যবে থেকে তাঁর পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আমার সকালগুলো শুরুই হয় লাইভ তুত্তুরী উবাচ দিয়ে। যেমন ধরুন আজ সকালে শ্রীমতী তুত্তুরী বললেন ‘জানো তো মা, কাল না অমুকের ইয়ে(পড়ুন অন্তর্বাস) দেখেছি।’ সদ্য কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠেছি, তখনও কাটেনি খোঁয়ারি। সামনে রাখা এক গ্লাস উষদুষ্ণ গরম জলের দিকে কেষ্ট মুখুজ্জের মত চোখে তাকিয়ে ভাবছিলাম মালটা দিয়ে ঠিক যেন কি করি? মানে কি করতে বলেছিল আমার তন্বী ডায়েটিশিয়ান? দিব্য নিয়ম মেনে চলছিলুম, মাঝখান থেকে দিন দুয়েকের মহানগর বাসটা দিল সব চটকে। একদিন হাটারি, একদিন আর্সলান, একদিন সিটি সেন্টার, তারপর যে ডায়েট বানানটা মনে রাখতে পেরেছি সেই ঢের। শুক্রবার দুপুর থেকে রবিবার সন্ধ্যাটা যে কিভাবে গিলে নিল তিলোত্তমা, নিজেরাই বুঝতে পারলাম না। নিজ আলয় তথা নিজের শহর ছেড়ে আসার সে যে কি তীব্র মনোবেদনা-
মহানগরের জাদু এই ছোট্ট শহরটায় নেই। তবুও বড় মনোরম এদিকের প্রাক শীতের সকালগুলো। বাতাসে কুয়াশা ভেজা মাটির মিঠে সুবাস, সবুজ ঘাসে গড়াগড়ি খাওয়া আদুরে নরম পশমী রোদ, বারান্দার গ্রিলে ঝাঁক বেঁধে বসে রোদ পোয়ানো ফুলোফুলো ছাতারে পাখির দল,পাঁচিলের ওপারে থোকা থোকা কুয়াশা। এমন সময় কেউ কারো অন্তর্বাসের কথা যে কি তুলতে পারে, তা মা না হলে হয়তো জানতেও পারতাম না। তবেই না বলে, 'মা হওয়া কি মুখের কথা'।
চমকে যাওয়া পিলেকে সামলে, হারিয়ে যেতে বসা বোধবুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে জানতে চাইলাম,সে কে? কোন নায়িকা বা উপনায়িকা নাকি? জবাব এল, তিনি শ্রীমতী তুত্তুরীর জনৈকা সহচরী। অনলাইন ক্লাশ চলাকালীন বোধহয়, তার হাঁটুতে কোন চোট লাগে, তাই তিনি ক্যামেরা অন থাকা অবস্থাতেই আতঙ্কিত হয়ে চেয়ারের ওপর সটান উঠে স্কার্ট নামিয়ে হাঁটু থেকে রক্ত মুচছিলেন।
যেমন তুত্তুরী, তেমনি তার বন্ধুবান্ধব। দুদিন আগেই শুনছিলাম মিস কাকে যেন, ‘ইউ নটি গার্ল, ইউ অসভ্য গার্ল, ইউ হনুমান, বাঁদর, জলহস্তী, খ্যাঁকশেয়াল’ বলে গালাগালি দিয়েছিলেন। কারণ তিনি নাকি ক্লাশ চলাকালীন বন্ধুদের তাঁর অনাগত যৌবনের কিছু নিদর্শন দেখাচ্ছিলেন। মিস রেগে আগুন, তেলে বেগুন হয়ে গেলেও আমি রাগতে পারিনি। বিগত দুবছর ধরে কোন শৈশব নেই বাচ্ছাগুলোর। অহর্নিশি বাড়িতে থাকা, ক্লাশ চলাকালীনই যা বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয় আর কদাচিৎ ভিডিও কলে প্রবল হৈহুল্লোড়। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের দল, দেহে এবং মনে কত পরিবর্তন ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, কার সাথে ভাগ করে নেবে সেসব অনুভব?
