‘বাঙালির দীপুদা’। যিনি বললেন, ভাগ্যচক্রে তিনিও দীপুদা। সময়টা ২০০৭ সাল। সদ্য সদ্য লেবার সার্ভিসে যোগ হয়েছে চোদ্দ জন নবীন সদস্য। নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের এগারো তলায়, জনৈক সদ্য অবসৃত বড় অফিসারের ঘরে জমে উঠেছে আমাদের ঠেক। মাঝে মধ্যে টুকটাক ডাক পড়ে বড় মেজ সাহেবদের ঘরে, ঘাড়ে চাপে ছুটকো দায়িত্ব, আলাপ জমাতে আসে বিভিন্ন জেলার সিনিয়র দাদা-দিদিরা। অন্য সময়টা নিছক আমাদের হুল্লোড়ের। চাকরি জীবনের সেরা সময় বলতে পারেন।
তেমনি কোন জমে ওঠা আড্ডার ফাঁকে দীপঙ্কর দা ওরফে শ্রী দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় বললেন উপরিউক্ত শব্দবন্ধ। এখন বলতেই পারেন,ব্যাচমেটকে দাদা বলো কেন? এতো দস্তুর নয়। না নয়। এর কারণ বলতে হলে, একটু ঢাক পিটোতে হয় এই আর কি। আমাদের ২০০৫ ব্যাচের তিন মহিলা অফিসারের মধ্যে ছিল এবং শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এখনও আছে ভয়ানক সৌহার্দ্য এবং বেশ অনেকটা ভালোবাসা। আজও আমাদের তিনজনের যেকোন একজনের অপছন্দের লোককে পছন্দ করি না বাকি দুই জন। আবার তিনজনের যে কোন একজনকে যদি পটাতে পারেন, তো বাকি দুজনের বন্ধু হতে সময় লাগবে এক পলক। তো এ হেন তিন বান্ধবীর অন্যতম শ্রীমতী (আর একবার ছিমান বা ছিমতী লিখলেই মারবে বলেছে শৌভিক, কি জ্বালা) সুকন্যা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে দীপুর জুনিয়র। দুজনেই লেবার গিরি শুরু করার আগে যুক্ত ছিল ভূমি রাজস্ব দপ্তরে। ফলে দীপু ছিল সু এর দাদা। অতএব আমাদের তিন কন্যারই দাদা। দীপুর সৌজন্যে বিদেশ-সবুজ- পার্থ- তপন সকলেই হয়ে যায় দাদা। এবং এখনও পূর্ণ বিক্রমে চালিয়ে যাচ্ছে দাদাগিরি। ব্যাচের সবথেকে মুখরা মেয়ে হিসেবে আমি যদিও বা মাঝে মাঝে, এই ব্যাটা দীপু বা তপন বা সবুজ করি, বাকি দুই নক্ষী মেয়ে আজও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে দীপুদা- তপন দা ইত্যাদিই করে।
যাই হোক, আবার ফিরে যাই ২০০৭ সালের সেই দিনে, যেদিন দীপুর মুখ নিঃসৃত বাঙালির দীপুদা শুনে আমি ভেবলির মত প্রশ্ন করেছিলুম, তিনি আবার কে? উফঃ আজও মনে পড়ে, বলা মাত্রই সরস্বতী ব্যতীত বাকি এক ডজন চোখ কেমন সার্চলাইটের মত ঝপ করে ঘুরে গিয়েছিল আমার দিকে। এ কোথাকার অগা রে? যাই হোক,আমাদের দীপুদা অবশ্য বুঝিয়ে বলেছিল দীঘা-পুরী-দার্জিলিং এর গল্প। পুরী আর দার্জিলিং ঘুরে এলেও তখনও পা রাখিনি দীঘায়।
