Friday 22 October 2021

অনির ডাইরি ৫ই অক্টোবর,১৯৯২

 

‘তোমরা সবাই পান্তা খাবে, আর আমার জন্য লুচি?’ যাকে প্রশ্নটা করল ঝুমি, তাঁর পরণে সাদা থান, মাথায় ঘোমটা, আর মুখে একগাল অমায়িক হাসি।পুরী লেখা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে গতরাত থেকে ভেজানো আছে লাল চালের ভাত। সামান্য ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে নির্ঘাত আজ তা থেকে। খেলে দারুণ ভালো ঘুম হয় বলে শুনেছি। গাঁয়ের লোক এমন এক থাল ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে মাঠে চাষ করতে বা চাষবাসের তত্ত্বাবধান করতে। এখুনি অ্যালুমিনিয়ামের শানকিগুলোতে ভাগাভাগি হয়ে যাবে জল সমেত অমৃত। তার সাথে মিশবে ঝাঁঝালো গন্ধওয়ালা ঘানিভাঙা সর্ষের তেল, আধখানা বা চারটুকরো করা পেঁয়াজ, মটমটে কাঁচালঙ্কা। নিকানো উঠোনের তুলসী তলায় হয়ে আছে পুঁচকে লঙ্কা গাছ, লাল সবুজ একরাশ লঙ্কার চাপে নুয়ে পড়েছেন তিনি। তার থেকে ভেঙে অানা হবে দুচারটে। মিশবে খেতের ছোলা ভাঙানো ছাতু, ঘরে ভাজা আউশ চালের মুড়ি। আর মিশবে নরম নরম মুসুর ডালের বড়া। ছোট ছোট দানার আধকুটো করা ঘরের খেতের ডাল, জলে ভিজিয়ে রাখা আছে, উনুন পাড়ে শিল পেতে বাটা হবে। একটু জলজলে করে বেটে তার সাথে পেঁয়াজ, লঙ্কাকুচি মিশিয়ে চাপড়া করে ঢেলে দেওয়া হবে গরম তেলে। পুড়তে থাকা পাটকাঠির ধিকি ধিকি আগুনে লোহার কড়ায় ভাজা সে বড়ার সোয়াদ আর গন্ধ অতুলনীয়। ওপরটা মুচমুচে আর ভিতরটা নরম তুলতুলে। 


এইসব মিশিয়ে যে সুখাদ্যটি প্রস্তুত হবে তাই দিয়েই প্রাতঃরাশ সারবে এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা। শুধু কলকাতা থেকে আগত জামাই আর নাতিনাতনীদের জন্যই তৈরী হয়েছে ফুলকো লুচি আর আলুর তরকারী। সাথে গঙ্গাপাড়ের নারান দাসের দোকানের রসগোল্লা। মনখারাপ করে বারান্দায় এসে বসলাম। বারান্দা নামে পরিচিত হলেও আসলে দাওয়া বা রোয়াক। দোতলা মাটির বাড়ির বাইরের দিকের দাওয়াটাকে এরা বলে বারান্দা। বারান্দায় এসে বসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়, বারন্দার একদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুটো নারকেল গাছ। ফি বছর ঝড়ে তাঁরা টালি ভাঙেন। 


অপরদিকে বিশাল বাগান। বাগান ভর্তি কত যে গাছ, সব দিদার নিজের হাতে লাগানো। মুর্শিদাবাদের উর্বর মাটিতে বড় জলদি বাড়ে গাছপালা। মস্ত পিটুলি গাছটা ডালপালা ছড়িয়ে উঠে গেছে প্রায় চারতলা বাড়ির সমান, পাশেই একখান সজনে ডাঁটার গাছ, বেঁটে বেঁটে গোটা কয়েক নারকেল গাছ, সুবিশাল একটা জাম গাছ, যা হয়তো লম্বায় আর কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাবে পিটুলি গাছটাকে। তবে আড়ে পিটুলি গাছটাকে ধরতে লাগবে আরো অনেকদিন। হনুমানদের আড্ডাখানা এই গাছটা। পাকা জামের লোভে আসেন তেনারা। জাম খান আর বীজগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেন দিদার বাগানে। এছাড়াও আছে কাগজি লেবুর গাছ, অনেকগুলো পেঁপে গাছ,হলুদ কল্কে আর সাদা টগর ফুলের গাছ আর বাগানের সীমানা বরাবর বাসক ফুলের গাছ।


