Monday 7 February 2022

প্যার সে পুকারল না-

 



দরজা ঠেলে প্রবেশ করলেন তিনি, সামান্য ভারাক্রান্ত চিত্তে। সেখানকার রাণী ছিলেন তিনি,চাইলে কত কিছুই করতে পারতেন সামান্য অঙ্গুলি হেলনে। করেননি অবশ্য, বরাবর থেকেছেন মাটির কাছাকাছি। একবার কেবল অনুযোগ করেছিলেন, এক ব্যাটা উঠতি ফ্লাইওভারের জন্য বন্ধ হতে বসেছিল ওণার ছোট্ট ফ্ল্যাটের আলোবাতাস। অনুরোধ করেছিলেন যদি একটু দেখা হয় ব্যাপারটা। ভাবতেও পারেননি যে শুধু ওণার জন্যই সম্পূর্ণ নক্সা বদলে যাবে উড়াল পুলের। ঘুরে যাবে অভিমুখ।  অগণিত মানুষের অপরিসীম স্তাবকতায়, ভালোবাসায়, প্রেমে, শ্রদ্ধায় পুরোপুরি সম্পৃক্ত, নুব্জ তিনি। 


কিন্তু এযে অন্য জগৎ। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা জগৎ। বড় ভয় লাগছে তার, লাগছে ভয়ানক বিষণ্ণ। আচমকা এক ফচকে ছোঁড়ার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলেন তিনি, ‘এই তো লতা দিদি এসে গেছে-’। বড় চেনা গলা ছোঁড়ার। জন্ম ফাজিল ছোঁড়া। প্রথম দেখাতেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, স্টেশন থেকে স্টুডিও অবধি এমন ভাবে পিছু নিয়েছিল, তিনি ভেবেছিলেন কোন পাতি রোড সাইড রোমিও বোধহয়। দু চার ঘা খেয়েই যেত ছোকরা, যদি না কেউ বলত যে খোদ দাদামণি ওর দাদা। শুধু কি সেবার, সুযোগ পেলেই মজা করত ছোকরা। সেই ১৯৮৭তে শেষ দেখা। কিন্তু ওভাবে ছোকরাকে দেখতে চায়নি তার লতা দিদি। বড় অকালে হারিয়ে গিয়েছিল ছোকরা। ভাবতে ভাবতে আনন্দে না খুশিতে কে জানে ছলছলিয়ে ওঠে সাম্রাজ্ঞীর দুই আঁখি। 


পাশ থেকে আরেক পরিচিত কণ্ঠ, বাঙালি টানে বলে ওঠে,‘ কিঁউ দিদি ঠিক হ্যায় না? আশা ক্যায়সি হ্যায়?’ ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির রেখা ফুটে ওঠে তাঁর। মনে পড়ে যায় সেই সব সাদাকালো দিনের কথা। কিশোর-রাহুল তো হল, তিন মূর্তির আরেক মূর্তি কই? ভাবতে না ভাবতেই তাঁর দেখা পেলেন। পরিচিত ঠেট হায়দ্রাবাদী টানে বলে উঠল মেহমুদ, ‘হাম কালে হ্যায় তো কেয়া হুয়া, দিদি আবসে ইয়ে ‘কুঁয়ারা বাপ’ আপকে ‘পডোসন’।’ খিলখিল করে বাচ্ছা মেয়ের মত হেসে উঠলেন তিনি। 


আদরের দিদির সঙ্গ ছাড়লই না তিন মূর্তি। ধীরে ধীরে দেখা হল, নৌশাদ জীর সাথে, এগিয়ে এসে স্বাগত জানালেন মদনমোহন জী। শঙ্কর জয়কিষণকে এক সাথে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। বড় ঝামেলা পাকিয়েছিল মাঝে দোঁহে। ভাগ্যে রফি সাব ছিলেন। দুটোই ধরে বসিয়ে আলোচনা এমনকি বকাবকিও কম করেননি। ভাবতে না ভাবতেই হাসিমুখে এগিয়ে এলেন দেবতুল্য মানুষটি। বড় অল্প বয়সে এ দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। পরিশীলিত বিনম্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন কেমন আছেন তিনি। আশ্বস্ত করলেন, ‘কড়া নিগরানি’তে রেখেছেন এস-জে জুটিকে। কোন বেয়াদবি আর বরদাস্ত করা হবে না এপাড়ে। এখানে তো সবাই রাজা। 