বিয়ের পর বরকে শুধালাম, হ্যাঁ গা, তুমি দীঘা গেছ? যায়নি শুনে সে কি আনন্দ। বিয়ে এবং শৌভিকের ব্লকের দায়িত্ব ঘাড়ে নেবার অন্তর্বর্তী সময়ে আমাদের তিন দফা মধুচন্দ্রিমার প্রথমটিই ছিল দীঘায়। পুরানো দীঘা, হোটেল ব্লু ভিউ। মুখের কথায় সবথেকে ভালো সি ফেসিং রুম বুক করে দিয়েছিলেন কর্মসূত্রে শ্বশুরমশাইয়ের পরিচিত তথা সুহৃদ জনৈক স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে দীঘায় যখন নামলাম, বঙ্গোপসাগরের মাথায় ফের সে ঘনিয়ে এসেছে নিম্নচাপের বাদল। দিনের বেলাতেও অন্ধকার সমুদ্র সুন্দরী। সপ্তাহের মাঝখান বলে এমনিতেও বেশ ফাঁকা দীঘা, তারওপর মেঘ আর তুমুল ধারাপাত। হোটেলে পৌঁছে, ঘরে ঢুকে ঝোড়ো বাতাস উপেক্ষা করে বারন্দার দরজাটা যখন খুললাম, কবির ভাষায় ‘জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিল চোখ।’ মসি কৃষ্ণ আকাশ ততোধিক কালো সমুদ্র উভয়েই ফুঁসছে একে অপরকে স্পর্শ করার জান্তব তাগিদে। মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিরে ঝলসে উঠছে দামিনী।
সন্ধ্যে সন্ধ্যেই উঠে গেল দীঘার বাজার। তখন জেনারেটরে জ্বলত সব আলো। বন্ধ করে দেওয়া হল জেনারেটর। নিকষ আঁধের ডুবে গেল দীঘা নগরী, অন্ধকারে কান ফাটানো সমুদ্রের গর্জন। তারই মধ্যে আলো বলতে আমাদের ঘরের নকল ছাতে আঁকা অজস্র সবজে তারা। এত ভালো লেগেছিল সমুদ্র সুন্দরীকে যে ফেরার সময় নিজের বাবা-মায়ের জন্য বুক করিয়ে এসেছিলাম ঐ ঘরটাই। বাবা মা নিম্নচাপ পায়নি বটে, তবে বাংলা বন্ধ পেয়েছিল ফেরার দিন। বাতিল হয়ে গিয়েছিল ট্রেন। একটা দিন অতিরিক্ত থাকতে পারার আনন্দ আজও দীঘার নাম করলেই ঝরে পড়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কণ্ঠ থেকে। হাঁটুর ব্যথা ভুলে কখনও পদব্রজে তো কখনও রিক্সা বা ভ্যানে করে কি ঘোরাই না ঘুরেছিল ওরা।
সেই শেষ,তারপর দীর্ঘ তেরো বছর বাদে দীঘার মাটিতে পা রাখলাম আমরা। তাম্রলিপ্ত থেকে সড়ক পথে মাত্রই দুঘন্টার পথ দীঘা, এই জেলায় বদলী হয়ে আসা ইস্তক যাবতীয় বন্ধবান্ধব- আত্মীয়স্বজন একটাই প্রশ্ন করে চলছে, হ্যাঁরে তোরা দীঘা যাসনি? তাই ভাবলাম যাই এক চক্কর ঘুরেই আসি। মাত্রই কয়েকঘন্টার ঝটিকা সফর, আপিস সেরে, শৌভিকের সান্ধ্যকালীন ভিসি মিটিয়ে রাত সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পরদিন রাত সাড়ে এগারোটায় ফেরা। সমুদ্রসুন্দরীকে তো দেখলামই, সাথে সাথে ঢুঁ মারলাম তাজপুর আর শঙ্করপুরে। সমুদ্র বা প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হবার সাথে সাথে আরেকটা জিনিসও প্রত্যক্ষ করলাম, তা হল প্রকৃতির রুদ্র রূপ। যে ইয়াসে কিছুই হল না বলে দুঃখ করছিলেন মহানগরীর একদল সুখী মানুষজন, তারই অভিঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে বড় বড় বোল্ডারের দল। উড়িয়ে এনে আছড়ে ফেলেছে মূল ভূখণ্ডে। উপড়ে গেছে গাছের পর গাছ। জনবিরল তাজপুর আর শঙ্করপুরের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিঃসন্দেহে শঙ্করপুর এগিয়ে। তাজপুর অনেক গুছানো হলেও বড় শুঁটকি মাছের গন্ধ বাপু। যাই হোক আর তাই হোক দীর্ঘ এক বছরের পর কোথাও বেড়াতে গিয়ে রাত্রিবাস করলাম আমরা, এই আনন্দের রেশই চলুক না এখন বেশ কটা দিন।
No comments:
Post a Comment