#তাম্রলিপ্তকড়চা
পরশু সন্ধ্যা ৭টা১০- আপিস থেকে বাড়ি ফিরে তুত্তুরীকে পড়াতে বসেছি, লোকটার মেল ঢুকল। নাঃ লোকটাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না, নিখাদ কেজো ইমেল।
বাংলা বই খুলল তুত্তুরী। সুর করে ‘কাজলা দিদি’ মুখস্থ করছে, আমি মন দিলাম লোকটার চিঠিতে। লোকটা লিখেছে, ‘মাননীয়/মাননীয়া মহোদয়, পত্রের প্রথমেই আমার পরিচয় জানাই। আমি হলুম ধরুন গিয়ে শ্রী আজিজুল। মোর বাপের নাম ধরেন গিয়া এজাদ। মোর গাঁয়ের নাম, পূব বাহালা।১০ই মার্চ ১৯৫৯ সালে মোর জন্ম। পেশায় ছিলুম নির্মাণকর্মী। আপনাদের দপ্তর আমাকে নির্মাণকর্মী হিসেবে মান্যতাও দিয়েছিল বৈ কি। পেয়েছিলুম নির্মাণকর্মীর কার্ড। এখন বুড়া হৈছি। আর খাটতে পারিনে কো। তাই পেনশন দেয় আপনাদের দপ্তর।
কিন্তু বিগত কয়েকমাস পেনশন ঢোকেনি কো। স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, শরীরের একটা অংশে বিশেষতঃ বাঁ হাত আর পায়ে তেমন সাড় পাই না আজকাল। পঙ্গুত্ব গ্রাস করিছে। ওষুধপত্রের ও যা অগ্নিমূল্য। পেনশনের টাকা কটা বড় দরকার, একটু দেখেন না। গরীবের বড় উপকার হয়।’
মোদ্দা কথা এই, এর সাথে আরো কিছু আনুষঙ্গিক কথাবার্তা, যা যে কোন সরকারী দপ্তর সম্পর্কে লোকে বলে আর কি। আমি বেশ কবার গেছি ব্লক আপিসে, ওরা বলেছে আপনার আপিসে পাঠিয়ে দিয়েছে বা বেশ কয়েকবার আপনাদের ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছি, পাইনি ইত্যাদি। পাবার কথাও নয়। সদ্য স্থানান্তর হয়েছে আপিসটা। বলে কয়ে টেলিফোন লাইনটা এখানে আনানো হয়েছে বটে, তবে এখনও তেমন শক্তপোক্ত নন তিনি। মাঝেমধ্যেই অক্ষিপটল উল্টে বসে থাকেন । আর সুস্থ হতেও সময় নেন বেজায়।
পরশু রাত ৮টা ৯- অবশেষে ফিরে ফোন করল শান্তনু। অচেনা পঙ্গু বৃদ্ধের মেলটা পড়ে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেলেতে দেওয়া তথ্য থেকে বৃদ্ধকে খুঁজে বার করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই শান্তনুকে ফোন করেছিলাম। শান্তনু পেশায় তাম্রলিপ্ত আপিসের সিকেসিও হলেও, গোটা অফিসটা থাকে ওর আঙুলের ডগায়। সমস্ত তথ্য সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে আপিসের নিজস্ব ওয়েবসাইটে। শান্তনুকে গুছিয়ে বলার মিনিট তিনেকের মধ্যেই আমার মোবাইলে পৌঁছে গেল বৃদ্ধের নাম, পিপিও নম্বর, লাইফ সার্টিফিকেট কবে জমা পড়েছে, কবে কলকাতা গেছে তার বিশদ তথ্য।
দেখে আশ্বস্ত হলাম যে বৃদ্ধের তথ্য আমরা কুক্ষিগত করে রাখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে মহানগরে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে। ভাবলাম কাল এইটুকু তথ্যই মেল করে জানিয়ে দেব বৃদ্ধকে।
পরশু রাত সাড়ে ৮টা- প্রবল বিরক্তি নিয়ে সোশ্যাল স্টাডিজের বই খুলল তুত্তুরী। আজকের পাঠ্য ডেজার্ট আর ফরেস্ট। বাংলা মাধ্যম থেকে পাশ করা আমি, নিরক্ষীয় চিরহরিৎ অরণ্য মুখস্থ করতেই কাঁদতে হয়েছে এতদিন এখন আবার ঐ একই জিনিস ইংরেজিতে বোঝাতে হচ্ছে মেয়েকে। এর থেকে বড় অত্যাচার আর কিছু হতে পারে? অতিকষ্টে ইকোয়াটোরিয়াল ময়েস্ট এভারগ্রিন থেকে ট্রপিকাল ড্রাই ডেসিডুয়াস ফরেস্টে পৌঁছতে বেরিয়ে গেল জিভ। ঢের হয়েছে বাপ। আজ এইটুকুই থাক। অকালেই ছুটি পেয়ে আনন্দে মত্ত নৃত্যরত তুত্তুরীর অসাক্ষাতে এসে সাহস করে ফোনটা করেই ফেললাম কলকাতার সুমিত বাবুকে। পেনশনগুলো মূলতঃ উনিই ছাড়েন। ভুল লিখলাম পেনশন অবশ্যই ছাড়েন বোর্ডের মাননীয় সিইও সাহেব। তবে যায় তো সুমিত বাবুরই হাত ঘুরে।