‘সরস্বতী বিসর্জনের দিনই ব্যাটারা তোমাকে হারিয়ে ফেলল লতা? এ বহুত বুরা হুয়া। অব চলো চলো আমরা সবাই অপেক্ষা করছি, এ শুধু গানের দিন,  আর আজ সেই গান হবে শুধু তোমার।’ চূড়ান্ত কতৃত্ব নিয়ে ঘোষণা করলেন শচীন কর্তা। ঠিক ঠিক মাথা নেড়ে সঙ্গত করলেন মান্না দে। লজ্জিত তাঁর দুই বিনম্র আঁখি খোঁজে এদিক ওদিক কাকে যেন। ঐ তো নূরজাহান জী, রাজকুমারী জী, গীতা আর গুরু দত্ত জী, মধুবালা জী, সুরাইয়া জী।  আছেন ইউসুফ সাব থুড়ি দিলীপ সাব। দেবানন্দ জী। মনোজ কুমার, রাজ কুমার, রাজেন্দ্র কুমার জী। পৃথ্বী রাজ কাপুর সাবকে ঘিরে বসে থাকা রাজ-শাম্মি-শশী কাপুর দের তিন ভাই এর সাথে পুঁচকে ঋষি। সবাই করজোড়ে নমস্কার জানাল। নার্গিস-সুনীল দত্ত ও আছেন দেখলেন, আছেন মীনা কুমারী, কামাল আমরোহী সাবও। ট্রাজেডি কুইনের চোখে হেথায় নেই কোন দুঃখ, আছে শুধু অপরিসীম শান্তির দীপ্তি। হেসে  ইশারায় বোঝালেন ‘চলতে-চলতে’টা গেও কিন্তু। 


এত এত পরিচিত মানুষকে দেখে খুশি তিনি, তবুও উদ্বেল হৃদয় যেন কার জন্য? তিনি কই? তাঁর কাছে কি খবর পৌঁছায় নি, নাকি অধমার সাথে এসে দুটো কুশল বিনিময়েও তাঁর কুণ্ঠা? অথবা অনীহা। গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করছে তাঁর। জ্বালা করছে চোখ দুটো। মঞ্চে অসহিষ্ণু পঞ্চম শুরু করে দিয়েছে ধুমধাম বাদ্য। লক্ষ্মীকান্ত জী নীচে থেকে বলে উঠলেন, ‘ইয়ে সুর নেহি হ্যায় পঞ্চম, ইয়ে শোর হ্যায়।’ গা করল না পঞ্চম, বাজানোর আনন্দে বাজিয়েই চলেছে,রাজেশ খান্না জী আরো উস্কে দিচ্ছেন আহাঃ আহাঃ করে। বাজনার তালে তালে কিশোর ডেকেই চলেছে,‘দিদি, ও দিদি। এবার তো এসো-’। মহা ফাজিল ছোঁড়া। গায়ে কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে, পায়ে পায়ে স্টেজে উঠলেন তিনি। চাঁদের হাটে পলকে নেমে এল অসীম স্তব্ধতা। © Anindita Bhattacharya 


গলা ঝাড়লেন তিনি, দম নিলেন, বুকটা সামান্য ব্যথা করে উঠল। নিজেকে সংযত করে চোখ বন্ধ করে গাইতে যাবেন, এমন সময় কর্ণ কুহরে মধু ঢালল কার যেন মধুর সুরেলা কণ্ঠ, ‘ইয়াদ কিয়া দিল নে কাঁহা হো তুম, ঝুমতি বাহার হ্যায় কাঁহা হো তুম-’। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল কি সাম্রাজ্ঞীর হৃদস্পন্দন? শাড়ির খুঁটে কি মুছলেন দু ফোঁটা আনন্দের অশ্রু? অপার দৃষ্টিতে তাকালেন পাশে এসে দাঁড়ানো ধপধপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত সৌম্যদর্শন বাঙালী যুবকের দিকে। কালো ফ্রেমের চশমার ওপারে দুই অতলান্ত গভীর চোখে যাঁর খেলছে শরতের রোদ। ইশারায় বললেন, ‘গাইয়ে লতাজী।’ বলতে হত না, লতাজীর সুর তন্ত্রী এই মুহূর্তে বোধহয় তাঁরও বশে নেই, ‘প্যার সে পুকারলো জাঁহা হো তুম। প্যার সে পুকারল যাঁহা হো তুম।’


পুনশ্চঃ চাইলে শেয়ার করতেই পারেন, দয়া করে কপি পেস্ট করবেন না। চিত্র সৌজন্য ফেসবুক।

No comments:

Post a Comment