Saturday, 6 November 2021

অনির ডাইরি ৬ই নভেম্বর, ২০২১

 

কি যে হইচই হত ভাইফোঁটার সকালগুলোয়। পুরো গমগম করত ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। হবে নাই বা কেন, বাবারা তিন ভাই, পাঁচ বোন। উপরি পাওনা হিসেবে মাঝেমাঝেই এসে উপস্থিত হতেন বাবলু পিসি, সম্পর্কে বাবাদের পিসতুতো দিদি। সাবেকী ঠাকুর ঘরে,তিনটি আসন পেতে, পিতলের লম্বা পিলসুজের ওপর রাখা মস্ত প্রদীপের কাঁপা আলোকে পরপর বসত জেঠু, বাবা আর ছোটকাকু। একে একে ফোঁটা দিত বড়পিসি, বাবলুপিসি, মেজো পিসি(যাঁকে আমরা তিন প্রজন্ম ধরে দিদি বলে ডেকে আসছি) আর অন্যান্য পিসিরা। এত মিষ্টি পেত বাবারা যে ছোটখাট একটা মিষ্টির দোকান দেওয়াই যেত বোধহয়। সাতদিন ধরে ঘুরতে ফিরতে মুখ চালিয়েও শেষ হত না সব।  


তারপর যা হয় আর কি, বয়ে যায় সময়ের নদী। টুপটাপ করে ঝরে যায় প্রিয় সম্পর্কগুলি। ১৯৮৯ সালে চলে গেল বাবলু পিসি। ২০০৬এ বড়পিসি। ২০১২ এ ছোটকাকু। ২০১৫য় বড় জেঠু। বাকি সম্পর্কগুলিতেও লাগল জরার ছোঁয়া। সবাই কেমন যেন ছিটকে গেল আরোও আরোও দূরে। পড়ে রইল কেবল মেজো পিসি আর বাবা।


কিছু সম্পর্কে বোধহয় হাত দেবার সাহস পায় না সময়, তাই তো কয়েক মাস কম ৮২ বছরের ছোট ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেবার জন্য আজও একই রকম ব্যগ্র আমার ৮৭ বছরের বৃদ্ধ পিসি। টুকটুক করে জমানো পয়সা নিয়ে খোদ গিয়েছিল মিষ্টি কিনতে। ভুল লিখলাম,পিসি অনুরোধ করেছিল আমায়। তখনও আসেনি কোজাগরী পূর্ণিমা, ব্যাগ গুছিয়ে তাম্রলিপ্ত যাবার তোড়জোর করছি আমি, পিসি ফিসফিস করে বলল,  ‘শোন না, ভাইফোঁটায় আসবি তো? আমার জন্য তিনটে প্যাকেট কিনে আনিস তো। একটা একটু বড়, আর দুটো একটু ছোট। টাকাটা নিতে হবে কিন্তু। ’ বুঝলাম বড় প্যাকেটটা আমার বাবার আর ছোট দুটো ছিমান বুল্লু কুমার আর ছিমতী তুত্তুরীর। কথা দিয়েছিলাম অবশ্যই কিনে আনব। 


কাল তাম্রলিপ্ত থেকে এক পক্ষকাল পর নিজের শহরে ফেরার পর খেয়াল হল,পিসির অনুরোধ আমি বেমালুম ভুলে এবং গুলে খেয়ে নিয়েছি। কি হবে এবার? অগতির গতি আমার খুড়তুতো ভাই শ্রীমান অয়ন কুমার চাটুজ্জে।  তিনি বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র কিনা, তিনি আশ্বাস দিলেন, ‘কুচ পরোয়া নেই। আমি কিনে আনছি। ’ কিন্তু গোঁ ধরল পিসি, তিনিও যাবেন।  অগত্যা, দ্বিপ্রাহরিক আহার সমাপন অন্তে পিসি ভাইপো রওণা দিল মিষ্টি কিনতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হেঁটে মোড়ের মাথা, সেখান থেকে টোটোয় চেপে কদমতলা বাজার। বাইকে চড়তে যে মোটেই চায় না পিসি। 


আর আমি, ভরদুপুরে চাদর মুড়ি দিয়ে, বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে লাগলাম,‘ হে ধরণী, দয়া করে দ্বিধা হও মা। ’ নিজের অপদার্থতা সম্পর্কে বরাবরই আমি সন্দেহহীন, তবে এবারের অপরাধটা একেবারে অমার্জনীয় যাকে বলে। 


ভাগ্যে পিসি ভুলে মেরেছে, এমন কোন অনুরোধ করেছিল,তাই রক্ষে। মা হলে নির্ঘাত আর মুখ দেখত না আমার। এক ডজন কথা ইতিমধ্যেই শুনিয়ে দিয়েছে তাও।  বিকাল চারটের সময় মস্ত লাইন দিয়ে বিরাট বাক্স করে মনপসন্দ মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরল পিসি। 


রাত পোহাতেই, স্নান সেরে, বুড়ো হাড়ে কাঁপতে কাঁপতে কাচা শাড়ি পরে, প্লেট সাজিয়ে দোতলা থেকে একতলায় নেমে, শ্যাওলা ধরা উঠোনের একফালি পেরিয়ে, মস্ত লাল রোয়াক ধরে হেঁটে এসে বাবার শরিকি বসার ঘরে। ফোঁটা মিটলে বললাম, চল দুই ভাইবোনের একটা ছবি তুলে দিই। এমন সম্পর্ক যে বড় বিরল আজকের দিনে। বড় ভাগ্যবান এরা, হয়তো টাকাপয়সা, সোনা দানা, ব্যাংক ব্যালেন্স কিছুই নেই দুজনের তবুও এমন ভাগ্য, এত ভালোবাসা কজন পায় আর কজনই বা দিতে পারে। খুব ভালো থেকো দিদি আর বাবা, তোমারই আমাদের আদর্শ। তোমরাই তো শিখিয়েছ, অন্তে সব হিসেব মিলেই যায়, আর যা মেলে না, ভুল আছে সেই অংকটাতেই। #ভাইফোঁটারগপ্প

No comments:

Post a Comment