সকাল গড়িয়ে বেলা বাড়ে, বাজে আপিস টাইমের ঘন্টা। আজ মাসি নেই, এত বড় বাংলোতে তো আর একা রেখে যেতে পারি না, তাই আমার সঙ্গে আমার আপিসে যাবে তুত্তুরীও। এই আপিসে হলদিয়ার বড় সাহেবের নামাঙ্কিত একখানি ফাঁকা চেম্বার আছে, যা তাঁর অনুপস্থিতির কারণে আজ ফাঁকাই থাকবে। সেই ঘরেই বসে ক্লাশ করবে তুত্তুরী। তবে স্কুল ইউনিফর্ম পরে নয়।
ঐ ইউনিফর্ম পরে ভদ্রসমাজে মেলামেশা করা যায় না। একে তো দুবচ্ছর আগের, স্কার্টটা আর গলেই না, শার্টটারও সেই কটি বোতামই লাগে,যতটুকু ল্যাপটপের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। শুধু বোতামহীনই নয়,রীতিমত শতরঙী জামাটা। যত্রতত্র জাঁকিয়ে বসেছে হরেক রকম দাগ। যার মধ্যে কি না নেই-পেন্সিলের দাগ, প্যাস্টেল কালার, ওয়াটার কালার,তিন চার রকম জেল পেনের কালি, চকলেট। মোটামুটি সারাদিনে তুত্তুরী যা করে,যা খায় ওর শার্টটাও তাই করে এবং খায়।
খেয়ে উঠে, থালাবাসন তুলে টেবিল মুছে, বেঁচে যাওয়া খাবার ঠাণ্ডা আলমারিতে তুলে, সেজেগুজে আপিস যাবার জন্য রেডি হয়ে গেলাম অথচ শ্রীমতী তুত্তুরীর বকবকানি আর থামেই না। বকেই চলেছেন অনর্গল। ক্লাশ থ্রিতে পিটি ম্যাম কি করতেন, চলছে সেই মহাকাব্য কথন। ম্যাম নাকি পিটি ক্লাসে খুঁটিয়ে চেক করতেন প্রত্যেকের ইউনিফর্ম, নখ, চুল ইত্যাদি। তারপর প্রশ্ন করতেন, ‘ইনার পরেছো? প্যান্টি পরেছ?’ প্রহারের ভয়ে সবাই বলত পরেছি। কিন্তু মিস নাকি ঠিকই বুঝতে পারতেন, কারা পরেছে আর কারা পরেনি। বলতেন এদিকে আয়, দেখি। শার্টের গলা সামান্য টেনে ধরলেই দেখা যেত ভিতরে নাদুসনুদুস গা। অমনি কপালে জুটত কানমোলা। ওপরেরটা নিয়মিত চেক করলেও, তলারটা অবশ্য মিস কোনদিন চেক করার সাহস পাননি।ওটা মুখের কথাতেই বিশ্বাস করতেন। মিসের ভয়ে সবাই থরহরি হলেও, কে যেন ছিল সম্পূর্ণ বিন্দাস। তাকে মিস যখন প্রশ্ন করত, ‘ইনার?’ সে বলত, ‘নো ম্যাম’। মিস রেগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে জানতে চাইত, ‘প্যান্টি?’ নির্বিকার মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি জবাব দিতেন, ‘নো ম্যাম। ’ গোটা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ত, আর হতাশ মিস চড়াও হতেন তার পরবর্তী ছাত্র বা ছাত্রীর ওপর। তার কপালে সেদিন সলিড দুঃখু থাকত।
তাঁর গল্প শোনানোর এমন তাগিদে, যে তিনি আমার পিছন পিছন সারা বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত চানঘরেও ঢুকে পরছিলেন আর কি। তাঁকে যাও বা ধমকেধামকে তৈরি করলাম, মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন তাঁর পিতৃদেব। সব অবতার একেকটা। ভগবান বেছে বেছে আমার কপালেই দিয়েছেন। তাঁর নাকি আজ কি সব জমকালো, চমকালো মিটিং-ভিসি-ডেপুটেশন আছে অথচ তিনি যে শার্টটা পরে বেরোচ্ছেন তা আমার মায়ের ভাষায়, 'রাস্তায় ফেলে দিলেও কেউ কুড়াবে না'। কুঁকড়ে-কুঁচকে এমন বিশ্রী অবস্থা।
তা তাঁর শার্ট, তাঁর মিটিং, তাঁর ভিসি। আমার কি? কিছুই না। তবুও আমায় অভিযুক্ত হতে হয়, আমার জন্যই নাকি তাঁর এই দুরবস্থা, আমি কেন সময় থাকতে ইস্ত্রি করে দিইনি। আবার ইস্ত্রিওয়ালাকে দিতেও দিইনি। যত নষ্টের গোড়া নাকি আমিই। দোষ যে আমার কিছুটা আছে তা মানছি, কোন বিস্মৃতপ্রায় অতীতে আমিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সোহাগ করে বলেছিলুম, ‘ওগো, কেন আর খামোখা ইস্ত্রিওয়ালাকে দেবে, তার থেকে আমায় আমায় দিও, আমি করে দেব।’ তারপর বেশ দুয়েক বার করেও দিয়েছিলাম।ভেবেছিলুম খুশি হবে, কিছু বকশিশ অন্তত পাব। ওমা সে গুড়ে বালি। বকশিসের ভাঁড়ে ভবানী, উল্টে পাওনা বলতে গুচ্ছ খানেক নালিশ, অভিযোগ আর অভিমান।
বাবা বাছা করে, শাশুড়ি মাতার অভিমানী ছানার মান ভাঙিয়ে, শার্ট খুলিয়ে চটজলদি ইস্ত্রি করতে করতে মনে হল, নাঃ বউ হওয়াও মোটেই মুখের কথা নয়। হেব্বি চাপ মাইরি।
ইয়ে ছবিতে সদ্য ইস্ত্রি করা জামা গায়ে তিনি। না খুশি হলেন না পেলাম বকশিশ 😏। উল্টে শুনতে হল, ইস্ত্রীওয়ালা নাকি আরো অনেক ভালো ইস্ত্রি করে।
No comments:
Post a Comment