#তাম্রলিপ্তকড়চা
চেম্বারের দরজায় পর্দা লাগাতে চেয়েছিল সাপ্লায়ার ছেলেটি। ‘পর্দা লাগিয়ে নিন ম্যাম। নাহলে যে সে ঢুকে পড়বে। এখানকার সব অফিসারদের ঘরেই দরজায় পর্দা লাগানো।’ এক কথায় নাকচ করে দিয়েছি। ইল্লি আর কি! একে তো ভাঁড়ে মা ভবাণী। টাকাপয়সার জন্য রীতিমত অ্যালুমিনিয়াম বাটি হাতে হেড আপিসে চক্কর কাটি আজকাল। ‘টাকা, নেই, টাকা চাই, টাকা কই’ করে মহানগরে এমনি রেপুটেশন বানিয়েছি যে, আমায় দেখলেই সেকশন ফাঁকা। হেড আপিসে ফাণ্ড অ্যালটমেন্ট ছাড়ে যে ছেলেটি, আগেরদিন বলেই ফেলল, ‘আপনাকে দেখলে আজকাল আমার হেবি ভয় লাগে ম্যাডাম।’ সুকন্যা সাক্ষী। একটুও বাড়িয়ে বলছি নেকো।
তবে টাকা না থাকার থেকেও বড় কথা হল, আমি চাই না মানুষ আমার চেম্বারে ঢুকতে ভয় পাক। এটা ল্যাবার দপ্তর। সমাজের একদম তলার দিকের মানুষদের নিয়ে আমাদের কাজ, তারাই যদি তাদের দাবীদাওয়া সুখবিসুখ না জানাতে পারে, কি লাভ অমন চেয়ারে বসে। এত বচ্ছরের লেবারগিরি একটা জিনিস শিখিয়েছে, যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। কেউ এটা ভেবে আসে না যে আমার হাতে সোনার কাঠি আছে, ছোঁয়াব আর সব মনোমত হয়ে যাবে। কি পারব, কতটুকু পারব, আদৌ পারব কি না, কেন পারব না বা কেন পারছি না খুলে বলে দিলে অনেকাংশে ঝামেলা মিটে যায়। অন্তত স্তিমিত তো হয় রে বাপু।
এই জ্ঞানের কথা শুনিয়ে, কাগজের কাপে আদা, গোলমরিচ আর বিটনুন দেওয়া একখানা পাঁচন মার্কা চা খাইয়ে আমার কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর পার্থকে বললাম, তাহলে বুঝলে কি না? যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। চলো যোগাযোগ করি। এত গুলো বেনিফিট ছাড়ছ, যোগাযোগ না করে ছাড়বেই না কেন? যোগাযোগ করো বিধায়ক মশাইয়ের সাথে, বিডিও সাহেব যদিও প্রচণ্ড ব্যস্ত তবুও বলোই না তাঁকে একবার। বলো পঞ্চাযেত সমিতির সভাপতি, সহ সভাপতি, পঞ্চায়েত সমিতি তথা জেলা পরিষদের সদস্য, পঞ্চাযেত প্রধানদের। কোলাঘাট আমার সবথেকে বড় এলডব্লুএফসি। এই ব্লকের প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ আমাদের নথিভুক্ত শ্রমিক।শুধু এই ব্লক থেকেই ১৫৭ জন নির্মাণ আর পরিবহন কর্মীকে পেনশন দিই আমরা। সবথেকে বেশি ডেথ কেস এবং ফাইনাল পেমেন্ট অর্থাৎ মেয়াদপূর্তিতে টাকা ফেরতের আবেদনও আসে এই ব্লক থেকে। এত কাজ করো, সেটা কেউ জানতেই পারে না। আর যেটা পারো না, সেটা নিয়েই উড়ে বেড়ায় অভিযোগের গরম বাতাস।
আমার জ্ঞান না কালেক্টরেটের চায়ের গুণ জানি না, দারুণ ভালো একটা প্রোগ্রাম নামাল বটে আজ পার্থ, শুভদীপ্ত আর তাদের দলবল। ৩৩জন মৃত বেনিশিয়ারীর উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দেওয়া হল প্রায় ২২লাখ টাকার মৃত্যুকালীন অনুদান। জনা ৩০ কে দেওয়া হল মেয়াদপূর্তির টাকা। তবে আজকে আমাদের অনুষ্ঠানের স্টার যিনি ছিলেন, তাঁর নাম হল শেখ ইসমাইল। এই সেদিন অবধি বাস চালাতেন উনি। তখনই নাম লিখিয়েছিলেন আমাদের পরিবহন কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে। ষাট বছর হবার পর আবেদন করেন পেনশনের জন্য। একটু সময় লেগেছে বটে, তবে যেদিন থেকে ওণার ষাট বছর হয়েছে সেইদিন থেকে ধরে আজ পর্যন্ত নিঁখুত ভাবে গণনা করে মোট সাড়ে তেত্রিশ হাজার টাকার পেনশন ঢুকেছে ওণার ঝুলিতে। প্রোগাম শেষে আমি স্বয়ং ওণার কাছে গিয়ে বললাম, ‘দাদা চলুন তো, আপনার সাথে একটা ছবি তুলি। আপনারাই হলেন আসল যোগাযোগ। আপনারা আছেন বলেই এই দপ্তরটাকে এত ভালোবাসি। ’
পার্থকে যে জ্ঞান দিয়েছিলাম, তা বাকিদেরও খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলুম। সেগুলো শুনল বটে, মাথাও চুলকালো বেজায়, তারপর কোথায় সটকে পড়ল একে একে। ভাবছে আমি খেয়াল করিনি-।সবকটাকে চেপে ধরব, শুধু একবার ফাণ্ডটা ঢুকতে দিন।
No comments:
Post a Comment