Sunday 19 December 2021

অনির ডাইরি ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২১

 


যবে থেকে তাম্রলিপ্তে বসতি পত্তন করেছি, জনে জনে শুধু ডেকেই গেছি। এসো না গো, দুদণ্ড জিরোতে। আমাদের সাথে হাসিমজার কটা মুহূর্ত কাটাতে। কে নেই সেই তালিকায়, উভয়ের আত্মীয়স্বজন, যৌথ বন্ধুবান্ধব, উভয়ের সার্ভিস তুতো দাদা-দিদি, ভাই-বনু। মোট কথা যাদের সাথেই সুর বা তালে মিলেছে, মিলেছে লয় এবং ছন্দে তাদেরই আহ্বান করেছি আমরা। আমরা না হয় নাই যেতে পারি মহানগর, মহানাগরিকরাই নাহয় একটু কষ্ট করে আসুক আমাদের কাছে। 


কি ভালো মাছ পাওয়া যায় এই জেলায়। রোজকার রুই-কাতলা-ভেটকিও স্বাদে অতুলনীয় হেথায়। অতিকায় পমফ্রেটই বলুন বা ছোট্ট ছোট্ট গুলি পাবদা স্বাদে যেন অমৃত। আর চিকেন? এখানে এক বিশেষ ধরণের চিকেন পাওয়া যায়, কাঁচা অবস্থায় দেখে রেড মিট বলে ভ্রম হয়। সোয়াদেও খাসির মাংসের মতই খেতে। স্থানীয়রা বলে লড়াই চিকেন। নিজে হাতে রেঁধে খাওয়াব। এত প্রলোভন দেখানো সত্ত্বেও জনগণ আসে কই? আসে কেবল এষারা। এষা-অর্জুন আর কুট্টুস। একবার ডাকলেই চলে আসে। বেশ কিছুদিন না ডাকলে ছটফট করে। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মেসেজ করে আমাকে। সম্পর্কে শৌভিকেরই সার্ভিস তুতো বোন, কিন্তু দাদাকে হেব্বি ভয় পায়। যত আব্দার দিদির কাছে। সপ্তাহান্তে ওদের ফেলে যেখানেই যাই, এষার মেসেজ ঢোকে, ‘ কি ভালো ঘুরেছ। তোমরা আমাদের ভুলে গেছ দিদি-’। 


যখন এষা জ্বালায় না, তখন তাকে জ্বালাতন করে  তুত্তুরী। ভুলভাল ইংরেজিতে মেসেজ পাঠাতেই থাকে, অনুরোধ উপরোধ করে, ‘এসো না এষা পিসি।’ শুধু এসোই না, জলদি জলদি এসো। আপিসের কাজ ফেলে, দরকারে আপিসে তালা মেরে পালিয়ে এসো। শুধু যে উৎকট দাবী করে তাই নয়, এষাদের আসার ঢের আগে থেকে বাগানে পায়চারি করে । দূর থেকে কোন গাড়ির আওয়াজ এলেই ছুটে যায় গ্রীলের বড় গেটটার কাছে। উঁকিঝুঁকি মারে। অতঃপর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে বসার ঘরে বা ঢুঁ মারে বাবার বাংলো চেম্বারে। কর্মব্যস্ত শৌভিকের নজর এড়িয়ে তুলে নেয় বাবার বা আমার ফোন, তারপর ফিসফিস করে জানতে চায়,‘হ্যালো এষা পিসি বা অর্জুন পিসে, তুমি যে বলেছিলে চারটের মধ্যে অফিস থেকে বেরোবে? সাড়ে ছটা বেজে গেল তো!’ 


শেষ পর্যন্ত এষাদের গাড়িটা যখন হর্ন বাজিয়ে এসে থামে তাম্রলিপ্তের মহকুমার শাসকের সরকারী আবাসের সামনে, এদিকে হুড়মুড় করে ছুটে যায় শ্রীমতী তুত্তুরী আর ওদিক থেকে নামানো কাঁচের ফাঁক গলে বেরিয়ে ছুটে আসতে চায় শ্রীমান কুট্টুস। আতঙ্কে যত চেপে ধরে এষা, যত ধমকায় অর্জুন ততো লম্ফঝম্ফ বাড়ে দুই এবং চারপেয়ে দুই ভাইবোনের। শৌভিক বিরস বদনে মন্তব্য করে, ‘এষা বুঝতে পারছ তো,  আসলে কার প্রতীক্ষায় বসেছিল এতক্ষণ। ’ 


