বুড়ো কালেক্টরেটের সামনে গাড়ি থামতেই ওণারা এগিয়ে এলেন, এক মেটে সিঁদুরের টপ্পা পরা দোহারা চেহারার মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, সঙ্গে এক বছর চল্লিশ বিয়াল্লিশের ঘোর কৃষ্ণবর্ণা নারী। পরণে সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি। সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। উভয়েরই মুখ মাস্কে ঢাকা। মহিলার হাত ধরে আছে এক অবোধ বালিকা।
জানতাম ওঁরা আজ আমার কাছে আসবে। কালকেই জানিয়েছিল আপিসের ড্রাইভার রঞ্জিৎ। ‘ম্যাডাম একটু উপকার করবেন?’ উপকার বলতে প্রিয়জন পরিত্যক্তা একটি সাড়ে তিন বছরের শিশকন্যাকে কোন হোমে রাখার ব্যবস্থা করা। বলতেই পারতাম, এটা আমার কাজ নয়। এমনকি এটা শ্রমদপ্তরেরও কাজ নয়- বলতে পারলাম কই? বলতে ইচ্ছে করে কই?
রঞ্জিতের মুখে শুনে, বা ফোনে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তাই জানিয়েছিলাম, কেউ যদি এসে একটু সামনাসামনি কথা বলে, খুব ভালো হয়। সেই মোতাবেক চাইল্ডলাইন মারফৎ জেলা চাইল্ড প্রোটেকশন সেলের যে আধিকারিক এই ব্যাপারটা দেখেন তাঁর সাথে কথাও বলে রেখেছিলাম। এঁরা এলেই তাঁকে ডেকে পাঠাব। বা তাঁর কাছে এঁদের পাঠিয়ে দেব। তবে ভাবিনি এইভাবে বাচ্ছা সমেত এসে উপস্থিত হবেন।
সসঙ্কোচে আমার চেম্বারে প্রবেশ করে, গুছিয়ে বসে ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনি ঐ শিশুকন্যার দিদিমা। এত অল্পবয়সী দিদিমা আমি এই প্রথম দেখলাম। শুনে উনি নার্ভাসভাবে একটু হাসলেন। তারপর জানালেন,‘আমার খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল তো দিদি, ইয়ে ম্যাডাম। গাঁয়ের মেয়ে ছিলুম। বর নেয়নি। দুটো ছেলেমেয়ের হাত ধরে পথে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। লোকের বাড়ি আয়াগিরি করে ছেলেমেয়েকে বড় কচ্ছিলুম। এমন কপাল, মেয়েটা কেলাশ ফাইভে পড়তে পড়তে পালিয়ে গেল। যার সাথে পালাল, সে একটা থাড কেলাশ ছেলে দি ইয়ে ম্যাডাম। মদ খায়। বউয়ের গায়ে হাত তোলে।’ বলতে বলতে সস্তা সিন্থেটিক শাড়ির আঁচলে চোখটা মুছে নিলেন ভদ্রমহিলা।
সামান্য ধরা গলায় বললেন,‘ আমার মেয়েটার বয়স ঐ ধরুন না বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ। এরই মধ্যে দু-দুটো মেয়ের জন্ম দিয়েছে। বরের তো ঐ ছিরি।’ বুঝলাম এণারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বামী পরিত্যক্তা। কিন্তু তবুও তাঁর মঙ্গলাকাঙ্খায় সীমন্তে ডগমগ করে সিঁদুর। আরো বুঝলাম, মেয়েটি জন্ম তো দিয়েছে কিন্তু মায়ের দায়িত্ব পালনে অপারগ। দুটি শিশুকন্যাকে মায়ের বাড়ির গলির মুখে নামিয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ-। ভদ্রমহিলার ভাষায়, ‘আমি ডিউটিতে বেরুচ্ছিলুম দিদি, হঠাৎ দেখি এরা ঢুকছে, ‘দিদা-দিদা’ করতে করতে। তো আমি জানতে চাইলুম, হ্যাঁরে তোরা একা? মা কই? তো বলে, মা আমাদের টোটো থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল-। তখুনি বুঝিচি।’
