Thursday, 9 December 2021

অনির ডাইরি ৯ই ডিসেম্বর,২০২০



 জানুয়ারী মাস, কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপছে বঙ্গদেশ। শিয়ালদা থেকে রাতের লালগোলা ধরল লোকটা। মাসের শেষ, হাত খালি। কিছু টাকা পাবার কথা ছিল এক পরিচিতর কাছে, বিনা পারিশ্রমিকে তার অনেক কাজ করে দিয়েছিল লোকটা, জানিয়েছিল টাকাটা পরে নেবে, সময়মত। আজ যখন চাইতে গেল- নাঃ থাক ওসব কথা ভেবে আর মনটা খারাপ করবে না লোকটা। আপাততঃ কিছু টাকা ধার তো পাওয়া গেছে, যেতে হবে অনেকদূর। সেই সুদূর পলাশী। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সাড়ে তিনটে। অত রাতে বাস থাকবে না। তাই হাঁটতে হবে  প্রায় সাত কিলোমিটার। তারপর ভোররাতের প্রথম ফেরী নিয়ে যাবে, ওপাড়ে শ্বশুরবাড়ি। সেখানে আছে আসন্ন প্রসবা স্ত্রী। এখনও আসন্ন প্রসবা কি? ডাক্তারের দেওয়া তারিখ শেষ হচ্ছে আজ। মিছিমিছি টাকাটার জন্য দেরী হয়ে গেল- 


ভোর রাতে নদী পেরিয়ে ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে ছুটছে লোকটা, মুর্শিদাবাদের কনকনে ঠাণ্ডা সূঁচের মত বিঁধছে লোকটার মুখেচোখে।  ভালো গরম জামার বড় অভাব। উচ্চপদস্থ দাদার ওভারকোট খানা ধার করে এনেছিল ভাগ্যিস। মাথায় একটাই চিন্তা, ছানাটা কি, বাবা না আসতেই জন্মে গেল? 


নাঃ জন্মায়নি ছানাটা। নির্দিষ্ট তারিখ পেরিয়ে যাবার পরও জন্মায়নি। বাবা আসেনি যে। মায়ের জঠরে বেড়ে উঠলেও, বাবার সাথে নাড়ির টান কম না তার। 


 কুয়াশা মোড়া এক অজ গাঁয়ের ছোট্ট সরকারী হাসপাতালে সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়ল লোকটার মুখে- কি করবে বুঝতে পারছে না লোকটা। কাকে কাকে খবর দেবে? কাকে কাকে মিষ্টি খাওয়াবে?  সোমপাড়া বাজারের সেরা দোকান থেকে গোটা দশেক হাঁড়ি রসগোল্লা কেনার পর খেয়াল হল, সদ্যোজাত বাচ্ছাটাকে স্পর্শ করেছে যে, তাই গাঁয়ের মানুষ তো তার হাত থেকে কিছু নেবে না। আঁতুড় বড় বালাই। কুচ পরোয়া নেই, দোকানীকে দুদণ্ড দাঁড়াতে বলে, ধার করা ওভারকোট,টুপি সমেত গঙ্গায় ডুব দিল লোকটা।  অতঃপর কনকনে ঠান্ডায়, ভিজে সপসপ করতে করতে ঘরে ঘরে বিতরণ করতে লাগল মিষ্টান্ন। মেয়ে হয়েছে যে-। 


মেয়ে বড় হবার সাথে সাথে একটাই দুঃস্বপ্ন দেখত লোকটা। কোন অচেনা জায়গায় বউ আর মেয়েকে দাঁড় করিয়ে, ট্যাক্সি খুঁজতে গিয়ে ফিরে এসে দেখে কেউ নেই- প্রতিবার ঘেমে চান করে যেত লোকটা। মেয়ে তো নয়, প্রাণ। আর বউ? ইয়ে ওকথা না হয় নাই কইলাম। শুধু এটুকু বলতে পারি, বউমেয়েকে ছেড়ে কোথাও একটা রাতও কাটাতে চাইত না লোকটা। যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই থাকুক, যত রাতই হোক, বাড়ি ফিরে আসতই লোকটা। কতবার কত অনুষ্ঠানে যে মুখ দেখিয়েই পালিয়ে এসেছে লোকটা, বাড়ি ফিরে বউমেয়ের সাথে দুধরুটি বা আলুসিদ্ধ ভাত খাবে বলে-  একবার তো এক বর্ষার রাতে, ওমনি কোন নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে জলদি বাড়ি ফেরার তাড়ায়,শর্টকাট করতে গিয়ে, সদ্য খোঁড়া কবরেই পড়ে গিয়েছিল লোকটা। 


