Monday 11 October 2021

অনির পুজোর ডাইরি ৬ই অক্টোবর, ২০২১

 অনির পুজোর ডাইরি ৬ই অক্টোবর, ২০২১

(পর্ব-২) 

যাই লিখি, খুঁটিয়ে পড়ে লোকটা। দেয় সুচিন্তিত মতামত। ছবিগুলোও দেখে, শুধু আমারই নয়, আমার স্কুলের বন্ধুদেরও। সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে তো-। ফেসবুকে ওদের দেওয়া সব ঘটনাবলী, তথ্য নখদর্পনে থাকে লোকটার। সারাদিনে কত বার যে চা খায় লোকটা।  আর সিগারেট? উফঃ তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠে বাড়ির লোক। সবসময় বসার ঘরে ফ্লেক্সের কড়া গন্ধ। একবার প্রশ্ন করেছিলাম,গোল্ড ফ্লেক্স খাওয়া না কেন? ওটা নির্ঘাত আরো ভালো। লোকটা বলেছিল, ‘দামটা একটু বেশী। চিরকাল তো চারমিনার খেয়েই এসেছি।’ তারপর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের সুরে বলেছিল, ‘কেন গরিব বাপ পাতি ফ্লেক্স খেলে কি তোমার সম্মানে লাগে?’ কি প্রশ্নের কি উত্তর মাইরি। 


দেরী হয়ে যাচ্ছে। পরপর তিনটে ওলা ক্যান্সেল হল। সম্ভবতঃ রক্তদান শিবির চলছে, শ্রীভূমির ওদিকে, তাই প্রচণ্ড জ্যাম রাস্তায়। ফোন করলেই, উল্টোদিকের ড্রাইভার জানতে চাইছে, ‘কোথায় যাবেন দিদি,’ যেই বলছি হাওড়া, অমনি ঘচ্ করে বুকিং ক্যান্সেলের মেসেজ ঢুকছে। এতো মহা জ্বালা। বাইক ধরব কি? এয়ারপোর্ট থেকে হাওড়া গাড়িতে যেখানে এই মুহূর্তে ৫৬৬টাকা, বাইকে মাত্র ১৯২। কিন্তু অনাত্মীয় ব্যক্তির বাইকে চড়া যে ভয়ানক অপছন্দ লোকটার। 


কি যে অসম্ভব মনের জোর লোকটার, বয়সের ভারে হয়তো এসেছে কিঞ্চিৎ নুব্জতা, স্বল্প স্থবিরতা। সেই ঘাটতি মিটিয়ে দেয় বিক্রম আর মনের জোর। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে আজও আমি অপেক্ষা করে থাকি,লোকটার অমোঘ বাণীর,‘ আরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘাবড়াস না। ’ লোকটার মুখের কথা খসার সাথে সাথেই, সত্যিই সব যে কি ভাবে ঠিক হয়ে যায়, তা আজও এক দুর্ভেদ্য রহস্য আমার কাছে। লোকটা প্রায়ই বলে, জন্মলগ্ন থেকেই নাকি আমি তার জীবনের সূর্য। আমাকে ঘিরেই নানা কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায় লোকটা। আমার সামান্য সময়, অল্প একটু মনোযোগের জন্য হ্যাংলার মত বসে থাকে লোকটা। জীবনেও আমার কোন দোষ,কোন খুঁত খুঁজে পায় না লোকটা। তাই না বড় সাধ করে আমার নাম রেখেছে, ‘অনিন্দিতা’। 


লোকটার আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাইকই ধরলাম। মাথায় ফেট্টি বাঁধা একটি অবাঙালি ছেলে আর তার ধুলো পড়া কেলে অ্যাভেঞ্জারই আপাততঃ আমার পরিত্রাতা। মাথায় একখান জব্বর হেলমেট চেপেছে, যার ভারে মাথা আমার নুইয়ে এসেছে। পরার ইচ্ছে ছিল না মোটেই, আমার সামনে হেলমেট উল্টে জল ঝাড়ছিল ছেলেটা, আমি ঘাবড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম নির্ঘাত আগের সোয়ারীর ঘাম হবে, যা গরম আজ। ছেলেটা মা-বাপ- আল্লার কিরে করে বলল, ‘ইটা জোল দিদি। জোল। পানি। বিষ্টির পানি। আমিও ভিগে গিছি দেখেন। ’ 


