আমরা যারা সরকারী চাকরি করি, পরিযায়ী পাখির মত বাঁচি, তাদের বদলীর সময় এলেই দুটি চিন্তা ভ্রমরের মত গুঞ্জরিত হয় মাথায়, প্রথমতঃ অবশ্যই আমার কোথায় হবে আর দ্বিতীয়তঃ আমার জায়গায় কে আসবে? কার হাতে তুলে দিয়ে যাব আমার দলবলকে, কেমন মানুষ সে? যখন দুটি প্রশ্নের উত্তরই হয় মনোমত তখন আর চিন্তা কি?
একে তো যেখানে যাচ্ছি, চেয়ে চিন্তেই যাচ্ছি, তারওপর উত্তরসুরি আবার পরম সুহৃদ। ফলতঃ 'আমার মত সুখী কে আছে'?অন্তত আজকের দিনটায়। বাকি থাকে কেবল বড়দি, অর্থাৎ উপরওয়ালীর মৌখিক সম্মতি। এমনিতে বড়দি নির্ঝঞ্ঝাট, প্রথম দিনেই বলেছিলেন, ম্যাডাম আর আপনি বলে সম্বোধন করলেই ঠ্যাঙাবেন। যেমন দিদিগিরি চলত, তেমনিই যেন চলে। তা এহেন বড়দি যদি অনুমতি দেন তো 'রইল ঝোলা, চলল ভোলা' করে গুটি গুটি রওণা দিই আর কি। বড়দি যে খুব একটা খুশি খুশি, ‘ আচ্ছা তাহলে পাততাড়ি গুটাও’ বললেন তাও না, বরং মৃদু অনুযোগের সুরেই বললেন,‘ এত তাড়া কিসের তোমার?’ বলবেন নাই বা কেন, একই অর্ডারে নাম ছেপে বের হওয়া কেউই যে এখনও অব্যাহতি পায়নি দায়ভার থেকে
শেষ পর্যন্ত অবশ্য বড়দিকে পটিয়ে, কাগজপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে গেলাম, বেশ একটা,‘ পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহ ভাই, সবারে আমি প্রণাম করে যাই’ মার্কা ফুরফুরে অনুভূতি নিয়ে শেষ করলাম সোমবারটা। মাঝখান থেকে ত্রিপাক্ষিক এগ্রিমেন্টটাও সই হয়ে গেল মালিক আর শ্রমিকপক্ষের মধ্যে। সব পক্ষের আনা মিষ্টির বন্যা বয়ে গেল আপিসে। মাথা পিছু তিন চারখানা মিষ্টি সাঁটিয়েও শেষ হল না। ধীমান বিরক্ত হয়ে বলল,‘ এই বাক্সটা বাড়ি নিয়ে যান। আর কেউ খেতে চাইছে না। ’
মেশিন বন্ধ করে উঠতে যাচ্ছি, কৌশিক বলল,‘ ম্যাডাম একটু সার্কিট হাউসটা যদি-’। বুক করাব? কেন? কেউ থাকবে নাকি রাতে? ঘাড় মাথা চুলকে যা বলল, বুঝলাম সার্কিট হাউসের মিটিং হলে ফেয়ারওয়েল দিতে চায় ওরা আমায়। ধীমান এমনিতেই খবর নিয়ে এসেছে, ফাঁকাই আছে মিটিং হলখানা। নাজিরের সাথে কথা বলে হাতে লিখেও দিয়ে এসেছে, শুধু একটা চিঠি যদি করে দি, আরো পোক্ত হয় ব্যাপারটা। নিজের ফেয়ারওয়েলের জন্য নিজেই চিঠি করলাম, একটু নজ্জা নজ্জা করছিল যদিও।
বাড়ি ফিরছি, সঞ্চিতার ফোন, ‘টিফিন আনবেন না। লাঞ্চের সামান্য ব্যবস্থা করেছি আমরা।তুত্তুরীকে অবশ্যই আনবেন। ওকেও ধরা হয়েছে-। ’ লজ্জায় আর বলতে পারলাম না, ওকে তো আনতেই হবে। প্রথমতঃ আমার বদলীর খবর আসা ইস্তক চুঁচুড়া আর তার মানুষগুলোর জন্য বিলাপ করে চলেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বিগত পাঁচ বছরে বেশ অনেক বারই এসেছে কিনা, পিকনিক থেকে মেলা সবেতেই উপস্থিত ছিলেন তিনি। প্রথম দিকে রমেশ আর প্রীতিই ছিল তাঁর প্রিয় বন্ধু, এখন আরো অনেকের সাথে দোস্তি হয়েছে তাঁর। আমার সাথে সাথে এই মানুষগুলোকে বিদায় জানাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁরও।
তবে শুধু এই জন্যই নয়, তুত্তুরীকে আনব, কারণ তেমনিই মানত করেছিলাম দেবী হংসেশ্বরীর কাছে। মানত করেছিলাম সেই বিগত জানুয়ারীতে। তারপর আর সেই মানত পুরো করা হয়ে ওঠেনি। এমনিই হয় আমার। প্রতিবছর মেলার আগে মানত করি, ঘাড় ধরে যখন বাঁশবেড়িয়াতেই টেনে আনো বারবার, তখন নির্বিঘ্নে মেলা মেটানোর দায় আমার পাশাপাশি তোমারও। তুমি এইবারটি করে দাও, তারপরই আমি এসে পুজো দিয়ে যাব। বলি বটে, তবে পুজো দিতে দিতে এসে পড়ে পরের বছরের মেলা। বাঁধে তুমুল গণ্ডগোল,দেখাদেয় উটকো সমস্যা, কিছুই হয় না ঠিকঠাক। তখন মনে পড়ে,হায় মা, তোর পুজোটা তো বাকি রয়ে গেছে। আসছি মা, আসছি, আর সমস্যা সৃষ্টি করিস না। অতঃপর চূড়ান্ত ব্যস্ত নির্মলকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাই মন্দির, চল বাবা চল। মিষ্টি ফুল যা যা লাগবে যোগাড় করে পুজো দিই। নাহলে তোর আর আমার মাথাটাই খারাপ করে দেবেন এই নীলবর্ণা ভদ্রমহিলা থুড়ি দেবী।
