Saturday, 1 January 2022

অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 অনির ডাইরি ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২১

#তাম্রলিপ্তকড়চা


বাড়িটা মম করছে টাটকা ফুলের সৌরভে। বিগত দুদিন ধরে যেখানেই গেছি, সে ময়না হোক বা নন্দকুমার,চণ্ডীপুর হোক বা শহীদ মাতঙ্গিনী- তাজা ফুলের স্তবক দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে এজেন্ট আর এসএলওরা। যত বলি, এতো প্রথম আলাপ নয়, এর আগেও মিলিত হয়েছি আমরা, আমার চেম্বারে। তারপর একপ্রস্থ ট্রেনিং হয়েছে পোর্টালের নতুন মডিউল নিয়ে, তাহলে আবার কেন? আর আমি তো অতিথি না, আমি তো তোমাদেরই লোক। ঠিক যেমন, তোমরা আমার লোক। 


শুরু করেছিল ময়না। ময়না আমার সবথেকে অবহেলিত ব্লক। একে তো তমলুক শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূর, প্রায় পশ্চিম মেদিনীপুর লাগোয়া, তারওপর দীর্ঘদিন যাবৎ নেই কোন পাকাপাকি ইন্সপেক্টর, নেই কোন কন্ট্রাকচুয়াল ক্লার্কও। এতদিন অতিরিক্ত দায়িত্বভার সামলাতেন যে ইন্সপেক্টর, সাম্প্রতিক অর্ডারে বদলি হয়ে যাবেন তিনিও। আবার নতুন কারোর ঘাড়ে চাপবে ময়না। 


সদ্য বদলি হয়ে এসেছি নতুন জেলায়, এর মধ্যেই বদলি হয়ে যাচ্ছেন চার জন ইন্সপেক্টর সাহেব। ওদিকে ৪৮ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যাবে দুয়ারে সরকার। চাপা উৎকন্ঠায় ভুগছিলাম, তাই ভাবলাম যাই একবার সামনা-সামনি দেখেই আসি, কতটা প্রস্তুত সবাই। ভেবেছিলাম ময়নার লোকজন হয়তো ক্ষেপে থাকবে, গেলেই উজাড় করে দেবে নালিশের ঝাঁপি। বদলে পেলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা। টুকরো নালিশ যে ছিটকে আসেনি তা নয়, ওটুকু ও না হলে সন্দেহ হত, ব্যাটারা কাজের কিস্যু জানে কি না। গিয়েছিলাম এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে, ফিরলাম আশ্বস্ত হয়ে। 


এবার নন্দকুমারের পালা। এদের একটু বকলাম অবশ্য, এতদূর এসেছি, ময়না থেকে আবার তমলুক ফিরে উল্টোদিকে যেতে হয় নন্দকুমার। একটু না বকাবকি করলে কেমন যেন গা ম্যাজম্যাজ করে। বদলে নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রণজিৎ একবাটি ছানার পায়েস খাওয়াল। ‘খান না ম্যাডাম, এখেনে এটা খুব ভালো বানায়। আমরা প্রায়ই খাই, ইয়ে খেলে মাথা ঠাণ্ডা হবে।’ বলি রসমালাইকে ছানার পায়েস বলে খাওয়ালে পৃথিবীর কারো মাথা ঠান্ডা হয়? যত বলি, এটা ছানার পায়েস না, এটা রস মালাই। এই তো পুঁচকে পুঁচকে একপাল রসগোল্লার বাচ্ছা সাঁতার কাটছে ঘন দুধে। বললে শুনছেই বা কে আর মানছেই বা কে? রঞ্জিত সমানে লড়ে গেল, ' না ম্যাডাম, এটা ছানার পায়েসই। রসমালাই তো ওই গুলো, লম্বা লম্বা রসগোল্লা, ঘন দুধে ভেসে থাকে-।' আপদ ওই বস্তুটাকে যে ক্ষীর চমচম বা মালাই চমচম বলে, সেটা তখন আর মাথায় আসেনি। নাহলে ছাড়তামই না ব্যাটাকে।


নন্দকুমারের পর চণ্ডীপুরের পালা। দীঘা যাবার রাস্তা ধরে, হলদি নদী টপকে খানিক গেলেই চণ্ডীপুর ব্লক। হলদি নদীর পাড়ে, বিশাল গঙ্গা মন্দির। মকর সংক্রান্তিতে নাকি মস্ত মেলা বসে এখানে। আসন্ন মেলার প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে, রাস্তার ওপর বাঁধা চলছে সুদৃশ্য তোরণ। পথে পড়ে ছোট্ট রেলস্টেশন, নাম ‘লবণ সত্যাগ্রহ’। এই জেলায় যদি এমন স্টেশন না থাকবে তাহলে থাকে কোথায়। 


