শৌভিক দিব্যি আছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, নিজেকে রাজা উজির ভেবে দিব্য চটি ফটফটিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, গোছা গোছা ফাইল আর সার্টিফিকেট সই করছে, শ্যেন দৃষ্টিতে আমার সমস্ত কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখছে, পদে পদে আমার দোষ ধরছে, চুরি করে মুখে একটা নারকেল নাড়ু পোরার সাথে সাথেই চলমান অশরীরীর মত এসে উদয় হচ্ছে এবং আমার গুষ্টির তুষ্টি করছে। সর্বোপরি কথায় কথায় আস্তিন গুটিয়ে ঘটি-বাঙালের ঝগড়া করছে। কে বলবে আজ সন্ধ্যার ডাকে খবর এসেছে ব্যাটা কোভিড পজিটিভ।
এমনিই তো ছেড়ে গিয়েছিলাম মঙ্গলবার। দিন দুয়েকের ছুটি নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম আমার শহরে। দুর্গা পুজোর পর আর থাকাই হয়নি বাবার বাড়ি। একদিকে পিছিয়ে যাওয়া দুয়ারে সরকার, অন্যদিকে তুত্তুরীর বন্ধ ইস্কুল, তাই ভেবেছিলাম দুটো দিন কাটিয়ে আসি হাওড়ায় গিয়ে। বাপের বাড়ি ভারি মজা। নৈশ ভোজে মায়ের হাতের লাল আটার লুচি, আলু ফুলকপির জিভে জল আনা বাটি চচ্চড়ি আর কড়কড়ে চিনি। বেলা সাড়ে নটার সময় চোখ খুলেই মুখের কাছে ধরা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, প্রাতঃরাশে কাঁচা আম আর লঙ্কার আচার দিয়ে ম্যাগি, দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে কাঁচা লঙ্কা আর অপরিমিত কাঁচা তেল দিয়ে পোস্ত বাটা, হিং গন্ধী বিউলির ডাল, আচারের তেল দিয়ে মাখা এক তাল আলু ভাতে, কাঁচা সর্ষের তেল ছড়ানো আলু-বড়ি পোস্ত, নিটোল করে ছাড়ানো হাফ বয়েল সিদ্ধ ডিম আর সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে নেটফ্লিক্স দেখা- এত সুখ সহ্য হলে তো।
সত্যি বলছি মাইরি আওয়াজ দেবার জন্যই ফোনটা করেছিলাম। ওরম আমি প্রায়ই করি, হাওড়ায় গেলেই। ‘ কি রে, কি করছিস? আপিস যাচ্ছিস? আজ ছুটি না? ওঃ আজ বুধবার বুঝি, ইশ্ কত খাটিস তুই। পারিস কি করে, কে জানে? ভেবেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। আমি তো এই ঘুম থেকে উঠে, জলখাবার সাঁটিয়ে আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুতে যাচ্ছি। আজ ভাবছি চানটাও আর করব না-। ’
কিন্তু এবারে জবাবটা প্রত্যাশিত পেলাম না। অঝোর গালি বর্ষণের বদলে ভেসে এল ম্রিয়মাণ কণ্ঠ, ‘নাঃ আজ আমিও যাচ্ছি না। পলাশকে(ড্রাইভার) নিষেধ করে দিলাম।বললাম অফিসে থাকতে। প্রয়োজনে ডেকে নেব। শরীরটা ঠিক যুৎ লাগছে না। কাল রাত থেকে গলায় ভীষণ ব্যথা।’ গলায় ব্যথাটা শৌভিকের নৈমিত্তিক সমস্যা। টনসিলের ধাত, মাঝেমধ্যেই ঠাণ্ডা লেগে ইনফেকশন হয়। পইপই করে নিষেধ করা সত্ত্বেও যে ভাবে গরম জলে স্নান করে সকাল-সকাল পাতলা টিঙটিঙে একখান টিশার্ট পরে ছাতে পায়চারি করে বা সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে ঐ টিশার্টটা পরেই হনহন করে বাগানে হাঁটে, ঠাণ্ডা লাগাটা তো সময়ের অপেক্ষা। কতবার বলি, ওরে একটা টুপি পর অন্তত, ছেলেদের টাকে ঠাণ্ডা বেশি লাগে- শোনে কেমন? যাই করতে বলি, শৌভিকের একটাই জবাব, ‘শ্বশুরটাকে করতে/পরতে বল। ’ সারাদিন আমার বাপকে নিয়েই পড়ে থাকে লোকটা। ঈর্ষা, পাতি ঈর্ষা। এত বছর বিয়ের পরও, আমার প্রিয়তম পুরুষ আমার বাবা কি না।
