Sunday 23 January 2022

অনির ডাইরি ২৩শে জানুয়ারী ২০১৯

 

 বিগত মধ্যরাত্রি থেকে যাঁরা ফেসবুক- হোয়াটস্অ্যাপ- এসএমএস আর মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, যাঁরা শুধুমাত্র অন্তর্জালে আবদ্ধ না থেকে ফোনটা করেই ফেলেছেন, তাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বড় ব্যস্ত এ জীবন আর বড়ই মূল্যবান এ সময়,তবুও তার মধ্যে থেকে কয়েক মুহূর্ত চুরি করতে পারা বড় কম কথা নয়। বিশেষতঃ অনিন্দিতা এবং চৈতালী এই মুহূর্তে যে চরম মানসিক শূণ্যতায় ভুগছে, তার মধ্যেও তাদের পাঠানো শুভেচ্ছায় আমি এক্কেবারে অভিভূত  তথা বিগলিত। 


এমনিতে আমি নিজেকে হাওড়ার মেয়ে বলে দাবী করলেও আমার জন্ম সেই সুদূর মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সে বছর বড় জব্বর শীত পড়েছিল, বাবা তো বলে সেটা নাকি বিগত শত বছরের শীতলতম দিন।ফুলহাতা হলুদ পুলওভারের ওপর জেঠুর কাছ থেকে ধার করা ওভারকোট চাপিয়ে, বাবা যখন পলাশী স্টেশনে নেমেছিল তখন ২১শে জানুয়ারি এর গভীর রাত। ডাক্তারের নির্ধারিত দিনলিপি অনুসারে আমার জন্মানোর কথা ছিল ২১শে জানুয়ারীই। ছুটি আর টাকা জুটিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে একটু দেরীই হয়ে গিয়েছিল বাবার, তাও প্রতিশ্রুতি মত টাকাপয়সা যোগাড় হয়নি। মন খারাপ আর উত্তেজনার যুগলবন্দি নিয়ে, বড় পাঁচ সেলের টর্চের ভরসায় অন্ধকার পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধার। শেষ পারানির নৌকায় নদী পেরিয়ে,এবার কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দিদার বাড়ি পৌঁছে দেখে মা দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, দুপুরে ভারি মশারি কেচেছে,মায়ের মনোবল তুঙ্গে। আর আমি? দূর দূর ডাক্তারবাবু বললেই হল নাকি? আমার বাবা না এলে আমি ভূমিষ্ঠ হব থোড়াই? ২১তো দূরের কথা-২২টপকে সেই ২৩শে ভোরে জন্মেছিলাম আমি। জন্ম থেকেই বাবার প্রাণ। এখনও প্রতি বছর ২২তারিখ রাতে বাবা আরেক বার শোনায়,ঠিক কি হয়েছিল সেবছর ২১-২২-২৩শে জানুয়ারী। 

বিয়ের পরও প্রতিবছর এই দিনটা নিয়ম করে হাওড়ায় কাটাই। না হলে বড় বেশী দুঃখ পায় আমার বৃদ্ধ বাবা। মেয়েটা তাহলে পরই হয়ে গেল। চ্যাটার্জী থেকে ভট্টাচার্যই হয়ে গেলে শেষে? 

এবছর আর যেতে পারিনি। কারণ মেয়ের স্কুল এবং আসন্ন পরীক্ষা। গতকাল মধ্যরাত্রে তাই আমিই ফোন করলাম আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে। শৌভিক যদিও চিমটি কাটছিল,“ওরে ওদের ঘুমোতে দে। ” কিন্তু আমি তো চিনি,বড় বেশী করে চিনি আমার জন্মদাতা এবং দাত্রীকে। জানতাম শ্রোতা হিসেবে আমি নেই তো কি, দালানের ডাইনিং টেবলে বসে নিঃসঙ্গ  বুড়োবুড়ি নিজেরাই স্মৃতিচারণ করছে সেই দিনটার। ফোন পেয়ে খুশির সীমা রইল না। যাক মেয়েটা বদলে যায়নি। আরো জানালাম বাপের বাড়ি যাচ্ছি না বলে,শ্বশুরমশাই খেতে নিয়ে যাবেন বলেছেন, আমার প্রিয় রেস্টুরেন্টএ। এরপর তো আর হাওড়া না যাওয়া নিয়ে কোন অভিযোগই থাকতে পারে না। 

ভোর থেকে স্বামী এবং কন্যা পর্যায়ক্রমে চপেটাঘাত  করেই চলেছে,“তুমি তো ছোট্ট বেবি। ছোট্ট বেবিদের জন্মের পর মেরে কাঁদাতে হয়।” জন্মের শোধ তুলে নিল বোধহয় দোঁহে। 

বেলা বারোটার সময় তৈরি হয়ে নেমে দেখি,গাড়িতে শাশুড়ি মাও বসে।  হাঁটু এবং ব্যালান্সের সমস্যার জন্য উনি পারতপক্ষে বাড়ি থেকে নড়তে চান না। তিনি নিজে চলেছেন,স্বেচ্ছায় আমার জন্মদিন পালন করতে পার্কস্ট্রীট এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে? তুত্তুরী মহানন্দে গিয়ে বসল ঠাকুমা-ঠাকুরদার কোলে। 

চালাও পানসি মার্কোপোলো। মার্কোপোলোর গোল্ডেন ক্রাম্ব ভেটকি আর মোহিতো দিয়ে যাত্রা শুরু করে- চেলো কাবাব হয়ে হট ব্রাউনি উইথ ভ্যানিলা আইসক্রীম দিয়ে ভুরিভোজ সমাপ্ত হল। পিটারক্যাটের সাথে চেলোকাবাব সমার্থক যাঁরা মনে করেন অনুগ্রহ করে একবার মার্কোপোলোয় খেয়ে দেখবেন। আর ফিশ এণ্ড চিপস্ টাইপ মাছ ভাজা ওদের অতুলনীয়। এত ভালো ভেটকি খুব কম রেস্টুরেন্টেই পাওয়া যায়। শৌভিক নির্দ্বিধায়,হাসিমুখে  বিল মেটাবার পর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম, আগামী একবছর বরকে কোন বাজে কথা বলব না।ঝগড়া করব না।  সেটা যদিও তুল্যমূল্য  বিচার করতে করতে আপাততঃ আগামী এক পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে।  


ফেরার পথে ২ নং বাবা বললেন,“চলো একটু ঘুরে যাই। ছোট্ট করে লং ড্রাইভ আরকি।” ফলতঃ বাড়ির পথ না ধরে, গাড়ি ছুটল বিদ্যাসাগর সেতুর পথে। কোনা এক্সপ্রেস ওয়েতে বেশ খানিকটা ঘুরপাক খেয়ে, নিবেদিতা সেতুতে ৪৫টাকার টোল দিয়ে গঙ্গার হাওয়া খেয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। 

আরেকবার অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাদের সকলকে, খুব ভালো থাকুন সকলে। সময় বড় নির্মম, যে হারে গুরুজনদের ছাওয়া সরে যাচ্ছে মাথার ওপর থেকে-- আজকে শুধু আজকের দিনে আঁকড়ে ধরতে চাই আমার প্রতিটা প্রিয়জনকে, আর বলতে চাই-- যাই হোক না কেন আমায় ছেড়ে যেও না। সময় যতজোরেই দৌড়ক না কেন, আমি বদলাইনি।  তোমরাও বদলে যেও না।

No comments:

Post a Comment