সেদিন সপ্তমী। শারদীয়া নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত উড়ে বেড়াচ্ছে একপাল দুষ্টু মেঘের দল। স্নান সেরে বরের আলয়ে সদ্য প্রবেশ করেছেন শ্রীমতী কলা বউ। বাতাসে খুশির সানাই। পাড়ার গলি থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্র উড়ে বেড়াচ্ছে রঙীন জোড়া প্রজাপতির দল। এই চারদিনের রোদে বোধহয় লুকিয়ে থাকে ম্যাজিক, হঠাৎ করে অনেকটা সুন্দর হয়ে যায় সবাই। খাবার গ্রুপ গুলিতে সাবেকী বাঙালি খানার জয়জয়কার। সবদিকে এক চূড়ান্ত খুশির আমেজ এপার বাংলা জুড়ে।
স্বার্থপর দৈত্যের বাগানের মত কেবল আঁধার আমাদের ১৪নম্বর বাড়ি জুড়ে। এবাড়িতে প্রবেশ করে না খুশির বসন্ত। এবাড়ির উঠোন জুড়ে কেবল ছুটে বেড়ায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ হতাশা। কোনায় কোনায় জমে থাকে ভারী মনখারাপের মণ্ড। আজ বোধহয় তার প্রকোপ একটু বেশীই। আজ নিয়ে পাক্কা নয়দিন হাসপাতাল বাস পূর্ণ করল বাবা। উৎসবের দিনে যদি কারো প্রিয়জন হাসপাতালে থাকে, তাহলে তাদের থেকে দুর্ভাগা বোধহয় আর কেউ নেই। শুধু যে হাসপাতালে আছে তাই নয়, বিগত নয়দিনের মধ্যে দেড় বেলা ছাড়া অভুক্ত আছে বাবা। শুধু স্যালাইন দিয়ে ফেলে রাখা আছে একাশি বছরের বৃদ্ধকে। কি যে তাঁর ব্যধি কেউ জানে না। তীব্র পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিল মহালয়ার আগের দিন। নাকে রাইজ টিউব পড়ানোর সাথে সাথেই বেরিয়ে এসেছিল প্রায় দেড় লিটার কুচকুচে কালো জল। প্রথমে বলা হয়েছিল ওটা রক্ত। বাবার উচ্চ হিমোগ্লোবিনের রিপোর্ট ভুল প্রমাণ করে তা। এখন বলা হচ্ছে ওটা বাইল বা পিত্ত রস। কেন অত বাইল জমেছিল তা উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে ডাক্তার। যত রকম টেস্ট হয় স্থানীয় নার্সিংহোমে বা গঙ্গাপাড়ের এই বুড়োশহরে, হয়ে গেছে তার সবকটাই। সব রিপোর্টই ভালো। রোজ একরাশ আশা নিয়ে যাই, আজ হয়তো ছেড়ে দেবে লোকটাকে। আর বৃথা মনোরথ হয়ে ফিরে আসি প্রতিদিন।ছাড়তে নারাজ ডাক্তার, রোগটাই যে ধরা পড়েনি এখনো।
আজ সকালে খবর এল, দক্ষিণ কলকাতার জনৈক নামজাদা হাসপাতালে হবে বিশেষ কোন টেস্ট। ওরাই নিয়ে যাবে। তবে সঙ্গে যেতে হবে আমায়। উৎসব মুখর শহর আর সুসজ্জিত নরনারীদের ভিড় কাটিয়ে এক সেট বিবর্ণ জামা পরে চটি ফটফটিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম আমি। স্ট্রেচারে করে বাবাকে এনে তোলা হল অ্যাম্বুলেন্সে। উল্টোদিকে পায়ের কাছে বসলাম আমি। আমার পাশে হাসপাতালের সুইপার ছেলেটি। বিনানুমতিতেই অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে বসেছে পাশের রাজ্য থেকে আসা ফচকে ছেলেটি। ‘দাদু’কে বড় ভালোবেসে ফেলেছে এই নয়দিনে।
উৎসবের শহর আর সুসজ্জিত মুণ্ডপ গুলোকে পাশ কাটিয়ে ছুটল অ্যাম্বুলেন্স। চোখ বন্ধ করে হাসি মুখে শুয়ে আছে বাবা। অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ আজ। যারা লোকটাকে চেনেন, তাঁরা জানেন, সর্বক্ষণ খই ফোটে লোকটার মুখ দিয়ে। জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা টুম্পা সোনার মত চটুল গানের কলি আর সুর। হাল্কা ঘাড় তুলে দেখার চেষ্টা করছে বাবা। ভেসে আসছে উৎসবের সুবাস। রবি অর্থাৎ বেহারি সুইপার ছেলেটি মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে ধরছে বাবার হাতটা আর জনৈক রাজনৈতিক সুপ্রিমোর সুরে মজা করে জানতে চাইছে, ‘দাদু, ও দাদু। ও দাদু ঠিক আছ তো?’ প্রতিবারই মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করছে বাবা। আলতো করে পায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম আমি। বললাম,‘ বাবা আমিও আছি।’ চোখ বন্ধ করেই ঘাড় নাড়ল বাবা।
বড় সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালে প্রবেশ করার সাথে সাথে মনে হল যেন অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করেছি। উৎসবের নাম গন্ধও নেই হেথায়। ঝাঁ চকচকে মহার্ঘ চত্বর জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে শুধুই রোগব্যাধির গন্ধ আর চাপা দীর্ঘশ্বাস। বড় পেশাদার এরা। নামে সেবা সদন হলেও, সেবার প্রবেশ নিষেধ হেথায়। দরকারী সইসাবুদ করে, টাকাপয়সা মিটিয়ে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হল স্ক্যান রুমের সামনে। রবিও এসেছে আমার সাথে সাথে। শুয়েই আছে বাবা। হাতে চলেই যাচ্ছে স্যালাইন। রবিকে বলে পাঁচ মিনিটের জন্য বাইরে বেরালাম আমি। এক বোতল জল না কিনলেই নয়। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পাঁচশ মিলিলিটার জল কিনলাম আমি। কে জানে কি আছে এতে, হয়তো মেশানো আছে কয়েক ফোঁটা তরল সোনা।