২০২১এর মেলায় জনৈক রাজনৈতিক দল এমন সমস্যা করছিল বলার নয়।ডেপুটেশন, মেলার বাইরে কালো পোস্টার, টুকটাক হুমকি। তারওপর অরাজনৈতিক একচোট মারামারি, জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তির ভিআইপি টিফিনে তুলতুলে খাসির মাংসের আব্দার- সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল পাগলই হয়ে যাব। দুচারটে লোককে কামড়ে দিলে যদি মেটে কিছু সমস্যা। একমুঠো বাজেটে খাওয়াব কি আর সাজাব কি? নিজেদের খাবার বলতেই তো ডিম ভাত, তৎকালীন বড়সাহেব বলেছিলেন দুটো ডিম যদি দেওয়া যায়, ওসি ফুড চঞ্চল হাত জোড় করে মার্জনা চেয়েছিল। ভিআইপি প্যাকেট নিয়ে স্যার-চঞ্চল-কেটারার আর আমি রীতিমত গবেষণা করেছিলাম সবথেকে সস্তায় সবথেকে বড় প্যাকেট কি হতে পারে, যা নাড়াচাড়া হলে ঠং ঠং করবে না। সেখানে খাসি আনব কোথা থেকে? তা যাও বা ম্যানেজ হল, এল নতুন ফর্মান, গান শোনাতে হবে। আমায় নয়, কোন ভাড়া করা সুগায়িকাকে দিয়ে।
আধপাগল থেকে পৌনেপাগল হয়ে মনে পড়ল, যাঃ বিগত বছরের পুজোটা তো রয়ে গেছে বাকি। বিশ্বাস করবেন না, পুজো দিয়ে আসার সাথেসাথেই কি ভাবে যেন মিটে গেল সমস্যা গুলো। ঝামেলা বাঁধানো রাজনৈতিক দলের জনৈক নেতা, স্বয়ং ফোন করে আশ্বস্ত করলেন,‘ আমাদের নিয়ে একদম টেনশন করবেন না। এটা রাজ্যব্যাপী কর্মসূচী, আমাদের তাই করতেই হবে। তবে এই আপিসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এত ভালো, গেলে আপনারা বসান, চা খাওয়ান। দাবীদাওয়া শোনেন, দরকারে কলকাতায় পাঠান লোকজনকে তত্বাবধান করতে। আপনাদের কোন ভাবে বিপদে বা অস্বস্তিতে ফেলব না আমরা। ’ অতঃপর তিনি বিশদে জানালেন, কোথায় জমায়েত হবেন তাঁরা, কোথা থেকে রওণা হবে ডেপুটেশনের মিছিল। এজেন্ডা কি ইত্যাদি। এবং পরিশেষে কোথায় তাঁদের আটকালে বাঁচবে তাঁদের মুখ আর আমাদের মেলা। অমুক বাবু, আমি জানি আপনি স্বনামে ফেসবুকে নেই, কিন্তু এটাও জানি আমাদের যাবতীয় ব্যাপারস্যাপার শ্যেন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন আপনারা। কথাপ্রসঙ্গে দু চারটে লোপ্পা বল আপনি বা আপনার দলবল স্বয়ং তুলে দিয়েছিল আমার হাতে। মুস্কিল হল, আমাকে দেখে যতটা গাম্বাট হোঁদলু মনে হয়, আসলে ততোটা নই। যাই হোক, এটাও নির্ঘাত অচীরেই আপনার দৃষ্টিগোচর হবে, তাই আগেভাগেই বলে রাখি, বিশ্বাস করুন, আপনার সেদিনের উপকার আমি জীবনে ভুলব না। আর একটা কথা আপনার নাম আমি আমার বর( যিনি আমার কোন বক্তব্যই হয় কান দিয়ে শোনেন না অথবা শুনলেও অন্য কান দিয়ে বার করে দেন) ছাড়া আর কারো কাছে আজ অবধি প্রকাশ করিনি। এমনকি বড়সাহেবের কাছেও নয়। সবাই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল আমার তথ্য শুনে। রাত এগারোটা অবধি থানায় বসে,রিহার্সাল হয়েছিল পুরো নাটকটা।তারপর আর কোথাও কোন সমস্যা হয়নি।
মোদ্দা কথা পুজো দিয়ে আসার সাথেসাথেই সবকিছু সাল্টে দিয়েছিলেন, নীলবর্ণা দেবী। বদলে মানত ছিল, 'মেলা উৎরে দাও মা, মেয়েটাকে সমেত ধরে এনে পুজো দেব।' তাই আনতেই হবে শ্রীমতী তুত্তুরীকে। ফোনটা রেখে, জানলার বাইরে ছুটে চলা আলোর শহর আর ছায়া মানুষ গুলোকে দেখতে দেখতে এই প্রথম উপলবব্ধি হল, চার বছর দশ মাস কাটানো শহর, থেকে তাহলে সত্যি সত্যিই এবার গোটাতে হবে পাততাড়ি।
No comments:
Post a Comment