পৌষ পার্বণ এলেই ঠাকুমার কথা খুব মনে পড়ে। আর মনে পড়ে যায় আমাদের সাবেকী রান্নাঘরটার কথা। এককালে এবেলা ওবেলা পঞ্চাশ-ষাট জনের পাত পড়ত এ বাড়িতে, সেই অনুপাতেই রান্নাঘরখানা বানিয়েছিলেন প্রপিতামহ। দুখানা দরজা, চারখানা জানলা, দুখানা কুলুঙ্গি ওয়ালা বিশাল ঘরটার আসল রঙ কি ছিল কে জানে। পৌনে শতক ধরে জ্বালানো উনুনের ধোঁয়ায় ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছিল ছাতের কড়িবরগা সমেত গোটা ঘরটাই। একটা ষাট ওয়াটের হলুদ বাল্বের আলোয়, কয়লা,ঘুঁটে আর গুলের উনুনে পিঠে বানাত ঠাকুমা।
উনুন ধরানোটাও ছিল একটা আর্ট। ধরানোর আগে সাজানো হত উনুনটাকে। তলায় পাতা হত কয়েটা ঘুঁটে। ওই বয়সে আমার মনে হত ঘুঁটে দেওয়াটাও একটা আর্ট বটে। আমাদের পূব দিকের দেওয়ালে ঘুঁটে দিত পদ্মদি। আর আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন পাঁচিলের ওপর থেকে হাঁ করে দেখতাম আর খোশ গল্প করতাম পদ্মদির সাথে। পদ্মদির ঘুঁটের ওপর থরে থরে রাখা হত কয়লা অথবা গুল। আশির সোনালী দশক, তখন সববাড়িতেই একটা করে হাতুড়ি থাকত কয়লা ভাঙার জন্য। কয়লার থেকে অনেক সস্তায় মিলত ঘেঁষ বা কয়লার গুঁড়ো। ধুলোর মত সেই ঘেঁষকে মাখা হত ভাতের ফ্যান আর পুকুরের পাঁক দিয়ে। পাঁক বিক্রি করত নকী পিসি। দুপুর বেলা যখন পাড়ার সব সমর্থ পুরুষেরা কাজে বেরিয়ে যেত, ভিজে শাড়ি পরে দুহাতে পাঁকের বালতি নিয়ে বাড়ি বাড়ি পাঁক বিক্রি করতে যেত নকী পিসি। সেই ঘেঁষ আর পাঁক/ফ্যান মিশিয়ে গোল গোল বড়ার মত গুল দিত মায়াদি আর দেবীদি। ওরা যে আদতে গৃহ পরিচারিকা বা গৃহ শ্রমিক এই তত্ত্ব যখন আদতে আমাদের মাথায় ঢুকেছিল, ততোদিনে মায়াদি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন আর দেবীদি বিবাহ করে বসতি গেড়েছে সুদূর খানাকুলের কোন গাঁয়ে।
উনুনের আঁচে বসানো চাটুতে কাঁটা বেগুনের বোঁটা দিয়ে তেল মাখিয়ে ঘরের শিলে বাটা চালগুড়ির মিশ্রন ঢালত ঠাকুমা, তারওপর উল্টে দিত মাটির সরা। ছ্যাঁক করে আওয়াজ হওয়া মাত্রই লাগোয়া রোয়াকে বসে নারকেল দড়িতে গিঁট ফেলতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। ঠাকুমার মুখে শোনা সেই উমনো-ঝুমনোর গল্পের বাবাটার মত।
কেন জানি না আজও মনে হয় ঠাকুমার মত আস্কে পিঠে আর কেউ বানাতে পারে না। আমার বড় মাসির মত পিঠেই বা কে বানাতে পারে? কি অমানুষিক খাটতে পারত বড়মাসি। অ্যালুমিনিয়ামের মস্ত গামলা ভর্তি ভর্তি পিঠে বানাত একা হাতে। দুই মাসি, মেসোমশাই, চার দাদা, তাদের অগণিত বন্ধুবান্ধব সবাইকে পেট পুরে খাইয়েও ঝোলা ভরে পাঠিয়ে দিত আমাদের জন্য। দুধ পুলিই বলুন বা সিদ্ধ পুলি, ভাজা পিঠেই হোক বা পাটি সাপটা সবকিছুই দুধরণের বানাত বড়মাসি, এক ধরণের ভিতরে থাকত নারকেলের পুর আর এক ধরণের পিঠের ভিতর হরিণঘাটার দুধকে ঘন করে প্রায় শুকিয়ে ফেলা ক্ষীরের পুর । সকাল থেকে একা হাতে আপিস টাইমের রান্না বাড়া করে সবাইকে খাইয়ে আপিস-ইস্কুল-কলেজে পাঠিয়ে, জামাকাপড় কেচে, শুকিয়ে, রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনে, দুপুরে হাল্কা গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে কাচা কাপড় পরে পিঠে বানাতে বসত বড়মাসি আর রাতারাতি হয়ে যেত পিঠে বানানোর মেসিন। খুব খুব মিস করি সেই দিনগুলোকে। শুধু পিঠে বানিয়েই ক্ষান্ত হত না বড়মাসি, দাদাদের হাত দিয়ে গরম গরম আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে তবে শান্তি। দাদাদের সময় না হলে, ধুত্তোর বলে নিজেই বাড়ির শাড়ি পাল্টে, ঘোমটা টেনে, ঝোলা হাতে রওণা দিত আমাদের বাড়ির দিকে। শুধু একদিন নয়, পরপর তিনদিন।
