ফোনটা যখন এল , তখন আমি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একাকী জলমগ্ন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। শাশুড়ি মা যথার্থই বলেন, মা গো, এমন কুচ্ছিৎ জায়গায় মানুষ থাকে? এক পশলা বৃষ্টি মানেই এক হাঁটু জল। মুঠো ফোন বলছে, সবে রাত সাতটা বাহান্ন, আমার পিছনে জলের তোড়কে উপেক্ষা করে দৌড়চ্ছে মহানগর, আর আমার সামনে অখণ্ড নিস্তব্ধতা আর ঘন কালো টলটলে জল। কে বলবে আজ সকালেও হেঁটে নয়, রীতিমত দৌড়ে পেরিয়েছি এই একফালি রাস্তা। আপাততঃ জনবিহীন। আমার সাথে যে কয়জন হতভাগ্য এপাড়ে এসেছিল, সকলে হাঁটুর ওপর প্যান্ট গুটিয়ে ঝপাং করে জলে নেমে রাস্তা পার হয়ে গেছেন। ভোম্বলের মত দাঁড়িয়ে আছি আমি একাই। পায়ে তিন/চার ইঞ্চি হিলের মহার্ঘ চপ্পল, আগের দিনের বৃষ্টি আর জমা জল কোতল করেছে আমার সাধের দুগ্ধফেননিভ স্নিকার জোড়াকে। এদের অপমৃত্যু প্রাণে ধরে সইতে পারব না। আর খালি পায়ে এই রাস্তায় এত জল ঠেলে হাঁটতেও পারব না। ভেসেই যাব নির্ঘাত। ডুবেও যেতে পারি। জনৈক রিক্সাওয়ালা আশ্বস্ত করে গেছেন, সোয়ারী নামিয়েই ফিরে আসবেন আমার তরে, তাঁরই প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুনছিলাম আর কি।
ফোনের ওপার থেকে পণ্ডিতের উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল, ' এই আমাদের কেয়ারটেকারকে সাপে কামড়েছে-'। পণ্ডিতে পুরো নাম না হয় উহ্যই থাকুক, শুধু এইটুকু বলি যে কোন এক মান্ধাতার আমলে তিনি এই অধমের অপরূপা সহপাঠিনী ছিলেন। আপাততঃ দক্ষিণ কলকাতার বিরাট বনেদি বাড়ির জাঁদরেল গৃহকত্রী। কেয়ারটেকারকে সাপে কামড়ানোর খবরটা শুনে রীতিমত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললাম, 'হাসপাতালে নিয়ে যা। ইঞ্জেকশন দিতে হবে।' আমার জ্ঞানের পরিধি অতটুকুই। ওপাশ থেকে ভেসে এল, জাঁদরেল গিন্নীর মৃদু ধমক, 'হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। এবার বল সাপটাকে কি করব?'
আমি জন্মসূত্রে চাটুজ্জে, কাশ্যপ গোত্র। নিজেকে কাশ্যপ মুনির বংশধর হিসেবে ধরলে, কদ্রু দেবীর পুত্রকন্যাগণ নির্ঘাত তুতো ভাইবোন, নিদেনপক্ষে খুড়োজেঠা তো হবেনই। তা সত্ত্বেও কেন যে ওণাদের প্রতি বিন্দুমাত্র আত্মীয়তা অনুভব করি না। বরং উগ্র বিরাগ আমার।
অকপটে মনোভাব ব্যক্ত না করলেও, এমনি কিছু বলাতে, আরেক চোট ধমক খেলাম। সাপ না লুপ্তপ্রায় জীব। সংখ্যায় নগন্য। আর এই মহানগরে, বিশেষতঃ নিউআলিপুরের মত ধনাঢ্য এলাকায় সাপ তো রীতিমত দুর্লভ। অসহিষ্ণু কণ্ঠে ধমকায় পণ্ডিত, ‘ আরেঃ তুই কি সরকারী চাকরী করিস রে? শীঘ্রি বল, ফরেস্ট ডিপার্মেন্টের কোন হেল্পলাইন আছে কি না? কাকে ফোন করব? সাপটা বাথরুমের দরজা থেকে রীতিমত টারজানের মত ঝুলছে।’
অজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম,যে বনদপ্তরের কোন সহায়িকা নম্বর আছে কি না আমার বাপও জানে না। আমি তো কোন ছাড়? বনদপ্তরের সাথে আমার একটাই ক্ষীণ যোগাযোগ আছ, ওদের জনৈক আধিকারিকের গিন্নী আমার যাকে বলে বেস্ট ফেরেন্ড। চেনা বামনির পৈতে লাগে না,তাই তাঁর নামটাও না হয় উহ্যই থাকুক। সবাই তারে এমনিতেই এক ডাকে চিনে- তাকে বলাই যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পাতলা দাস্ত সককথাই তো বলি আমরা একে অপরকে। মাঝে মাঝে তো আমাদের বাক্যালাপ শুনে চমকে ওঠে আমাদের বরেরাও-' আচ্ছা এটাও কি অমুককে বলার দরকার ছিল?' কি করব! আমরা ওমনিই।
সমস্যা সেটা নয়,সমস্যা হল, এই যে মাত্র এক মাস আগেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কারো জন্য কারোকে বলব না। অন্য এক বন্ধুর জন্য ফোন করেছিলাম জনৈক আধিকারিককে। এমন কিছুই দাবী ছিল না, সামান্য দু মিনিট সময় চেয়েছিল প্রবাসী বন্ধুটি। টাটা কোম্পানিতে বড় চাকরি করে ছেলেটি, বিশেষ কোন লাইসেন্সের জন্য কিছু টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট জমা করেছিল টাটারা। কাজ মিটে যাবার পর টাকা ফেরৎ চেয়ে আবেদন করেন, তারপর কেটে গেছে সাত আটটা বছর। বন্ধু বলল, 'ও টাকা ফেরৎ না পেলেও কোন সমস্যা নেই। তবে বাড়ি ফিরছিই যখন, আমাকে বলা হয়েছে একবার তদারকি করে আসতে।তুমি তো চিনবেই ওই অফসরকে। একটু বলবে, আমি জাস্ট দুমিনিট নেব ওনার।' বেশ তো। এ আর এমন কি? জানতে চাইলাম কত টাকা? উত্তর যা পেলাম শুনে চমকে উঠলাম।গরিব দপ্তরের পক্ষে এটা অনেক টাকা। ফেরৎ তো পাওয়াই উচিৎ। আশ্বস্ত করলাম, বর্তমানে ওই দপ্তরের আধিকারিক আমার পরিচিত। বললে নিশ্চয় উনি কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
আশ্বস্ত তো করলাম। নিজে আশ্বস্ত হলাম কি? ফোন করতেই এমন ভয়ানক তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব এল, যে মনে হল অনেক হয়েছে, আমার আর এগিয়ে দরকার নেই। কার টাকা কে ফেরৎ পায়, বা না পায় শুধু শুধু আমার অপমানিত হওয়া নিরর্থক। পরোপকারের পোকার কামড় এমনি, যে তা সত্ত্বেও রীতিমত করুণাভিক্ষার সুরে বললাম, ' দেখো ভাই আমার নিজের প্রয়োজনে তো বলছি না। আশ্বস্ত থাকো যে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমি কখনোই তোমাকে বলব না। কিন্তু বন্ধুবান্ধব অনুরোধ করলে-। আর ও শুধু দুটো মিনিট কথা বলতে চায়।'
'আরে না, না এরকম বলছ কেন? তুমি পাঠাও না।দেখছি কি করতে পারি।' এই শুনে বন্ধুটিকে তো পাঠালাম। পরিণাম এটা হল যে তাকে বসিয়ে রাখা বেলা বারোটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটে অবধি। অবশেষে ঘর ফাঁকা দেখে যখন সাহস করে প্রবেশের সুযোগ পেল ছেলেটি, সাক্ষাতের মেয়াদ দাঁড়াল দুমিনিট এর জায়গায় মাত্র তিরিশ সেকেন্ডে। আর আমার নাম করতেই বলা হল, 'বাইরে যান।বাইরে গিয়ে বসে থাকুন।' পাঁচটার সময় আমিই ফোন করে একরাশ ক্ষমা চেয়ে বললাম, ভাই তুই বাড়ি ফিরে যা।