 বাসক ফুল ফোটে ঝুড়িঝুড়ি, কে যেন শিখিয়েছিল সম্ভবতঃ মায়ের কোন তুতো বোন, ফুটে থাকা বাসক ফুল তুলে, সবুজ বৃতিটা ছিঁড়ে ফেলে দলমণ্ডলের পিছনের অংশটা মুখে পুরে সুড়ুৎ করে টানলেই মুখ ভরে যায় মিষ্টি বাসক ফুলের মধুতে। ওটা যে মধু নয় মকরন্দ বা নেক্টার তা শিখতে তখনও বাকি অনেকদিন। কল্কে ফুলের মকরন্দও দারুণ খেতে তবে লাল পিঁপড়েদের সাথে লড়াই করে উদ্ধার করতে হয় তা। গাছ থেকে ঝড়ে পড়া কল্কে ফুলের মকরন্দ চুষতে গিয়ে একে তো লাল পিঁপড়ের কামড়ে ঠোঁট ফুলিয়েছি তারওপর উদোম কানমলা খেয়েছি বড়দার কাছে। একটাই ভালো কথা যে রামনগরে এসে মা কিছু বলে না, সারাদিন কি করছি, কি খাচ্ছি, কার সাথে কোথায় যে ঘুরছি হদিশই রাখে না মা। বছর ঘুরলে একবার বাপের বাড়ি আসে কি না, চুটিয়ে উপভোগ করে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে নেয় গ্রামবাংলার যাবতীয় রূপরস গন্ধ। 


এবছর বড়দা ছাড়া বাকি দাদারা কেউ আসেনি। ফলে পুজোটা বেশ নিস্তরঙ্গ কাটছে আমার। গল্প করার, খুনসুটি করার, হাতাহাতি করার কেউ নেই। বড়রা ব্যস্ত তাদের জগতে। শহরের পুজো আর জাঁকজমক ফেলে এই নিবান্দা নিস্তব্ধপুরীতে আসতে কারো ভালো লাগে? তারওপর এরা আমায় পান্তাও খেতে দেয় না। শুকনো মুখে লুচি চিবাচ্ছি, গায়ে একটা নরম স্পর্শ হয়ে লাগল, নাকে তামুক পাতার হাল্কা সৌরভ। একটা ছোট বাটিতে চাট্টি মুড়ি নিয়ে এসেছে দিদা, ভুলে গিয়েছিলাম দিদা তো পান্তা খাবে না। কায়স্থ বাড়ির বিধবা বড়গিন্নী, নিরামিষাশী তো বটেই ভাতও দিনে একবেলা কেবল খায় দিদা। মায়ের মুখে শোনা, কোনদিনই তেমন আমিশাষী ছিল না দিদা, তবে পেঁয়াজ খেতে বড় ভালোবাসত। ভাতের সাথে একটুকরো পেঁয়াজ থাকলেই খাওয়া হয়ে যেত দিদার। ছোটদাটা ঠিক দিদার মতই হয়েছে, সকাল বিকেল একটুকরো পেঁয়াজ চাইই ওর। মাঝে প্রোটিনের অভাবে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল দিদা, মরেই যেত যদি না ডাক্তারের পরামর্শে প্রোটিনেক্স খাওয়ানো হত। দিদার মশলার আলমারি ভর্তি নতুন পুরাতন এমনকি মরচে ধরে যাওয়া প্রোটিনেক্সের টিন। যে জিনিসটা দুধে গুললে এমন অমৃত,সেটা একবার লুকিয়ে কাঁচা খেতে গিয়েছিলাম আমি। কি তেঁতো, বাপস্।  উচ্ছে করলাও ওর থেকে কম তেঁতো হয়। 


আমি লুচি খাচ্ছি, পাশে বসে মুড়ি চিবোচ্ছে দিদা, মাঝে মাঝে বলছে, ‘চাট্টি মুড়ি খাবে? ও ঝুমি? খাও না? ’ দিদারা বোধহয় এমনিই হয়। এত ভালো,এমন মিষ্টি, নরম তুলোর বলের মত-- শুধু বড্ড তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় আর যাবার সময় রেখে যায় একরাশ দমচাপা কষ্ট, আর উপলব্ধি, ‘আর কেউ কখনও এমন ভালোবাসবে না। আর কেউ কখনও কেউ এমন রসোগোল্লার রসে চুবিয়ে ডাকবে না, 'ঝুমি'।


 দাও তোমার থেকে একগাল মুড়িই খাই দিদা, তবে দুটো শর্ত আছে তোমাকেও কিন্তু আমার থেকে দু-একটা লুচি খেতে হবে।তারজন্য অম্বল বাঁধালে বা এঁটো খাইয়েছি বলে মা এসে চিৎকার করলে বা ঠ্যাঙাতে এলে বাঁচাতেও হবে তোমায়। আর হ্যাঁ আরো অনেকদিন থাকতে হবে আমার সাথে-  অনেএএএএএএএএএএক অনেএএএএএএএএএক দিন। ইলেক্ট্রিকের তারে বসা ফিঙের মত ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যেও না যেন- প্লিজ।

No comments:

Post a Comment