যতই লঘু ভাবে নিই ব্যাপারটা, শৌভিক অফিস কিন্তু চট করে কামাই করে না। বিশেষতঃ অসুস্থতার অজুহাতে তো নয়ই। বেলা এগারোটা নাগাদ ফোন করলাম, খোঁজ নিতে। কম্বলের তলা থেকে চিঁচিঁ কণ্ঠে জবাব এল, ‘পলাশকে একটা থার্মোমিটার আনতে বলেছি। জ্বর আসছে।’ এরপর আর রিস্ক নিইনি। তুত্তুরীকে তার দাদু-দিদার নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে একাই ফিরে আসি তাম্রলিপ্ত। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ যখন দরজা খুলে দিল শৌভিক, মুখ লাল, চোখ ছলছলে। টেবিলে আধখাওয়া ম্যাগির প্লেট। জীবনেও এ বাড়িতে অর্ধভুক্ত প্লেট পড়ে থাকে না টেবিলে। যতই শরীর খারাপ হোক উচ্ছিষ্টটুকু ময়লার বালতিতে ফেলে, সিঙ্কে প্লেটটা নামাবেই শৌভিক। জন্মসূত্রে Virgo কি না, তাই পরিচ্ছন্নতার বাতিক মারাত্মক। সেই লোকটা আজ কোন মতে দরজাটা খুলে দিয়েই গিয়ে শুয়ে পড়ল, তখনই বুঝতে বাকি রইল না, কি বাঁধিয়ে বসেছে।
বুধবার রাতটা সত্যিই একটু চাপে কাটল। প্যারাসিটামল চিবিয়েও জ্বর দাঁড়িয়েই রইল ১০২ এর ঘরে, সাথে ব্যাপক কাঁপুনি আর অসহ্য বেদনা। এ আমার চেনা লক্ষণ। ২০২০র জুন-জুলাই মাসে ঠিক একই অনুভূতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলাম। খুঁড়ে খুঁড়ে বেদনা বার করে আনে কোভিড। ভাগ্যে ছুঁতে শেখেনি হৃদয়কে।
ঝঞ্ঝাবহুল রাতের পর বৃহস্পতিবার সকালটা অবশ্য শুরু হল বেশ পজিটিভ ভাবে। জ্বর পুরোপুরি না সারলেও থমকে দাঁড়াল ৯৯ এর ঘরে। গলা ব্যথা, কান কটকট আর পিঠে সামান্য বেদনা বাদে রোদ খেতে গেল বাকি ব্যথাবেদনার দল। সদলবলে সদর হাসপাতালে টেস্ট করাতে গেল শৌভিক। বাড়ি বসে করল না কেন? এ প্রশ্ন করিয়া লজ্জা দিবেননি। রাপিড টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ এল। RTPCR টেস্ট করিয়ে দুটো পাখনা সমেত উড়তে উড়তে বাড়ি এল শৌভিক। শুক্রবারও উড়ছিল, এমন সময় খবর এল বাবু ওমিক্রন বাঁধিয়ে বসেছেন।
তারপর থেকে শুধু তুল্যমূল্য বিচারই করে চলেছি আমরা। আমার কোভিড আর শৌভিকের কোভিডের। আমার সময় টেস্ট করাতেই লেগেছিল পাঁচ ছদিন। তাও পোড়াতে হয়েছিল বিস্তর কাঠ আর খড়। আর ওর বেলায়-। আমার সময় একঘরে হবার ভয়ে হাতে গোণা জনা কয়েক বন্ধু ছাড়া আর কাউকে খবর দিতে সাহস পাইনি আমরা। যেদিন টেস্ট হয়েছিল, সেদিনই দুসপ্তাহের মত চাল, আলু, মাছ আর ডিম কিনে গুদামজাত করে রেখেছিল শৌভিক। এমনকি তুত্তুরীর জন্মদিনেও বেরোয়নি বাড়ি থেকে। ঐ গুদামজাত সামগ্রী দিয়েই মাথা খাটিয়ে হাতে গোণা উপকরণ দিয়ে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে দিয়েছিলাম মেয়ের সামনে। সুস্থ হয়ে আপিস যেতেও বুক কাঁপছিল, যদি আমাকে অচ্ছুৎ গণ্য করে এক ঘরে করে ব্যাটারা। যদিও ফুল,মিষ্টি আর কিসব উপহার দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল আমার তৎকালীন টিম, তবুও মনে আছে সেই গা ছমছমে দিনগুলোর কথা।
আর শৌভিকের বেলায়, দুবেলা আসছে যাচ্ছে ফাইলের পাহাড়। এবেলা ওবেলা খবর নিয়ে যাচ্ছে শৌভিকের লোকজন। খুচখাচ বাজার নিয়ে চার বার তো পলাশ একাই এসে ঘুরে গেল। টেস্ট করতে যাবার সময় শৌভিকের ড্রাইভার আর সিকিউরিটিকে বললাম, ভালো করে মাস্ক পরে যেতে। দুজনে হেসে উড়িয়ে দিল। ব্যধিটা একই আছে অথচ কত বদলে গেছে সমাজ আর তার দৃষ্টিভঙ্গি।
পুনশ্চঃ আর একটা জিনিসও বদলায়নি, তা হল আমার ভূতের ভয়, সেদিনও একা শুতে পারতাম না, আজও নয়। ভূতের থেকে কোভিডের সঙ্গে কুস্তি করা অনেক ভালো রে বাবা।
No comments:
Post a Comment