রূপনারায়ণ নদে তখন পূর্ণ জোয়ার। আমরা চলেছি স্রোতের বিপরীতে, মাঝ নদী বরাবর। ঘড়ি বলছে সময় ঠিক মধ্যাহ্ন, শেষ ডিসেম্বরের রেশমী রোদ মোটেই গা জ্বালানো নয়। বরং বেশ মনোরম।উত্তুরে বাতাসে হালকা হিমেল ভাব। ফোলানো স্পিড বোটে নৌকা বিহারে বেরিয়েছি আমরা। নদীর বিপরীত দিকে হাওড়া জেলার তটভূমি আপাততঃ হাল্কা কুয়াশার চাদরে মোড়া। মুছে যাওয়া তটভূমির জন্যই কেন জানি না, বেশ সমুদ্দুর মার্কা একটা অনুভূতি হচ্ছিল আমাদের।
বলাতে শৌভিক বলল, কিছুদিন আগে কারা যেন এমনিই বোটে চড়ে সমুদ্রে গিয়েছিল, সমুদ্রের তিন চার কিলোমিটার ভিতরে গিয়ে আচমকা খারাপ হয়ে যায় বোট। পাক্কা দেড় ঘন্টা তারা, চড়া রোদে মাঝ সমুদ্রে বসেছিল ওমনি খারাপ হয়ে যাওয়া বোটে। এক্কেবারে হিচকক সাহেবের 'লাইফবোট' এর মত কেস আর কি।
বলতে না বলতেই বন্ধ হয়ে গেল আমাদের বোট খানা। খুব এক চোট দাঁত কিড়মিড় করলাম আমি, কোন সময় কোন কথাটা বলতে নেই, সেটাও জানে না মাইরি। তারপর আর কি, বিস্তর খোঁচাখুঁচি, টানা হ্যাজরা এবং হে ঠাকুর এবারের মত তরিয়ে দাও প্রভু। আমাদের দেরী দেখে অনেকটা এগিয়েও পিছিয়ে এল আরেকটা বোট। তবে খুব কাছে এলো না। মোচার খোলার মত ফোলানো বোট কি না, চলমান বোটের ঢেউ এর ধাক্কায় না হলে উল্টে যাবে যে।
আমরা সাকুল্যে নয় জন। পাঁচটা লেবার, একটা এক্সিকিউটিভ আর তিনটে ছানা। এত লোক তো আর একটা ফোলানো বোটে ধরে না, তাই ভাগ করে উঠেছি আমরা। আমাদের বোটটা ছাড়ার সময় ও বেগড়বাই করছিল। বন্যার পর থেকে গুদামজাত হয়ে পড়ে থেকে নাকি কি একটা সুইচ বসে গেছে। একটা পিন বা পেরেক না পেলে তাকে তোলা যাচ্ছিল না। বিরক্ত হয়ে শৌভিক বলল, 'এই মনোরঞ্জন তোমার রিভলভারটা এনেছ?' মনোরঞ্জন ওরফে মনা হল মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। তাঁর পকেটে সবসময়ই একখানা বন্দুক আর গাড়িতে দুখানা জবরদস্ত লাঠি থাকে বটে।
মনা তো হেসেই অস্থির। আমরা সমস্বরে হাঁ হাঁ করে উঠলাম, কাকে গুলি করবে? বোটটাকে? দুই বোটম্যান তড়িঘড়ি বলে উঠল, 'গুলি করলে আর চলবেই নি স্যার।' যাই হোক তখন মোনার বন্দুকের ভয়ে দৌড়েছিল বটে, এখন এই মাঝ দরিয়ায় তো আর মনা নেই। তাহলে কি হবে? বাড়ি ফিরব কি করে? বোট চালকদের অবশ্যি কোন হেলদোল নেই। ওরা জলের বোতল আর কেকের প্যাকেট নিয়েই উঠেছে। আবার শুরু করল টানাটানি।
কান টানলে মাথা আসার মত, বিস্তর টানাটানির পর অবশেষে ছুটতে শুরু করলেন তিনি। এবার আবার স্রোতের বিপরীতে এমন জোরে ছুটতে লাগলেন যে রীতিমত ঢেউয়ের তালে উঠতে এবং নামতে লাগলাম আমরা। জলের ছিটেয় অর্ধেক ভিজেই গেলাম বিদিশা দি আর আমি। আর তুত্তুরী বলল, 'উফঃ কি গদাগুম রাইড হচ্ছে মাইরি। বাড়ি ফিরেই দাদুকে বলব-'।
No comments:
Post a Comment