মেয়ের প্রতি বরাবরই ছিল সীমাহীন প্রশ্রয়। বড় হবার সাথে সাথে বেপোট আদর পেয়েই কি না জানি না, মেয়ে হল নাদুসনুদুস, ন্যাদোশ পানা। স্কুলে সহপাঠিরা ক্ষেপায় আর মেয়ে বাড়ি এসে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। লোকটা পড়ল মহাজ্বালায়, শক্তপোক্ত হতে হবে তো। খেলাচ্ছলে বলে বসে, “মোটা তো মোটা আমার খেয়ে মোটা। বলে দিস বন্ধুদের।” ব্যাস। গুণধরী কন্যা বলেও এল, “মোটা তো মোটা, আমার বাবার খেয়ে মোটা। তোর বাবার তো নয়-”। নালিশ এল বাড়িতে। গিন্নীমা তো বেলুন নিয়ে প্রস্তুত, ঠেঙিয়ে বড়লোক করে দেবেন আজ কন্যাকে। বাধ সাধে লোকটা,“বেশ করেছে। আবার বললে আবার বলবি। বাকি আমি বুঝে নেব-”। 


সময় এগোয়, বড় হবার সাথে সাথে পথেঘাটে অনুভূত হয় অবাঞ্ছিত স্পর্শ, কানে অাসে চটুল অশ্লীল মন্তব্য। ঘাবড়ে যায়,মুষড়ে পড়ে কিশোরী মেয়ে।  লোকটা শেখায়, কি ভাবে চলতে হয়, ভিড়ের মধ্যে, নিজেকে বাঁচিয়ে। আর যদি তারপরও- তাহলে মহৌষধ হাওড়া জেলার আদি অকৃত্রিম খিস্তি।  মেয়েটার খিস্তির ভাঁড়ার যে আজ এমন ঈর্ষণীয়, সৌজন্য শুদ্ধু ঐ লোকটা। 


কোনদিনই নিখাদ প্রশ্রয়দাতা বা শাসনকারী বাবা নয়, বরং মেয়ের পরম বন্ধু হতে চাইত লোকটা।বয়ঃসন্ধির কিটকিটে ব্রণয় যখন ছেয়ে গেল মেয়েটার মুখ, লোকটাই পরিচয় করালো শ্বেতচন্দনবাটার সাথে। চুল উঠছে মেয়ের তো খুঁজে পেতে আনত সুগন্ধী তিলের তেল। অকালে পেকে যাওয়া চুলের জন্য বড়বাজার থেকে রাজস্থানী হেনা। 


 প্রথম সিগারেটটা নিজেই এগিয়ে দিয়েছিল মেয়ের দিকে, “টেনে দ্যাখ”।  সেবার, যখন বুড়ো ধাড়ি মেয়ে আর তার স্যাঙাৎরা ঠিক ধরল দোলপূর্ণিমার রাত্রে সিদ্ধি খাবে-সেই মত সব যোগাড়যন্ত্র হল,মাঝখান থেকে তারাসুন্দরীরা ভুলে গেল খালি সিদ্ধি পাতাটাই। শিবরাত্রির সিদ্ধি চাটুতে নেড়ে কিভাবে ঠান্ডাইতে মেশাতে  হয় শিখিয়ে ছিল লোকটা।


মেয়ের নিষেধ সত্ত্বেও, প্রতিটা চাকরীর পরীক্ষায় সঙ্গে যেত লোকটা। বসার জায়গা পেলে ভালো, না হলে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকত, ছোট্ট পকেট রেডিওটা চালিয়ে। দুটো পরীক্ষার মাঝে খবরের কাগজ পেতে ফুটপাতে বসে, সকালে গিন্নীমায়ের সেঁকে দেওয়া চিনি ছড়ানো মাখন পাঁউরুটি খেতে খেতে মেয়েকে বোঝাত ফিউডালিজম। 


ইয়ে বলতে ভুলে গেছি, লোকটার আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বাবা, আমার জীবনের কতটা জুড়ে একলা তোমার আধিপত্য তা বোধহয় তুমিও জানো না। এই কোভিডের বছরে শুধু এই টুকুই বলব, খুব ভালো থেকো, খুব সাবধানে থেকো। সবথেকে বড় কথা মাথার ওপর এমনি ছাতা হয়ে থেকো। এক সমুদ্র, এক আকাশ ভালোবাসাও বুঝি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়-

No comments:

Post a Comment