শুভ অষ্টমী
সবার রঙবেরঙের ছবির পাশে বড়ই সাটামাটা, বড়ই ম্যাড়মেড়ে এবছর আমার অষ্টমী। নাঃ আমি অঞ্জলি দিইনি। আনন্দময়ীর ওপর অভিমান করেছিলাম যে, এমন দিনে যদি ঘরের লোকটা হাসপাতালে শুয়ে থাকে, কার মন ভালো থাকে? আমার জীবনের দুই পুরুষের একজন আজ নয় দিন ধরে বন্দী হাসপাতালে আর অপরজন জড়িয়ে আছে 'তোমার ছুটি, আমার নয়' মার্কা দপ্তরী কর্তব্যের ফাঁকফোকরে। একাহাতে দশদিক সামলাতে গিয়ে রীতিমত বেরিয়ে আসছে জিভ, অকারণেই ছলছলিয়ে উঠছে আঁখি আর সপ্তমে চড়ছে মেজাজ।
সবথেকে বেশী দুঃখ হচ্ছে আমার মেয়েটার জন্য, সারা বছর এই কটা দিনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে মেয়েটা। আর এবছর এমন নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে জীবন আমায়,যে দুটো ঠাকুরও দেখাতে পারিনি মেয়েটাকে। ঠাকুর দেখা বলতে, বাড়ি থেকে হাসপাতাল যাবার পথে যেকটা পড়ে অথবা হাসপাতাল থেকে বাজার যাবার পথে যাঁদের অধিষ্ঠান। ঐ আর কি-
তাই বলে কি ভাবছেন, ঠাকুর দেখতে পায়নি, শ্রীমতী তুত্তুরী। ভুল ভাবছেন মশাই। তুত্তুরীর বড়মামা আছে না। ষষ্ঠীর বিকেলে বুল্লু বাবু সমেত তুত্তুরীকে নিয়ে দেখিয়ে এনেছে হাওড়ার যাবতীয় ঠাকুর। শুধু হাওড়া নয়, সপ্তমীর দিন তো তিন মুণ্ডু এক হয়ে পাড়ি দিয়েছিল উত্তর কলিকাতা। শৈশবের মহম্মদ আলি পার্ক হয়ে কলেজ স্কোয়ার আরোও কত কি। এমন কি কফি হাউসেও ঢুঁ মেরেছিল তিন জনে। কফি হাউসের কাটলেট আর কোল্ড কফির ছবি সেবন রত তিন মূর্তির নিজস্বী এখনও ভাস্বর আমার মুঠো ফোনে।
বাবার জন্য, আমার থেকেও বেশী যাদের মন উতলা, তাঁরা হলেন আমার মা আর পিসি। একটাও নতুন পোশাক ভাঙেনি ওরা এবার। পিসির আদরের তিন ভাইয়ের মধ্যে অবশিষ্ট আছে শুধু বাবা, পিসি বলে, ‘আমার শিবরাত্রির সলতে। ’ আর মায়ের তো গোটা জীবনটাই আবর্তিত হয় বাবাকে ঘিরে। যখনই এককাট্টা হয় দুই বৃদ্ধা, বয়ে যায় বিলাপের নদী। আবার কখনও দেখি, উভয়কে ঘিরে বয়ে যাচ্ছে অখণ্ড নীরবতার হিমবাহ। থেকে থেকে উপচে ওঠে দুজনেরই আঁখি। ভিজে যায় আটপৌড়ে শাড়ির বিবর্ণ আঁচল।
আজ সকালটাও এমনি কাটছিল। হয়তো সারাদিনটাই এমনি কুয়াশাঘণ কেটে যেত, যদি না জবরদস্তি দুটো শাড়ি ভাঙাতাম আমি। বাবার জীবনের প্রিয়তমা দুই নারী যদি বাঙালীর জীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসবের দিনে এমনি রঙচটা বিবর্ণ পোশাকে, আলুথালু চুলে অধোবদনে বসে থাকে বাবার ভালো লাগবে কি? রীতিমত সেন্টু দিয়ে, সাজিয়ে গুজিয়ে ছবি তুলে, মুঠো ফোন বন্দি করে নিয়ে গেলাম বৃদ্ধের কাছে। কাঁপা হাতে, ফোনটা ধরে ছবি গুলো দেখতে দেখতে কি জানি কি রোদ্দুর আর মেঘের লুকোচুরি চলছিল বৃদ্ধের হৃদয়ে, কে জানে কেমন লাগছিল বাবার, তবে ফিরে আসার সময়, অন্যদিনের মত,‘তোদের পুজোটা আমিই বরবাদ করে দিলাম,’ এই আক্ষেপটা আর আজ শুনতে হয়নি। মহাষ্টমীর দিনে এটাই বা কম পাওয়া কি?
No comments:
Post a Comment