Saturday, 1 January 2022

অনির ডাইরি ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২১

 

পৌনে তিনটে নাগাদ ফোন করলাম। ফোনের ওপার থেকে চরম ব্যস্ত কেজো স্বর বলল,‘হুঁ?’ আমার ভয় পাওয়া চেহারা আমি আদতে আনাড়ি, স্বভাব সিদ্ধ ভীতু স্বরে জানতে চাই, ‘বেরোলে?’ রোজ একই প্রশ্ন করি। তবে অন্যান্য দিন সময়টা পেছিয়ে যায় আরোও ঘন্টা তিন, সাড়ে তিন। আজ তো বছরের শেষ দিন। 


বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি আমি। মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য বাড়ি ফেরা, বাসি রুটি আর সকালের বা আগের দিনের লাউয়ের তরকারী বা দু পিস স্যাঁকা পাঁউরুটি আর সকালের বেঁচে যাওয়া ডাল নাহলে নিছক দুধ কর্নফ্লেক্স খাই আমরা মা আর মেয়ে। নাক সিঁটকাবেন না। এগুলো মোটেই তেমন খারাপ নয়, ভয়ঙ্কর তো হল ওলকপি আর বড়ির তরকারি। এই মোটা মোটা করে কাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ওলকপির সাথে সামান্য আলু আর বড়ি মিশিয়ে ঝোল। উফঃ একবার রাঁধলে তিনদিনেও শেষ হয় না তা। 


যাই হোক, যাই থাকুক তাই দিয়ে টিফিন সেরে শ্রীমতী তুত্তুরীর মাথায় একখানা চাঁটি মেরে আপিস যাই আমি। আমার সাথে বসে ঐসব অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়া আর আমার হাতের চাঁটির জন্য বসে থাকে তুত্তুরী। যেদিন কোন মিটিং এ আটকে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়, সেদিন একটু বেশীই শুকিয়ে থাকে মেয়ের মুখ। বুঝি খিদে পেয়েছে, কিন্তু না খেয়ে বসে আছে মায়ের জন্য। তমলুক পোস্টিং এর এই একটাই ভালো দিক খুঁজে পায় তুত্তুরী। 


তবে আজ ফিরব না। কাজ গুছিয়ে বেরোতে একটু দেরী হবে। সকালে বলাতে মুখ ঝুলে গিয়েছিল শ্রীমান তুত্তুরীর। তখন উপযাজক হয়ে শৌভিকই বলেছিল, পৌরসভায় কিসব কাজ আছে, সামলে ফাইলপত্তর নিয়ে তিনটের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। এখন যখন ফোন করলাম, জাস্ট উড়িয়েই দিল, ‘না-না-না। দেরী হবে।’ অগত্যা কি আর করি, মাসির ফোনে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, ‘খেয়ে নে বাবু। বাবার দেরী হবে।’ 


সাড়ে তিনটে নাগাদ, শৌভিক উচ্চস্বরে ঘোষণা করল,‘আমি বেরিয়েছি।’ যেটা অনুচ্চ থেকে গেল, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। এবার পাতাতাড়ি গোটাতে হবে আমাকেও। অন্ততঃ মহকুমা শাসকের সেটাই মনোবাঞ্ছা। মুস্কিল হচ্ছে গোটাও বললেই তো আর গোটানো যায় না। ফাইল-চিঠি-অর্ডার জলদি হাতে গোটাচ্ছি, জহর বাবু এসে বললেন,‘ম্যাডাম চলে যাবেননি যেন।  একটু মিষ্টি-’। মিষ্টি বোধহয় বানিয়ে আনছে ব্যাটারা, উসখুস করছি আমি। আরএলও ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করছি,‘সৌরভ আমি বাড়ি যাই?’ সব আপিসে আপিসমাস্টাররা আটকায় কর্মচারীবৃন্দকে, এখানে উল্টোপুরাণ। সৌরভ গম্ভীর সুরে বলে, ‘দাঁড়ান ম্যাডাম, আজ শেষ দিন তো। সব লাইফ সার্টিফিকেট গুলো গেল কি না একবার দেখে নি।’ মিনিট পনেরো পর জানা গেল তাঁরা হেঁটে হেঁটে মহানগরের পথ ধরেছে। এবার আমিও গুটি-গুটি- মানে হেঁ-হেঁ আর কি। 

আবার মাথা নাড়ে সৌরভ। আসে আরো কিছু কাজের ফিরিস্তি, আসতেই থাকে। যতক্ষণ না আমি নাকে কাঁদতে শুরু করি। ‘আমি বাড়ি যাব। যাবোই-’।


আজ বর্ষশেষ। ফেসবুকের পাতা ভরে ওঠে সুসজ্জিত উৎসব মুখর নরনারী আর রঙবেরঙের তরল পানীয়র ছবিতে। কম্বল মুড়ি দিয়ে নেটফ্লিক্সে ডুবে যাই আমি। আপাততঃ কিছুদিন আর বই পড়ছি না। মাইকেল প্রঙ্কোর দা লাস্ট ট্রেন শেষ করে পুরো ঘেঁটে গেছে মাথা। কেন যে বইটার এত নাম, কারা যে এইসব বইগুলোকে এত পুরষ্কার দেয় ভগবান জানে। ব্যোমকেশ-ফেলুদা-শবর-কাকাবাবু ছাড়ুন আমাদের কিরিটি রায়ও এর থেকে অনেক ভালো। অন্তত পড়ে বোঝা যায় কে, কি এবং কেন। জাপানীদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা।  

 

তুত্তুরীকে বগলদাবা করে ইন্ডিয়ানা জোনস্ দেখতে বসে শৌভিক। হেড ফোন ভেদ করে ভেসে আসে বাপবেটির উত্তেজিত কথাবার্তা। কোনটা যে বেশি বিমোহিত বুঝতে পারি না। একবাটি গরম চিলি-পটেটো বলস্ ভেজে নিয়ে দুজনের মধ্যে ঢুকে বসি আমি।  একসাথে তিনজনে ঘুরে বেড়াই পেট্রা নগরীর পথে পথে। মা-মেয়েতে একসাথে প্রেমে পড়ি তরুণ হ্যারিসন ফোর্ডের। শৌভিকের সাথে ঝগড়া করি কে বেশী মহোময় শন কনোরি নাকি হ্যারিসন ফোর্ড। এই ভাবেই কাটুক না আগামী বছর, আগামী প্রতিটা বছর। বছর আসুক, বছর যাক, সম্পর্ক গুলো অমলিন থাকুক সবার। বাকিটা ঠিক ম্যানেজ হয়েই যাবে।

No comments:

Post a Comment