পৌষ পার্বন এলে জ্যাঠাইমার কথাও খুব মনে পড়ে। কি ঝটপট পিঠে বানিয়ে ফেলত জ্যাঠাইমা। মালপোই বলুন বা ভাজাপিঠে বা রসবড়া সবকিছুই আধঘন্টার মধ্যে রেডি করে ফেলত জ্যাঠাইমা। কোন উৎসব বা পার্বণ নয়, জ্যাঠাইমা পিঠে বানাত শুধু আমার জন্য। যখনই খেতে চাইতাম, যাই খেতে চাইতাম। জ্যাঠাইমার কাছেই পায়েস বানাতে শেখা আমার। পৌষ পার্বণে আর কিছু বানাই বা না বানাই, ঘণ লাল চাপ-চাপ গুড়ের পায়েস অবশ্যই বানাই।
এই বছর অবশ্য পিঠে পায়েস বানানোটা ছিল বেশ চাপের ব্যাপার। সদ্য নতুন জেলায় আস্তানা বানিয়েছি আমরা। কাছাকাছি দোকানবাজার কোথায় কি কিছুই আজ অবধি শিখে উঠতে পারিনি। সবকিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় সহযোগীদের ওপর। শৌভিকের আগের বেশ অনেকজন মহকুমা শাসকই একলা থাকতেন হেথায়, আমার মত পাগল আর কে আছে, যে মেয়ের মহানাগরিক পড়াশোনা, ইস্কুল জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র একসাথে থাকা, একসাথে বাঁচার মোহে বদলী নিয়ে আসবে গোবিন্দপুর। তো সেই কারণেই হয়তো সহযোগীগণ অভ্যস্ত একলা মানুষের দোকানহাট করাতে। আমরা যে সদলবলে থাকব এবং যাবতীয় উৎসব পাব্বন ঢাকঢোল পিটিয়ে করব তা আর বেচারা জানবে কি করে।
বলেছিলাম পলাশ ‘একটু ভালো গুড়’ এনে দিও তো। পলাশ এনে দিয়েছে বৈকি। ভয়ানক 'ভালো' প্রায় সাড়ে তিনশ টাকার গুড় এবং যথার্থই 'একটু' অর্থাৎ মাত্র পাঁচশ গ্রাম। আর এনে দিয়েছে দুখানা নিটোল নারকেল। ও দুটো অবশ্যি কেনা নয়, উপহার। আমার পিঠে বানানোটা যে পলাশের ঘোরতর না পসন্দ, তা পলাশ খোলাখুলিই জানিয়েছে আমায়। 'ম্যাডাম, আপনি করবেন কেন? ম্যাডামরা আবার ওসব করে নাকি? তাদের অত সময় কুথা? আমার বউ বানিয়ে দিবে খন।' সত্যিই পলাশের বউ বানিয়ে দেয়, অনেক কিছুই, যেমন ধরুন বাড়ির পুকুরের গেঁড়ির ঝাল, নারকেল নাড়ু, সিদ্ধ পুলি, আরো কত কি। ভীষণ সুস্বাদু হরেক রকম খাবার। তাই বলে পৌষ পাব্বনের দিন এরকম বেয়াড়া আব্দার কেউ করে? না হে পলাশ, আমি নিজেই বানাব।
নারকেল তো পেলাম, কাটারি আর কুরুনি নেই যে।
শেষে রান্নার দিদিকেই ধরলাম। এই জেলার মেয়েরা ভয়ানক কর্মঠ। আমাকে একটা অন্তত নারকেল যদি একটু বাড়ি থেকে কুরে এনে দেয়। ভগবান মঙ্গল করুন তাঁর, অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি, একটা নয়, দুটোই কুরে এনে দিয়েছেন তিনি। যে চায় চিনি, যোগান চিন্তামনির মত, মাত্র একশ একটাকা দিয়ে এক কিলো দুর্ধর্ষ ঝোলা গুড়ও এনে দিল আমার আপিসের শুভদীপ্ত। ব্যাস আর কি? বাকিটা তো চেনা সিলেবাস।
বাসনকোসনের ভয়ানক অভাব সত্ত্বেও টুকটুক করে অনেক রকমই হল, পায়েস, দু রকম সিদ্ধ পুলি( নোনতা আর মিষ্টি), দুধ পুলি, ভাজা পিঠে, রস বড়া, সরু চাকলি। নতুন থালা বাটি কিনে, সাজিয়ে ঘরের ঠাকুরের সামনে যখন তুলে ধরলাম, ঘড়িতে রাত পৌনে দশটা। এত উঁচু গ্যাসের টেবিল, যে বড় কড়া বসিয়ে লেঙচে লেঙচে পিঠে বানাতে গিয়ে যন্ত্রনায় বেঁকে যাচ্ছে পিঠ আর হাঁটু।
শৌভিক তুত্তুরীকে বেড়ে দিয়ে নিজের হাতের পিঠে নিজে খেতে বসে হঠাৎ ভীষণ মনটা খারাপ হয়ে গেল। এক প্রস্থ খারাপ হল তাদের জন্য যাদের কাছে পিঠেপুলির জন্য হ্যাংলামি করতাম আমি আর দ্বিতীয় দফায় খারাপ হল তাদের জন্য প্রতি বছর আমার হাতের পিঠে খাবে বলে হ্যাংলার মত বসে থাকে যারা। যাঁদের কেউ গুরুজন আবার কেউ লঘু।এত দূরে সরে আসার জন্য খাওয়াতে পারলাম না যাঁদের কাউকেই। প্লিজ এমনি থেকো তোমরা, বদলে যেও না, আর সবথেকে বড় কথা হারিয়ে যেও না।
No comments:
Post a Comment