Saturday, 4 December 2021

অনির ডাইরি ১লা ডিসেম্বর, ২০২১

 


#সব_চরিত্র_কাল্পনিক


সে অনেককাল আগের কথা। তারপর কত্ত কি হল, বারো বছরের বনবাস, এক বছরের অজ্ঞাতবাস, আরো না জানে কত, কত কি। সেদিনও এমনিই মিঠে রোদ উঠেছিল। বাতাসে ছিল হাল্কা হিমেল স্পর্শ। অল্প ধোঁয়াশা-কুয়াশা মাখা মহানগর জুড়ে কেমন যেন উৎসবের গন্ধ। রামধনু রঙা পশম আর পশমী পোশাকের পসরা সাজিয়ে ওয়েলিংটনে বসেছিল একেবারে পুতুলের মত দেখতে ভুটিয়া নরনারীর দল, ময়দানে বাঁশ বাঁধছিল যেন কারা, মেলা বসবে যে।  


সেজে গুজে, সবথেকে ভালো জামাটা পরে বেরোল যখন মেয়েটা, ঘড়ি বলছে বেলা এগারো। সাজতেও তেমন জানত নাকি মেয়েটা? সাজ বলতে তো সেই ল্যাকমের ক্লেনজিং মিল্ক, আয়ুরের গোলাপী টোনার আর ভ্যাজলিন বডি লোশন। তাই মুখে মাখত মেয়েটা। তার ওপরে ল্যাকমের সানস্ক্রিন, চোখে ল্যাকমেরই কালো আইলাইনার আর ঠোঁটে লিপস্টিক। লিপস্টিকও একটাই ছিল মেয়েটার। গোলাপী রঙের। ভাগ্যে অমন সুন্দর সোনালী পশমী রোদ উঠেছিল, তাই না অমন অপরূপা লাগছিল মেয়েটাকে। অন্তত মেয়েটার তাই মনে হয়েছিল বটে সেদিন, ‘আমি অপরূপা। আমি অতুলনীয়া।’ সবই মরশুমের দোষ মশাই। 


হেঁটে হাওড়া ময়দান। সেখান থেকে বৈষ্ণবঘাটা মিনি। থিয়েটার রোডে নামবে মেয়েটা। প্রতীক্ষা করছে কেউ। এর আগে একবার দেখা হয়েছিল বটে, সে আরো অনেককাল আগের কথা। ভালো করে আলাপ পরিচয় কিছুই তেমন হয়নি। ছেলেটাকে হেব্বি নাক উঁচু মনে হয়েছিল মেয়েটার। বড় বেশী সবজান্তা। জানিস তো জানিস, তাই বলে দেখানোর কি আছে রে ভাই। না হয় তুই সোনারটুকরো, আমি ঢিপচালতি গোবরগণেশ। তাই বলে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কি আছে? কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া, গোবরগণেশকে গোবরগণেশ বলতে নেই, এটাও জানিস না? 


তবে সে সব অবশ্যি, এখন অতীত। বিগত কয়েকমাসে দূরভাষের মাধ্যমে বন্ধুত্ব বেশ ভালোই হয়েছে উভয়ের। প্রাথমিক খোলস, সঙ্কোচের বাঁধন খোলার পর দুজনেই তাজ্জব হয়ে গেছে। বড় বেশী রকম মিল উভয়ের মধ্যে। কোথাও যেন মিলে যায়, অনুরণন সৃষ্টি করে উভয়ের হৃদয়ের তরঙ্গ। যেমন যেমন ঘুঁচেছে হৃদয়ের দূরত্ব, তেমনি তিল তিল করে ফুলে উঠেছে মেয়েটা। বাড়িয়ে ফেলেছে বেশ কয়েককেজি ওজন। কে জানে ছেলেটা ওকে চিনতে পারবে কি না। কথাটা তুলেওছিল আগের রাতের আলাপে, উল্টোদিক থেকে জবাব এসেছে, ‘মানুষ মোটা হয় কি করে? এক জোড়া জুতো কিনে, দৌড়তে শুরু করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ’ বলেছিলাম না, বেশ আঁতেল আর অনেকটা কাঠখোট্টা ছেলেটা। 


থিয়েটার রোডের বেশ খানিক আগেই নামিয়ে দেয় বাসটা। সাহারা সদনের সামনে দাঁড়াবে ছেলেটা, দুরুদুরু বুকে হাঁটতে থাকে মেয়েটা। রাস্তা পেরিয়ে মুখোমুখি হয় তার সাথে, একটা সাদা ঢলঢলে গেঞ্জি আর সবজে প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাতে রোল পাকানো কাগজের বাণ্ডিল। ইতিউতি তাকিয়ে বোধহয় মেয়েটাকেই খুঁজছিল ছেলেটা। সামনে গিয়ে হাত নাড়তে সম্বিত ফিরে পেল ছেলেটা। অদূরে আরেক স্থূলাঙ্গিনীকে দেখিয়ে নার্ভাস ভাবে বলল,‘ আমি তো ভাবছিলাম ঐটা তুমি।’ 


বাকি গল্পটার সাক্ষী মহানগর, সাক্ষী রবীন্দ্রসদন আর নন্দনচত্বর। সাক্ষী ঋতুপর্ণা-সাহেব চ্যাটার্জি আর জয় সেনগুপ্তর ‘চতুরঙ্গ’। সাক্ষী একাডেমির পিছনের ছোট্ট ক্যান্টিন। আর সাক্ষী ধর্মতলা, নন্দন থেকে হাঁটিয়ে ধর্মতলা নিয়ে এসেছিল ছেলেটি। ততোক্ষণে অস্ত গেছেন সূয্যি মামা। জ্বলে উঠেছে মহানগরীর বুকের ওপর শতেক আলোকমালা। বেশ কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে গুটি কয়েক ফাজিল বন্ধুবান্ধবের দল। ছেলেটি শুধু একবার জানতে চেয়েছিল, ‘আমার সাথে দেখা করতে এসেছো, এটা জানে না, এমন কেউ আছে?’ বাসে তুলে দিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা। ক্লান্ত মেয়েটার মুখে তখন কয়েক হাজার ওয়াটের দ্যুতি। বাসে স্টার্ট দিল ড্রাইভার,কন্ডাকটর হাঁক পাড়ল ,‘হাওড়া-হাওড়া। বেবোন রোড- হাওড়া স্টিশন-ময়দান-কদমতলা। ’ হাত নাড়ল মেয়েটা। ঘুরিয়ে হাত নাড়ল না ছেলেটা, সামান্য মাথা নাড়ল শুধু। তারপর আলগোছে থুতনি চুলকে বলল,‘আরেকটু জোরে হাঁটা প্রাকটিশ করো। বড্ড আস্তে হাঁটো।’ এবং ‘মানুষ যে কি করে, মোটা হয়?’


আবারও বলছি কিন্তু, সব চরিত্র নিছক কাল্পনিক।

No comments:

Post a Comment