Thursday, 9 December 2021

অনির ডাইরি, ৯ই ডিসেম্বর, ২০১৮

 বন্ধুবান্ধব কোনদিনই তেমন ছিল না। তাতে অবশ্য সহপাঠী বা পাড়াতুতো সমবয়স্কদের কোন দোষ ছিল না।  ভয়ানক অমিশুক ছিলাম আমি।হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া কাউকেই যেন তেমন পছন্দ হত না। সুযোগ পেলেই স্কুলে ডুব। কলেজে তো কহতব্য নয়। কোনমতে উপস্থিতির হারটুকু বজায় ছিল। 

আসলে বাইরে বন্ধু খোঁজার কখনও প্রয়োজনই হয়নি। বাবা ছিল যে। “আজ আর অফিস যেও না বাবা” আব্দার করলেই হল, কত যে ছুটি নিত বাবা। বেতন কাটার পরিস্থিতি যতক্ষণ না আসত, আমার আব্দার রাখতে পিছপা হত না বাবা। রিটায়ার করার সময় লিভ স্যালারি বাবদ এক নয়া পয়সাও পায়নি।

গ্রীষ্মের আগুন ঝরানো দুপুরে কাঠের খড়খড়ি বন্ধ করে,ঘড়ঘড়ে ডিসি পাখার তলায়, ঠাকুমার ঠাকুরদাদার সুবিশাল বার্মাটিকের পালিমচটা খাটে জমত আড্ডা। খড়খড়ির ফুটো দিয়ে গুড়িগুড়ি সৌরশ্মি ঢুকে আসত আমাদের গল্প শুনতে। শীতে কাঠপাল্লা খুলে,বন্ধ করা হত কাঁচের তিনপাল্লা। দুষ্টু উত্তরে হাওয়া ঠকঠকিয়ে প্রবেশাধিকার চাইত।শীতে  চাদর লেপ সহযোগে ইগলু বানাত বাবা। ইগলুর মধ্যে ঢুকে কল্পনা করতাম আমরা হলাম এস্কিমো। আর ঘোর বর্ষায়? পশ্চিমের জানলা দিয়ে অনুপ্রবেশকারী মিহি জলকণা আর ভেজা বাগানের সোঁদা সোঁদা গন্ধ রচনা করত অ্যামাজন অরণ্যের রহস্যময়তা। 

কি নিয়ে গল্প হত না?বাবা মানে  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর হিটলার(প্রসঙ্গত বাবার ডাকনামটাও হিটলার), ১৯৪৩এর “ভাত দাও মা- ফ্যান দাও মা” দুর্ভিক্ষের হাহাকার। তীব্র অনাহারে কঙ্কালসার মৃতা রমণীর শুষ্কস্তন কামড়ে ধরে মৃত শিশুর ছবি গুগল দেখাবার অনেক আগে দেখেছিলাম বাবার চোখ দিয়ে। বাবা মানে “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে”র হুঙ্কার আর রক্তপাত। বাবা মানে প্রথম স্বাধীনতার ভোর, বেতারে পণ্ডিত নেহেরুর ঐতিহাসিক ভাষণ।স্বাধীনদেশের মুক্ত বাতাসে উড্ডিয়মান তেরঙা।  বাবা মানে খাদ্য-আন্দোলন, বিমলা-অমিয়া-প্রতিভা দিবস পালন, বাবা মানে বেলিলিয়াস স্কুল আর নরসিংহ দত্ত কলেজ,বাবা মানে আগুনে সত্তর। বাবা মানে বরানগরের গঙ্গার লালচে জল। বাবা মানেই মার্ক্স-এঙ্গেলস্- লেনিন-স্ট্যালিন-মাও।  বাবা মানেই নকশালবাড়ি- বাবা মানেই মায়ের মাধবীলতা হয়ে ওঠা-বাবা মানে ঠিক মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের কণ্ঠে ঘোষিত জরুরী অবস্থা, বাবা মানে ধরে ধরে জবরদস্তি নাসবন্দীর গল্প, বাবা মানে শান্তির আশির দশক,রেশনের চাল-চিনি, গম ভাঙানো গরম আটা, বন্ধ হতে থাকা কলকারখানা, কলকাতায় রিলায়েন্স কাপ, বাবা মানে ভেঙে পড়া বাবরি মসজিদ, প্রথম কার্ফু,টহলদার সাঁজোয়া গাড়ি, বাবা মানে হার না মানার অদম্য জেদ- বাবা মানেই চারমিনার(এখন অবশ্য ফ্লেক্স দিনে দুই থেকে আড়াই প্যাকেট,এমনকি তিনও হয় মাঝেসাঝে )- বাবা মানেই খকখকে কাশি- বাবা মানেই গড ফাদার(সেই যে প্রতিশোধ বাসি হলে মিষ্টি হয়)- বাবা মানেই পথের পাঁচালী,কাঞ্চনজঙ্ঘা, বাইশে শ্রাবণ-ভুবন সোম-বাবা মানেই শাম্মী কাপুর ,তিসরি মঞ্জিল- বাবা মানেই নিউ মার্কেট- বাবা মানেই মোহনবাগান- বাবা মানেই শৌভিক আর আমার নিরন্তর ঘটি-বাঙালের দ্বৈরথ। বাবা মানে হারিয়ে যাওয় ছেলেবেলা-বাবা মানে মূলের সাথে জুড়ে থাকা।সর্বোপরি বাবা মানে নিরন্তর হারিয়ে ফেলার ভয়, শুভ জন্মদিন বাবা। বড় বেশী ভালোবাসি তোমায়, আজও-

No comments:

Post a Comment