#তাম্রলিপ্তকড়চা
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা যে এতখানি ঐতিহ্যপূর্ণ তা এখানে আস্তানা না বানালে হয়তো জানতেও পারতাম না। এ জেলার আছে, নিজস্ব ইতিহাসের ধারা। গোটা জেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে একটা দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা রাজবাড়ি। আরো বেশিও থাকতে পারে আমি এখনও পর্যন্ত কেবল তমলুক, মহিষাদল, পাঁচেৎগড়, কাজলাগড় আর ময়না রাজবাড়ির হাল হদিসই জানতে পেরেছি। আজও সেই সব রাজবংশ তথা তাঁদের অধীনস্থ ভূস্বামীদের তৈরি অসংখ্য পোড়া মাটির মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই জেলার এদিক-ওদিক। বেশ কিছুর অবলুপ্ত প্রায়। বাকিদেরও অবস্থা খুব খারাপ। যেগুলো সারানো হয়েছে, সেগুলি দেখলে কান্না পায়। পাতি সিমেন্ট বালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে যাবতীয় পোড়ামাটির সুক্ষ্ম কারুকার্য।
মংলাইয়ের মন্দিরটা অবশ্য এখনও টিকে আছে। পয়লা জানুয়ারির দুপুরে আমরা গিয়েছিলাম ফুল দেখতে। ক্ষীরাই নয়, ওখানে আজ বড় ভিড় আর হট্টগোল। তাই ভিতরে, গ্রামে যেখানে আমরা ছাড়া কেউ নেই এমন অঞ্চলে। এবছর যদিও ফুলের হাল খুবই খারাপ। অসময়ের বৃষ্টিতে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ পাঁশকুড়ার ফুলের চাষ। অন্যান্য বছরে এতদিনে মাঠগুলো ভরে যায় রঙবেরঙের মরশুমি ফুলে। দূর থেকে মনে হয় শতরঙী গালচে পাতা হয়েছে বুঝি। এবছর এখনও আসেনি ফুলের পুরো বাহার। তাও যা দেখা গেল, আমরা তো তিনজন তো তাতেই মোহিত। বড় উর্বর এখানকার মাটি, ফুল-সব্জি যাই লাগানো হয়, ঝেঁপে আসে ফসল।
ফুলের শোভা দেখে ফিরে আসব, বিডিও সাহেব অনুরোধ করলেন কয়েকটা স্থানীয় মন্দির দেখে যেতে। সবই বেশ প্রাচীন, আড়াই-তিনশ কি আরো পুরানো পোড়ামাটির মন্দির। রাজপথ থেকে বেশ অনেকটা ভিতরে, চাষের জমির মাঝে মংলাই রাধাদামোদর মন্দিরে গিয়ে যখন আমরা পৌঁছালাম, সন্ধ্যা নামছে। দিনের শেষে রাসমঞ্চের পিছনে মুখ লুকাচ্ছেন অস্তমান দিনমণি।
১৭খানা চূড়াওয়ালা তিনতলা দোলমঞ্চ। মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়। সরু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম তুত্তুরী আর আমি। তিনতলায় ওঠার আর সাহস হল না। বেশ খারাপ অবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন এবছর বন্যায় দীর্ঘদিন ডুবে ছিল দোলমঞ্চটি। সাপখোপের বাসা। শীতকাল বলে হয়তো সামনে আসছেন না তাঁরা, তাই বলে বেশী সাহস না দেখানোই বাঞ্ছনীয়। দোলমঞ্চটি শোভিত অপরূপ পোড়ামাটির ভাস্কর্যে।
বঁদিকে ভগ্নপ্রায় মন্দির। আদতে বানিয়েছিলেন যে ভূস্বামী, তাঁর বংশধরেরা আজও চেষ্টা করে চলেছেন মন্দিরটিকে টিকিয়ে রাখার। আজও উপাসিত হন,এই মন্দিরের দেবতা। ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে পৌঁছেছি আমরা, দেবতার সামনে জ্বলে উঠেছে সন্ধ্যাদীপ, অন্ধকার মন্দিরের ভিতর কম্পমান দীপশিখা যেন আচমকা শরদ্বিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর কোন ঐতিহাসিক গল্পের পটভূমিকায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কে জানে কালের মন্দিরার মত কোন গল্প রচিত হয়েছিল কি না, এই মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে।
মন্দিরের গায়ে রয়েছে অসংখ্য পোড়া মাটির মূর্তি। যার অন্যতম হল ১৮ হাতের মা দুর্গা। বিষ্ণু মন্দিরে দেবী শক্তির মূর্তি কেন? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? সবকিছুই যেন কেমন রহস্যে মোড়া-
No comments:
Post a Comment