মোটামুটি ওণার নখদর্পনে থাকে অনেকটাই তথ্য। যদিও এই ভাবে পূব বাহালা গাঁয়ের স্বর্গীয়(তাই হবেন নির্ঘাত) এজাদ বাবুর পুত্র আজিজুল বাবুর পেনশন কেন ঢোকেনি বা কবে ঢুকবে বললে উনি বলতে পারবেন না, তবুও যদি কিছু জানা যায়। যদি সামান্য ত্বরান্বিত হয় বৃদ্ধের কটা টাকা।
ফোনের প্রথমেই বিস্তর মার্জনা চাইলাম, আপিস টাইমের আগে বা পরে বা ছুটির দিনে কেজো কারণে কাউকে ফোন করলেই মার্জনা চাই আমি। তারপর শোনালাম বৃদ্ধের করুণ মেলের কথা। উনি অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে জানালেন, বৃদ্ধের পিপিও নম্বরটা দিলেই উনি কাল আপিসে গিয়ে জানিয়ে দিতে পারবেন, পেনশনের কি অবস্থা। ফোনটা রেখেই পাঠিয়ে দিলাম শান্তনুর দেওয়া পিপিও নম্বরখানা।
গতকাল বেলা ১২টা ২৭- সুমিত বাবু বার্তা পাঠালেন, বৃদ্ধের লাইফ সার্টিফিকেট সিস্টেমে উঠে গেছে। এই মাসের মধ্যেই ঢুকে যাবে পেনশন।
গতকাল বেলা ১টা ৬- প্রথমে ভেবেছিলাম বৃদ্ধকে ফোন করেই জানাই। বারংবার অনুযোগ করেছেন ওণার ফোন ধরেনি কেউ। তবে অফিসের ফোনটা আবার মৃত। ব্যক্তিগত ফোন থেকে জানালে যদি ভাবেন মস্করা করছে কেউ-। সাত পাঁচ ভেবে শেষমেষ ইমেলই করলাম। লিখলাম-
‘প্রিয় আজিজুল বাবু,
আপনার ইমেল আমরা পেয়েছি। এতদ্বারা আপনাকে জানানো হচ্ছে যে আমাদের অফিস রেকর্ড অনুযায়ী, আপনার লাইফ সার্টিফিকেট কলকাতায় পাঠানো হয়েছে এবং কলকাতা অফিস তা পেয়েও গেছে। কলকাতা অফিসের সাথে আপনার কেসটা নিয়ে আমরা কথা বলেছি, এবং ওনারা আশ্বস্ত করেছেন যে খুব শীঘ্রই, সম্ভবতঃ এই মাসের মধ্যেই আপনার পেনশন ঢুকে যাবে। ভালো থাকবেন এবং আসছে নভেম্বরে অবশ্যই মনে করে আপনার লাইফ সার্টিফিকেটটা জমা করবেন।
ধন্যবাদান্তে
আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর তাম্রলিপ্ত।’
গতকাল রাত ৭টা৫৭- তুত্তুরীর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ঠিক করলাম পাটিসাপটা বানাব। বেশ খানিকটা নারকেলের ছাঁই রয়ে গেছে। গৃহকর্তার বড় প্রিয় পিঠে ঐটা। কড়ায় পাতলা ঘোল ঢেলে গ্যাস কমিয়ে একবার আপিসের ইমেলটা দেখতে গেলাম। এটাই আমার নিত্য রুটিন। দেখতে গিয়ে দেখি মেল করেছেন আজিজুল বাবু। জানিয়েছেন, এই বৃদ্ধের জন্য আপনাদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণে আমি ধন্য। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা নেবেন। ভালো থাকবেন।
ভিতরে গুড় নারকেলের পুর ভরে আলগা করে পাটাসাপটা খানি মুড়তে মুড়তে ভাবলাম, একখানা ইমেল আর দুটো ফোন করা ছাড়া আমি আর করলাম কি? সদ্য চাকরিতে ঢোকার পর, তৎকালীন অফিসার সংগঠনের জনৈক বড় দাদা বলেছিলেন, ‘সরকারি আপিস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সব থেকে বড় নালিশ কি জানিস? কেউ কথা শোনে না। একটু শুনিস। কাজ হওয়া, না হওয়া পরের কথা, মানুষের কথাটা তো শোন।’ তারপর কেটে গেছে কত বছর, ভাগ্যে সেদিন সেই ভদ্রলোকের এই কথাটা কান করে শুনেছিলাম।
No comments:
Post a Comment