আট বছরের  তুত্তুরীর সাথে যখন প্রথম মোলাকাৎ হয়েছিল কুট্টুস বাবুর তখন আমাদের হিসেবে ওর বয়স ছিল কয়েক মাস মাত্র।  আর ওদের হিসেবে চার বা পাঁচ বছর। আমাদের এক বছর সমান ওদের ছয় বছর, এই তত্ত্ব সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম। সেদিন থেকেই  তুত্তুরী দিদি আর কুট্টুস ভাই। তারপর বিগত দুবছরে বেড়ে উঠে কুট্টুস এখন বছর আঠারোর তরতাজা যুবক। দিদি সেটা মানলে তো। এখনও দিদির মতোই খবরদারি করে। ধমকায়। কথা না শুনলে বা দুষ্টুমি করলে নালিশ করে, কখনও কখনও গর্হিত অপরাধ যেমন লুকিয়ে প্লাস্টিকের ফুল চিবোলে বা একপেট মাংস আর সেরেলাক খেয়েও হ্যাংলার মত রান্নাঘরের ময়লার বালতি হাঁটকে মাংসের হাড় চিবোলে চোরাগোপ্তা কষিয়েও দেয় দুটো থাপ্পড়। কুট্টুসও কামড়ে দেয় কুটকুট করে। আবার ঝগড়া ঝাঁটি করে,ওকে ফেলে তুত্তুরী চলে গেলেও তীব্র হল্লা জুড়ে দেয় কুট্টুস।


অবিকল মানুষের ছানার মত খেলা করে দোঁহে। ছুটোছুটি-হুটোপাটি-লাফালাফি-নাচানাচি তো বটেই এমনকি স্লিপওভার-স্লিপওভারও খেলে দুজনে। সেটা কি খেলা প্লিজ আমায় জিজ্ঞাসা করবেন না। অনেকক্ষণ মেয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কি করছে সে, দেখি ভালো করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে তুত্তুরী। পাশের বালিশে মাথা রেখে শুয়েছে কুট্টুস। তাকে কিসব সাপব্যাঙ গল্প শোনাচ্ছে তুত্তুরী, জবাবে চোখ পিটপিট করছে,হাই তুলছে আর মাঝেমাঝে খরখরে জিভটা দিয়ে দিদির মুখটা চেটে সাফ করে দিচ্ছে কুট্টু বাবু। আমি ঢুকতেই ধড়মড় করে খাটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল কুট্টুস। আর ‘মাআআআআআ  তুমি ওকে তুলে দিলে’ বলে প্রবল শোরগোল জুড়ে দিল তুত্তুরী। 


এষারা রাতে থেকে গেলে, ঘুমায়ও দুজনে একসাথে। আগের বার আলাদাই শুয়েছিল দুজনে। দিব্যি মানুষ বাবা-মার মাঝে চার হাতপা তুলে ঘুমিয়েও পড়েছিল কুট্টুস। তারপরই কি যে হল, লাফিয়ে খাট থেকে নেমে দরজা আঁচড়াতে লাগল কুট্টুস। মাঝরাতের ন্যাকামো বলে বেশ খানিকক্ষণ পাত্তা দিল না এষা আর অর্জুন, তখন করুণ সুরে কাঁদতে লাগল কুট্টুস। পেট ব্যথা বা অন্য সমস্যা হচ্ছে ভেবে যেই খোলা হল ঘরের দরজা, ওমনি এক ছুটে তুত্তুরী দিদির ঘরে। সোজা খাটে উঠে, পিছন দিয়ে তুত্তুরী দিদিকে ঠেলে- তার বালিশটা দখল করে গুটিসুটি মেরে শুল। তুত্তুরী তো হেসেই খুন, এষা আর অর্জুন  কোমরে হাত দিয়ে বকেই চলেছে, কি নাটুকে ছানা রে তুই। মাঝরাতে আর কত ঢঙ করবি। 


ঢঙই তো। দিব্যি নদীর ধারে পোজ দিয়ে বসেছিল অর্জুনের সাথে। গোটা দুয়েক ওদের ছবি তোলার পর, তুত্তুরীকে বলা হল, তুই ওর পাশে গিয়ে বস। একসাথে তিনটের ছবি তুলবে বাবা। ওমা তুত্তুরী যেই উবু হয়ে বসল, প্রথমে  তার দিকে একবার তাকাল, তারপর সটান হাত দিয়ে তার হাতটা চেপে ধরল কুট্টুস। যেন ডাকছে, একটু আমার দিকেও তাকা দিদি। তাকাবে কি, দিদি তো হেসেই খুন।

No comments:

Post a Comment