মাঝপথে কথা থামিয়ে জানতে চাই, বাচ্ছাটা কিছু খেয়েছে কি না। ব্যাগে তো কিছুই নেই। এত সকালে আর এই আবহাওয়ায় কালেক্টরেটেও মিলবে না কিছু। যদি দুটো বিস্কুট খায়-। অবোধ শিশু বড় লক্ষ্মী মেয়ে। দিদার দুই পায়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আপনমনে কি সব বিড়বিড় করছে, আঙুল চুষছে আর মাঝে মাঝে উৎসুক চোখে আমায় দেখছে। দিদা শশব্যস্ত হয়ে জানাল,‘চাট্টি দুদরুটি খাইয়ে এনিছি। আর চা বিস্কুট আমরা নীচে থেকে খেয়েই এসিছি। ’ আমরা বলতে মনে পড়ল, সাথে আসা টপ্পা পরা আগন্তুকের কথা। আমি জানতে চাইবার আগেই প্রশ্নটা করলেন, চাইল্ড প্রোটেকশন সেলের সূর্যনারায়ণ বাবু। ‘ আপনি কে?’ লোকটা দেঁতো হেসে বলল,‘জী, আমি ওদের পড়োশী। দিদি খুব বিপদে পড়ে গেছেন, তাই হামিই রঞ্জিৎকে বললাম। রঞ্জিৎ হামার দোস্ত কি না-’।
ভদ্রমহিলা আবার তাঁর বক্তব্য রাখতে যাচ্ছিলেন, তাঁর আগেই জানতে চাইলাম, বারবার দুটো মেয়ের কথা উঠছে,আরেকজন কোথায়? জবাবে দিদিমা বলল, ‘ওকে একটা হোমে দিইছি দিদি। এই তো চন্দননগরে।’ জানলাম তার বয়স আট। ঐ হোমে সাত-আট বছরের নীচে শিশু নেয় না বলেই দিদা তাঁর কনিষ্ঠ নাতনীকে নিয়ে আমাদের দ্বারস্থ।
হোম আর উঠতি বয়সী মেয়ে শুনলেই কেমন আতঙ্ক হয়। সূর্যনারায়ণ বাবুকে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলাম, যে হোমে দিয়েছে বলছে সেটা কেমন? উনি আশ্বস্ত করলেন যে সমাজকল্যাণ দপ্তরে নথিভুক্ত ভালো হোমেই দিয়েছে। কিন্তু হোমটা তো এখন বন্ধ। তাহলে বাচ্ছাটা গেল কোথায়?প্রশ্ন করাতে দিদা ছলছল চোখে জানাল, ‘আমার পিসতুতো বোনের কাছে কদিনের জন্য রেখে আসতে বাধ্য হইছি। বাড়ির মালকিন খুব অশান্তি করছিল। বলছিল, ‘তোমায় বাড়ি দিইছিলাম, এসব বাচ্ছাকাচ্ছা নিয়ে এখেনে থাকা যাবে না। বলছে বাড়ি ছেড়ে দিতে। ইলেকট্রিক লাইনটাও কেটে দিয়েছে-’। ক্ষণিক থেমে বললেন, ‘আসলে ভাড়াও খানিক বাকি তো। লকডাউনে কাজ পাইনি তো, তাই। আমি বলিছি, একটু একটু করে শুধে দেব। দিচ্ছিলামও।’
সমাজকল্যাণ দপ্তরের সূর্যনারায়ণ বাবু দেখলাম ভীষণ পরিপক্ক এবং দক্ষ। আমার মত আবেগ তাড়িত নয়। উনি খুব ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝালেন, ওণাদের সামনে দুটি পথ খোলা, এক যদি ওণারা বাচ্ছাটিকে পাকাপাকি ভাবে হস্তান্তর করতে চান, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে তারপর বাচ্ছা অ্যাডপশনে চলে যাবে। তার ওপর এণাদের থাকবে না আর কোন অধিকার। দিদার আঁচলের খুঁট করে খেলা করা মেয়েটার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। নিশ্বাস নিতে কেন যে এত কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একবার সূর্যনারায়ণ বাবু আর একবার আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে দিদা।