ঠাণ্ডা জলের বোতলটা হাতে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বাবার কাছে। আরো একটু সময় লাগবে বাবার নম্বর আসতে। লম্বা ফাঁকা করিডোরে আপাততঃ বাবা আর আমি। উদাস চোখে নকল শিলিং এর দিকে তাকিয়েছিল বাবা। আমি গিয়ে দাঁড়াতে চোখ নামিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর চোখ জোড়া ঘুরে গেল আমার হাতের জলের ভর্তি বোতলটার দিকে। লোভে চকচক করে উঠল দুই চোখ। তারপর শুয়ে থাকা অবস্থায় এদিক ওদিক যতটা চোখ যায় মাথা ঘুরিয়ে দেখে, ফিসফিস করে বলল,‘ হাঁ করছি। ছিপি খুলে চটপট একটু ঢেলে দে তো।’ দীর্ঘ নদিন ধরে জলও খেতে দেয়নি ওরা বাবাকে। নয়দিনের তৃষ্ণার্ত বৃদ্ধকে না বলা যে সন্তান হিসেবে কতখানি দুষ্কর, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। তবুও না বলতেই হয়। প্রিয়জনের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য কত পাপই যে করতে হয় হাসি মুখে।
শুকনো অপরাধী মুখে নকল হাসি এনে বলতে হয়,‘তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। তরপর যত ইচ্ছে জল খেও। ’ যে বলে, আর যে শোনে দুজোড়া ফুসফুস নিঙড়েই বেরিয়ে আসে হাহাকার মাখা দীর্ঘশ্বাস। ভারি হয়ে ওঠে মূল্যবান হাসপাতালের আপাত জনশূণ্য এই করিডোর। বেশ কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর অনদিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে, ভেজা স্বরে বৃদ্ধ বলে,‘সুস্থ কি আর কোনদিন হবো? মনে হয় না। ’
ঠিক সেই মুহূর্তে ঐ একই নেগেটিভ অনুভূতিতেই মাখামাখি ছিল আমারও মন আর মাথা, আমারও সমস্ত জগৎ জুড়ে নামছিল হতাশার প্রগাঢ় আঁধার। বৃদ্ধের মুখের কথাগুলো যেন চাবুকের মত এসে পড়ল মুখের ওপর। অ্যাসিডের মত, গোড়া থেকে পুড়িয়ে দিল যত সব নেগেটিভ চিন্তার আগাছা। কোথা থেকে যে ভেসে এল এত পজিটিভ এনার্জি। লোকটার শুকনো খসখসে হাতটা চেপে ধরে, প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, ‘সুস্থ তোমাকে হতেই হবে বাবা। সুস্থ তুমি হবেই। বাজি ধরবে?’ বললাম, আপদ হাসপাতাল আর ডাক্তার যাই বলুক, সুস্থ হয়ে বাড়ি তুমি ফিরবেই। তোমার বাপের ভিটে, যার প্রতি তোমার ভালোবাসা আর টান তুত্তুরীর থেকেও প্রবল, সেখানে আবার প্রতিষ্ঠিত হবে তোমার সর্বাঙ্গীণ কতৃত্ব। এতদিনের অভুক্ত থাকা আর শুয়ে থাকার ফলে পেশীগত জোর কতটা ফিরে আসবে জানি না, কিন্তু তোমার বিক্রম ফিরে আসবে হুড়মুড় করে প্রবল বিক্রমে। আবার মায়ের সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে তুমি। ধমকে থামিয়ে দেবে পিসিকে। ঘন্টা খানেক ধরে ফোনে খোশগল্প করবে আবার আমার শ্বশুরমশাইয়ের সাথে। আবার জমিয়ে তুলবে চাটুজ্জে বাড়ির মধ্যরাত্রির আসর। আবার গল্প শোনাবে বুল্লু আর তুত্তুরীকে। সব হবে বাবা। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আবার পালন করব আমরা তোমার জন্মদিন। হৈহৈ করে কেক কাটব সবাই মিলে। শুনতে শুনতে হঠাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সবেগে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল বৃদ্ধ। চোখের ওপর চাপা দিল অস্থিচর্মসার একখান হাত, তারপর ধরা গলায় আমায় ধমকে বলল,‘স্তোকবাক্য দিস না। ওদিকে গিয়ে বোস। ’ সেদিন বলতে পারিনি, তবে আজ বৃদ্ধের ৮২ তম জন্মদিনে এসে তো বলতেই পারি, স্তোকবাক্য দিইনি বাবা, সমস্তটাই ছিল আমার ইনট্যুশন। আর যাদের ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি তাদের ক্ষেত্রে আমার ইনট্যুশন যে কতখানি অব্যর্থ তা কি তুমি জানতে না।
শুভ জন্মদিন বাবা। বারবার ঘুরে ঘুরে আসুক আজকের দিনটা। বটগাছ হয়ে আমাদের জড়িয়ে থাকো আরও বহু বহু বছর। এত এত ভালোবাসি তোমায়, তবুও মনে হয়, খুব খারাপ সন্তান আমি, তোমার যে আরো অনেক অনেক বেশি ভালোবাসা প্রাপ্য ছিল বাবা।
No comments:
Post a Comment