বদলী হয়ে যখন এই জেলায় আসি,কে না সতর্ক করেনি। ‘খুব সাবধান। পূর্ব মেদিনীপুর কিন্তু হুগলী নয়। চুঁচুড়ার বদান্যতা, আনুগত্য এই জেলায় আশাও করো না।’ নাঃ আমি আশা করিনি। কেন করব? এই জেলাটা তো হুগলী নয়। এখানকার মানুষজনই বা কেন হুগলীর মানুষের মত হবে। 


গাঙ্গেয় বঙ্গের অধিবাসীরা যতই তাচ্ছিল্য করুক, কিচ্ছু যায় আসে না এই জেলার। এই জেলার চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা বলেই হয়তো অনেক বেশি লড়াকু এখানকার মানুষজন। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জেলা যার সীমান্ত বরাবর খোলাখুলি আড়ামোড়া ভাঙে স্বয়ং বঙ্গোপসাগর। জেলা জুড়ে জড়িয়ে আছে কত যে রাজবাড়ি আর তাদের অজানা ইতিহাস। বিশ্বাস হচ্ছে না তো?  তমলুক,মহিষাদল, কাজলাগড়, পাঁচেতগড়, ময়না।  পাঁচটা রাজবাড়ির হাল হকিকৎ তো এখুনি কড় গুনে বলে দিতে পারি। আর স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা যদি বলেন, তো এই জেলার ধারে কাছে বর্তমান এপার বঙ্গের কোন জেলা আসবে মশাই? ' ভারত ছাড়' আন্দোলনের সময় আক্ষরিক অর্থে মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল এই জেলা। এই তো গত ১৭ই ডিসেম্বর তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের ৭৯তম জয়ন্তী পালিত হল।


চণ্ডীপুরের পর শহীদ মাতঙ্গিনীর পালা। এখানকারই মেয়েছিলেন কিনা তিনি। ব্লক চত্বরে রয়েছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি। বছর শেষের পড়ন্ত রোদে, তাঁর মূর্তির সামনে ক্ষণিক দাঁড়ালাম আমরা, কাকতলীয় ভাবে এই ব্লকের এজেন্ট এসএলও দের মধ্যে মহিলারাই সংখ্যা গরিষ্ঠ, মেয়েদের মধ্যেও আবার অল্প বয়সীদের থেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের সংখ্যা বেশ বেশি। বলে দিতে হয় না, এটা গান্ধীবুড়ির মহল্লা। দিদিদের মধ্যে অনেকেই কাজে ঢুকেছেন এই সহস্রাব্দের শুরুতে। তারপর কত কি ঘটে গেছে, বদলে গেছে স্কিম, উঠে গেছে মোটকা সাবেকি লেজার খাতা, এসেছে- গেছে একাধিক সাইট, বদলাননি শুধু এখানকার দিদিরা। জনৈক দিদি গল্প শোনাচ্ছিলেন এ বছরের মত বন্যা দীর্ঘদিন দেখেনি গান্ধীবুড়ির ব্লক। খোদ ব্লক অফিসটাই দীর্ঘদিন ছিল আধ ডোবা হয়ে। তারই মধ্যে কাজে আসতেন তাঁরা। এক হাঁটু জল ঠেলে। খুব সাদামাটা ভাবে বললেন, 'হাঁটুর ওপর জল ম্যাডাম। ল্যাট্রিন অবধি জলের তলায়। ওই জল ঠেলে এলি কি পা চুলকাইত।' পাশ থেকে ইনস্পেক্টর সাহেব বললেন, 'পচা জল তো ম্যাডাম। বিডিও অফিস থেকে কিছু গামবুট দেওয়া হয়েছিল , তবে সে তো আর -'। বুঝলাম, উনি পাননি। পাবার কথাও নয়। তাজ্জব আমি প্রশ্ন করলাম, ' শাড়ি পরেই আসতেন? মানে ভিজে শাড়ি লটপট করতে করতে?' ওনারা হেসে মুখে চাপা দিলেন, ' হায় ম্যাডাম কি যে বলেন, শাড়ি পরবুনি?'

No comments:

Post a Comment