সূর্যনারায়ণ বাবু কেজো অথচ দরদী গলায় জানালেন, আর একটা উপায় হল, বাচ্ছাটাকে কোন শেল্টারে রাখা। যেখানে চাইলে গিয়ে দেখেও আসতে পারবে বাড়ির লোক। আর একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছালে আবার ফিরিয়েও আনতে পারবে। হাতে চাঁদ পেলাম মনে হল। দিদার হয়ে আমিই বলে উঠলাম, এটাই বোধহয় ভালো। আজ না হলে কাল আবার দেখতে তো পাবে প্রিয়জনদের।
সূর্যনারায়ণ বাবু অভিজ্ঞ সুরে জানালেন, সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরিবারবর্গকেই। যদি পূর্ণ হস্তান্তর করতে হয়, তাহলে ইন্সপেকশন হবে, কাউন্সেলিং হবে আর প্রয়োজন পড়বে শিশুর পিতামাতার হস্তাক্ষরের। তাঁদের লিখিত অনুমতি ব্যতীত এটা অসম্ভব। শুনেই ঢোঁক গিললেন দিদা। সেটা কি করে সম্ভব। উভয়েই তো নিরুদ্দেশ।
‘তাহলে ও প্রসঙ্গ ছাড়ুন। এমনি হোমে ওকে রাখাটাও কিন্তু আপনার এক্তিয়ার বহির্ভূত। আপনার কন্যা যে নিঁখোজ আপনি মিসিং ডায়েরি করিয়েছেন?’ জানতে চান সূর্যবাবু। ভদ্রমহিলার দেহের ভাষা সুস্পষ্ট ভাবে জানায়,ওণারা করেননি। মাথাতেও আসেনি ওণাদের। কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে জানান, ‘আজ্ঞে, এর আগেও একবার ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ছদিনের জন্য। আবার ফিরেও এসেছিল। হাজার হোক মা তো। আর আমিও তো তার মা। তাই ভেবেছিলুম হয়তো এযাত্রাও-’। বাকি কথাটা অনুক্তই থেকে যায়।
উনি নিজে দেখবেন, প্রয়োজনে পুলিশ দিয়ে বাড়িওয়ালীকে কড়কানি দেবেন আর যা যা প্রয়োজন সব করবেন এই আশ্বাস দিয়ে সূর্যবাবু নিয়ে যান ওদের। আজ শুনলাম পুলিশে জিডি করা হয়েছে বাড়িওয়ালীর নামে। মিসিং ডায়েরিও হয়েছে মা’টার নামে। সেই ডায়েরীর কপি দিয়ে শিশুটিকে হোমে রাখার লিখিত আবেদনও করেছেন দিদা। তবে সময় লাগবে কিছুদিন।এনকোয়ারি হবে। পুজোর আগে হবে না। পুজোর আর বাকিই বা কটা দিন। সবাই আমরা ব্যস্ত আসন্ন শারদীয়ার শেষ মূহূর্তের প্রস্তুতিতে। জামাকাপড়- জুতো- মেকআপ- অ্যাকসেসারিজ আরো না জানি কত কি। বৎসর ঘুরে একরাশ আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরছেন আনন্দময়ী, সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও যদি পৌঁছায় এক লাইন কেটে দেওয়া অন্ধকার এককামরার ঘরে- যেখানে কাজ হারানো দিদার আঁচল নিয়ে খেলে দুই অবোধ বালিকা। খুশি হবার অধিকার তো ওদেরও আছে-
No comments:
Post a Comment