ন্যাড়া বেলতলায় আর কবার যায়? জানি না, তবে রিক্সায় উঠে প্রিয় বান্ধবীকে ধরলাম। আর যাই হোক, এ অমন তাচ্ছিল্য দেখাবে না। এটা নিশ্চিত। পরের ধাপে দেখা যাবে। বন দপ্তরীয় আধিকারিকের গৃহিনী, বনজঙ্গল তথা জীবজন্তু-সাপখোপের ওপর তাঁর কি অকাট্য প্রেম, সর্পনন্দন টারজানের মত ঝুলঝুল করে ঝুলছে শুনে প্রথম চোটে তার কি হাসি। অতঃপর যখন বললাম, যে বেচারী কেয়ারটেকার ইতিমধ্যে সর্পদ্রষ্ট এবং আমাদের পণ্ডিত দু-বগলে ছানা এবং পোনাকে আঁকড়ে ঠকঠক করে কাঁপছে (জানতে পারলে পণ্ডিত নির্ঘাত আমায় কোতল করবে। তবে কি না গল্পে রঙ চড়াতে ওসব বলতে হয়), বন্ধু ঘচ্ করে ফোন কেটে দৌড়ল। ফোনের এপার থেকে শুনতে পেলাম বন্ধুর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর, ‘ও গোওওওও শুনছোওওওও-----’।
ফ্ল্যাটের বেল বাজাতে না বাজাতেই ঢং করে ঢুকল মেসেজ, দক্ষিণ ২৪ পরগণার বন দপ্তরের আধিকারিকের নাম আর নম্বর। তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলাম পণ্ডিতকে। সাথে সাথে বিধিবদ্ধ সতর্কবাণীও দিলাম, ভাই, নম্বর না হয় যোগান দেওয়া গেল, কিন্তু এত রাতে তিনি ফোন ধরবেন কি না বা আদৌ কোন ব্যবস্থা নিতে পারবেন কি না, দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারছি না। ছিমতী পণ্ডিত, যাকে আমাদের চৈ ওরফে চৈতালী এই সেদিন অবধি সুযোগ পেলেই, ‘শেয়াল পণ্ডিত’ বলে খ্যাপাত, বাস্তবিক পণ্ডিতের মতই বলল, ‘জানি রে। এত বৃষ্টি হচ্ছে ও বেচারাই বা কি করবে, আর বনদপ্তরই বা কি করবে? ভাব নিউ আলিপুরে সাপ বেরোচ্ছে, কি দিনকাল পড়ল বাপু।এবার বাঘটা বেরোলেই একেবারে ১৬ কলা পূর্ণ হবে। ’
আশার বাণী আমি শোনাতে না পারলেও, রাত নটা নাগাদ পণ্ডিত শোনাল বটে, ‘ফোন ধরেছেন রে। এবং জানিয়েছেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমি যেন ধৈর্য না হারাই।’ জানতে চাইলাম, তিনি কি এখনও ঝুলছেন? জবাব পেলাম, তিনি এখনও টারজান মোডেই বিদ্যমান।
রাত গড়ায়। নানা নৈমিত্তিক কাজের ফাঁকে মন পড়ে থাকে শৈশবের বান্ধবীর কাছে। কি করছে তারা, কোন মেসেজও তো আসে না ছাই। অবশেষে রাত সোয়া দশটায় ঢুকল মেসেজ, ‘নিয়ে গেছে রে বাবু। থ্যাঙ্কু। তোর জন্য ছবিটা পাঠালাম।’
ছবি দেখে ভদ্রলোককে চিনতে পারব, এত বড় সর্পবিশারদ আমি নই। চিনতে যে খুব একটা উৎসুক তাও নই। বিন্দুমাত্র আত্মীয়তা বোধ এখনও আমার মধ্যে জাগেনি। তবে বেচারা অবোলা জীব, নিছক গণঠ্যাঙানিতে প্রাণ না হারিয়ে, বনদপ্তরের তত্ত্বাবধানে থাকবে ব্যাপারখানা মন্দ নয়। আমাদের পণ্ডিত আর তার শিশুরা নিরাপদে আছে এটাই আমার কাছে একমাত্র স্বস্তির কারণ। তবে সবথেকে যেটা ভালো লাগল, প্রথম অভিজ্ঞতার সময় চেনা মানুষও বাড়িয়ে দেয়নি ন্যূনতম সহযোগিতার হাত, আর এখানে আলিপুরের বনদপ্তরীয় আধিকারিককে না আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, না আমার প্রিয়তমা বান্ধবী, উনিও নির্ঘাত অজ্ঞাত আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে, এতদসত্ত্বেও এমন বর্ষণমুখর রাতে, যেখানে অর্ধেক কলকাতা জল অবরুদ্ধ, নিছক দূরভাষে ভেসে আসা এক অজ্ঞাত পরিচয় জননীর সামান্য অনুরোধের ভিত্তিতে তাঁর টিমকে পাঠালেন এবং তারাও যেভাবে দায়িত্ব সহকারে এসে নিজ কর্তব্য পালন করল কোন প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। এদের জন্যই মনে হয়, সত্যি সত্যিই বোধহয় মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
No comments:
Post a Comment