Saturday, 11 December 2021

অনির ডাইরি, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২১

 


‘হ্যালো, তোমরা কি বেরোলে?’ ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা হ্যাংলা আওয়াজটা দিল মটকা গরম করে। সকাল থেকে দম ফেলার ফুরসৎ পাইনি, দুদিনের জন্য সংসার ফেলে যেতে হলেও কেন যে এত মালপত্র গোছাতে হয়? তারওপর সব দরজায় চাবি দেওয়া, সব জানলা বন্ধ করা, শ্রীমতী তুত্তুরীকে রেডি করা। সক্কাল সক্কাল তাঁর ব্যাগ গোছাতে গিয়ে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে এসেছে গা গুলিয়ে। কি বোঁটকা গন্ধ আলমারিতে। নির্ঘাত পরা জামাকাপড়ই তুলে রেখেছে ভিতরে। তুলে মানে পাট করে ভাবলেন কি? আজ্ঞে না মশাই, জাস্ট পাকিয়ে দলামোচড়া করে ঠেসে ঢুকিয়ে রাখা। 


যাই হোক, একটু ঝেঁঝেই বললাম, ‘আঃ বারবার ফোন করছ কেন? বেরিয়ে, গাড়িতে উঠে ফোন করব বলেছি তো!’ ওপারের হ্যাংলা স্বরটা কিঞ্চিৎ  আশাহত শোনাল, ‘অঃ। এখনও তমলুক থেকে বেরোওনি? আমি ভাবলাম কদমতলা বাজার বা সাঁতরাগাছিতে আছ বুঝি।’ কি করে যে বাবা এরকম ভেবে নেয় জানি না। সকাল এগারোটা নাগাদ আপিসে ঢুঁ মেরে মেয়ে বগলে বেরোব জানিয়েই রেখেছিলাম। তাও-। একগাদা পেনশন কেস নিয়ে যাব মহানগর। বলেছিলাম যা পড়ে আছে, সব নিয়ে যাব। রাজীব, অরূপ আর কারা যেন বলল, ‘ম্যাডাম সব মিলিয়ে পনেরো কেজি হবে। ’ ১৫কেজি পেনশন বইবার ক্ষমতা আমার বা আপিসের গাড়ি কারোরই নেই। মাপজোখ  করে তিন-চার কেজি দিয়েছে ওরা।


সব গুছিয়ে, মেয়ে,মেয়ের প্লাস্টিক (বলা তো যায় না, এককালে গাড়িতে উঠলেই বমি করত তুত্তুরী। সরকারী গাড়িতে বোমো বাচ্ছা তুললে তার মুখে রবি ঠাকুরের দাড়ির মত প্লাস্টিক বাঁধি আমি) নিয়ে বেরোলাম যখন সাড়ে এগারো। মানভঞ্জনের জন্য ফোন লাগালাম বৃদ্ধকে,‘ বেরিয়েছ? সবে? কখন পৌঁছাবে? এসে আবার আপিসও যাবে?’ বাবার সাথে কথা বলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, বাবাই প্রশ্ন করে এবং বাবাই উত্তর দেয়। বাবা বনাম বাবার মধ্যে সবেগে ঢুকে নিজের সমস্যা বা নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে বসলে, অমনি বাবা টেনে আনে তাদের বা ক্ষেত্র বিশেষে পিতামহের সময়কালের কোন ঘটনা। রঙ্গ রসিকতার মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বোঝায়, আমার অভিজ্ঞতা বা অনুভব সে যত তিক্ত বা যতই রসাল হোক না কেন, তা অভূতপূর্ব মোটেই নয়। অগণিত বার বাবার এই টোটকায় হারানো আশা বা উদ্যম ফিরে পেয়েছি আমি, আজ তেমন দিন নয়, তাই বৃদ্ধকে মাঝপথে থামিয়ে জানতে চাইলাম আমার মা জননী কোথায়? সকাল থেকে একটি বারও তাঁর কণ্ঠস্বর শুনিনি কেন?


মা মোটেই অন্তঃপুরবাসিনী বা পর্দানশীন নয়, তবে বাবা আর আমার বাক্যালাপ থেকে বরাবরই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। সর্বোপরি মায়ের একটা অদ্ভূত প্রতিভা আছে, যখনই কেউ ফোন করে, মা, বাবার সামনেই বসে থাকে বা আসেপাশে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু ঠিক যেই মুহূর্তে টেলিফোনরত ব্যক্তিটি মায়ের সাথে দুটি কুশল বিনিময়ের আকাঙ্ক্ষা জাহির করেন, কিভাবে যেন ঠিক তখুনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্য কোথাও চলে যায় মা। আবার মাকে ফোনে না চাইলেও গোঁসা করে মা। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। মা কই, প্রশ্ন করার সাথে সাথে বিকট হল্লা শুনতে পেলাম হাওড়া থেকে তাম্রলিপ্ত। ‘ওগো তুমি কোথায়-’।  বাবার গলা দূরভাষ ছাড়াও দিব্যি শোনা যায় এই সব মুহূর্তে। 


ওদিক থেকে কোন জবাব আসে না। বেশ খানিকক্ষণ হৈচৈ করে অবশেষে ফোনের ক্যামেরাটা অন করে বাবা, দেখি দূরে দালানের বেসিনে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে মা। ঘাড় নেড়ে ইশারায় বলছে, অপেক্ষা করতে। স্বভাবসিদ্ধ রসাল সুরে বাবা বলে,‘দেখতে পাচ্ছ?তোমার গর্ভধারিণী কি কচ্ছেন? তেনাকে ফোন ধরতে বললেই তেনার দর কি রকম বেড়ে যায়? ইঁদুরে গু(আমরা একে ঘটি, তায় হাওড়ার বাসিন্দা ফলতঃ এই শব্দটি আদৌ অপশব্দ  নয় আমাদের কাছে) থেকে কিছু রোগের ওষুধ তৈরি হয়। এখন ইঁদুর যদি সেটা জানতে পারে,তাহলে তাদের পায়া ভারি হয়ে যায়। বুঝলে কি না। রোজ রান্নাঘরে ইয়ে(আসল শব্দটা সেন্সর করলাম) করে যায়, অথচ সেদিন সে গাড়ু নিয়ে যায় তিনতলার ঠাকুরঘরে ইয়ে( আবার বিপ্ এবং সেন্সর্ড) করতে। তোমার মায়ের হল তেমনি অবস্থা। এতক্ষণ আমার সামনে গালে হাত দিয়ে বসে মুচকি মুচকি হাসছিলেন, ঠিক তুমি চাইলে তার আগের মুহূর্তে ওণার মনে হল জলখাবারের বাসনগুলো মেজে আসি।তারপর বাসন মাজতে গিয়ে মনে হল, মাজবই যখন, তখন বাসনের সাথে সাথে দাঁতটাও আরেকবার মেজেনি।’ প্রবল হাসতে হাসতে ফোন কাটলাম। কোলাঘাট ব্রিজের ওপর দিয়ে লেজ তুলে  ছুটছে গাড়ি, তলায় চিকচিকে রূপালী রূপনারায়ণ নদ। নদ পেরোলেই আমার জেলা, আর একটু এগোলেই আমার শহর। প্রিয় শহর, আর একটু ধৈর্য ধরো। আসছি আমি, তোমার সব রূপ-রস-গন্ধ পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নিতে। আবার কবে সুযোগ দেবে সময় কে জানে? আর কতদিন সুযোগ দেবে, কে জানে?তবে আজ মোটেই তা ভাবতে বসব না। আজ মোটেই মনখারাপের দিন না-

No comments:

Post a Comment