এহেন লোকটা, ঠিক পুজোর আগেই যে কি বাঁধিয়ে বসল-। এই প্রথম মহালয়ার চণ্ডীপাঠ ধ্বনিত হল না আমাদের বাড়ি। প্রতি বছর ভোর চারটেয় ঠিক আমাকে ফোন করে লোকটা, অথবা আমি করি, ‘ওঠো,ওঠো মহালয়া শুরু হয়ে যায়-’। মহালয়া শেষ হয়ে গেলে আবার ফোন করে লোকটা,শোনায় তার ছেলেবেলার আগমনী গপ্প। বিশাল সাবেকী রেডিওতে গমগমে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর। ভোর বেলা বাবলু পিসির শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনার মনকেমন করা গল্প। আগুনে পুড়ে মারা যায় বাবলু পিসি। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণী। 


ঠিকঠাক রাস্তা চেনো তো, ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি আমি। কি জোরে চালাচ্ছে রে বাবা ছেলেটা। বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে জুড়ে এক মানুষ গভীর গর্ত। ইতিউতি জমে আছে শারদীয়া বৃষ্টির জল। ছিটে এসে লাগছে প্যান্টে। আকাশের মুখ এই গোমড়া তো এই হাসিখুশি। আচমকা বৃষ্টি নামলে কি যে হবে-। দক্ষিণেশ্বর ব্রীজ পেরিয়ে, বালি হয়ে,বেলুড়মঠ, লিলুয়া পেরিয়ে শালকিয়া চৌরাস্তায় পড়তেই খপ করে ধরল পুলিশ। ‘এই ব্যাটা এটা না ওয়ানওয়ে,  নাম। লাইসেন্স দেখা। ’ প্রায় দশ মিনিট হল ছেলেটা লাইসেন্স দেখাতে আর চালান কাটতে গেছে, বোকার মত বাইকে বসে আছি আমি। পাশ দিয়ে হাওড়া-হাওড়া হেঁকে চলে যাচ্ছে অটো। 


পরশুরাতেই ধমকে ছিলাম তুত্তুরীকে, সারাদিনে একটি বার ফোনও করেনি বুড়োবুড়িকে? কি এমন রাজকার্য করেছে তাহলে? ধমক খেয়ে রাত এগারোটায় করা ফোনে প্রথম জানতে পারলাম সন্ধ্যে থেকে অসহ্য পেটের ব্যথায় কাহিল লোকটা। ফোনের ওপার থেকে চিঁচিঁ করে বলল, ‘ডিকলিক খেয়েছি। কমে যাবে। তোকে অকারণ আর বিরক্ত করিনি। ’ পরদিন কাক ভোরে বৃদ্ধার ফোন, সারা রাত যাতনায় ছটফটিয়ে নেতিয়ে পড়ছে বৃদ্ধ। বাড়ির ডাক্তারকে খবর দিয়ে, তাঁর পরামর্শ মত দেওয়া হয়েছে অ্যানিমা, ফোটানো হয়েছে একাধিক ইঞ্জেকশন। পরবর্তী পদক্ষেপ হল হাসপাতালে ভর্তি করা। 


ট্রাফিক পুলিশের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে ফিরে এল ছেলেটা। সরি দিদি। ‘আপনার জন্য কিছু বললাম না,না হলে দিখাতাম মজা। ’ কাতর স্বরে জানালাম,ভাই, আমার এমনিতেই মজার শেষ নেই, তাই আমায় দয়া করে হাসপাতালে সময় মত পৌঁছিয়ে দে। যেখানে আইসিইউ এর দরজার দিকে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করছে এক বৃদ্ধ। শুধু আমার তরে, আমিই যে তার জীবনের সূর্য। আর সে আমার ধ্রুব তারা।  উৎসবও যে মাঝে মাঝে কেন এমন বেদনার হয়-  জলদি সেরে ওঠো বাবা।

No comments:

Post a Comment