ক্রিকেট। বড় ভালো খেলত এককালে। তখনও ঘণ কৃষ্ণ কেশদামের ফাঁকে উকি মারেনি একটা দুটো কাশফুলের গোছা। জানি এখনও সুযোগ পেলে ইউটিউব খুলে পুরাণ ম্যাচের রেকর্ডিং দেখে লোকটা। লোকটার কাছে ভিভ রিচার্ডস নিছক ক্রিকেটার নন, ঈশ্বর স্বয়ং।
ব্যাগের মধ্যে কেঁপে উঠল বেরসিক মুঠোফোন। বার করতে গেলাম, বিরক্ত হল সে। ‘থাক না। ওটা থাক।’ পরক্ষণেই তরল হয়ে এল কণ্ঠস্বর, ‘এই ম্যাচটা কিন্তু ইণ্ডিয়া হারবে। পরেরটাও। ম্যালকম মার্শালের বল বেঙ্গসরকারের থোবড়া ভেঙে দেবে।’ থুতনিতে সত্যিই আঘাত পেল পর্দার বেঙ্গসরকার, বিবেকহীনের মত, বল থেকে টুসকি মেরে রক্ত ঝেড়ে ফেলল পর্দার মার্শাল। নিজের সিটে সটান হয়ে বসল সে, বলল, ‘ ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেয়ারদের এমন ভিলেনের মত দেখাচ্ছে কেন? আসলে তো ওরা ভিলেন নয়। নিছক বিপক্ষ কেবল। যেটা দেখালো না, সেটা হল,পরের বলটা করতে গিয়ে মার্শাল দেখেছিল বলটায় খানিক মাংস আর রক্ত লেগে। দেখে ও মাঠেই বমি করে দিয়েছিল।’ বেশ বুঝতে পারি, মন আর মাথাকে ক্রমশঃ ঘিরে ধরছে অপরিসীম মুগ্ধতার কুয়াশা।D
বাড়ছে উত্তেজনার পারদ। এর পরের ম্যাচটা জিতবে তো? ব্যগ্র হয়ে জানতে চাই আমি। ‘হ্যাঁ একদম। এরপরের ম্যাচেই তো জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড।’ ৯রানে পড়ে যায় ৪ উইকেট। যদিও জানা ইতিহাস, তবুও ড্রাম বাজতে থাকে বুকের মধ্যে। অন্ধকারে কি করে বোঝে সে কে জানে, বলে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তারপর মদনলাল আর কিরমানিকে সঙ্গে নিয়ে বেদম পেটায় কপিল।’
দমবন্ধ করা সুখ বড় স্বল্পস্থায়ী। জ্বলে ওঠে সিনেমা শেষের আলো। স্ক্রিনে তখন মুখ খুলেছেন আসল কপিল দেব। স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠছে একের পর এক সাদাকালো ছবি। কেউ বসে দেখছে, কেউ বা উঠে ভিড় জমাচ্ছে এক্জিট লেখা দরজার সামনে। একদম ইচ্ছে করছে না উঠতে, নীরবে পর্দার দিকে মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাশের জনও। তবুও উঠতেই হয়, একটু আগের দমবন্ধ করা সুখের মুহূর্ত গুলোকে স্মৃতিতে তালা বন্ধ করে ধরতেই হয় নিজের নিজের রাস্তা। R
হ্যাংলা মন শুধু চিৎকার করে ওঠে, 'আরও কিছুক্ষণ না হয় রইলে কাছে--'। শুনতে যে পেল না সেও বুঝলাম। মুখ বন্ধ ছিল যে। বড় সাহস বেড়ে গেছে মনের, আজ আর কিছুতেই থামতে দিতে চায় না কথার স্রোতকে। নিছক খেজুরে কথা বলার জন্যই বললাম,“ তোমার সেই ডাস্ট এলার্জি?সেরে গেছে বুঝি?” জবাবে ভ্রু কুঁচকে বলল,“কমোনি তো দেখছি এক ছটাকও। ” মোটা বলল বুঝি, রাগ হল না তো?হৃদয়ের বেদনা যেন কিছুটা উপশম হল, বললাম,“নাঃ কমিনি। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বরং বেড়েই গেছি। ” হাল্কা হাসির রেখা ফুটে উঠল কি ওষ্ঠ আর অধরের জটিল বিভঙ্গে? সুযোগ বুঝে বললাম,“একটা সেল্ফি?” বলল,“সেল্ফাইটিস্ টাও বেড়েছে দেখছি।” বলতে পারলাম না,“কয়েদ করে রাখতে চাই এই মুহূর্তটাকে। যেমন রেখেছি তোমার সঙ্গে কাটানো আরো অজস্র মুহূর্ত।" বলতে পারলাম না, একদলা কষ্ট কোথা থেকে এসে চেপে ধরল বুক আর গলা। ছলছলে চোখকে অন্যদিকে ঘোরালাম, ধরা পড়তে চাই না। কিছুতেই না। সূর্য কি পশ্চিমে ঢলে পড়ল খানিকটা? এবার যেতে হয় এবং যেতে দিতেও হবে। মন বলল,“ভালো থেকো। ” আর সে? সে বলল,“চলো তোমার ছবিটা তুলে নি”। হাসলাম দুজনেই। ক্যামেরার সামনে হাসতে হয় তো। শাটার বন্ধের সাথে সাথেই কি নেমে আসবে নিশ্ছিদ্র অমানিশা?না কি সব নিয়ম ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে উল্টোদিকে দৌড়বে পৃথিবী?K
No comments:
Post a Comment